প্রণয়
আমি লতাকে ভালোবাসি। এ কথা বাবাকে বলবো বলবো করে একটি বছর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। আমার বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে আমাকে ঘরছাড়া করবেন, এ ভয় আমাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলেছে। ইচ্ছা আছে ভয়কে জয় করে নতুন জীবনের কেতন ওড়াবো লতার হাত ধরে।
সেদিন বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে কলেজে লতা আর আমি দ্বৈত নৃত্য করি। অনুষ্ঠানে নৃত্যটি যেমন দর্শক সমাদৃত হয়েছিল; তেমনই সেদিনের পর থেকে আমার মনে লতার অনুভূতি দাগ কাটতে শুরু করলো। অনুভূতি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করলো। তবে আমি পরিবারের কড়া শাসনে থাকায় এবং লতার বড় ভাইয়ের ভয় আমাকে প্রেমের রাজ্যে বিচরণ করে লতার হাতে ফুল তুলে দেওয়ার সাহস জোগাতে অক্ষম করে তুললো।
আজ কলেজে অর্থনীতি ক্লাসে অনিক স্যার অপরচুনিটি কস্ট পড়ানোর সময় বললেন, অর্থনীতির ভাষায় অপরচুনিটি কস্ট বলতে যখন তুমি অনেকগুলো বিকল্পের মাঝে একটিকে বেছে নেবে; তখন তোমার অন্য যে সুযোগগুলো হারাতে হবে। সেই কস্টটাই হলো অপরচুনিটি কস্ট।
স্যারের লেকচার শোনার পর মনে হলো আমিও এমন তত্ত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় আছি। যেটি আমাকে লতার হাতে হাত রেখে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, অনেক বেশি’ বলার সাহস জোগাবে। লতাকে আপন করে নিতে আমি অন্য সব সুযোগ হারাতে রাজি আছি। আমার মনে বসন্তের হাওয়া নাড়া দিয়ে এক হিম রক্তস্রোতে বিষণ্ন করে তুলছে। সে স্রোতধারা থেকে নিজেকে পুষ্পিত সৌরভে লতাকে আপন করে নেওয়ার বাসনায় পরিবারকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর সাহস জোগাতে অনুপ্রাণিত করলো।
অনিক স্যার প্রথম বর্ষের ক্লাসে আমাকে আর লতাকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, তোমাদের সুন্দর লাগছে। পরবর্তীতে বসন্ত বরণে আমাদের নাচ করতে উৎসাহিত করলেন। আবার এমন মোক্ষম সময় অপরচুনিটি কস্ট নিয়ে আলোচনা করলেন, যা আমার আর লতার সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সাহস জোগালো।
অনিক স্যার অনেক আন্তরিক শিক্ষার্থীদের প্রতি। আমার সাথে স্যারের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুপ্রতীম। স্যার সব সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অর্থনীতির শিক্ষক হলেও নান্দনিকতা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় এক বিশেষ নজির স্থাপনে তিনি সর্বমহলে প্রশংসিত।
লতার বড় ভাইকে ভয় পাওয়ার মূল কারণ তিনি কাঞ্চনপুরের নামকরা মাস্তান। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তিনি বেশ আলোচিত হওয়ায় লতার দিকে আমার বন্ধু বা বড় ভাই কেউ তাকাতে সাহস করে না। আমিও ভীতুদের দলে, তবে তার প্রতি আমার আকর্ষণ সে ভয়কে জয় করার সাহস সঞ্চারে যথেষ্ট। আমি লতাকে পছন্দ করি এটি এখন ধ্রুবের মতো সত্য। কেন তাকে পছন্দ করি! এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।
লতার বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। ফলে শৈশব থেকে কিছুটা বলা যায়, সে আমার চেনা-জানা। তবে তাকে দেখলে আমার কখনো প্রেম নিবেদনের ইচ্ছে জাগেনি। আজ সময়ের ব্যবধানে আমার লতার প্রতি ভীষণ আর্কষণ খেলা করছে। এ আকর্ষণে আমার মনোরাজ্যে ঝড় তুলে এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। সতর্ক সংকেত যদিও বিপদ সংকেত নির্দেশ করে কিন্তু আমি আমার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হলেও কেন জানি এ আবেগ থেকে নিজেকে সংযত করতে পারছি না।
বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে লতা হলুদ শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ছিল বকুলতলায়। কলেজের বকুলতলায় সেদিন শাড়ি পরে আমার অনেক বান্ধবী দাঁড়িয়ে থাকলেও সেসব বাড়ন্ত বান্ধবী আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি। লতার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ আমার মনোরাজ্যে এক উন্মাদনা খেলা করলো। খোঁপায় ফুল দিয়ে হলুদ শাড়িতে তার বাঁকা চোখের চাহনি বলে দেয় কিছু কথা সে আমাকে বলতে চায়।হয়তো আমার মনের ভ্রম হতে পারে। কিন্তু আমার এ ধারণা মিথ্যা হলো কিছুটা সময় পার হতেই।
অনিক স্যার বকুলতলা এসেই আমাকে ডাক দিলেন। মাই বয় বলে স্যার আমাকে সম্বোধন করতেন। স্যারের ডাকে সাড়া দিয়ে আমি স্যারের কাছাকাছি দাঁড়াতেই আজকের আয়োজনের প্রাক-প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন। এরইমধ্যে লতা পাশে এসে দাঁড়ালো।স্যার বললেন, তোমার হলুদ শাড়ির পাশে আকাশকে হলুদ পাঞ্জাবিতে দারুণ লাগছে। সত্যি বলতে তোমাদের দুজনকে আজ অসাধারণ সুন্দর লাগছে। এ কথা শুনতেই লতার লাজুকতা আর তার স্নিগ্ধ মায়াবী হাসি আমাকে মুগ্ধ করলো। একইসাথে আমি অনুভব করলাম আমার প্রতি তার আকর্ষণ খেলা করছে।
সেদিনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লতা এবং আমার সখ্য ভালো বন্ধুত্বে রূপ নেয়। মাঝে মধ্যে এখন আমরা কলেজের পাশের ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে নাস্তা করি। মোবাইল ফোনে ক্লাস লেকচার নিয়ে আলাপও জমে। সে আলাপ সময়ের ব্যবধানে আমাদের আরও বেশি কাছাকাছি যাওয়ার আকর্ষণ সৃষ্টি করবে, তা আমি প্রথমে উপলব্ধি করিনি। তবে আমাদের মধ্যে চলমান বন্ধুত্ব, বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু এটি উপলব্ধি করছি সময়ের ব্যবধানে। লতাও অনুভব করছে। এজন্য হয়তো সময় পেলে সে মাঝে মধ্যে আমার জন্য নুডলস বা পিঠা বানিয়ে আনে। লোকচক্ষুর আড়ালে তার হাতে বানানো পিঠার স্বাদ আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার মনে হয়। এমন সুসময় লতার সাথে অতিবাহিত করা হয়তো বিধাতার পক্ষ থেকে আমার জন্য বিশেষ পুরস্কার।
মাঘের শেষ নাগাদ শীতের তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে শীতল আবেশে আমার মায়ের পাশে পিঁড়িতে বসে পিঠা খেতে খেতে লতার গল্প করতেই মা মৃদু হাসি দিলেন। মা লতার সাথে আমার সম্পর্ক হয়তোবা আঁচ করতে পেরেছেন। কলেজ থেকে একদিন লতা জেদ ধরলো আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি এমন দাবি শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। আমার মা বিষয়টি কীভাবে নেবেন বা আমার ছোট ভাইয়ের সামনে সংকোচ তো রয়েছে। এ ছাড়া বাবার ভয় সব সময় আমাকে আতঙ্কিত রাখে। তবুও সে নাছোড়বান্দা, আমাদের বাড়িতে আসবেই। সেদিন প্রথম আমার কোনো বান্ধবীর আগমন ঘটলো আমাদের বাড়ির আঙিনায়। আমার মা সব সংকোচ দূর করে লতাকে আতিথেয়তায় মুগ্ধ করলেন। আমার মায়ের আতিথেয়তায় লতা মুগ্ধ হয়েছিল। কেননা সেদিনের গল্প সুযোগ পেলে সে শোনায়। এটি বারবার আমাকে পুলকিত করে।
আজও মা লতা প্রসঙ্গ আসতেই তার খোঁজ-খবর নিলেন। আমি মাঝে মধ্যে তাকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আনি, আমার মা এটি চান। বিষয়টি মায়ের আলাপে বুঝতে পারলাম। ফলে মা লতাকে পছন্দ করেন, এটি বুঝতে আমার বাকি রইলো না। তাকে পছন্দ করার আরও একটি কারণ রয়েছে। লতার মা এবং আমার মা দূরসম্পর্কের আত্মীয়। শৈশবে একই স্কুলে তাদের পড়ালেখা। সেই সখ্য বিয়ের পরও ছিল। কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনায় লতার মায়ের অকালমৃত্যু সম্পর্কের ইতি টানে।
লতার মা এবং তার বাবা জেলা শহর থেকে সেদিন ফিরছিলেন। স্বাভাবিক গতিতে বাস ছুটে চলছে কিন্তু পথিমধ্যে বাস খাদে পড়ে ঘটলো ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বাসের ড্রাইভার একটি ট্রাককে অতিক্রম করতে গিয়ে বেপরোয়া গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় সাতজন মারা যায়। তার মধ্যে লতার মা আখলিমা খাতুন ছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান তার বাবা। মা হরানোর শোক আজও তাকে বহন করতে হয়। আমার মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই তার মধ্যে মা হারানোর আক্ষেপ খেলা করে। মাঝে মধ্যে দু’ফোঁটা অশ্রু নীরবে ঝরে যায়। আমি সে অশ্রু মুছে দিয়ে কিছুটা শোক দূর করার বৃথা চেষ্টা করি।
লতা দেখতে দারুণ মায়াবী, তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের লাজুকতা মুগ্ধ করবে যে কোন তরুণকে। লতার সৌন্দর্য শত তরুণের ঘুমহীন রাত কাটানোর জন্য যথেষ্ট। তার কয়েকবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তবে তার বড় ভাইয়ের খ্যাতির বিড়ম্বনায় সম্বন্ধ ভেঙেছে। সেটি নিশ্চয়ই আমার জন্য শাপেবর হয়েছে। আমি বিয়ের চাপ ছাড়া চুটিয়ে প্রেম করছি। তবে এটি আর দীর্ঘতর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কেননা তার ভাই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তার মাফিয়া পার্টনারের সাথে একমাত্র বোনের বিয়ের পরিকল্পনা করছে।
মাস ছয় পূর্বে বানিয়াপুকুর গ্রামের নাদিম শেখের লাশ পাওয়া যায় একটি ডোবায়। সে হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে গ্রেফতার হন তার ভাই লিটন। এ ঘটনায় আরও গ্রেফতার হয় লতার ভাইয়ের বন্ধু মাদকসম্রাট জুয়েল। পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ না মেলায় ছাড়া পেয়েছেন তারা দু’জন।
লতার ভাষ্যমতে, লিটন ভাই নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়তে চায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লতার সঙ্গে জুয়েল ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করতে চান। ঘটনাটি অনেকটা বাংলা চলচ্চিত্রের মতো। তবে লতা সরাসরি এ বিয়েতে রাজি নয়, এটি জানিয়ে দিয়েছে। তার ভাইও জোর করে বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
আমার বাবা অনেক রাগী একজন মানুষ। আমাদের এ সম্পর্কের কথা তাকে বললে তিনি নিশ্চয়ই মেনে নেবেন না। এ ছাড়া আমার উপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে বিভিন্ন বিষয়ে। ফলে এ বিষয়ে সমাধানের জন্য বাবাকে কিছু বলার সুযোগ নেই। লতা তার বাবাকে বা ভাইকে আমাদের সম্পর্কের কথা বললেও আমার কপালে দুর্গতি রয়েছে। ফলে সেটিও সম্ভব নয়।দু’জনেই মহা সংকটে আতঙ্কিত সময় পার করছি।
বসন্তে গাছে পলাশ ফুল ফুটেছে। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ ও লালচে কমলা রঙের পলাশ ফুলও দেখা যায়। পলাশের ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো। বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গায় কমবেশি পলাশ গাছ একসময় দেখতে পাওয়া গেলেও এখন তা অনেক কমে এসেছে। আমার বাড়ির সামনের পলাশ গাছটি আমার দাদির লাগানো। গাছটিকে আমার মা পরম যত্ন করে আগলে রেখেছেন। যেমন করে আমি লতাকে আগলে রাখতে চাই। কিন্তু পালাশ ফুলের মতো সুন্দর, কোমল লতাকে আমি হারাতে বসেছি সময়ের পথপরিক্রমায়, এটি একমাত্র আমি অনুভব করি।
কিছুটা দূর এগিয়ে রাস্তায় একটি অটোতে চেপে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কয়েকদিন কলেজে যাওয়া হয় না। ক্লাসে আমি অনুপস্থিত থাকায় অনিক স্যার আমার খোঁজ নিয়েছেন বড় ভাই সালাহ উদ্দিনের কাছে। গতকাল ভাই আমাকে জানালেন সে কথা। কলেজ গেটে অটো থেকে নামতেই বামপাশে রাকিব ভাইয়ের কসমেটিকসের দোকানে গুটিকয়েক গোলাপ এবং রজনীগন্ধা ফুল চোখে পড়লো। ফুল দেখে মনে কড়া নাড়লো, আজ তো আমার আর লতার বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপান্তরিত হওয়ার বর্ষপূর্তি।
বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানের পর কিছুটা সময় গড়ায় বন্ধুত্বে। সে বন্ধুত্ব পরিণয়ে রূপ পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরও কয়েকটি মাস।তারপর একে একে প্রায় বছর পার হয়ে আজকের এইদিনে আমি তার হাত স্পর্শ করে বলেছিলাম, লতা আমি তোমার হতে চাই।লতা লাজুক চাহনীতে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছিলো। আমি উপলব্ধি করলাম, সে আমার হাতটি শক্ত করে ধরে আছে। হয়তো আমার চোখে নিজেকে লুকানোর জায়গা খুঁজছে।
সেদিন আমি লতার শরীরে আমার ব্যাগে থাকা পলাশ ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। সকালে বের হওয়ার সময় বাড়ির সমানে থেকে কুড়িয়ে আনা পাপড়ি দিয়ে বাড়ির হবুবধূকে বরণের ইচ্ছা পূরণ বলা যায়। খোলা চুলে কিছুটা পাপড়ি ছড়িয়ে থাকা, হাতে নীল চুড়ি আর টিয়া রঙের থ্রি-পিসে বড্ড মায়াবী লাগছিল মেয়েটিকে। আমি তার হাত ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই শিমুলতলায় লতা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। চোখের সে অশ্রু ছিল মায়া আর বিশ্বাসে জড়ানো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করলাম। লতা তোমার এ হাত আমার হাত থেকে নিশ্চয়ই আলাদা হবে না।
রাকিব ভাই আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন। অনেকদিন পর তার সাথে আমার দেখা। মাঝেমধ্যে আমি ফুল কিনি ফলে নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে বাড়তি সখ্য রয়েছে। আজও এক তোড়া গোলাপ দিলেন রাকিব ভাই। লতা কলেজে এসেছে তথ্যটি জানিয়ে রাকিব ভাই মৃদু হাসলেন। তার সে হাসিতে এভারেস্ট বিজয়ের তৃপ্তি খেলা করছে। আমার কাছে লতাকে পাওয়ার অনুভূতি হয়তো তার চেয়ে বেশি আনন্দের, যা বোঝানোর উপমা হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়বস্তু এখন মাথায় আসছে না।
কলেজের ক্লাস শেষ হয়েছে। আজ দুটি ক্লাস হয়েছে ফলে দ্রুতই সবাই বেরিয়ে পড়ছে। অনিক স্যারের সাথে দেখা হলো বিজ্ঞান ভবনের সামনে। স্যারের সাথে সালাম বিনিময়ের পর এগিয়ে গেলাম বকুলতলার দিকে। লতা নিশ্চুপ বসে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। গতকাল রাতে কথা হয়ছিল মোবাইল ফোনে ঘণ্টাখানেক। কিছুটা মনমরা লাগছিল তার কণ্ঠ। প্রাণবন্ত আবহে তার যে উচ্ছ্বাস, সেটি ছিল না কণ্ঠে। বকুলতলায় তার অবয়বে সে ছাপ চোখে পড়লো। লতা আজ এক বিমর্ষ অবয়বে দৃশ্যমান।
সে আজ বেগুনি রঙের থ্রি-পিস পরেছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার ভাই এটি তাকে উপহার দিয়েছিল। আজ তার বিমর্ষ বদনেও তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। প্রেয়সী প্রেমিকের চোখে সব সময় সুন্দর। আমি লতার দিকে হাত বাড়িয়ে ফুল উপহার দিতে সে কিছুটা আনন্দিত হলো। ইতোমধ্যে কলেজ প্রায় জনশূন্য। প্রশাসনিক ভবনে গুটিকয়েক কর্মচারী বসে গল্প করছে। অনেকে পান চিবিয়ে ভবনের গেটে পিক ফেলে নোংরা করছে। জাতি হিসেবে এটি আমাদের সহজাত অভ্যাস। জাপানের নাগরিক আর বাংলাদেশের নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য নিরুপনে এটি বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
লতাকে গোলাপের তোড়া উপহার দিয়ে প্রণয়ের বছরপূর্তির কথা মনে করিয়ে দিতেই সে মিষ্টি হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানালো, একইসাথে সে আমার পছন্দের কিছু চকলেট উপহার দিলো। যদিও সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। লতা আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো, আকাশ আমার এ সপ্তাহে যে কোন দিন বিয়ে। আমার বড়ভাই জোর করে তার বন্ধু জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। আমার বাবাও একমত। সুতরাং আমি আর বাড়ি যেতে পারবো না। আমি বিয়ে না করলে এর পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। সুতরাং আমি আর বাড়ি যেতে চাই না।
লতার মুখে এমন কথা আমার অপ্রত্যাশিত ছিলো। কেননা আমাকে কিছু একটা করতে হবে জানা ছিল। তবে এত দ্রুত তা করতে হবে এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের কথা লতার ভাই জানলে আমার উপর যেমন হামলা হবে; তেমনই আমার বাবা জানলে এর পরিণাম আরও ভয়াবহ হবে। লতার সঙ্গে আমার প্রণয় আমার পরিবার মেনে নেবে না। তার মূল অপরাধ সে রংবাজ লিটনের বোন। সমাজ এদের ভয় পায় কিন্তু গ্রহণ করে না। ফলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে উভয় সংকটে পড়লাম।
ইতোমধ্যে কলেজে রুটিন মেপে ছুটির ঘণ্টা দিলেন দপ্তরি। কলেজে ক্লাস ঠিকমতো না হলেও ঘণ্টা নিয়মিত বাজে। প্রশাসনিক ভবনের গেট বন্ধ করে চন্দন দাদা বেরিয়ে পড়লেন তার রংচটা বাইসাইকেল নিয়ে। আমিও বেরিয়ে পড়লাম লতার হাত ধরে দামোদর রেলস্টেশনের দিকে। আজ লতাকে পেতে সব পরিস্থিতি বরণ করতে আমি প্রস্তুত।
দুপুর একটায় বেনাপোলগামী লোকাল ট্রেন ছাড়ে স্টেশন থেকে। লতার হাত ধরে স্টেশনে বসে আছি। পরিচিত কারো চোখে পড়লে বিপদ আছে। ফলে কিছুটা লুকোচুরি খেলা চলছে। এসময় মানুষের ভিড় কম থাকে। দু’জন হকার বসে আছে। স্থানীয় হলেও আমার সঙ্গে পরিচয় নেই। আমি দশ টাকার বাদাম কিনে দু’জনে কিছুটা ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করলাম।
ট্রেন স্টেশনে ভিড়েছে। লতার হাত ধরে ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে তার আপন গন্তব্যে। আমি তার হাত ধরে শরীরে হেলান দিয়ে সমাজ ও পরিবারের মায়া ছেড়ে রওনা হলাম গন্তব্যহীন যাত্রায়। ট্রেনের জানালা দিয়ে দু’পাশে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের দৃশ্য দেখছি। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ছে লতার মায়াবী চাহনী। ট্রেন ছুটে চলছে মাঠ-প্রান্তর সবকিছু ছাড়িয়ে। আমরা যেমন ছুটে চলছি সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, সবকিছু ছেড়ে নিজেদের মতো ভালো থাকতে।
এসইউ/জেআইএম