মায়াবতী: পর্ব ৩১
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
উনত্রিশ.
গুলশানের এক অভিজাত চাইনিজ রেস্টুরেন্টে এসেছে ওরা।
মুনা ও রিয়ার পরামর্শে টেবিল সাজানো হয়েছে। বড় গোলাকার টেবিলের চারদিকে দশটা গোলাকার চেয়ার বসানো হয়েছে। হালকা হলুদ রঙের টেবিলক্লথ দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে টেবিল। টেবিলের সেন্ট্রাল গোলাকার অংশটা চাকতির মতো ঘোরে। চাকতির ওপর খাবার কিংবা পানীয় রাখা হয়। নিজের চেয়ারে বসে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুরিয়ে সবগুলো আইটেমের সহজ নাগাল পেতে পারে যে-কেউ।
আজ মুনার সঙ্গে এসেছে ‘ও লেভেল’ পড়ুয়া শাশা।
শাশা থাকে মুনাদের অ্যাপার্টমেন্টে। ওরা তিনজন লাঞ্চ আওয়ারের বেশ আগেই চলে এসেছে রেস্টুরেন্টে। শাশার মুখ থেকে সাঁই সাঁই করে ইংরেজি কথা ফুটতে থাকে।
রিয়া মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে শাশাকে। শাশা পরেছে সাদা শর্ট গেঞ্জি, থ্রি কোয়ার্টার টাইট প্যান্ট। পায়ে পরেছে ভিন্নরকম স্যান্ডেল, ছয় ইঞ্চি হিল। স্যান্ডেলের ছইয়ের উপরের অংশজুড়ে আছে স্টোন বসানো মাকড়সা, নিচের অংশে আছে পাতার মাঝে সাঁটানো একটা ছোট ঘড়ি। হাতের ঘড়ি চলে এসেছে পায়ে। গলায় সে ঝুলিয়েছে মঙ্গলসূত্র।
রিয়া দেখল অন্যরকম নতুন ফ্যাশন।
সাধারণত হিন্দু বিবাহিত নারীরা বিয়ের চিহ্ন হিসেবে মঙ্গলসূত্র পরে। হিন্দি সিরিয়াল অনুকরণ করে কিশোরীরা। অনুকরণ করে মঙ্গলসূত্রকে তারা ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছে। বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে বদলে যাচ্ছে এদেশীয় সংস্কৃতির হাওয়া। অনুকরণ করতে গিয়ে এ ধরনের নানারকম ফ্যাশন গ্রহণ করতে শুরু করেছে টিনএজাররা। সব ফ্যাশনই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই না।
ভেবে ভেবে শাশাকে উদ্দেশ করে রিয়া বলল, তোমার ড্রেসে আধুনিকতার ভিন্ন ছায়া আছে।
শাশা বলল, পোশাকে যদি মডার্ন না হতে পারি তবে কীসের ফ্যাশন?
রিয়া আবার বলল, তোমার সঙ্গে তো তেমন একটা দেখা হয় না। তোমার সময় কাটে কীভাবে?
শাশা এ প্রশ্নের জবাবে হালকা ফুঁসে ওঠে।
মাম বাসা থেকে বের হতে দেয় না। বলে, বের হলে নাকি নষ্ট হয়ে যাব। এজন্য বেশিরভাগ সময় বাসাতেই বন্দি থাকতে হয়।
বন্দি থাকতে হয়?
ওই একই কথা। আটক থাকার মতো। কোনো ছেলেবন্ধু বাসায় এলে মাম-ড্যাড ভাবে, এখনই তাকে নিয়ে বেডসিন শুরু করব। মেয়েবন্ধুদের বাসায়ও যেতে দেয় না। ভাবে, গোপনে ডেটিং অ্যারেঞ্জ করব।
এ ধরনের বিষয় কি আসলেই ঘটছে? মাম-ড্যাড সন্দেহ করে কেন?
ঘটছে। বাট আমি তো ঘটাচ্ছি না। আমাকে সন্দেহ করবে কেন? আই লাইক গাই টু টক। আই লাইক গাই টু শেয়ার। গার্লদের সঙ্গে তো শেয়ার করা যায় না। দে আর মোর জেলাস, সামটাইমস হার্মফুল। শেয়ার করতে হলে বয় লাগে।
ছেলেরা তো হার্মফুল হতে পারে অন্যভাবে।
আমার ইনটেনশন, ইউ নো, আড্ডা দেওয়া। আমি তো দেহের জন্যই ফ্রি মিক্স করতে চাই না।
তোমার ইনটেনশন যা-ই থাকুক, তোমার মতো শার্প টিনএজারের জন্য তো ফ্রেন্ডদের মনে গোপন―পরিবর্তন হতে পারে। তোমাকে ফাঁদে ফেলতে পারে তখন। সে কারণে হয়তো মা-বাবা এত কঠোর থাকেন।
হার্ড হলেই কি আমাকে আটকে রাখতে পারবে নাকি? আই ক্যান গো এনিহোয়ার। আই ক্যান এনজয়। অনেকে তাই করছে। ডেটিং করতে গিয়ে ভালো লাগলে সেক্স করছে। নো প্রবলেম। টেক ইট ইজি।
‘নো প্রবলেম’ কি বলা যায়? প্রবলেম কি হয় না?
আই নো, ওয়ান গার্ল এনজয় থ্রি গাইস অ্যাট এ টাইম। ইভেন মিক্সড গ্রুপ এনজয়মেন্ট ইজ হ্যাপেনিং।
আর দে নট সিক? ইজ ইট ট্রু নিড?
নো, দে আর নট সিক। দে আর এনজয়িং। ডেফিনিটলি ইট ইজ জেনারেশন্স নিড।
রিয়া বলল, আই থিংক দে আর সিক, সেক্স ম্যানিয়াক। সেক্স ক্রেজি গার্ল মে বি সিক। দে নিড ট্রিটমেন্ট। মা-বাবা যা করছে, সন্তানের ভালোর জন্যই করছে। তাদের বোধটাকে শ্রদ্ধা করা উচিত।
মাম-ড্যাড তো ওল্ড হেগার্ড। সেন্টিমেন্ট দিয়ে আমাদের চেইনিং করতে চায়।
রিয়া দমে গেল। ভাবে ওরে বাবা। টু ফার্স্ট টিন। তবে বুঝতে পারল জেনারেশনে ঘটে যাচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। পরিবর্তনের ধুম লেগেছে উচ্চবিত্তের ঘরে। সবাই একরকম না, এ কথা বলা যায়। কেউ কেউ এমন হতে পারে। অল্পসংখ্যকের জন্য সবাইকে দোষ দেওয়া যায় না।
মা কেন তার পেছনে লেগে থাকতেন, বুঝতে পারে রিয়া। শাশার আচরণের ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখতে পায় ও। ভাবে, আরও সংযত হয়ে চলতে হবে। জেনারেশনের পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাওয়া চলবে না। খারাপ ঘটনার ভেতর থেকে ভালো সেন্টিমেন্ট বেছে নিতে হবে। বেছে নিতে না পারলে বিপদ।
সহজ হওয়ার জন্য রিয়া বলল, ইউ আর স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আই লাইক ইউ।
নো আপা, ইটস নট এ ম্যাটার অভ স্ট্রেট ফরওয়ার্ট ইভেন্ট। আই হ্যাভ জাস্ট প্রেজেনটেড দি ট্রুথ।
রিয়া মনে মনে বলল, আর ট্রুথ জানতে চাই না, ট্রুথ জানতে গেলে আমার টুথই ভেঙে যাবে।
এ সময় মুনা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আলাপ থামা। মেন্যু দেখ। এই যে এগুলো অর্ডার দিতে চাই। আঙুল দিয়ে মেন্যু দেখিয়ে মুনা বলল, দেখ চয়েস হয় কি না। শাশা তুমিও মতামত দাও। তুমি হচ্ছ সবার ছোট।
স্টার্টার, প্রন বল উইথ হট টম্যাটো সস, থাইস্যুপ, এগ ফ্রাইড রাইস, স্পাইসি ব্রোস্টেড চিকেন, চাইনিজ ফ্রায়েড চিকেন, সুইট অ্যান্ড সাউর ফিশ, চিলি বিফ, ওফ ফ্রায়েড ভেজিটেবলস, ফ্রুট সালাড, মিক্সড সালাড, গ্রিন টি, কফি, ফ্রুট জুস।
গুড চয়েস। শাশা বলল, বাট আই নিড বাম্বু শুট অ্যান্ড মাশরুম, এশিয়ান গ্রিন সসেস।
ফাইন। রিয়া একদম একমত শাশার সঙ্গে। মুনার সঙ্গে। মেন্যু ঠিক করে দেয় ওরা। এ সময় ঢোকে কুসুমকলি। সঙ্গে মাহিন। মুখোমুখি ওরা কেউ মাহিনের সঙ্গে পরিচিত হয়নি। ফোনে কথা হয়েছে। মাহিন রিয়েলি এ বয় অভ আর্ট, সুদর্শন। রিয়াকে বলল মুনা।
শাশাও সাপোর্ট দেয়। ইউ আর হান্ড্রেড পারসেন্ট রাইট আপা।
কাছে এসেই মাহিন বলল, কনগ্র্যাচুলেশন!
শাশা কথা লুফে নিয়ে প্রশ্ন করল, কাকে কনগ্র্যাচুলেশন জানালেন?
সবাইকে। বলেই হেসে ওঠে মাহিন।
নো, নো, আই’ম আউট অভ দা রেঞ্জ অভ কনগ্র্যাচুলেশন।
কেউ রেঞ্জের বাইরে না, আমরা সবাই ভেতরে। বলেই আবার হাসল মাহিন, সবাই। কুসুমকলির হাসিই হচ্ছে আসল হাসি। পূর্ণাঙ্গ হাসি। এ মুহূর্তে কুসুম টইটম্বুর হয়ে আছে লজ্জা ও খুশিতে।
বাঁধন এসেছে। বাঁধন একদম সাদামাটা ড্রেস পরেছে। বাঁধন নিজেই ফ্যাশনেবল মেয়ে। ওর উপস্থিতিই যথেষ্ট। আবহ বদলে দিলো ও।
সবার জন্য গোলাপ নিয়ে এসেছে বাঁধন। প্রত্যেকের হাতে একটা করে গোলাপ তুলে দেয়। বাঁধনের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসে ঘাটতি নেই।
রিয়া বলল, চুমুবতী, তুই এ চেয়ারে বস।
বাঁধন বলল, কেন আমার জন্য স্পেশাল সিলেকশন কেন? আমি স্পেশাল অ্যাডভানটেজ চাই না।
কুসুম প্রশ্ন করে, অ্যাডভানটেজের প্রশ্ন এলো কেন?
আছে, কারণ আছে। একটা শিক্ষা পেয়েছি।
মুনা প্রশ্ন করে, কী শিক্ষা পেয়েছিস?
ব্যাংকক থেকে টিজি ৩২১ এ ফিরতে গিয়ে বিমানে উঠে দেখি আমার এক প্রিয় স্যার। স্যারকে পেয়ে মহাখুশি আমি। স্যার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারকান্ট্রি মিটিংয়ে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে ফিরছেন। গলায় ঝোলানো আছে সংস্থার ডেলিগেটস হিসেবে সম্মানজনক লোগো এবং বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। হইহই শুরু করলাম আমি। উনি আমার মাথা ছুঁয়ে আদর করে দিলেন। তারপর আর দেখা নাই। ঘটনা এখানে শেষ নয়। শোন তোরা। ঢাকায় ইমিগ্রেশনের প্রতিটা বুথে লম্বা লাইন। আমার সহযাত্রীরা আমাকে লাইনে দাঁড়াতে দেবে না। তারা নতুন স্টারকে লাইন ছাড়া পার করতে চাইছে, পারছে না। আমি ক্যাবলাকান্তের মতো লাইন ছাড়া পার হতে চেষ্টা করলাম। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পুলিশ পাত্তাই দিলো না। একসময় লাইন পেরিয়েই ইমিগ্রেশন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট বাড়িয়েছি। ডানে মুখ ঘুরিয়ে দেখি পাশের বুথে আমার সে-ই স্যার। স্যার উপদেশ দিয়ে বললেন, নেভার টেক এক্সট্রা অ্যাডভানটেজ। সম্মান জোর করে পাওয়া যায় না। সম্মান যখন পেছনে ধেয়ে আসবে তখন নেবে। জোর করে নেওয়ার চেষ্টা কোরো না। এই শিক্ষাই ওইদিন পেয়েছি আমি।
রিয়া বলল, এখন তো জোর করে নিচ্ছিস না। পেছনে, সামনে ধেয়ে আসছে সম্মান আর সম্মান। আমাদের চুমুবতী স্টারকে সম্মান দিতে চাই আমরা। এই সম্মান নেওয়া যাবে।
এবার আলাপে ঢুকে মাহিন বলল, আমি মাহিন।
বাঁধন চিৎকার করে রিয়াকে বলল, হাবলুশ, সম্মান দেবো আমরা মাহিন ভাইয়াকে। দে, চেয়ার টেনে দে উনাকে। নইলে আবার ইনসাল্ট ফিল করতে পারেন তিনি।
শাশা বলল, ইতোমধ্যে আমি ওনার ইনসাল্টেশনের বেলুন ফুটো করে দিয়েছি। উনাকে বলেছি, বুকের বোতাম লাগিয়ে নিন। চোখে চোখে বলেছি। উনি বোতাম লাগিয়ে চুপসে আছেন। আর ইনসাল্ট হওয়ার সুযোগ পাবেন না।
আচমকা সবার কথা থেমে গেল।
সবাই একযোগে সামনে তাকাল। রেস্টুরেন্টের মূল গেট পেরিয়ে এগিয়ে আসছেন যেবু আপা। পেছনে সামান্য দূরত্বে আসছে রেজা মামা।
রিয়ার মনে চট করে প্রশ্ন ঢুকে গেল, ওনারা দুজন কি একসঙ্গে এলেন? প্রশ্ন মাথায় নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রিয়া। বাঁধন, কুসুম এগিয়ে গেছে।
ওনাদেরই সম্মান দিতে হবে, রিয়ার উদ্দেশে কথা শেষ করে মাহিনও এগিয়ে গেল সামনে।
মাহিনের সঙ্গে পরিচিত হয় রেজা। কুসুম বলে, উনি আমাদের প্রিয় রেজা মামা। উনি যেবু আপা। আর মাহিনকে দেখিয়ে বলল, উনার নাম মাহিন, বুয়েটে লেভেল ফোরে, দ্বিতীয় পর্বে আছেন।
রেজা বলল, আমি দেখেছি দুজনকে রিকশায়, ধেয়ে বেড়াচ্ছিলে টিএসসি এলাকায়।
মাহিন লজ্জা পেল। কুসুমও।
যেবু আপা ওদের লজ্জা কাটিয়ে দিতে বললেন, সুযোগ পেলে সবাই এমন ধেয়ে বেড়ায়। বলতে বলতে সামনে এগোলেন তিনি। রিয়া আর মুনাও এগিয়ে আসে। যেবু আপার হাত ধরে রিয়া বলল, কনগ্র্যাচুলেশন আপা।
কী ব্যাপার, আমাকে কনগ্র্যাচুলেশন কেন?
মুনা চট করে বলে বসে, আপনার ছাত্রী ভালো রেজাল্ট করেছে, অভিনন্দন তো আপনারই। মনে মনে বলল, মামার পাশে আপনাকে বেশ মানিয়েছে। মামি হিসেবে আপনাকে পেলে অভিনন্দন দেওয়া যেত।
রিয়া কি অগ্রিম কোনো অভিনন্দনবার্তার ছাড়পত্র দেবে। মামার পাশে যেবু আপাকে দেখে এমন ভিরমি খেলো কেন? মামার সঙ্গে কি যেবু আপার ইন্টিমেসি গড়ে উঠেছে? ওরা কি একান্তে কথা বলে? মামার তো বেশ পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনের কারণ কী? রিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি সেই কারণে টোকা খেয়েছে? রিয়া কী চোখে দেখে মামাকে? মামার চোখে ও দেখেছে নির্ভরতা। দেখেছে মামার প্রতি ওর আস্থা। এর বাইরে কিছু আছে কি? অনেক টিনএজ মেয়েও তো বয়স্ক পুরুষের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। রিয়াও কি তবে ঝুঁকে গিয়েছিল? নানা প্রশ্ন মুনার মনে জড়ো হতে থাকে। বেশি ভাবার সুযোগ পেল না ও। সবাই ইতোমধ্যে গোল হয়ে বসে গেছে।
টেবিলে এসেছে স্যুপ, স্টার্টার। স্প্রাইট, প্লেন ওয়াটার।
যেবু আপা বলল, সবাইকে অভিনন্দন। যে যার পছন্দমতো সাবজেক্টে ভর্তি হলে আর একবার অভিনন্দন জানাব।
রেজা বলল, আমার আরেক ঘোষণা শোনো। শিগগির মুনার বিয়ে হচ্ছে। বিয়েতে ধুম আনন্দ করব আমরা।
বিয়ের কথা শুনে যেবু আপার চোখ চকচক করে ওঠে। মামার প্রত্যেক ভঙ্গিতে যেবু আপা এমন ঝলসে ওঠে কেন? নাকি নিজেই ভুল দেখছে। ভাবতে ভাবতেও ট্র্যাকচ্যুত হলো না রিয়া। আড্ডায় পুরোপুরি অংশ নিয়ে মামাকে উদ্দেশ করে বলল, মুনা কি ‘তিন বেহুঁশের’ গলায় ঝুলছে?
বাঁধন প্রশ্ন করে, সে কী? তিন বেহুঁশের মানে কী?
যাকে একবার দেখে তিনবার বেহুঁশ হতে হয় তাকে তিন বেহুঁশ বলা হয়।
বাঁধন আবার জানতে চায়, দেখেই বেহুঁশ?
রিয়া উত্তর দেয়, হ্যাঁ এমনই সুদর্শন যে দেখেই বেহুঁশ হতে হবে।
শাশা এবার কথা বলল, সুদর্শন হলেই কনশাসনেস লস হতে হবে? কই, মাহিন ভাইয়া তো হেভি অ্যাট্রাকটিভ। রেজা আঙ্কেলও দারুণ ম্যানলি। কেউ তো বেহুঁশ হলো না উনাদের দেখে?
শাশার কথায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।
মুনা ঘোষণা দিলো, লেট আস এনজয় ডিশেস।
সবাই খেতে শুরু করে।
রিয়া এবার অন্য প্রসঙ্গ তোলে। দশটা চেয়ার আমাদের। দুটো খালি। পুনম আপা আর যূথী আসেনি। কেন? যেবু আপা ও বাঁধনকে একসঙ্গে প্রশ্ন করে ও।
বাঁধন বলল, যূথী ঢাকায় নেই। চিটাগং।
যেবু বললেন, পুনম চাকরি নিয়েছিল। গতকাল আনঅফিসিয়ালি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ওর মন খুব খারাপ। এজন্য আসেনি।
রিয়া খেয়াল করল, যেবু আপার মুখের উচ্ছ্বাস কমে গেছে। পুনমের মনের বিষাদ তাঁর মনও ছুঁয়ে গেছে।
রিয়া বলল, ঠিক আছে আপা। আমাদের এখনকার গ্রোগ্রাম শেষ করে আমি আপনার সঙ্গে পুনম আপাদের বাসায় যাব।
যেবু মাথা নাড়ালেন।
রেজা মামার দিকে তাকিয়ে মাহিন বলল, এত কম বয়সে মুনার বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছেন কেন? পড়ালেখা শেষ করার আগে বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
মাহিনের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রশ্ন অস্বীকার করতে পারল না রেজা।
সহজ গলায় বলল, এটা পারিবারিক সিদ্ধান্ত। তাছাড়া মুনাও রাজি হয়েছে। বিয়ের পর সে পড়তে পারবে।
মাহিন ব্যাখ্যা শুনে আশ্বস্ত হলো না। মন খারাপ করল। এত অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়েতে মন সায় দিলো না।
বাঁধন বলল, শোন মুনা, পাঁচ বছরের আগে বাচ্চা নিবি না। বাচ্চা হয়ে গেলে পড়াশোনা হবে না।
রিয়া বলল, হ্যাঁ, বাচ্চা হলে পড়ালেখা পিছিয়ে যেতে পারে, তবে মা হিসেবে তো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। অগ্রগামী মাতৃত্বের বিজয়কেতন উড়বে তখন।
মুনা এসব কথায় কান দিলো না। ছেলে পছন্দ হয়েছে, এজন্য সে রাজি হয়েছে। তাছাড়া পড়ার সুযোগ পাবে জেনেছে। তবে এ বয়সে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই মনে। রাজি হওয়া আর মন থেকে মেনে নেওয়া এক কথা নয়। ভেতর থেকে মন সায় দিয়েছে বলে মনে হয় না। এজন্য বিয়ের আলাপ তাকে তেমন টানল না।
মুনা বলল, আইসক্রিমের অর্ডার দিইনি। কফি বা গ্রিন টি কেউ না চাইলে আইসক্রিম চলতে পারে।
শাশা বলল, আমার আইসক্রিম চাই।
সবাই বলল, ঠিক আছে, শাশার সৌজন্যে আমরাও চাই আইসক্রিম।
যেবু এবার মাহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার গ্রেড কেমন হচ্ছে।
কুসুম নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা লুফে নিয়ে আপন আলোয় জেগে উঠে বলল, চারের মধ্যে সর্বোচ্চ গ্রেড পাচ্ছে, থ্রি পয়েন্ট ফাইভ থাকছে।
যেবু বলল, তাহলে তো ডেফিনিটলি বাইরের স্কলারশিপ জুটে যাবে। এমএস করতে কোথায় যাবেন?
মাহিন হেসে বলল, দেখা যাক। সব ভালো তার শেষ ভালো যার।
রেজা বলল, উইশ করি সবার শেষটা ভালো হোক।
চলবে...
এসইউ/এএসএম