মায়াবতী: পর্ব ৩০
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
রিয়া চুপ থাকে। মনে মনে বলে, শুনবে কেন? ও তো মনের মালা পরিয়ে দিয়েছে সোনার হরিণের গলায়। ওই হরিণ বাস করে কুসুমের বুকের ঘরে। মুখে বলল, আঙ্কেল, ওর বিয়ের ব্যাপারে একদম এগোবেন না। পড়ালেখা শেষ করার আগে এ প্রসঙ্গ তুলবেনই না। ওর মতামত ছাড়া কোনো কথা কোথাও দেবেন না। জোর দিয়েই কথাগুলো বলল রিয়া।
কায়সার জামান মনে মনে খুশি হলেন। রিয়ার কথার জোর মুগ্ধ করল তাঁকে।
হঠাৎ তিনি মুনা আর কুসুমকলির প্রসঙ্গ পালটালেন। সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, তোমার খবর কী, রিয়া? তোমাকে কেমন জ্বালাতন পোহাতে হচ্ছে?
রিয়া সহজভাবে নিল প্রশ্নটা। হাসিমুখে জবাব দিলো, বাপি দেখবেন এসব বিষয়, এ ব্যাপারে কিছু জানি না আমি।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গাড়ির গতি রিয়ার মনে স্বস্তি ঢেলে দিলো। স্বস্তি নিয়ে সামনে তাকাল এবার। বিএসএমএমইউ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লকের বিশাল উঁচু ভবনের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো। নিজেকে বড় ডাক্তার হিসেবে দেখতে চায়। বড় ডাক্তার হতে হলে ‘এ-ব্লক’ পাড়ি দিতে হবে। বিরাট সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের। রেজাল্ট কী হবে কে জানে, মেডিক্যালে চান্স পাবে কি না তাও জানে না। তবে তার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই।
জামান সাহেবের কথা থামল না। তিনি ঠান্ডা গলায় বলে বসেন, সন্ত্রাসীরা কি তোমার পিছু ছেড়েছে? শুনেছিলাম, বখাটেদের একজন গ্রেফতার হয়েছে। এখন কী অবস্থা?
রিয়া বড় ডাক্তার হওয়ার কল্পচোখে উড়ে গিয়েছিল ‘এ-ব্লকের চূড়ায়। আঙ্কেলের প্রশ্নটা তার বুকে ঢুকিয়ে দিলো শীতল এক বুলেট। উঁচু চূড়ার শীর্ষবিন্দু থেকে ধপাস করে ও পড়ে গেল শাহবাগের মোড়ে। গাড়ি এখন ঘুরে শেরাটনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জবাব দিতে পারছে না রিয়া। নীরবতা চলছে গাড়ির ভেতর। গাড়ি চলে এসেছে শেরাটন হোটেলের ক্রসিং মোড়ে। লাল বাতি জ্বলছে। ডানে ঘুরে গাড়ি যাবে বেইলি রোডের দিকে।
এ সময় এক কিশোরী হাতে ফুল নিয়ে ছুটে এলো উইন্ডশিল্ডের কাছে। লাল গোলাপের পাশাপাশি আছে এক তোড়া অর্কিড ফুল।
কিশোরীর গায়ের রং কালো। ড্রেস পরিচ্ছন্ন। ক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধা। তার মুখে নির্মল হাসি। ওরা ফুল বিক্রি করে। বড় হোটেল থেকে অনেক সময় ব্যবহার করা তাজা ফুল জোগাড় করে। ছুটে ছুটে বিক্রি করে রাস্তায়। অনেকে একদম তাজা ফুলও ফেরি করে। জানে রিয়া।
তিনবার উইন্ডশিল্ডে টোকা দেয় রিয়া। ড্রাইভারকে ইশারা করে খুলে দিতে। খোলার পর রিয়া বলল, ওই তোড়াটি দাও। অর্কিড ফুলের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
কিশোরী খুশি হয়। এগুলো দামি ফুল। দামি ফুলে বেশি টাকা পাওয়া যায়।
কত টাকা? প্রশ্ন করল রিয়া।
কিশোরী হাসল। জবাব দিলো না। এই হাসির অর্থ, আপনি দেন।
রিয়া হিসাব করে দেখে দামি ফুলশপ থেকে নিতে গেলে এগুলোর দাম হবে ২০০ টাকা। ব্যাগ থেকে ২০০ টাকা বের করে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো ও।
চকচক করে ওঠে মেয়েটার আনন্দচোখ। ২০০ টাকা হাতে নিয়ে রিয়াকে অবাক করে ফিরিয়ে দিলো ১০০ টাকার একটা নোট। ফিরিয়ে দিয়েই ছুট দিলো সে নিরাপদ জায়গায়। হলুদ বাতি জ্বলে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করবে।
সবুজ বাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বসে থাকে রিয়া। ব্যবহৃত অর্কিড। হোক ইউজড। তবু তো তাজা। তাজা ফুলের গায়ে ইউজড হওয়ার চিহ্ন নেই। তাজা ফুল বেগুনি রঙের চোখ মেলে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে। রিয়া ডুবে গেল ফুলের ভেতর। ও যেন শুনতে পেল, বেগুনি চোখ কথা বলছে, সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়েছিলে। তুমি ইউজড হওনি। তাজাই আছো। হাসো তুমি, হাসো।
মনের গহিন থেকে হাসি বেরিয়ে আসে। মুখে ফোটে হাসির ঢেউ। বখাটেদের থ্রেট নাই এখন। অনলাইনে ছবি ছেড়ে দেওয়ার ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছে ও। তবে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে মুক্তি ঘটেনি। আঙ্কেলের প্রশ্ন ভাবতে গিয়ে মনে হলো চারপাশের সবাই সচেতন-অবচেতনে টেনে আনে দুর্ঘটনাটা। টেনে এনে তাকে চেপে ধরে অতীতে। বর্তমানে ছুড়ে দেয় কালির ছোপ।
কায়সার জামান ভেবেছেন, রিয়া তার প্রশ্ন শোনেনি। ফুল কেনার কাজে ব্যস্ত আছে। ভেবেছেন ভালোই হলো। প্রশ্নটা ওকে করা ঠিক হয়নি। ভেবে ভেবে সেলফ মেইড আত্মতৃপ্তি খুঁজে নিলেন তিনি।
রিয়াও খুঁজে পেল তৃপ্তি। অস্বস্তি তাকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারেনি। ও পেয়েছে নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা। এই শিক্ষা যে কোনো বিপর্যয় তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিতে পারে। আঙ্কেলের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধার প্রকাশ করেনি ও। কৌশলে উপেক্ষা করেছে প্রশ্নের জবাব।
গাড়ি চলে এসেছে বেইলি রোডে।
কলেজ গেটের দিকে বেশ ভিড়। একটু আগেই নেমে গেল রিয়া। জামান সাহেব মাথা বের করে বললেন, মামণি, রেজাল্ট পেলে আমাকে জানিয়ো ফোনে। কুসুমের রোল নম্বর মনে আছে তোমার?
জি আঙ্কেল। মনে আছে। আপনি ভাববেন না।
গাড়ি চলে গেল।
শেষ মুহূর্তের মামণি ডাক রিয়ার মনের সব কষ্ট মুছে দেয়। এমন মমতামাখা ডাক যার কণ্ঠে আসে, তিনি তো ইচ্ছাকৃত কষ্ট দিতে পারেন না। বোঝে রিয়া। সবাই অনিচ্ছায় তাকে কষ্ট দিয়ে বসে। এ ধরনের কষ্ট কেন গায়ে মাখবে ও? নব উড়িয়ে দিয়ে ভীরুপায়ে কলেজ গেটের ভেতর ঢুকে গেল।
ভেতরে ঢুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রেইনট্রি গাছের তলে দাঁড়িয়ে রইল। অনেক স্পটে দেয়ালে রেজাল্ট সেঁটে দেওয়া হয়েছে। একেক জায়গায় একেক দল ছাত্রী হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দিচ্ছে। চারদিকে ফাটাফাটি উল্লাস।
এ সময় ও দেখল মুনাকে। ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সে। সুনামিতে বিধ্বস্ত নাবিকের মতো তার অবস্থা। চুল এলোমেলো, চাপে দিশেহারা অবস্থা। ভিড় থেকে বেরিয়ে দিশা খুঁজে পায় সে। সামনে তাকিয়ে দেখে ফেলল রিয়াকে।
আচমকা উল্লাসে ফেটে পড়ল।
ছুটে এসে রিয়ার গালে চুমু বসিয়ে দিলো।
রিয়া বুঝতে পারে মুনার রেজাল্ট। বোঝে কী হতে পারে নিজের রেজাল্টও।
প্রশ্ন করল, কুসুমকলির খবর কী?
ফাইভ। সবাই জিপিএ ফাইভ পেয়েছি।
রিয়া জানতে চায়, সব সাবজেক্টে ‘এ’ প্লাস?
মুনা জবাব দিলো, তা তো জানি না। সব সাবজেক্টে ‘এ’ প্লাস পেয়েছি কি না, এখানে সেটা জানা যাবে না। অনলাইনে জানা যাবে। পেপারে নিউজ এসেছে, বিকেল পাঁচটার পর জানতে পারব।
টিভি রিপোর্টাররা ছুটোছুটি করছে। ক্যাম্পাসজুড়ে উল্লাস বয়ে যাচ্ছে। উল্লাসের ঢেউ ক্যামেরায় ধারণ করে নিচ্ছে তারা।
সেরা কলেজের সেরা রেজাল্ট। সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। নটর ডেম কলেজের পরই এ কলেজের অবস্থান।
রিয়া সেলফোন চাপতে থাকে। একের পর এক ফোন করে, প্রথমে জানায় বাপিকে। মামণির সঙ্গে কথা বলে। এরপর একে একে কথা বলে কুসুমের সঙ্গে, কুসুমের বাপির সঙ্গে। রেজা মামা, যেবু আপা, বাঁধন সবাইকে রেজাল্ট জানিয়ে দিলো ও।
এ সময় চ্যানেল ওয়ানের জনপ্রিয় রিপোর্টার শামিম আল-আমিন সামনে এসে দাঁড়ায়।
আপনাদের এক্সপ্রেশন আমরা ক্যামেরায় ধারণ করে নিয়েছি। মুনাকে উদ্দেশ করে বলল, আপনি উনার গালে চুমু বসিয়ে দিয়েছেন। আনন্দের এক্সক্লুসিভ দৃশ্য এটি। প্রচার করতে পারি চুমুর দৃশ্য?
মুনা হাসতে থাকে।
রিয়া হাসতে থাকে।
হাসির বন্যায় ভাসতে থাকে সবাই। এ দৃশ্যপটেরও শর্ট নেওয়া হয় ক্যামেরায়!
আটাশ.
অনেক চেষ্টায় বিকেল পাঁচটার পর বাসায় বসে অনলাইনে ঢুকতে পেরেছে রিয়া। রোল নম্বর অনুযায়ী প্রতি পরীক্ষার্থীর রেজাল্ট ট্রান্সক্রিপ্ট আছে ওয়েবসাইটে।
সহজেই নিজের নম্বর পেয়ে গেল ও।
নিজের ট্রান্সক্রিপ্ট নিজের চোখে দেখছে ও। জ্বলজ্বল করছে।
প্রতিটা বিষয়ে ‘এ’ প্লাস! গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ!
আনন্দে ওর চোখ বুজে এলো। বাপির মুখে হাসি ফোটাতে পারবে ও।
মামণি খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি। ওনাদের অনেক দুঃখ দিয়েছে। দুঃখের সাগর পাড়ি দিচ্ছে নিজেও। মাঝপথে ছিনিয়ে এনেছে সুখের খবর। নীরব আনন্দে বুক ভরে গেল। কান্না এলো। সুখের কান্নায় বুঁদ হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হঠাৎ টনক নড়ে তার। বাপির কথা মনে হয়। বাপি বাসায় নেই। মোবাইল ফোনে কানেক্ট করে বলল, বাপি তোমার মুখরক্ষা করতে পেরেছি। গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছি! সব সাবজেক্টে ‘এ’ প্লাস!
হে আল্লাহ ব্লেস ইউ মাই ডটার। আই’ম নাউ দা হ্যাপিয়েস্ট পারসন ইন দিস ওয়ার্ল্ড!
বাপির এক্সপ্রেশনে চোখে আবার পানি চলে আসে।
ফোনসেট রেখে মামণির খোঁজে আসে।
মামণি টিভি সেটের সামনে বসে আছেন। ইদানীং উনার প্রধান কাজ হিন্দি মুভি দেখা। বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের হিন্দি ডেইলি সিরিয়াল গোগ্রাসে গেলেন তিনি। ‘কিউ কি সাস ভি কাভি বহু থি’, ‘কাহিনি ঘর ঘর কি’, ‘কসমসে’, ‘সাথ ফেরে’, ‘দুলহান’, ‘কাহি তো হোগা’―এরকম আরও অনেক মেগা সিরিয়ালের প্রতি তার বেশি আগ্রহ।
এখনো ডুবে আছেন এক সিরিয়ালের ভেতর।
রিয়া এসে সামনে বসে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল আনন্দ সংবাদের কথা।
সাধারণত সিরিয়ালের সামনে থেকে তাকে সরানো যায় না। সিরিয়াল ছেড়ে এই প্রথম তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
রিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন রাহেলা চৌধুরি। এ তার সুখের কান্না। মেয়ে ভুল করেছিল। ভুল করে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল, কষ্ট ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে, এখন নিজের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে আনন্দের ঢেউ।
মেয়েকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখেন তিনি।
রিয়া মুখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল।
রাহেলা চৌধুরি জানতে চাইলেন, মুনা ও কুসুমকলির রেজাল্ট?
মনে পড়ল ওদের কথা। ওদের নম্বর দেখা হয়নি। দ্রুত ফিরে এলো কম্পিউটারের সামনে। মুনার নম্বর দেখল প্রথম। মুনা গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পায়নি। দুই সাবজেক্টে ‘এ’ প্লাস মিস করেছে। কুসুমকলিও গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পায়নি, এক সাবজেক্ট মিস করেছে।
কী করবে সে এখন?
মুনা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে নিজের রেজাল্ট।
সেলফোনে ও কানেক্ট করে মুনাকে।
কনগ্র্যাচুলেশন রিয়া। আমি গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ মিস করেছি, কষ্ট লাগছে। তবে তোর রেজাল্ট সে কষ্ট অনেক কমিয়ে দিয়েছে। গোল্ডেন ফাইভ তোর দরকার ছিল।
মাই ফ্রেন্ড মুনা, প্লিজ মন খারাপ রাখিস না। ভর্তিযুদ্ধে গোল্ডেন ফাইভের কোনো মূল্য নেই। জিপিএ ফাইভই কেবল কাউন্ট করা হয়। ভর্তিযুদ্ধে ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে হবে।
মুনা বলল, জানি। তবুও কষ্ট লাগছে।
কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। চল, আমরা সবাই জিপিএ ফাইভ সেলিব্রেশন করি। ফাইভের মূল্য তো তুচ্ছ না।
ঠিক আছে। তোর কথা থাকল। আমি কুসুমের সঙ্গেও কথা বলছি। যেবু আপা, রেজা মামা, বাঁধন, যূথী, পুনম আপা―এদের সবাইকে নিয়ে ছোট্ট গ্রুপ করে আমরা বাইরে একসঙ্গে খাব, কী বলিস?
মাহিন ভাইয়াকেও বলিস আমাদের পক্ষ থেকে। কুসুমের সঙ্গে কথা বল। আমিও বলছি।
রিয়া কথা বলে কুসুমের সঙ্গে।
মাহিন অনলাইন থেকে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে কুসুমকে। কুসুমের মন খারাপ। ঢাকায় এসে পৌঁছে গেছে।
রিয়ার রেজাল্ট শুনে কুসুমের মন ভালো হয়ে গেল।
নিজেদের সার্কেলে ছোট্ট একটা গেট টুগেদারের জন্য একমত হয়। কুসুমের সঙ্গে কথা বলার সময় কল ওয়েটিংয়ে ভেসে ওঠে বাঁধনের নম্বর। কথা শেষ করেই বাঁধনকে কানেক্ট করে ও।
বাঁধন চিৎকার দিয়ে বলল, কনগ্র্যাচুলেশন।
একবার তো কনগ্র্যাচুলেট করেছিস।
আবার দিলাম। এইমাত্র চ্যানেল ওয়ানে দেখলাম তোকে আর মুনাকে। মুনা তোর গালে চুমু বসিয়ে দিয়েছে।
হেসে উঠল রিয়া।
বাঁধন বলল, আমি একাই চুমুবতী না। তোরাও এখন চুমুবতী।
রিয়া হাসতে হাসতে বলল, পৃথিবীর সব মায়াবতীই গোপনে গোপনে চুমুবতী।
হায়! কাউকে দিয়েছিস নাকি রে?
না না। এমনি বললাম। শোন বাঁধন। তুই থাইল্যান্ডের গল্প করলি না তো। সেই যে গেলি, এর মধ্যে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট পর্যন্ত হয়ে গেল।
আরে। কেবল কি থাইল্যান্ড। দিল্লি-ফিল্লিও ঘুরে এলাম। তাজমহল দেখে এলাম। ব্যাংকককে মনে হয়েছে নারীর রাজ্য। ব্যাংককের সব জায়গায় নারীদের আধিপত্য। আর আগ্রা হলো প্রেমরাজ্য। তাজমহল না দেখলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের কাতারে থাকতে পারবি না।
সেকি! অর্ধেক কাতার মানে কী?
তাজমহল দেখে বিল ক্লিনটন বলেছেন, পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ তাজমহল দেখেছে। এক ভাগ দেখেনি।
ওঃ! তাজমহল দেখার গোপন বাসনা গেড়ে বসে রিয়ার মনে।
হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বিয়ের পর হানিমুন করিস আগ্রায়। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা যাবে।
তোর কথাটা মনে থাকবে। তবে আমার কপালে বোধ হয় বিয়ে জুটবে না।
থাপ্পড় খাবি। বাঁধন ধমক দেয়।
রিয়া বলতে থাকে, মুনা, কুসুম আর তোর মতো আমারও বিয়ের প্রপোজাল আসে। এলেও আর এগোয় না। ওরা জেনে যায়, আমি এক ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছিলাম। কেউ কেউ বাড়তি শুনেছে, সন্ত্রাসীরা আমাকে তুলে নিয়ে তিনদিন রাতভর গ্যাং রেপ করেছে।
বাঁধন খেপে ওঠে, বললেই হলো, যারা বলবে, তাদের আমরা ছেড়ে দেবো নাকি? নাক ফাটিয়ে দেব না আমি।
আমার ফ্রেন্ড হিসেবে এ কথা বলছিস তুই। আমাকে ভালোবাসিস বলে এভাবে বলছিস। সবাই তো আর ভালোবাসে না। কেউ কেউ ঈর্ষায় পুড়ে আমাকেও জ্বালিয়ে দিতে পারে। দিচ্ছে। বিশ্বাস হয় না, না?
বাঁধন কোনো জবাব দিতে পারল না। গায়ের জোরে বলল, ওসব কিছু পাত্তা দেবো না আমরা, তুইও দিবি না। শক্ত থাক। আমরা সবাই আছি তোর পাশে।
আমি জানি। আমার কিছু ভালো ফ্রেন্ড আছে। ওদের কারণেই শক্ত আছি আমি। ভালো আছি। ভেঙে পড়িনি।
বাঁধন ফোন করেছিল আনন্দ করার জন্য।
আনন্দের আয়ু খুব কম। এই আনন্দ। এই বিষাদ। এই সুখ। এই দুঃখ। হায়রে মানবজীবন। এত ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে মানুষে মানুষে কত দ্বন্দ্ব! কত সংঘাত! কত অবিশ্বাস! গোপন দর্শন জেগে ওঠে ওর মনে।
নিয়তির কোন গোপন চালে চলে মানবমন। কিছুই জানে না রিয়া। কিছুই বোঝে না বাঁধন।
চলবে...
এসইউ/এমএস