একরাতে একদা
‘এসো নিয়ম ভেঙে নিয়ম গড়ি
চাঁদের নিচে অহেতুক গল্প করি’
দুপুরের পর থেকে লাইন দুটো আটকে গেছে মাথায়। এখন মধ্যরাত। ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজেই চলেছে মাথার ভেতর অবিরাম। পরের লাইনটাও আসছে না। আবার এই দুটো লাইনও যাচ্ছে না মাথা থেকে। এমন হয় মাঝে মাঝে। সেই সময়টা খুব অস্থির, অসহ্য বেদনার। মনে হয় মাথাটাকে ঠুকে দিই দেয়ালে। মাথাটা ফেটে বের হয়ে যাক ঘিলু সবটুকু। সেই সঙ্গে বের হয়ে যাক অভিশপ্ত লাইন দুটো।
কবিতা আসলে এমনই। সুন্দরী নারীর মতো। কখনো খুব মায়ায় ভরা। কখনো খুব স্বার্থপর। যখন ইচ্ছে ধরা দেবে। নিপুণ ভঙ্গিতে করোটিতে হাজির হবে একটার পর একটা শব্দ। মায়ময় মোহনীয় এক আল্পনার রূপ নিয়ে বসে যাবে খাতায়। দুধসাদা খাতায় নীল কালির আঁচরে ফুটে ওঠা কাগজটাকে তখন মনে হবে মেঘের ভেলায় ভেসে থাকা শরতের আকাশ। মাথা থেকে বের হয়ে অক্ষর থেকে শব্দে, শব্দ থেকে বাক্যে, বাক্য থেকে পুরো কবিতার অবয়বটা দাঁড়িয়ে গেলে তখন তাকে মনে হয় রক্ত-মাংসের মানুষ।
কত রাত অদিত কথা বলেছে তার কবিতার পঙক্তির সঙ্গে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছে কবিতার প্রতিটি লাইন! আবার কখনো কখনো বশে না আসা সুন্দরী রমণীর মতো শুধু পিছলে পিছলে যায় কবিতা। লাইনগুলো খেলা করে চারপাশে। আসি আসি করেও ধরা দেয় না কিছুতেই। খুব জোর করে ধরতে গেলে পড়ে যায় হাত গলে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাসে তাচ্ছিল্যের হাসি। ভাবটা যেন এমন—কী, খুব চেষ্টা করছো আমায় ধরতে! কিন্তু আমি তো ধরা দেবো না কিছুতেই। হাসে দুষ্টু কিশোরের মতো!
তখন খুব রাগ হয় অদিতের। রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। অকারণ ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে ইভানার সাথে। মেঝেতে সজোরে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে চায়ের কাপ। একটার পর একটা সিগারেট পুড়িয়ে নিজের ফুসফুসের বারোটা বাজাতে ইচ্ছা করে। আজকের রাতটাও মনে হয় তেমনই। রাত কি, বলতে গেলে দুপুরের পরের থেকেই সময়টাই মনে হচ্ছে এমন।
শেষ দুপুরের ভাতঘুমের সময়টাতে আচমকা মাথায় এসেছে উপরের দুটো লাইন। আর লিখে ফেলেছে অদিত। ভেবেছে পরের লাইনগুলোও আসতে থাকবে একটার পর একটা। কিন্তু না, আসেনি। মাথাটাকে, ভাবনাটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য ফেলে রেখেছে লাইন দুটো। যেন শান্ত মাথায় মেঘের ভেলায় ভেসে চলে আসে পঙক্তিরা। আদুরে বিড়ালের মতো বসে যায় একের পর এক। কিন্তু এলো না তো, এলোই না। খুব জেদ চেপে যায় অদিতের। লিখতেই হবে পরের লাইনটা। যে করেই হোক। ধরা দিতেই হবে কবিতাকে। জেদ এক সময় রূপ নেয় ক্রোধে। কার প্রতি এই ক্রোধ? নিজের প্রতি? কবিতার প্রতি? উত্তর নেই কোনো। উত্তর খোঁজার দরকারও নেই। শুধু একরোখা চেষ্টা। পরের লাইনটির খোঁজ পাওয়ার জন্য। বড় যন্ত্রণাময় কবিত্বের পৃথিবী। আবার অকবিত্বের মুক্ত পৃথিবীতে ফিরে যাওয়াও দায়। তবে কি যন্ত্রণাকাতর বেঁচে থাকাই কবির নিয়তি? খুব অস্থির লাগে তার। অসহ্য বেদনা হয় মনের গহীন কোনো কোণে।
পুরো বাড়ি সুনসান। সবগুলো ঘরের বাতি নেভানো। ঘণ্টাখানেক আগে ইভানা এসে দেখে যায় অদিতকে। ঘুমানোর জন্য ডাকে। ধোঁয়ায় অন্ধকার ঘরের মধ্যে চেয়ারে মাথাগুঁজে বসে থাকা অদিত একবার শুধু তাকায় চোখ তুলে। বলে না কিছুই। সিগারেটের কটুগন্ধে আর দাঁড়ায় না ইভানা। ইভানার নীরবে চলে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে দুলির মা বুয়া এক কাপ চা রেখে যায় টেবিলে।
‘এসো নিয়ম ভেঙে নিয়ম গড়ি
চাঁদের নিচে অহেতুক গল্প করি’
দুটো লাইনই লিখে চলেছে বারবার অদিত। সব মিলিয়ে একশ তেপ্পান্ন বার লেখা হয়েছে—গুনে গুনে দেখে সে। সময় বইতে থাকে মন্থর। যেন থেমে গেছে পুরো চরাচর। এক সময় রান্নাঘরের দিকে চিকচিক করে দুটো চিকার ঝগড়া হুটোপুটি কানে আসে অদিতের। মিনিট তিনেক পর থেমে যায় তা-ও। ফ্যানের বাতাসে ফড়ফড় শব্দ করে ওড়ে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা। নিচে দারোয়ানের ফিসফাস করে কথা বলার আওয়াজ আসে কানে। কার সাথে এত কথা বলে বাতেন মিয়া। খিলখিল হাসির শব্দ কানে আসে। দারোয়ানের ঘর থেকে। উঠে গিয়ে দেখে আসার ইচ্ছে জাগে মনে।
সবাই খুব সুখে আছে। কারো কোনো ভাবনা নেই। নিশ্চিতে ঘুমু্চ্ছে সবাই। শুধু ঘুম নেই অদিতের চোখে। অভিশপ্ত দুটো লাইন মাথায় নিয়ে আটকে গেছে সে এক নির্ঘুম রাতের কাছে। যেন নির্বাসন হয়েছে তার নির্জন কোনো দ্বীপে। পরের লাইনটা লিখতে না পারলে মুক্তি নেই তার। কী অসহ্য! কী অসহ্য! কী যন্ত্রণাময় কবিজীবন। কোনো মানে হয় এসবের? কেন আসবে না কবিতা? এই তো সেদিন এক আড্ডায় বলেছিল সৌরভ—অদিত ভাই, আপনার কোনো সমস্যা নেই। যেন মেশিনে অর্ডার দিয়ে দেন আর বের হয়ে আসতে থাকে একের পর এক নিখুঁত সব কবিতা। কোথাও কোনো খুঁত নেই। নিটোল সুন্দর সব কবিতা! সৌরভের কথায় মুখ বাঁকিয়ে একটু হেসেছিল আফজাল। তাতে কিছুই মনে করেনি অদিত। বরং নিজের সক্ষমতার ওপর প্রবল বিশ্বাস রেখে মনে মনে একটু করুণা করেছিল আফজালকে। কিন্তু আজ এই গভীর রাতে সত্য মনে হয় আফজালের বাঁকানো হাসি। আসলেই হয়তো কোনো সক্ষমতা নেই অদিতের। সৌরভ হয়তো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে—খুশি করার জন্য। হঠাৎ কী মনে হয়—রাত পৌনে দুইটায় আফজালকে ফোন করে অদিত। রিং হয়—একবার, দু’বার—হতেই থাকে। কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না ওপাশ থেকে। আবারো ফোন করে অদিত। এবারো সাড়া নেই। ফেসবুকে ঢুকে খোঁজে আফজালকে। দুই ঘণ্টা আগে সক্রিয় ছিল আফজাল বহুল ব্যবহৃত এই সামাজিক মাধ্যমে। এমন তথ্য দেখেও মেসেঞ্জারে একটি টেক্সট পাঠায় অদিত। ক্ষমা করো আফজাল। আমার লেখার ক্ষমতা সব শেষ! পড়ে থাকে টেক্সট আফজালের মেসেঞ্জারে অদেখা অবস্থায়।
কিছুতেই শান্ত হয় না মন। রান্নাঘরের চিকা দুটো ফিরে এসেছে আবার। শোনা যায় চিকচিক শব্দ তুলে তাদের হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ। পাশের ফ্ল্যাটে কেঁদে ওঠে একটি শিশু। শিশুটিকে শান্ত করার চেষ্টায় মায়ের কাতর গলা কানে আসে। জ্বলে ওঠে সেই ফ্ল্যাটের লাইট। অদিতের বারান্দায় এসে পড়ে আবছায়া আলো। বাথরুমের ফ্ল্যাশ টানার শব্দ কানে আসে। একটু পর আবার শান্ত হয়ে যায় সব। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে শিশুটি এবং তার মা-ও। শুধু নিস্তার নেই অদিতের।
রাত সাড়ে তিনটা। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় অদিত। দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়। কোনো জন-মানুষের দেখা নেই। অথচ দিনভর কী ব্যস্ত থাকে রাস্তাটা। এক সময় অনেকখানি দূরে গলির একবারে মুখটায় ঝাঁকড়া ছাতিম গাছের নিচে যেখানে দিনভর পান-সিগারেটের বাক্স নিয়ে বসে থাকে বাবুল; সেখানে ছোট্ট এক বিন্দু আলো চোখে পড়ে। একটু একটু করে আলোটা এগিয়ে আসে গলির ভেতর। সাত তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে অদিত, মাঝবয়সী কেউ একজন সিগারেট টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে। এত রাতে রাস্তায় কী করছে লোকটা? তারও কি সময় আটকে গেছে—না পাওয়া কোনো কবিতার লাইনে? আমার মতো? ভাবে অদিত। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা হারিয়ে যায় গলির বাঁকে।
আগের মতোই আবার নির্জন হয়ে যায় গলি। দূরে বড় সড়কে এই প্রায় শেষরাতেও শোনা যায় ভারী যান চলাচলের শব্দ। এমন সময় পেছনে এসে দাঁড়ায় ইভানা। এখনো ঘুমাওনি? বিস্ময় ঝরে তার কণ্ঠে। অদিত পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় ইভানা—অদিতের মুখটা কেমন করুণ। যেন পরের লাইনটি লিখতে না পেরে বড় অপরাধ করে ফেলেছে সে। এমনিতেই কবিতা-টবিতা নিয়ে খুব মাথা ব্যথা নেই ইভানার। অদিত কী লেখে, কেমন লেখে কখনো জানার ইচ্ছা দেখায়নি সে। দেখেওনি কখনো। কিন্তু আজ এই শেষরাতে অদিতের করুণ মুখটা দেখে কেমন যেন মায়া লাগে ইভানার। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অদিতও তাকিয়ে আছে চুপচাপ। এক সময় আবার ইভানার দিক থেকে ঘুরে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়ায় অদিত। ইভানার একবার মনে হয় চলে যাই। কিন্তু কী ভেবে যেন চুপচাপ বসে থাকে বেতের চেয়ারটায়। শেষ রাতের এই সময়টায় হিম শীতল বাতাস বইছে বারান্দাজুড়ে। ইভানার একটু শীত শীত লাগে। এদিকে একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলেছে অদিত।
চা খাবে একটু? করে দিই? কোনো উত্তর দেয় না অদিত। ইভানা নীরবে চয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। অল্প সময় পর চুলায় জল ফোটার বিজবিজ শব্দ কানে আসে অদিতের। আর একটু পর ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে দার্জিলিং চায়ের সুঘ্রাণ।
আচমকা পরের লাইনটা মাথায় আসে অদিতের। আসতেই থাকে। একটার পর একটা। লাইন ধরে। শুভ্র সতেজ শিউলির মতো নরম কোমল একেকটা শব্দ। আসছে ছন্দময় লাইনের পর লাইন। আহ! কী মধু! কী মধুময় যন্ত্রণা। এখনই সব লিখে ফেলতে হবে খাতায়। অল্প একটু অমনোযোগেই হারিয়ে যেতে পারে স্বর্গীয় সব পঙক্তিমালা! ব্যস্ত পায়ে লেখার ঘরের দিকে পা বাড়ায় অদিত।
বাইরে তখন ফর্সা হতে শুরু করেছে পুবের আকাশ!
এসইউ/জেআইএম