কাজী নজরুলের কারা জীবন সাহসী করে তোলে
আমাদের জাতীয় অহঙ্কার কবি নজরুলকে ভারতের কবি, বাঙালির কবি, সাম্যবাদের কবি, মানবতার কবি, বিদ্রোহের কবি। অসাম্প্রদায়িক সমাজের প্রতিচ্ছবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীনতার কবি বিদ্রোহের কবি বললেও ভুল হবে না। ভারতের আজাদি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার কবিতা, গান আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তার কারা জীবন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই করার পথ দেখিয়েছে।
অনেক সময়ই রাষ্ট্রের চিন্তাশীল মানুষর, দার্শনিক কিংবা মহান স্বাধীনচেতা কবিরা ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী, রাজা বা শোষকদের নিষ্ঠুর বৈরীতা বা রক্তচক্ষুর মোকাবিলা করতে হয়েছে। বহু সুপরিচিত কবির অনেক মহান সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট দেশের শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছে। হোমারের কালজয়ী সৃষ্টি ওডিসীর পঠন নিষিদ্ধ ছিল। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতামত, তাঁর সময়ের তাঁর দেশের শাসকগোষ্ঠী আক্রমণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই তালিকায় কাজী নজরুল ইসলামের নাম যোগ না করলে তা অসম্পূর্ণ থাকবে। সকল রকম শোষণের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠস্বর আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
কবির বেড়ে ওঠার সময়টাতেই বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটছিলো। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন। তাইতো কবি কখনও বিদ্রোহী, কখনও সংস্কারবাদী, কখনও প্রেমিক পরুষ, কখনও নবীর শান গেয়েছেন কখনওবা গেয়েছেন শ্যামা সংগীত। কাজী নজরুল ইসলাম সারা জীবনের সংগ্রাম ছিলো ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং করাচীতে বসবাস এবং সেই সূত্রে ওমর খৈয়াম ও রুমির সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয় তার জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। আবার করাচী থেকে ফেরার পরে কলকাতাতে কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সাহচর্য তাকে মানবধর্মের এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।
তাই তিনি ঐ সময় সাহসী উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন:
“তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা পরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহার?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
ঘায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”
ভারতীয় উপমহাদেশে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি লিখিত দলিলের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। কাজী নজরুল তাঁর ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)-এ প্রকাশিত ধূমকেতুর পথ রচনায় লিখেছেন, “একটিমাত্র টুকরো ভারতীয় ভূমিও বিদেশীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। ভারতীয়দের পরিচালনার দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে থাকবে। এ বিষয়ে কোনও বিদেশির অধিকার নেই আমাদের নির্দেশ করার। যারা ভারতের রাজা বা স্বৈরশাসক হয়েছে এবং এই ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করেছে, তাদের তল্পি-তল্পাসহ সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।”
বিশ শতকের বিশের দশকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লব পরবর্তী পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক পটভূমিকায় সাহিত্যিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ। এ সময় তাঁর কাব্যপ্রতিভা অভিব্যক্ত হয়েছিল বহুমুখী ধারায়, বিচিত্রভাবে, স্বকীয়তায় সম্পন্ন ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত রূপে। ভারতবর্ষে যখন দীর্ঘ দিনের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার কলধ্বনি, ইতিহাসে এই প্রথম যখন সমগ্র বাঙালি জেগে উঠেছে, ঠিক তখনই কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। সহায়-সম্বলহীন পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা, যুদ্ধ ফেরত তরুণ কবির কণ্ঠে মানুষের যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত দুঃখ-বেদনা ও কান্না মিশ্রিত ক্ষোভ অসাধারণ বিক্রমে উদগীরিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নে ১৯২২ সালে 'ব্যথার দান', 'অগ্নিবীণা' ও 'যুগবাণী' গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। 'অগ্নিবীণা' কাব্যগ্রন্থের 'বিদ্রোহী' কবিতাটিতে তিনি ঘোষণা করলেন 'চির-উন্নত মম শির'। এর মাধ্যমে বিদেশী শাসকদের কারণে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালী জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই ২৩ নবেম্বর ১৯২২ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি আর প্রকাশিত হয়নি। এরপর ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতাটি। এই কবিতার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এক বছর জেল খাটেন। সাহিত্য যে শোষক-নির্যাতনকারীর গায়ে চাবুকের মতো আঘাত করতে পারে তারই উদাহরণ কাজী নজরুলের এই কবিতা। এটি তাঁরই সম্পাদিত 'ধূমকেতু' পত্রিকার ১২শ সংখ্যায় (১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়।
কবিতাটি প্রকাশের পর পুলিশ ধূমকেতু অফিসে হানা দেয় ৮ নবেম্বর ১৯২২ সালে। কারণ কবির বিরুদ্ধে ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইনের ১২৪-ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছিল। 'ধূমকেতু' অফিসে তখন উপস্থিত ছিলেন মুজফফর আহমদ ও আবদুল হালিম। যদিও পুলিশ তখন তাকে গ্রেফতার করতে পারে নাই, কবি তখন ছিলেন কলকাতার বাইরে। কবিতাটি প্রকাশের ছয় সপ্তাহ পর ৮ নবেম্বর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করতে পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ পুনরায় 'ধূমকেতু' অফিসে এবং প্রেসে হানা দেয়। পুলিশ ৩২, কলেজ স্ট্রীটে হানা দিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে না পেয়ে 'ধূমকেতুর' প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফজালুল হককে গ্রেফতার করে। তিনি অবশ্য তিন-চার দিন প্রেসিডেন্সি জেলে হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তিলাভ করেছিলেন। পুলিশী হামলা সত্ত্বেও ধূমকেতু ২২শ সংখ্যা ১৭ নবেম্বর ১৯২২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল।
গ্রেফতার প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম জানান, 'কাজী নজরুল গ্রেফতারের পূর্বেই বিহারে সমসত্মিপুরে চলে যান, গিরিবালা দেবী তখন প্রমীলাকে নিয়ে সেখানে ভাইদের কাছে ছিলেন। কবি নজরুল সমসত্মিপুর থেকে তাদের নিয়ে কুমিল্লায় যান।' পরে, কুমিল্লার 'ঝাউতলা মোড়' থেকে ১৯২২ সালের ২৩ নবেম্বর পুলিশ কবিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক রাত রেখে পরদিন কলকাতায় নিয়ে যায় পুলিশ। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে কবিকে রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। কবির পক্ষ সমর্থনে বেশ ক'জন আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন তখন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মলিন মুখোপাধ্যায়। মামলার অপর আসামী এবং জামিনে মুক্ত কবির বন্ধু ধূমকেতুর প্রকাশক আফজালুল হক কবির বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে সাক্ষি দেন। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মতান্তরে ১৭ জানুয়ারি বিচারক সুইনহো মামলার রায় দেন। ভারতীয় ফৌজদারী দন্ডবিধির ১২৪-ক এবং ১৫৩-ক ধারা অনুযায়ী 'ধূমকেতু' রাজদ্রোহ মামলায় কবিকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
সে সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আদালতে যে জবানবন্দী প্রদান করেছিলেন সেটাও তাঁর এক অনন্য সৃষ্টি বলেই গবেষকরা মনে করেন। সেই জবানবন্দী ১৯২৩ সালে ধূমকেতুতেই ছাপা হয়েছিল। জবানবন্দীটি 'রাজবন্দির জবানবন্দী' নামে খ্যাত। এটি কবি প্রেসিডেন্সি জেলেই লিখেছিলেন।
বিচারপতি সুইনহো যে একজন কবি ছিলেন সেটি কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন। তাই জবানবন্দিতে কবি কাজী নজরুল লিখেছিলেন, 'শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট। কিন্তু বেলা শেষের শেষ খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্তঊষার নবশঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা করছে; তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন; তাই আমাদের উভয়ের অসত্ম-তারা আর উদয় তারার মিলন হবে কিনা বলতে পারি না। ...আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো একি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়ত সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী? এ ক্রন্দন কি একা আমার? না-এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল-নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের ঐ প্রলয়-হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার। আমায় ভয় দেখিয়ে মেরে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না। হঠাৎ কখন আমার কণ্ঠের এই হারাবাণীই তাদের আরেকজনের কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে।
আজ ভারত পরাধীন না হয়ে যদি ইংল্যান্ড ভারতের অধীন হতো এবং নিরস্ত্রীকৃত উৎপীড়িত ইংল্যান্ড অধিবাসীবৃন্দ স্বীয় জন্মভূমি উদ্ধার করবার জন্য বর্তমান ভারতবাসীর মতো অধীর হয়ে উঠত, আর ঠিক সেই সময় আমি হতুম এমনি বিচারক এবং আমার মতই রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত হয়ে এই বিচারক আমার সম্মুখে বিচারার্থ নীত হতেন, তাহলে সে সময় এই বিচারক আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলতেন, আমিও তাই এবং তেমনি করেই বলছি।'
কাজী নজরুল ইসলামের এই জবানবন্দীতে যে জ্বালাময়ী প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ছিল কবিতাটির মাঝে। আর কবি তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে তীব্র প্রতিবাদের জোয়ার তুলেছিলেন, তাই তাঁকে জেলে পুরে দমাতে চেয়েছিল ইংরেজ সরকার। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে কবিকে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি ১৯২৩ তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
কেন 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতাটির ওপর ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের কথা বলেছিলেন কবি তাতে এই কবিতা সংবলিত ধূমকেতু বাজেয়াপ্ত না করে উপায় ছিল না শাসকদের। এর কারণ কবিতাটির মর্মার্থ সকালীন অসহযোগ উত্তর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের জয়গান এবং সমালোচনা। কবিতাটিতে এ আন্দোলনকে সক্রিয় করার জন্যদেশবাসীর প্রতি যেমন ছির তেমনই চিল ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যারা জীবন দিয়েছেন সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসীম, টিপু সুলতান, ঝাঁসির রানী, রানী ভবানীর প্রসঙ্গ।
এ ছাড়াও কবিতায় সমকালীন রাজনৈতিক নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য ক্ষোভ, গান্ধী, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন, সুরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বারীণ ঘোষ প্রমুখের নিষ্ক্রিয়তায় ব্যঙ্গ এবং ধর্মের নামে ভণ্ডামী ও অহিংসার নামে কাপুরুষতার প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছিল। কারাদণ্ডের পর কবিকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কবি ছিলেন প্রায় তিন মাস, ১৭ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল ১৯২৩।
এ প্রসঙ্গে মানিক মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত 'চির উন্নত শির' গ্রন্থে লিখেছেন, 'নৈহাটি স্টেশনে গাড়ি এলে তাঁকে সাধারণ পোশাক পরানো হল-ডোরাকাটা প্যান্ট শার্ট। কোমরে বাঁধা হল দড়ি। নজরুলের মনে কোনো কষ্ট ছিল না। ছিল না কোনো বেদনার ছাপ। জেলের কয়েদিরা বিদ্রোহী কবিকে পেয়ে খুশি।'
জেলের মধ্যে কবি তাঁর গান ও আবৃত্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের মনে আনন্দ ও আশার সঞ্চার করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে জেলের কয়েদীদের সাথে কবির হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আর সাথে সাথে কয়েদিদের ওপর নির্যাতনও বাড়তে থাকে। কবির হাতে লোহার হাতকড়া, পায়ে বেড়ি পরিয়ে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়া হল। তিনি লোহার গারদের সঙ্গে ঘা দিয়ে বাজিয়ে বাজিয়ে গাইতে লাগলেন শিকল পরার গান। 'শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল' কিংবা আবৃত্তি করতে থাকলেন 'সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়' ইত্যাদি। ফলে জেলের অবস্থা ক্রমে ঘোলাটে হয়ে উঠে এবং যত রকম শাস্তি দেয়া যায় তার সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কয়েদীদের ওপর অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অন্য কয়েদীরা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এর কারণ ছিল ব্রিটিশ জেল সুপারের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
হুগলি জেল সুপার মি. আর্সটেন কয়েদিদের নিপীড়নের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতেন যেন তারা সরকারের প্রতি অবনত হয়। কিন্তু যখন কয়েদিগণ নজরুলের নেতৃত্বে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, আর্সটেন তখন তাদের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করেন। তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কবির নজরুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করে এই মর্মে যে, কাজী নজরুল জেল কোড ভঙ্গ করেছেন।
যখন কাজী নজরুল ইসলামের অনশন ধর্মঘট ৩৮ দিনে উপনীত হয়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন। রবিঠাকুর একটা ছোট চিঠিতে তাকে অনুরোধ করেন, “অনশন ধর্মঘট পরিত্যাগ করো, আমাদের সাহিত্য তোমাকে দাবি করে।” কিন্তু টেলিগ্রামটি তার কাছে পৌঁছেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে কারা কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি কবিগুরুর কাছে ফেরত পাঠায়। ৩৮ দিনের অনশনের পর কেবলমাত্র কবির শাশুড়ি বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তাঁর হাতে লেবুজল পান করে কাজী নজরুল ইসলাম অনশন ভঙ্গ করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের জেলের সঙ্গী নরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবত্রী 'নজরুলের সঙ্গে কারাগারে' (১৯৭০) গ্রন্থে লিখেছেন, 'এই বন্দিশালার সীমাবদ্ধ ও শাসন সংযত পরিবেশেও কত সহজেই না কাজী গান লিখতেন, সুরারোপ করতেন, লিখতেন দীর্ঘ কবিতা। জেলের মধ্যেই 'বালেশ্বর বলিদান' দিবস পালন করা হয়। সেখানে কাজী 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' গানটি গেয়েছেন। এই গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। সভাপতির ভাষণ শেষ হল। কিন্তু সভা ভঙ্গ হল না। নজরুল নতুন করে সভা শুরু করে জাঁকিয়ে ধরলেন গান। স্বরচিত গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গান। নজরুল বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে।
তাঁর বন্দী জীবন সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, 'কারাগারে আমরা অনেকে যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায় যে, তিনি একজন জ্যান্ত মানুষ।'
সাহিত্য যে সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সেটাই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের জীবনবোধ। তাঁর চিন্তাধারা ছিল জীবনের সমস্ত অধিকার হারিয়ে জীবন ধারণ করার চেয়ে জীবন দিয়ে জীবন প্রতিষ্ঠা করাই মহত্তর। আর সে জন্যই তাঁকে জেল খাটতে হয়েছিল।
১৫ ডিসেম্বর ২০২১ কবি কাজী নজরুল ইসলামের কারা মুক্তির ৯৮তম বার্ষিকী। এই দিনে কবির প্রতি জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।
এইচআর/এমএস