ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ২৭

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

অনেকক্ষণ পর রিয়া মুখ খোলে, মামা, মাঝেমধ্যে মনে হয় আপনি একজন দুঃখবান মানুষ, ঠিক না?
আমি তো আমাকে দেখতে পাই না। কথাটা ঠিক কি ঠিক না অন্যরা বলতে পারবে। এই যেমন এখন তুমি বললে।
আপনার নিজস্ব উপলব্ধি কী? আপনার মনে কি অনেক দুঃখ আছে? বিয়ে করেননি কেন?
আচমকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রেজা। মুখ ঘুরিয়ে রিয়াকে দেখে তারপর বলল, দুঃখ আছে কি না জানি না। দুঃখ ছিল। বিয়ে করিনি কথাটা ঠিক না। বিয়ে করেছিলাম।
বিয়ে করেছিলেন!
হ্যাঁ। মুনা বলেনি তোমাকে?
না। আমরা জানি, আপনি বিয়ে করেননি।
বিয়ে করেছি বলাটা কতটুকু যৌক্তিক জানি না। করিনি বললেও ভুল হবে।
না, বুঝতে পারছি না আপনার কথা। কথার মারপ্যাঁচ বাদ দিয়ে সত্যটা বলুন।
কথার মারপ্যাঁচ না। জীবনের মারপ্যাঁচের কাছে আটকে গেছি আমি।
হেরে গেছেন?
হেরে গেছি কি না জানি না। তবে নিয়তির বলির পাঠা হয়েছি আমি।
ঘটনা কী? বলবেন?
শোনা কি খুব জরুরি?
জরুরি কি না জানি না। শুনতে ইচ্ছা করছে। বলুন, শুনব।

রেজা চোখ বোজে। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে পেছনের অসংখ্য ছবি:
রেজার বিয়ের কথা যখন ফাইনাল হচ্ছে সে-সময় বড় আপা একদিন মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। মেয়েটার নাম ‘কথা’। স্বল্পবাক মেয়েটির সঙ্গে কথা শেষ করে রেজা মনে মনে ঠিক করে বিয়ের পর ওকে ‘চুপকথা’ বলে ডাকবে। আবার বড় শ্বাস ছেড়ে ফেলে আসা, পিছু ধাওয়া ছায়া―অতীতের কথা রিয়াকে বলতে থাকে রেজা:
বাসরঘরে ঢুকে দেখি, ‘চুপকথা’ বসে আছে। চুপ করে আছে। অন্যরকম চোখে দেখছি তাকে। দেখে মনে হলো ওর নাম চুপকথা না হয়ে ‘রূপকথা’ হওয়া উচিত ছিল। রূপবতী মেয়েটা খাটে বসে নেই। বসে আছে সাজানো খাট থেকে একটু দূরে চৌকশ বেতের দোলানো চেয়ারে। দুলছে না। স্থির হয়ে আছে। নববধূর ঘোমটা নেই। নববধূর পরনের শাড়িটাও বিয়ের শাড়ি না। বিয়ের শাড়ি বদলে পরে আছে লাল প্রিন্টেড মাঝারি মানের শাড়ি।
প্রথম দেখাতে মনে চোট পেলাম।
ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড।
চুপকথার মনের মধ্যে সম্ভবত জমে আছে ঘূর্ণিকথা। ঘূর্ণির গতি বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে ঘূর্ণির কেন্দ্রে আছে প্রলয়ংকরী ডিপ্রেশন। বাসররাতে এমন দুর্বিনীত দাপুটে দেহভঙ্গি কেন? ওর নাম কি ‘ঘূর্ণিকথা’?
মনে মনে ভাবি জোকস করে মাঝে মাঝে ওকে আগুনকথা বলেও ডাকা যাবে। ওই মুহূর্তে ওর চোখ থেকে আগুন বেরোচ্ছিল।
বাসররাতে দৃষ্টিনন্দন এপিসোড তৈরি হওয়ার কথা। তা হচ্ছে না। চুপকথা চুপই আছে। বিয়ের আসরে দেখেছিলাম ওর গলায় জমজমাট চওড়া হার। চওড়া হারের নিচে লকেট লাগানো লম্বা আরেকটা হার। এই মুহূর্তে চওড়া হার নেই। মাথায় টিকলি ছিল। এখন নেই। কানে আছে সিম্পল নকশার দুল। হাতে ছিল আকর্ষণীয় ডিজাইনের হাতপদ্ম, চওড়া বাউটি আর বালা। না এগুলোও নেই। পরে আছে হালকা চুড়ি।
আমি চুপসে থাকি। মনে মনে ভাবি, ভালোই হলো। অন্যরকম ঢঙে বসে আছে চুপকথা। গয়নার চাপে ভারী দেখাচ্ছে না ওকে। বিয়ের ভারী শাড়ির বাড়তি ঝামেলা নাই। চুপকথা একদম অরিজিনাল, রূপকথার না হয়ে চুপকথা বাস্তবের বউ হয়ে বসে আছে।
নববধূর ঘোমটা তোলার রিহার্সাল দিয়ে রেখেছিলাম।
রিহার্সাল কাজে আসছে না। নতুন রিহার্সাল দেওয়া প্রয়োজন। কীভাবে কী শুরু করব তাও বুঝতে পারছি না।
ঘরে বসার আর কোনো চেয়ার নেই। ওর পাশে বসার ইচ্ছা হচ্ছে। বসলে সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে।
বিষয়টা কি খুব আনস্মার্ট হয়ে যাবে না? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম চুপকথার দিকে।
কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল চুপকথা।
ও কি কদমবুসি করবে আমাকে? চেয়ার ছেড়ে দিয়ে আমাকে বসতে দেবে?
সনাতন বাঙালি নারীর শাশ্বত কল্পিত দৃশ্য গেঁথে ছিল মনে।
না। ভাবনা, কল্পনা মিলছে না।
চুপকথা দুই কদম সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল।
আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। স্পষ্ট গলায় জড়তাহীন শুদ্ধ উচ্চারণে বলল সে।
কী কথা?
আমি জানি, আপনি সজ্জন। গুণী ব্যক্তি। ভদ্রলোক। চুপকথার মুখ থেকে কথার খই ফুটছে।
অবাক চোখে দেখছি ওর দিকে। কোনো শব্দ বের হলো না মুখ থেকে। ভাবার সময় পেলাম, মেয়েটার নাম বদলাতে হবে। ওর নাম দিতে হবে ‘খইকথা’।

খইকথা আচমকা চুপ হয়ে গেল। কিছু জরুরি কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তবে চুপকথার চুপচাপ বৈশিষ্ট্যের আলামত এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
আমি বললাম, মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাইছ, বলো।
চুপকথা বলল, বললে আপনি কষ্ট পাবেন।
বাসররাতে কষ্টের কথা না বললে চলে না?
না। চলে না। বলতে হবে।
বলতেই যদি হয়, বলো।
আপনি কষ্ট পাবেন। বাক্যটা আবারও রিপিট করে চুপকথা।
আমি পরিস্থিতি সহজ করে তুলে চুপকথার মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করি। ভরাট গলায় স্মার্টলি আবৃত্তি করি হুমায়ূন আহমেদের কবিতার কয়েকটা লাইন:
‘কষ্টের কথা কী বলিব
কষ্ট কাকে বলে
কষ্ট হচ্ছে মনের আগুন
বুকের মধ্যে জ্বলে।’
চুপকথা হাসল না। অধীর হয়ে বলল, আপনাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না। না-দিয়ে উপায় নেই। আপনিই এখন একমাত্র ভরসা। আপনিই পারেন আমার উপকার করতে, পারেন আমার শেকল খুলে দিতে।
আমার গলা এবার থমথমে হয়ে যায়। থমথমে স্বরে বলি, মনে হচ্ছে তুমি কষ্টে আছো। মনে হচ্ছে তোমার মনে আগুন জ্বলছে। তোমার কষ্ট আমি দূর করতে সাহায্য করব, তোমার মনের আগুন নেভাতে আমি পাশে থাকব। বলো, তোমার কথা স্পষ্ট করে বলো।
আশ্বাস পেয়ে চুপকথা সহজ হয়ে গেল। বাচ্চা মেয়ের মতো বলে বসল, আমাকে অরণ্যের কাছে নিয়ে চলেন। ওর কাছে দিয়ে আসুন।
আমার বুকে গেঁথে গেল বুলেট।
টের পেলাম না নিজে। টের পেল না চুপকথা। হঠাৎ অ্যাকসিডেন্টে দেহের কোনো অঙ্গচ্যুত হলে সঙ্গে সঙ্গে টের পাওয়া যায় না। জানতাম।
আমিও তখন টের পেলাম না যে হার্টচ্যুত হয়ে গেছে, টের পেলাম না মনের ভিত ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। ফাটল-ধরা বিরাট স্তম্ভের মতো চুপকথার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। স্থির ও অবিচল কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, অরণ্য? অরণ্য কে?
প্রথমবারের মতো চুপকথা আমার মুখের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, অরণ্য...। ওকে আমি ভালোবাসি। ষড়যন্ত্র করে এ বিয়ে দিয়েছে ভাবি। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। নারীর ঈর্ষার শিকার।

নির্ভেজাল শুদ্ধ অভিব্যক্তি আলো ছড়াচ্ছে চুপকথার মুখে। আমি দেখতে পেলাম সেই শুদ্ধ আলোর উদ্গিরণ আমার জন্য নয়, অরণ্যের জন্য।
আমার মন ওই আলোর রোশনিতে প্রভাবিত হয়ে গেল। বদলে গেল। শান্তগলায় বলি, অরণ্য কোথায় থাকে?
ওর বাসায় ফোন করুন। নম্বরটা হচ্ছে...
গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, আরও একটু ভেবে দেখবে? অরণ্যের কাছে কি তোমাকে যেতেই হবে। আমাদের জীবনে যা ঘটে গেছে কিছুতেই কি মেনে নিতে পারবে না?
ক্ষমা করবেন আমাকে। আমার মনে অন্য কারও জন্য নতুন কোনো জায়গা তৈরি হবে না।
আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না।
মনে মনে নম্বরটা মুখস্থ করে শোবার ঘরের বেডসাইড টেবিলের কাছে এসে ডায়াল ঘুরিয়ে লাইন কানেক্ট করলাম।
এক মেয়ে ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো, কে বলছেন, প্লিজ?
আমাকে চিনবেন না। এটা কি অরণ্যদের বাসা? একদম স্বাভাবিক গলায় কথা বললাম আমি।
জি। অরণ্যদের বাসা। আমি অরণ্যের বোন বলছি। ভাইয়াকে ডেকে দেবো?
প্লিজ। দিলে খুশি হব।
একটু হোল্ড করুন, প্লিজ। বলেই রিসিভার আলগা করে রাখে মেয়েটা।
একটু পর রিসিভার তোলার শব্দ হয়, অরণ্য বলছি। কে বলছেন?
আমার নাম রেজা। আপনি কথাকে চেনেন?
জি হ্যাঁ। কোথায় সে এখন? আচমকা অরণ্যের কণ্ঠে অস্থিরতা বেড়ে যায়।
কথার বিয়ে হয়েছে, জানেন?
জি জানি। বিট্রে করেছে সে। অরণ্যের কথায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
না। বিট্রে করেনি। ওর কথায় বুঝতে পেরেছি একটা ষড়যন্ত্র এবং ঈর্ষার শিকার হয়ে সে এখন আমার রেজিস্ট্রি করা কাগুজে বউ। আমরা বাসরঘরে যথেষ্ট দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কথা আপনার কাছে যেতে চাইছে। ওকে কি আপনি গ্রহণ করবেন?
জি?
জি জি করবেন না। ডিসিশন নিন। স্ট্রং ডিসিশন নিন। আমি ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসব। রাজি? আনব?
হ্যাঁ। নিয়ে আসুন।
এবার দৃঢ়প্রত্যয়ী স্বর শুনতে পেলাম আমি।
আপনি প্রস্তুতি নিয়ে থাকুন। ওকে আপনার হাতে তুলে দেবো। কাজি অফিসে আসুন সকাল ন’টায়। ন’টার আগে অফিস খুলবে না। এখন অনেক রাত। এ সময় যাওয়া উচিত হবে না। আশ্বাস দিচ্ছি, আপনার ‘কথা’ আপনার জন্যই থাকবে। এ রাতে ওর কোনো অমর্যাদা বা ক্ষতি হবে না। ওর সঙ্গে কথা বলুন।
চুপকথা এসে রিসিভার ধরে। চুপকথা কোনো কথা বলতে পারেনি। কেবল কাঁদতে থাকে। কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে যায়। চেয়ারে বসে নির্ঘুম পার করি দুঃস্বপ্নের বাসররাত।

চুপকথার সেই কান্না আমার বুকের কান্না থামিয়ে দেয়। কখনো আর কাঁদিনি আমি। পুরো দৃশ্যটা রেজা বর্ণনা করল রিয়াকে। কথা শেষ করে একদম শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। সড়কদ্বীপের চারপাশের সারিবদ্ধ গাছগাছালির সবুজ পাতার মধ্যে থেকে একসময় ফিরে এলো সে। বাঁয়ে তাকাল। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল বাঙালি, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল দক্ষ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। অস্ত্র হাতে দীপ্ত মানুষের বিমূর্ত প্রতিকৃতিতে ফুটে আছে অসীম তেজ ও সাহসের বীরগাথা।
রিয়া কোনো কথা বলতে পারছে না।
একবার ও চোখ তুলে তাকাল রেজা মামার দিকে।
নরম গলায় জানতে চাইল, তারপর কী হলো মামা? অরণ্য কি চুপকথাকে বিয়ে করেছিল?
হ্যাঁ। ও বিয়ে করেছে। আমি স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছি অরণ্যের হাতে। ওদের বিয়ের ইস্যু নিয়ে ধর্মীয় কিছু নিয়ম-নীতি পালন করতে হয়েছিল।
বলতে গিয়ে রেজার বুক ফেটে যায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা।

ছাব্বিশ.
রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিজের আনন্দসংবাদ শুনে এসেছিল মামার সঙ্গে সময় কাটাতে। নিজের আনন্দের বিনিময়ে মামার কষ্টের জগতে ঢিল ছুড়ে দিয়েছে। নিজেকে অপরাধী লাগছে!
মামা কাঁদছে। কাঁদতে দেয় রিয়া। কাঁদলে কষ্ট লাঘব হয়, জানে ও। রিয়ার চোখও ভিজে ওঠে।
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। রিয়া এবার নীরবতা ভাঙে।
মামা, একটু উঠে দাঁড়াবেন?
কেন?
দাঁড়ান প্লিজ।
রেজা উঠে দাঁড়ায়।
রিয়া টুপ করে বসে পড়ে মামার পায়ের কাছে। কদমবুসি করে। মহান মানুষটার সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে।
রেজা কী করবে বুঝতে পারল না। তাকে বিমূঢ়তা পেয়ে বসেছে। বিহ্বল অবস্থা কাটানোর আগে উঠে দাঁড়াল রিয়া।
এ মুহূর্তে রিয়ার মন তৃপ্ত। শান্ত।
তৃপ্তি নিয়ে ও তাকাল রেজা মামার দিকে। অসামান্য মানুষটা তার জন্য এতকিছু করেছে, বিনিময়ে সে কী করবে!
কান্নাজড়িত স্বরে রিয়া বলল, মামা আপনার জন্য একটা কিছু করতে চাই।
কী করতে চাও? শান্ত-সৌম্য মামার পালটা প্রশ্ন।
কী করব জানি না। তবে একটা কিছু করব।
কেন আমার জন্য একটা কিছু করার ইচ্ছা হলো কেন?
ইচ্ছা হয়েছে। ব্যস। আমার জীবন নিরাপদ করেছেন আপনি।
ওহ! তাহলে স্বার্থ হাসিলের গোপন বাসনা নিয়ে কি কিছু করেছি আমি? আমাকে কি স্বার্থপর ভাবছ?
না, না। স্বার্থপর ভাবব কেন?
তাহলে বিনিময় দিতে চাও কেন? তাছাড়া তোমার জন্য তো আমি কিছু করিনি। সন্ত্রাসী গ্রুপের কেউ একজন তোমার প্রতি অনুরক্ত ছিল। অনুরক্ত সেই ছেলেটাই তোমার বিপদের সূত্র নষ্ট করে দিয়েছে। একটা কিছু করলে তার জন্য করো।
মামার যুক্তিটা ফেলে দিতে পারল না। মনে মনে সেই যুবকটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল মন। টের পেল না রিয়া।

এমন সময় এক ফেরিওয়ালা পাশে এসে বলল, চা, সিগারেট।
চলবে, মামা?
চা চলতে পারে। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।
রিয়া প্রসন্ন চোখে মামার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। ছেড়ে দিয়েছি। বললাম তো।
কখন থেকে ছেড়েছেন?
কৌতুকে নড়ে ওঠে রেজার চোখ। কৌতুকের ছলে বলল, চারুকলার বকুলতলা থেকে নবান্নের উৎসবের দিনে এক মায়াবতী আমার জন্য একটা অ্যাশট্রে পাঠিয়েছিল। ওটা ছিল অসাধারণ মূল্যবান গিফ্ট। অ্যাশট্রের ভেতরে ছিল একটা স্লিপ। স্লিপে লেখা ছিল, থ্যাঙ্কস ফর নো স্মোকিং। সিগারেট ছাড়ার ব্যবস্থাপত্র। আমি ছাড়তে পেরেছি। ব্যবস্থাপত্রটা সাকসেস। সেই মায়াবতী এখন সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
উফ্! মামা! ইউ আর রিয়েলি গ্রেট! রিয়া নিজের সফলতায় খুশি হয়। অচেনা-অজানা খুশি রিয়ার ভেতরটা বাইরে নিয়ে এলো।
রেজা বলল, আমার জন্য একটা কিছু করার ইচ্ছা তৈরি হয়েছে তোমার মনে, না? তুমি তো সেই অসামান্য কাজটা ইতোমধ্যে শেষ করে ফেলেছ, বুঝেছ?
রিয়া এবার প্রতিবাদ করে বলল, না মামা। বিনিময়ের জন্য কিছু করতে চাইনি। যা করছি নিজের তাগিদেই করেছি। নিজের তাগিদেই ব্যবস্থাপত্রটা পাঠিয়ে ছিলাম।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার এখনকার কথাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের জন্য করবে, বিনিময়ে কিছু আশা করে থাকবে না। কিছু করার পর যে আনন্দ সেটা সহজে পায় না মানুষ। পেলে ভালো হতো। তুমি পেয়েছ। এটা তোমার নিজস্ব আনন্দ। এ আনন্দকে সম্মান জানাব আমি। আর একজনও পেয়েছিল হয়তো এমন আনন্দ।
বেশি কঠিন কথা হয়ে গেল না, মামা? মাথায় তো ঢুকছে না সব অর্থ। সহজ করে বলুন, আর একজনটা আবার এলো কেন?
তাহলে আসল কথাটা বলি, শুনবে?
বলুন, শুনতে চাই তো।
একদিন চুপকথার একটা টেলিফোন পেয়েছিলাম।
কী বলেছিল সে? আবার চুপকথা প্রসঙ্গ আসায় কৌতূহলী হয়ে উঠল রিয়া।
চুপকথার শেষ ডায়ালগটা ছিল, ‘আমার একটা ছেলে হয়েছে। ছেলেটার নাম রেখেছি তারেক। ওর জন্য দোয়া করবেন।’
কিছুটা থেমে এবার রিয়ার দিকে তাকিয়ে রেজা বলল, জানো তো আমার পুরো নাম তারেক মেহমুদ রেজা।
রিয়াও তাকাল রেজা মামার মুখের দিকে। গম্ভীর হয়ে গেল ও। চুপকথার জন্য ওর মনে শ্রদ্ধা জাগার কথা। জাগছে না। রাগ জাগছে। রাগে চুপ হয়ে গেছে। চুপকথার কৃতজ্ঞতা পছন্দ হয়নি ওর। চুপকথা কৃতজ্ঞ নারী। চুপকথা মায়াবী নারী। চুপকথার ভালোবাসাও দোর্দণ্ড শক্তিশালী। এমন নারী কেন ছেড়ে গেল রেজা মামাকে? এমন নারীই তো ফিট ছিল রেজা মামার জন্য। মহান নারী মহানুভবতার শেষ অস্ত্র দিয়ে বেঁধে রেখে গেছে রেজা মামাকে! এ কারণেই কি মামা বিয়ে না-করার সিদ্ধান্তে অটল?
মনে মনে ভাবল, উনার অটল সিদ্ধান্ত ভাঙতে হবে। উনাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতেই হবে।
রেজা বলল, চলো রিয়া। সামনে তোমাদের পরীক্ষা। এত সময় বাইরে থাকা ঠিক না।
রিয়া কিছু না বলে উঠে সামনে হাঁটতে শুরু করে।
ও জানতে চায়, গাড়ি ছাড়া এসেছেন কেন? চলুন, আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।
রেজা বলল, গাড়ি এনেছি। গাড়ি আছে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছে। গাড়ি ছাড়া একাকী হাঁটতে ভালো লাগে।
একাকী হাঁটার কী মজা, মামা?
একা হাঁটলে ইচ্ছামতো সময় কাটানো যায়। ইচ্ছামতো দেখা যায় সব।
দোকা থাকলে দেখা যায় না?
যায়। যাবে না কেন? এতক্ষণ আমরা দোকা ছিলাম। অনেক দিন পর সময়টা ভালো এনজয় করলাম। বহু বছর পর ফুচকা খেলাম। এখানে এসে বসার সুযোগ পেলাম। দোকাতেও মজা আছে। তবে দোকাতে নিজের ইচ্ছায় চলা যায় না। অন্যের ইচ্ছায় চলতে হয়।
অন্যের ইচ্ছায় চললে নিজেকে কি পরাধীন মনে হয়? অসুবিধে কোথায়? অন্যের ইচ্ছায় যদি এনজয় করা যায়, সেই আনন্দ তো আলাদা রকম সুখ দিতে পারে। সমর্পণের অর্থ এই না যে পরাজিত হওয়া, হেরে যাওয়া।

চলবে...

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন