ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

২০ কবির কবিতায় জীবনের আলোকপাত

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৪:৫৩ পিএম, ০৫ নভেম্বর ২০২১

কবিতা তো জীবনের কথাই বলে। আর সে জীবন মানুষের। প্রকৃতি কিংবা যাবতীয় অনুষঙ্গ—কিছুই মানুষের বাইরে নয়। তাই তো বাংলাদেশের ২০ কবির ১০০ কবিতায় মানুষের জয়গান লক্ষ্য করা যায়। কবিরা তাতে করেছেন জীবনের আলোকপাত। বর্তমানের প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়ে নির্বাচিত এ বিশজন কবি সমকালেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। কালের অবস্থান বা স্থানগত ভিন্নতায় নয়; উপস্থাপনের চমৎকারিত্বে তারা সার্থকতার সোপানে পৌঁছে গেছেন। তবে এখানে যাদের কথা বলা হচ্ছে, তারা একটি গবেষণা বা সংকলনগ্রন্থের তালিকাভুক্ত। এর বাইরেও অনেকে আছেন।

সমকালীন কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার কবিতার উপমা, শব্দচয়ন, ভাববস্তু নিমিষেই আকৃষ্ট করে পাঠককে। তার কবিতার দূরত্ব যেন নিয়ে যায় অন্য কোনো উচ্চতায়। দুঃখ হয়ে ওঠে রহস্যের নাম। মঞ্জু বা মঞ্জুমালা দূরত্বের নামে ভুল ভ্রমণে আগ্রহী হয়। তার কবিতার চরণে পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। শব্দের পরে শব্দের মোহনীয় সুর ও জাদু আচ্ছন্ন করে পাঠককে। স্বপ্নময়তার অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে সে স্বপ্ন জেগে দেখা; ঘুমিয়ে থেকে নয়। সাম্প্রতিক বিবর্তন ফুটে ওঠে নিগূঢ় চেতনায়। কবি যখন বলেন,
‘মাঠের ওপাশেই
বিবাহসভার বয়ান ওড়ে
তার মধ্যে মিসড হচ্ছে কল
জিগোলো কি বাণিজ্য-সফল?’
সুতরাং বলা যায়, কবিতাকে শুধু আক্ষরিক বয়ান হিসেবেই তিনি উপস্থাপন করেননি। যেন মন ভালো করার জন্য মধ্যরাত উপহার দিয়েছেন আমাদের।

অসীম সাহা বাংলাদেশের অন্যতম কবি। তার কবিতায় অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক জীবনের ভিড়ে প্রকৃতি যেন হাতছানি দেয়। যাবতীয় অনিশ্চয়তার মাঝেও প্রেম এসে ধরা দেয় আপন মহিমায়। তার কবিতায় ইতিহাস-বিজ্ঞান পাশাপাশি দাঁড়ায়। প্রকৃতির কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয়। পুঁজিবাদ বা বাণিজ্যিকীকরণের কাছে আর্তনাদ করে মাধবীলতারা। যেন পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সে সুরে যাবতীয় অর্জন তুচ্ছ হয়ে ওঠে। প্রতীকী পাগলা বাতাস মুহূর্তে এলোমেলো করে দেয় সব। রাধিকাদের আর্তনাদে থমকে যায় তালগাছও। কবি বলে ওঠেন,
‘রাধিকার আর্তনাদে থমকে যায় তালগাছ;
আর বিপন্ন বাহুডোরে ভাষা পায় গভীর ইঙ্গিতবাহী
নির্বাক রাত্রির এক মূর্ত প্রতিকৃতি।’
তবুও তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার শেষ প্যারা লেখা হবে বিকেলের লাল কালি দিয়ে’। কবিতার এ নিজস্বতাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।

বাঙালি জাতিসত্ত্বার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সুখের সঙ্গে তার যত খুনসুঁটি। তবুও সুখের সঙ্গেই তার বেশ সন্ধি। তিনি চৌকাঠের বাইরে থেকে সুখকে ভেতরে বন্দি করে রাখেন। তবে তার এ সুখ আদৌ কি সুখ; নাকি অন্য কিছু। তা হয়তো কবিই ভালো বলতে পারবেন। এছাড়া তিনি ঈশ্বরের একটি চোখ আবিষ্কার করেছেন। নানা রঙের সেই চোখ। সে চোখে আনন্দ-বেদনা-ক্ষোভ ঝরে পড়ে। তিনি ঈশ্বরকে বলেন,
‘ঈশ্বর, আপনি একবার কাঁদুন।
আপনার নীলচোখে অশ্রুর আষাঢ়-প্লাবন
ভাসিয়ে নিক আপনার ভস্ম-সৃষ্টি।’
কবির ঈশ্বর সব ক্ষমতাধর মানুষের প্রতিনিধি। তিনি সবার কাছে শান্তি অন্বেষণ করেন। তার স্বতঃসিদ্ধ হাসি কিংবা অশ্রুগুলোই আনন্দ-বেদনার কাব্য। তার অন্তমিলযুক্ত কবিতাগুলো পাঠকের মনে এক সাংগীতিক দোলা দিয়ে যায়। ভাব-ভাষা-ছন্দে রসসুধা পান করায়। কেউ জানুক বা না জানুক, এভাবেই তিনি রচনা করবেন আমাদের জলস্থল। এমনকি তালাবদ্ধ দেহের ভেতর হাহাকারের ঘর বাঁধবেন।

আবিদ আনোয়ার পেশা এবং নেশায় বিপরীতমুখি মানুষ। একদিকে বিজ্ঞানী, অন্যদিকে কবি। তবুও বিজ্ঞান এবং কবিতাকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। কবিতায় তিনি রাজপথের মিছিল, লড়াকু মানুষ, শহিদ মিনার, সংগ্রামী নারীর কথা বলেন। প্রসঙ্গক্রমে আসে মধ্যযুগ, বৈষ্ণব, পুরাকীর্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজা-বাদশাহ ও প্রেমিকার মুখ। কবি বলে ওঠেন,
‘তুমি চলে গেলে ঘরজুড়ে হাঁটে তোমার প্রতিমা,
সারা বাড়ি হয় পরাবাস্তব কোনারক ও খাজুরাহো:
সাজের টেবিলে-বিছানা-বালিশে,
ফাঁকা করিডোরে-বিরান হেঁসেলে
থেকে থেকে জলে ‘তুমি নেই’ এই সত্যের দাবদাহ।’
কেননা রমণীই যেন তার আরাধ্য। যে কারণে নানারূপ ফাদ, জীবনের স্বাদ তিনি অন্বেষণ করেন নারীর মধ্যে। দিনশেষে সব মানুষের যন্ত্রণা যেন একই। হোক সে রাজা কিংবা ফকির। রাজকীয় আবহে বোনা তার কবিতায় পাঠ করা যায় পরাজয়ের ইতিহাস বা নির্বাসনের দলিল।

সমকালীন কবিদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন বিমল গুহ। তার কবিতায় স্বাজত্যবোধ, স্বাধীনতার স্মৃতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, ১৫ আগস্টের কালো অধ্যায়, মানুষের বিবেক, প্রকৃতি ও ধরন উঠে এসেছে নিগূঢ় বাস্তবতায়। তার কবিতায় একদিকে যেমন গৌরবমাখা; অপরদিকে বিষাদের কালো ছায়া ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই আবার অন্ধকার ভেদ-করা অন্য এক আলোর সকাল দেখা দেয়। যে কারণে তিনি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও এক দুর্ভাগা জাতি দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণগলির মোড়ে এসে। কবি বলেন,
‘আজ ১৫ আগস্ট—আজ শোকাবহ দিন
আজ বত্রিশ নম্বর
টাঙিয়েছে কালো ব্যাচ হয়ে আকাশে আকাশে।’
তাই কবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায়, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক আমাদের সকল কালিমা। আর যেন নিভৃতে মৃত্যুর স্তব না করে একদল পাপাচারী লোক। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘চারদিকে দেখি সব পশুর খোঁয়াড়!’

বাবুল আশরাফ পেশায় শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষিত জাতি গড়ার পাশাপাশি কবিতায় তিনি পরিচ্ছন্ন মানুষ গড়ার দায়িত্ব পালন করেন। তার কবিতায় ভাষা আন্দোলন, শোকার্ত জননী, স্বজনের কান্না উঠে এসেছে। তার প্রতিটি কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বন্দি-অন্ধ মানুষের কথা বলেছেন। তার ‘কালো আলখেল্লা’য় দুঃখগাঁথা জমা হয়ে আছে। কবি বলে ওঠেন,
‘আলখেল্লার আস্তিন থেকে কইতর
দু’মুখো বীণবাঁশি থেকে সাপের মাথা,
হায় কালোজামা! বলো কি সেই মন্তর
হাতে তালি দিয়ে গাওয়ায় দুঃখগাঁথা।’
তার আলখেল্লা ঘেরা জনপদ যেন সন্ত্রস্ত আজ। তাই তো তিনি নিরাপদ নদী খোঁজেন। অথচ কোথাও কুমারী নদী নেই বাংলাদেশে। এখানেই তার যত আক্ষেপ। তবুও ‘যাদুকর ভেল্কিবাজির মঞ্চ সাজায়’। মানুষের জন্য দুঃখ জমা হয় কবিতার চরণে চরণে। তার কাছে সত্য শুধুই উত্তরাধুনিক দাসত্ব।

সংগীতশিল্পী অঞ্জনা সাহার কবিতা যেন সময়ের বিচিত্র আখ্যান। তিনি প্রত্যুষের প্রথম প্রহরে দিনলিপি লিখে চলেছেন অদৃশ্য খাতার পাতায়। তার কবিতায় রামায়ণ ও মহাভারতের উপলক্ষ্য এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। কবিতায় মধ্যযুগীয় উপাদান তুলে এনেছেন আপন মহিমায়। মানুষের জয়গানে একাত্ম হয়েছে বিজ্ঞানও। তার আনন্দের উৎসমূলে মেঘমল্লার। কবি তাই বলেন,
‘আমার তথৈবচ দিন কী আনন্দের!
তার উৎসমূল ছুঁয়ে এই ভরা শ্রাবণে মেঘমল্লারের
অপূর্ব সুরে সুরে চতুর্দিক আন্দোলিত করে ছুটে যাচ্ছে
দিগ্বিদিক নাচের ভঙ্গিমায় উন্মত্ত মেঘদূত!’
তিনি কবিতার চরণে চরণে অভিমান, আদর, সংশয়, সঙ্কট, জিজ্ঞাসা খুঁজে বেড়ান। মহাজটিল এক আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে কৃষ্ণগহ্বরের অতলে ডুবতে ডুবতে পাতালে প্রবিষ্ট হয়ে যান। তিনি একা একাই ছুটে যান দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। তবুও সম্ভাব্য ঢেউগুলো আর্তনাদ করে ছুটে আসে।

যাপিত জীবনের নানা বিপত্তি তুলে ধরেছেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু। এখানে সময়ের রূঢ়তা, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা—সবই যেন অর্থহীন হয়ে ওঠে। যেখানে শেষ পর্যন্ত জীবনের অর্থই পাল্টে যায়। তবুও প্রবল সংগ্রামী জীবন মানুষের। যাবতীয় প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময় পেরিয়ে তারা সন্তুষ্টি খোঁজে। যে জীবনের গলি থেকে পালাবার কোনো পথ নেই। পৃথিবী নামক যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ কেন আসে? এতসব আবর্জনা দেখেও তারা আসে। কবির কাছে তাই ধরা দেয়,
‘এখন শুধু মনের যাতনা!
এখন শুধু দুঃখবোধ!
এখন শুধু অনুশোচনা!
গলিতে কেন? গলিতে কেন?
পথ ছিল না! পথ ছিল না!’
কবি তারপরও মানুষ খোঁজেন। কিন্তু মানুষ খুঁজে পান না। তিনি মানুষের মত হাঁটাচলা করে হাটে গিয়ে জমির তরকারি ও মাছ বিক্রি করে বাঁচতে চান! অথচ বারবারই হয়ে ওঠেন আত্মাহীন পাথর। তাই বলা যায়, তার কবিতাগুলোতে কেবল মানুষ দেখি। নানা রঙের মানুষ। নানা ঢঙের মানুষ। মানুষ আর মানুষ।

পেশায় চিকিৎসক হারিসুল হকের কবিতা স্বপ্ন-স্মৃতি নিয়ে ডানা মেলে ষাটের কোটায়। কখনো কবিতায় আজীবন তৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাই পাঠকের প্রতি তার আহ্বান উচ্চারিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতোই তিনি কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করেন। রুগ্ন-রুক্ষ্ম মননকে জাগ্রত করার মহৌষধ আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পায় গাছ, ঘাস, পাতা, নদী, তারা, বাতাস। অথচ কবিকেই মনে হয় প্রাণহীন। মাস শেষে বেতন, কেতাবী শাসনে কবি যেন স্বস্তির ভিখিরী। তাই আক্ষেপ করে বলেন,
‘তোর কি জীবন আছে এক ছুটে এখুনি পালাবি?
কী তোর ক্ষমতা আছে যাবি ছিঁড়ে কব্জির চতুর বাঁধন?
কতখানি দাবী তোর নিজের উপর আজতক বলবৎ আছে?’
তাই তো মানব জীবনকে পুতুলের জীবন মনে হয়। ফলে কবি অসীম নির্জনে কালের পঞ্জিকা ঘাঁটেন আনমনে। তিনি দেখতে চান, শুনতে চান। কিন্তু সাড়া মেলে না। কবির আঙুলে তাই নিষেধের তারকাটা।

কবি আবু হেনা আবদুল আউয়াল একটি কবিতা লেখার জন্য সারারাত টেবিলে বসে থাকেন। অথচ কবিতাটি অসমাপ্ত রেখে সকালে ঘুমিয়ে পড়েন। কখনো কখনো অবস্থা বেগতিক দেখে ছুটে যান দিগ্বিদিক। কিন্তু তিনি জানেন, কোথাও গন্তব্য নেই। তার বক্তব্যে আফ্রিকার জঙ্গলের দৃশ্য ভেসে ওঠে। প্রতীকী অর্থে এমন দৃশ্য শুধু আফ্রিকার নয়; পুরো পৃথিবীরই। এমনই নানাবিধ সংকটের অবতারণা করেছেন তার কবিতায়। তার ঘুমহীন এক চোখে অন্ধকার; অন্য চোখে আলো। কবির মনে হয়, ‘সূর্য কিছু দূর উঠে আটকে আছে ঘড়ির কাঁটায়’। আবার পরক্ষণেই এ তল্লাটের সবাই ঘুমায়। যে যেভাবে পারে ঘুমায়। ঘুমহীন আর ঘুমকাতুরে মানুষগুলো দেখা যায়। অথচ কবি দেখেন জীবনের অবচেতন স্বপ্নগুলো। আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টি এলে কবির কী এক বিরহে মন যক্ষ-উদাস হয়ে ওঠে।

বহুবিধ মেধার স্বাক্ষর রাখা তপন বাগচীর কবিতায় প্রকৃতি যেন মিলেমিশে একাকার। উঠে আসে চিরায়ত গ্রামীণ জীবন। শরতের কাশবন আর হেমন্তের অপরূপ সৌন্দর্য পাঠকমনে শৈশবের স্মৃতি জাগ্রত করে দেয়। উঠে আসে বাউলের একতারা-দোতারা। মোহময়ী গানের সুর। কখনো কখনো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের জন্য বাড়ে মনস্তাপ। কবি বলেন,
‘বলো তো জীবনবাবু, কী করে তোমার কাছে যাবো?
এই তো এসেছি আমি একা—
বনলতা ভেবে সুখে কত আর বিরহে পস্তাবো!’
অন্যত্র বলেন,
‘ট্রামের তলায় আমি শরীর এলিয়ে দিই আজ
কে পারে খুলতে বলো হেমন্তের মগ্নতার ভাঁজ!!’
কবিজন্মের হতাশাকে পুঁজি করেই তিনি ফিরে যান মা-মাটির পৃথিবীতে। যেখানে মানুষের উদাস দৃষ্টি আর অপার আতিথেয়তা। শেকড়ের সন্ধানে তিনি কবিতায় আঞ্চলিক সুর তোলেন। যা পাঠককে আবিষ্ট করে। অন্ত্যজ শ্রেণির মুখের ভাষাই তার কবিতায় প্রথিত হয় পরম মমতায়। এখানেই কবির সার্থকতা।

কবি পল্লব সেনগুপ্ত আবির্ভাবের পরিবর্তে দেখেন ঝড়। তার দেখা বারান্দায় স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে দুঃসময়। এ জনপদ তার বড়ই অচেনা। এটাই যেন কবির চিরচেনা বাংলাদেশ। কবিতায় স্বদেশ নিয়ে তার উদ্বেগ ফুটে ওঠে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি পরিবেশ সচেতনও। পরিবেশ সচেতনতা ধরা দেয় কবিতার চরণে। কবিতার উপমার আড়ালে কঠিন সত্য এবং গভীর উপলব্ধি দেখতে পাই। এভাবেই বলে ওঠেন,
‘নদী ও পুকুর যদি সাধারণ মেয়ে হতো কতবার যে পোয়াতি হতো তারা,
ভালবাসতে গিয়ে ফেলে আসা দুঃসময় বেড়ে ওঠে তার কোলে
যে যেখানে পারে নির্দ্বিধায় ফেলে রেখে আসে প্রসব বেদনা,
জলে জঙ্গলে পাহাড়ে সমতল কি তলপেট ভেদ নেই।’
কবি সাহসিকতার সঙ্গে স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হয়েছেন। তিনি তার ইচ্ছেটাকেই সঙ্গে নেবেন। তবুও একটি তৃষ্ণা তার সারা গায়ে লেপ্টে আছে। তাই পালাতে গিয়েও ধরা পড়ে যান প্রেমিকার চোখে। কী এক গভীরতা খেলা করে যাবতীয় উপমার আড়ালে।

কবি মতিন রায়হানের সব্যসাচী হাত জীবনের পরিধি বাড়ায়। সেই হাতের আকাক্সক্ষা কম নয়। উপমার শাখায় ভর করে ছুটে যায় মধ্যযুগে। প্রেম-প্রার্থনার কাছে ঝড় তোলে হাতের কারুকাজ। জগতে যা কিছু আছে; সবই এই হাতের কারুকাজ। কবিতায় তুলে আনেন নগর জীবন। ছন্দ-উপমায় সুরধ্বনি তোলে সাধুসন্ত জীবনে। কখনো হংসবলাকা, ডলফিন নেচে ওঠে ডুবসাঁতারে। কবি তাই বলেন,
‘অনন্ত পারাবারে তুমি এক উদ্ধারকারী মায়াময়ী ডলফিন
নদীর গল্পগুলো জমা থাক খুনশুটি কিংবা ডুবসাঁতারে
ন্যায্যতা বুঝি না, তোমার পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াই জলে ও পাহাড়ে!’
তাই কবির পর্যটক মন কখনো কখনো কুয়াশামাখা পদ্য রচনা করে। কবি ত্রস্ত হাতে খুঁজে চলেন ঢেউরাশি, ভাটার স্রোতসমগ্র ও শিউলিবন। কৃষ্ণচূড়া যেন দু’চোখ রাঙায়। আবার বরফগলা নদীর কান্না শুনতে পান। কবির নগরজুড়ে কেমন আগুন জ্বলে। এই বহতা মনের কথা কবি ছাড়া আর কেউ বোঝে না।

বীরেন মুখার্জীর কবিতায় জীবনের নানাবিধ অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। কবি ছুটে চলেন জীবনের খোঁজে। এভাবেই উপল ভূমির দিকে যেতে যেতে মনের ভেতরে কবি জমিয়েছেন কানামাছি দিন, বিবর্ণ হেমন্ত আর মানুষের প্রতীতি। কবিতার সুরে সুরে তিনি যেন জীবনের গল্প বলে যান। তবুও গল্পের জীবনে অনেক না-বলা কথা, ধূসর ও রুগ্ন ইতিহাস থেকে যায়। ঋতুর বৈচিত্রে ধরা পড়ে না সব রং। হেমন্ত বা শীতে হাঁটতে হাঁটতে পাল্টে দেন ঋতুর ধারণা। কবি বলে ওঠেন,
‘একদিন রোদের প্রয়োজনে মণিমুক্তাসমেত তামাশা উঠে আসবে- এমনকি, তোমার আলিঙ্গনমাখা শয্যাও তখন খুঁজবে না নিয়তির দাগ; ও হেমন্ত; বরং দীর্ঘকাল বয়ে যেতে যেতে, বিবাহিত রাত্রির গোপন কথায় ন্যায্যতার কর বসিও...’
তবুও পাতার অক্ষরে লেখা কবির এইসব ঋণ ফিরিয়ে দেয় ভবঘুরে দিন। তখন বাঁকফেরা নদী চুপিচুপি বলে, ‘ওহে চেতনার দাস-/ তবুও, তোমাকেই ‘ভালোবাসি’...

অণিমা মুক্তি গমেজ তার কবিতায় নিদারুণ বেঁচে থাকা জীবনের অযাচিত ইচ্ছে বিকিয়ে দেন। যেন অগ্নিতলে দেহ সঁপেই তার বেঁচে থাকা। লজ্জায় চাদরে মুখ লুকালেও চারিদিকে অট্টহাসির রোল। কখনো কখনো নাগরিক কবির মুখে অঞ্চলের বুলি ফুটে ওঠে। তখন মনে হয় খেটে খাওয়া মানুষের এই অভিব্যক্তি যেন কবির নিজেরই আকুতি। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের হৃদয় ছুঁতে পেরেছেন। কবি যখন বলেন,
‘ইছামতির পারে দেহুম
যত কচতুরি ফুল
হেই ফুলে বানিয়্যা দিব্যা
দুই কানেরই দুল।’
সহজ-সাবলীল ভাষায় তার এমন গভীর আবেদন শুধু তাকেই মহান করে না; সাথে সাথে মহান করে বাংলা কবিতাকেও। কেননা কবিতায় মানুষের কথা থাকবে, মানুষের জন্য কবিতা রচিত হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। ফলে এই যেন তার ব্রত। তাই দুঃখ-সুখের ফেরিওয়ালা হয়েই কবির অনন্ত যাত্রা।

গোলাম মোর্শেদ চন্দনের কবিতার উপলব্ধি ব্যতিক্রম। কেমন যেন উল্টোদিকে চলার মত। বন্ধচোখে হাঁটার মত। কেননা পৃথিবীর আজ বাতজ্বর। তাই ব্রাকেট উঠালেই মুক্তি! আট কুঠুরী নয় দরজার ফাঁকে কে কাকে খুঁজে ফেরে? তার কোনো উত্তর হয়তো আমাদের কাছে নেই। এখানে আলোছায়া পাশাপাশি। তাই ভোরের পতনে হেসে ওঠে রাত। কারণ ইদানিং বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। বেখেয়ালী ইচ্ছেগুলো তাকিয়ে থাকে। তাই কবি বলেন,
‘অনেক খেয়েছি জল ডুবে ডুবে, প্রিয় উপস্থিতি
চান্দার বিলের দোহাই, বর্নি বাওরের কসম—
চার পুরুষের দিব্বি মধুমতি। করফার কইগুলো জানে,
শিং মাগুরেরা জানে তরুর বিল
আমারে জানি আমি।’
সুতরাং কবির স্বপ্রণোদিত জবানবন্দীতে জানা যায় অনেক কিছু। তাই অনাগত জঙ্গল চাষের ভার জঙ্গলেরই থাক। আমরা সেখানে বেমানান। কারণ আমরা মাঝে মাঝে বিপরীত দিকে সাঁতার কেটে জল ঘোলা করে বেঁচে থাকি।

সরিফা সালোয়া ডিনার কবিতায় উঠে আসে সংগ্রামী জীবনের গল্প। যে জীবন ধ্বংসের সীমায় থেকেও বয়ে চলে নদীর মত। তার কবিতার প্রকৃতি চেতনা, ঐতিহ্যগত ধারণা পাঠককে ভ্রমণের আনন্দ দেয়। ভ্রমণপিপাসু কবি বলেন,
‘সাইকেল আরোহী বনরক্ষী—চেনা ও চিকন পথের পথিক।
চেনাপথ তবু ভয়—সঙ্গী ছায়ার রাক্ষুসীপনা
হানা দেয় মনের গহীনে
কখন যে এসে পড়ে বুনো মহিষ কিংবা হাতির দল!’
মূলত ভ্রমণের আড়ালে জীবনের অভিঘাত ফুটে ওঠে। অন্যত্র বিষণ্নতা ঝংকার তোলে বোধ এবং মননে। নানাবিধ প্রসঙ্গ ধরা দেয় কবিতার চরণে চরণে। অবলীলায় ভাবালুতা জাগিয়ে তোলে বিরহী হৃদয়ে। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মধুরতম আবেগ বিরহের দহনে দগ্ধ হয়। তবুও মুখের ভাঁজে খুঁজে পায় না আনন্দরেখা। কেবলই অকালের স্রোত বয়ে চলে। ক্রমশই আকাশের চাঁদ গাঢ় হয়। আসন্ন তিমির মুখোমুখি চাঁদ আর বিবর্ণ সন্ধ্যা। তবুও কবি কামনা করেন, জলমগ্ন গানেই বেজে যাক তানপুরা।

তারুণ্যের আলোয় উদ্ভাসিত কবি তুষার প্রসূনের কবিতা ভিন্ন মাত্রার আহ্বান নিয়ে হাজির হয়। তার একেকটি কবিতাকে মনে হয় একেকটি ছোটগল্প। সেসব কবিতায় মায়াবী জাদুর পরশ রয়েছে। রয়েছে অনুভূতির নির্যাস। কবি পৃথিবীর প্রতিটি পিতাকে এক একটি মায়াবী জাদুকর রূপে অভিহিত করেছেন। তার প্রতিটি কবিতাই বিশেষ কোনো বার্তা বহন করে। গতানুগতিক কবিতার বাইরে এ যেন এক ধরনের বিপ্লব। সেই বিপ্লবের স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছেন কবিও। কবি তাই বলেন,
‘আসলে আমি ভেসে আছি। ভালোবেসে আছি চোখের জলতরঙ্গ। যেখানে বাসা বেধে আছে মেঘ, বৃষ্টি আর তোমার শরীরে জমাকৃত যত জলের অনুষঙ্গ।’
তাই বলা যায়, কবির অনুভূতি এতটাই প্রখর যে, সেখানে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা যায় কিন্তু বিনা অনুভূতিতে নয়। এ ঘর অন্ধকারে গড়েছেন বিনম্র শব্দের কারিগর। সেই কারিগরের হাতেই ধরা পড়ে মানুষের যৌবন ও বার্ধক্য। কবির সার্থকতা এখানেই।

সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতা যেন মুক্তির মিছিল। ভালোবাসা বুকে নিয়ে সে মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কারণ মুক্তির নানা কৌশল রপ্ত করতে হয়। মুক্তি তো আর সহজে মেলে না। সেখানে বিশ্বাস, বোধিসত্ত্ব, স্বপ্ন ও বন্ধন মুক্তি জোগায়। ফলে তার কবিতায় জাদুর ছোঁয়ায় সব শব্দদের প্রাণে এসেছে বান। আমরা সে কলাবতি ঘ্রাণ শুঁকে দেখতে পারি। কেননা তার দুঃখগুলো উড়ে যায় পাখির ডানায়। কবি বলেন,
‘যন্ত্রণা শিকল ভেঙে মুক্তির কান্নায়
ভিষণ অচেনা লাগে সুখের আদল
অনুভূতি ভোতা দা’য়ে কাটে না অস্তিত্ব
পদার্থের সূত্রাবলি মিথ্যের ভাগাড়ে
পৃথিবীটা বড় বেশি জড় বস্তু আজ’
ফলে আমাদের মানুষ জন্ম যেন বৃথা হয়ে যায়। তবুও জীবনের দামে কিনে নেই সেইসব আঙুর দিনরাত্রি। কখনো কখনো কোন মহানের স্বপ্নের ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙে। সেখানে দেখি পূণ্যমুখে লাল-সবুজের হাসি। কবিতায় দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ ধরা দেয় এভাবেই।

কবি নাহিদা আশরাফী চাইলেই নদী পাওয়া যায়। তাই তিনি ছুটে যান কিংবা পিছিয়ে পড়েন। কখনো সরে যান কিংবা চুপসে যান। তবে নদী তার সাথে প্রতারণা করে না। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেরিতে হলেও তিনি নদীর দেখা পান। এছাড়াও তার কবিতায় প্রকৃতি, দেশপ্রেম, স্বার্থ, ইতিহাস, মানচিত্র, ক্ষমতা উঠে আসে আপন অনুষঙ্গে। তার কোনো কোনো কবিতায় গীতিধর্মিতা রয়েছে। তিনি কবিতায় সুর, তাল, লয় ও অন্ত্যমিল সহযোগে হাজির হন পাঠকের সামনে। কবি যেন গেয়ে ওঠেন,
‘মাটির বুকটা একটু ছুঁইয়া
নদীর ঢেউ তো চইলা যায়
ঢেউ কি আর খবর রাখে তার
পারের বুকে কি তরপায়?’
আবার অপরাপর কবিতায় গদ্যের নির্যাস লক্ষ্য করা যায়। যেন কবিতায় তিনি আস্ত একটি গল্প বলতে চেয়েছেন। যদিও কবিতায় দৃশ্যকল্প তো থাকেই। সেই দৃশ্যকল্পের মলিন মৌসুমেও কাঁচাসোনা রোদ ওঠে। লাউয়ের ডগার মত লকলকিয়ে বাড়ে অকারণ ইচ্ছেগুলো। ফলে কবিতায়ও এমন গল্প বলা যায়—এখানেই সার্থকতা তার।

অবশেষে বলা যায়, তাদের কবিতার আবেদন পাঠককে বিমোহিত করবে। কবিতার যাবতীয় গুণাবলী এতে বিদ্যমান। তারা শব্দচয়ন, ছন্দ, অলংকার, উপমা, রীতি—অবিচল রেখে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছেন। বিচিত্র স্বাদের কবিতা এখানে বিদ্যমান। সব শ্রেণির পাঠকের কাছে তা সমাদৃত হবে বলে আশা করা যায়।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন