ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ১৯

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০২:৫৪ পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০২১

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

সতেরো.
মুঠোফোন এখন মুঠিতে রাখা যায় না। অফ করে হ্যান্ডব্যাগে রাখতে হয়।
ফোন অন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতিতে আসতে থাকে এসএমএস। মিসকল কিংবা কল।
এসএমএসের ভাষা কখনো রোমান্টিক, কখনো রহস্যময়, কখনো ভীতিকর কখনো-বা অশালীন, কুৎসিত।
এত নিম্নশ্রেণির এসএমএস পাঠায় কী করে মানুষ?
সেলফোন বার্তার নোংরা কয়েকটা শব্দ তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল রিয়াকে।
প্রথমে ‘ফান’ হিসেবে নিয়েছিল এসব। এখন ‘ফান’ ভাবতে পারছে না। ভাবে নিশ্চয়ই নিজের কোনো ঘাটতি আছে। হাঁটার সময় নিশ্চয়ই নিজের দেহের বিশেষ অঙ্গের বেঢপ ঢঙের প্রকাশ ঘটে।
নইলে এমন বর্ণনা আসে কীভাবে?
বড়রা বলেন, ইগনোর করো। পাত্তা দিয়ো না। সহনশীল হও।
সহনশীল হলেই কি বিড়ম্বনার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে?
যাবে না। যাচ্ছেও না।
হাঁটতে গেলে মনে হয় দেহের পেছনের দিক ঠকঠক করে বাড়ি দিচ্ছে। নিজের বুকের দিকে নজর গেলে মনে হয় বুকটা খুব বেঢপ। সবাই কুরুচিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। এসব বিষয়ে নোংরা এসএমএস আসে। এজন্য হাঁটতে গিয়ে সাবধান হতে হয়। সাবলীল হাঁটার গতি পায় না রিয়া। সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতে হয়। নইলে মনে হয় বুকের মধ্যে থেকে পাখির ডানা উড়াল দেওয়ার জন্য পাখা ঝাপটাচ্ছে।

সব কথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু কথা গোপন থাকে। গোপন রাখতে হয়। গোপন রাখলেও বিপদ। মাথা জ্যাম হয়ে যায়। মাথা টনটন করে। ডুয়েট ট্যাবলেট খেয়ে ব্যথা আর কত কমানো যায়!
জ্যাম মাথা নিয়ে সেলফোন অন করল রিয়া। মুনাকে কল করা দরকার। অন করার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল সেলফোন।
ভিজুয়াল মনিটরে অজানা নম্বর।
না। ধরবে না সে অজানা নম্বর। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর থেমে গেল কল।
এই ফাঁকে কল করল রিয়া। মুনার নম্বর মুখস্থ। কলবুকে নম্বর খোঁজার চেয়ে মুখস্থ নম্বর ডায়াল করতে কম সময় লাগে। দ্রুত সময়ে ও লাইন কানেক্ট করে ফেলল। মুনার সেটের মিউজিক রিং শুনতে পাচ্ছে। রিং-মিউজিক খুব সুন্দর। ভালোবাসি! ভালোবাসি!
কাকে ভালোবাসে ও? নাকি সবার জন্য ভালোবাসা উজাড় করে দেয়?
সবার জন্য দিলে তো নিজের একান্তে কিছু থাকে না।
মনের মানুষের জন্য কিছুটা রেখে দিতে হবে না?
ভাবার সুযোগ পেল না আর। মুনার কণ্ঠ ভেসে এসেছে।
কল রিসিভ করেই মুনা জানতে চায়, তুই এখন কোথায়?
আমি বাসায়। এত সকালে কোথায় থাকব আবার?
তো, সকাল সকাল কল করেছিস কেন?
এমনি। ভালো লাগছিল না। তাই কল করলাম।
ভালো না-লাগার মোড়কটা খুলে নে দেহ থেকে। মন ঘোড়ার মতো ছোটা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সকালের দিকে তোর কোনো প্রোগ্রাম আছে? কোনো কাজ আছে হাতে?
না। সকালে নেই। বিকেলে আছে। কেন?
কুসুম বলেছিল সকাল ন’টায় ও চারুকলার বকুলতলায় যাবে।
কী অনুষ্ঠান?
হেমন্তে নবান্নের উৎসব চলছে। কাঁচা ভোর থেকে শুরু হওয়ার কথা অনুষ্ঠানমালা। এজন্য সকাল আটটার মধ্যে তোকে রিং করলাম।
একটু আগে বললি ভালো লাগছে না, তাই রিং করেছিস। এখন বলছিস বকুলতলায় যাওয়ার জন্য কল করেছিস। কোনটা আসল সত্য?
দুটোই সত্য। দুটোই আসল। খাঁটি কথা।
ঠিক আছে প্রথম সত্য ঝেড়ে ফেল। কুসুমকে নিয়ে চলে যা তুই। আমি দশটা-এগারোটার দিকে আসার চেষ্টা করব।
মুনার ঝোড়ো কথার দাপটের সঙ্গে অভ্যস্ত রিয়া দুম করে অফ হয়ে গেল। মুনা এখন যাচ্ছে না শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। রিয়ার মনের এখনকার অবস্থাটা চট করে বুঝে ফেলল মুনা। সহজ স্বরে বলল, রেজা মামাকে পাঠিয়ে দেব? উনি কি যাবে তোদের সঙ্গে?
মুনার প্রশ্ন শুনে হোঁচট খেল রিয়া। কেন হোঁচট খেলো বুঝতে পারল না। স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো, এ ধরনের অনুষ্ঠানে মামার যাওয়া কি ঠিক হবে? ওনার বোধ হয় ভালো লাগবে না।
থাক। মামাকে তাহলে বলছি না। তোরা চলে যা। আমি ঠিক সময়ে এসে হাজির হব।
আচ্ছা। বলেই লাইন কেটে দেয় রিয়া। লাইন কেটে দিয়ে ভাবতে থাকে, রেজা মামা কি এলেই ভালো হতো না! না করল কেন ও? মন থেকেই কি না করেছে? অ্যানালাইসিস করতে থাকে। উত্তর খুঁজে পেল না।

অনেকক্ষণ চুপ থাকে ও। এই ফাঁকে বেজে ওঠে নিজের মোবাইল ফোন।
এবারও ‘আননোন’ নম্বর।
কল অ্যাটেন্ড না-করে রিং বাজতে দেয় ও। বাজতে থাকে। একসময় থেমে গেল কল।
কুসুমকে কল করে এবার।
একবার রিং বাজার সঙ্গে কল অ্যাটেন্ড করে কুসুম। রিসিভ করেই চিৎকার দেয়।
ঘুম থেকে উঠেছিস?
হ্যাঁ। উঠেছি প্রায় একঘণ্টা হলো।
আমি তো ভোর পাঁচটায় উঠেছি। তোর খোঁজ নিয়েছি ছ’টায়। তুই ঘুমাচ্ছিলি। তাই ডিস্টার্ব করিনি।
ডিস্টার্ব করিনি মানে? ডিস্টার্ব বা আনডিস্টার্বের কী হলো?
না। মানে আমার পরিচিত একজন কল করল বকুলতলা থেকে। কল পেয়ে চলে এসেছি। এখন আমি বকুলতলায়। দারুণ উৎসব চলছে। পিঠা খাচ্ছি।
একজন কল করল আর চলে গেলি? আমাকে নিয়ে গেলি না সঙ্গে?
না। ব্যাপারটা তা না। মানে হুট করে চলে এলাম।
একবার রিয়ার ইচ্ছা হলো ‘পরিচিতজনের’ পরিচয় জানতে। আবার ইচ্ছা দমিয়ে দিয়ে, সহজ থেকে প্রশ্ন করল, কী পিঠা খাচ্ছিস?
নানা পিঠার আয়োজন হয়েছে। ভাপাপিঠা গরম গরম পরিবেশন করা হচ্ছে। এছাড়াও আছে পুলিপিঠা, ফুলপিঠা, কাটাপিঠা, নাড়ু, মালপোয়া, চিতই, দুধবড়াসহ আরও অনেক নাম-না-জানা পিঠার আয়োজন করা হয়েছে নবান্নের উৎসবে।
রিয়ার মনে অভিমান জেগে ওঠে। কুসুম এখন পরিচিতের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। পরিচিতজনের পরিচয় দেয় না নিজ থেকে। জানতেও চায় না ও। পরিচিতজন ‘ছেলে’, না ‘মেয়ে’? প্রশ্ন আসে মনে। মনের ভেতরই প্রশ্নটা আটকে গেল।
কুসুম উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, এবারের নবান্নের উৎসবের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘হেমন্তের বুক থেকে তুলে আনো নবান্নের সুখ।’
রিয়া প্রতিপাদ্যটি শোনে। ভালো লাগে ওর। সুখ তুলে আনার আহ্বানের প্রতি উচ্ছ্বাস ঢেলে দিয়ে বলল, তুই তুলে নে সুখ। আমার জন্যও নিয়ে আসিস ছিটেফোঁটা।

কুসুমের উচ্ছ্বাস জোয়ারের মতো দাপিয়ে উঠছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার ইচ্ছা হচ্ছে আকাশে উড়াল দিতে। আকাশে ঘুড়ির মতো হাত ভাসিয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে আঙিনাজুড়ে আছে রং-বেরঙের ঘুড়ি। ঘুড়িগুলো ঝোলানো হয়েছে গাছের ডালে। বকুলতলাকে সাজানো হয়েছে লাল, কমলা এবং নীলের মতো উজ্জ্বল রঙের কাগজ আর কাপড় দিয়ে। ভোর থেকেই দলে দলে নারী-পুরুষ-শিশুর দল এসেছে এই উৎসবে। যন্ত্রীরা একতালে বাজিয়ে গেছেন হেমন্তের উৎসব ধ্বনি। উৎসব ধ্বনি শুনতে পেল না কুসুম। যন্ত্রীদের ঢোল মন্দিরা আর বাঁশির পাগল করা সুর কুসুমের কানে ঢোকেনি। হেমন্তের নবান্নের ভেতর থেকে চুষে নিয়েছে অন্য সুখ। অন্য ধ্বনি। এই ধ্বনি একান্ত নিজের। একান্তই গভীরের খেলা। এই খেলার ভাগ দেওয়া যাবে না রিয়াকে। এই খেলার মূলপ্রাণ হেমন্তের ছোঁয়া না। নবান্নের উৎসব না। মূলস্রোত বয়ে চলেছে মাহিনের সান্নিধ্য থেকে। মাহিন আছে সঙ্গে। ওর কথা বলা হয়নি রিয়াকে। বলা যাচ্ছে না। কীভাবে বলবে জানে না। মাহিনের টানে ছুটে এসেছে ও। মিথ্যাও বলছে এখানে-সেখানে। এই মিথ্যার বুনো সুতোর জালে জড়িয়ে আছে আনন্দসুখ। এই সুখ নবান্নের সুখকেও হার মানায়। এ সুখের ভাগ দেওয়া যাবে না কাউকে, রিয়াকেও না।

কথা বলতে পারছে না কুসুম।
রিয়া প্রশ্ন করল, চুপ করে আছিস কেন? হেমন্তের বুক থেকে সুখ তুলে কি গলা পর্যন্ত ভরে ফেলেছিস?
ঠিকই ধরেছিস। বুক-গলা ভরে গেছে। এ ধরনের উৎসব হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যের ধারা। ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
রিয়ার অভিমানের দেয়াল শক্ত হলো না। কুসুমের সাবলীল উল্লাসধ্বনি নিজের অভিমানের দাপট কমিয়ে দিলো। আবার প্রশ্ন করল, ঐতিহ্যের আকর্ষণীয় ধারাটা কী?
একজন চিত্রশিল্পী বক্তৃতায় বলছেন, নবান্নের উৎসব শুধু ধান কাটার উৎসব না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষকের শ্রম, আনন্দ-বেদনা, গ্রাম্য কৃষাণির বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সুখ।
বাহ! কৃষাণির সুখের স্বাদ কি পাচ্ছিস?
পাচ্ছি। পাচ্ছি রে! তোকে বোঝাতে পারব না, রিয়া!
এই কুসুম, মাথা ঠিক আছে তোর? এমন লাগছে কেন কথার ধ্বনি? মনে হচ্ছে অন্য কেউ কথা বলছে আমার সঙ্গে। মনে হচ্ছে কোনো এক সুখী গ্রাম্য কৃষাণি কথা বলছে।
তোদের কুসুমকে চিনতে পারছিস না?
পারছি না তো?
অন্য কেউ মনে হচ্ছে তোর?
মনে হচ্ছে তো?
হতেও পারে। মনের ঘরে অন্য কুসুম বোধ হয় পাপড়ি খুলছে। ওই কুসুমকে চিনবি না তুই, এটাই স্বাভাবিক।
লাইন কেটে যায়।

রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। নিজের খাটে এসে শুয়ে রইল। মনে হতে লাগল জানের বন্ধু কুসুমের জানের মধ্যে ওর আসন নড়ে গেছে। মনে হচ্ছে ওই আসন দখল করেছে অন্য কেউ। এই দখলদারিত্ব মানতে পারছে না রিয়া। কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট সামাল দিতে খাট থেকে নেমে এলো এবার।
এক গ্লাস পানি পান করা দরকার। পানির জন্য ডাইনিং স্পেসের দিকে এগিয়ে গেল ও।
এ সময় আবার সেলফোনে রিং বেজে ওঠে।
পানি পান না-করে ফিরে এলো নিজের ঘরে। খাটের ওপর সেটটা পড়ে আছে। বাজছে। ‘আননোন’ নম্বর থেকে কল এসেছে। একই কল। বারবার আসছে।
ইয়েস বাটনে চাপ দিলো এবার। কানের কাছে সেটটা ধরে চুপ মেরে রইল।
রি! তুমি বলছ?
ধক করে ওঠে রিয়া। বুকের মধ্যে ডাইনামাইট ফাটে। আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল সে। গলা দিয়ে স্বর বের হলো না আর।
সন্ত্রাসীচক্র ওর পথ থেকে সরে দাঁড়ায়নি। এখনো পেছনে লেগে আছে। এখনো ধরা পড়েনি। এখনো রেহাই দেয়নি ওকে।
মাকড়সা নিজের জালে আটকায় না। পোকামাকড় আটকায়। নিজেকে মনে হচ্ছে পোকামাকড়। আটকে গেছে সে। মাকড়সার শিকারে পরিণত হয়েছে।
ফারুক মামা বলেছিলেন, সন্ত্রাসীরা ধরা পড়বে। নিজেদের জালে নিজেরা ধরা পড়বে। ধরা পড়েনি। জাল আরও বিন্যস্ত হয়েছে।
রিয়া কোনো কথা বলছে না। লাইনও কেটে দিচ্ছে না।
রি। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? কথা বলো। জরুরি কথা আছে।
এপাশ থেকে জবাব নেই। রিয়া একদম চুপ হয়ে আছে।
একসময় লাইন কেটে যায়।

সেট অফ করে দিল রিয়া। নিজের খাটে এসে শুয়ে পড়ল।
শুয়েও থাকতে পারছে না। মন ছটফট করছে। বাপির কথা মনে পড়ছে! কত ভালো বাবা তার। সৎ এবং মোটামুটি সফল তাঁর জীবন। সফল বাপির প্রিয়জন ও। প্রিয়মুখ ও। নিজের মেয়ের সুখের জন্য করতে পারবে না এমন কাজ নেই বাপির। এমন বাবার মেয়ে আজ অসহায়। সন্ত্রাসীদের জালে জড়িয়ে বিপাকে পড়ে আছে।
মাকড়সার পা ক্লোরোফর্মজাতীয় পদার্থে ডুবিয়ে রাখলে তৈলাক্ত জিনিসটা ধুয়ে বেরিয়ে আসে। তখন মাকড়সা নিজের গড়া আঠালো তন্তুর ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে যাবে। জানে রিয়া। রিয়ার সন্ত্রাসীদের পায়ে কে মাখবে ক্লোরোফর্ম? কে আটক করবে তাদের?
রেজা মামার কথা মনে এলো।
ফারুক মামার কথা মনে পড়ল।
উনারা সাহস জুগিয়েছিলেন। কেবল সাহস দিয়ে জীবন চলে না।
সমস্যা জয় করার জন্য কৌশলী হতে হয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বুদ্ধি দিয়ে জয় করতে হয়, বলেছিলেন রেজা মামা।
বুদ্ধি খুলছে না। মাকড়সার পিচ্ছিল জালের মতো অন্য কোনো জালে জড়িয়ে গেছে বুদ্ধির সুতো। উদ্ধার হচ্ছে না নিজের আটকে যাওয়া সময়-চাকা।
চিকন সুতোর গিঁট খোলার চেষ্টা চালায় ও।
হঠাৎ মনে হলো, ফারুক মামার নম্বর এন্ট্রি করে রেখেছিল। ফোন বুক অন করে নম্বরটি পেয়ে যায় ও।
যে কোনো বিপদে জানাতে বলেছিলেন তিনি।
জানানোর প্রয়োজন হয়নি। এখন প্রয়োজন হয়েছে।
ফারুক মামাকে কল করে বসল।
ইয়েস! রিং হচ্ছে! খুশি জাগে মনে। বিপদে ভেঙে পড়েনি। বিপদের সময়ও খুশি কুড়িয়ে পাওয়া যায়। বুঝল ও।
বলো রিয়া। কী বলবে, বলো? কল অ্যাটেন্ড করেই জানতে চাইলেন ফারুক মামা।
চিনতে পারছেন আমাকে?
শিয়োর। চিনতে পারছি। তোমার নম্বর আমার সিমে এন্ট্রি করা আছে।
থ্যাঙ্কস মামা। থ্যাঙ্কস আপনাকে।
শোনো মেয়ে। তোমার বয়সি আমার একটা মেয়ে আছে। আমি তোমাকে মেয়ের মতোই দেখছি। থ্যাঙ্কস জানানোর দরকার নেই। আসল কথা বলো। বুঝেছ?
জি মামা। বুঝেছি। আপনি কোথায় আছেন এখন?
ঢাকার বাইরে আছি। দূরে থাকলেও তোমার কাছেই আছি। আমার ফোন পেলে ওখানকার সহকর্মীরা তোমাকে হেল্প করবে। এখন বলো, তোমার কথা বলো। হঠাৎ ফোন করলে কেন, বলো? কোনো বিপদ?
হ্যাঁ। ভয় পাচ্ছি। সন্ত্রাসীদের একজন, যে আমাকে টেলিফোন করত, যার জন্য পালিয়েছিলাম, টোন শুনে মনে হলো সে-ই ছেলে আমাকে রিং করেছে আবার।
কখন করেছে।
কিছুক্ষণ আগে।
ওকে রিয়া। ডোন্ট গেট নার্ভাস। তুমি কলটাইম নোট করো। নম্বরটাও আলাদা কাগজে টুকে রাখো। সব আমাকে জানাও।
রিয়া বলল, আচ্ছা মামা। আমি জানাচ্ছি।
তোমাকে উদ্ধার করার পর এই প্রথম ফোন পেলে?
প্রথম কল অ্যাটেন্ড করেছি। সাধারণত আননোন নম্বর ধরি না আমি।
মিসকল বা এ ধরনের কল কি বহুবার এসেছে, যেগুলো ধরোনি তুমি?
জি মামা। বহুবার কল এসেছে। নম্বর মুখস্থ রাখিনি।
এখন থেকে মুখস্থ রাখবে। নম্বর টুকে রাখবে আলাদা খাতায়।
আচ্ছা রাখব।
খেয়াল করবে, একই নম্বর থেকে কল আসে, নাকি ভিন্ন ভিন্ন নম্বর থেকে আসে।
জি মামা। খেয়াল রাখব।
শোনো, তোমার মা একসময় একটা নম্বর কাগজে টুকে রেখেছিলেন। দেখো তো ওই নম্বরের সঙ্গে মিল আছে কি না।
জি দেখব। বলেই হোঁচট খেল। একটু ইজি হয়ে আবার বলল, মামণি এতদিন নম্বরটা রেখেছে কি না জানি না।
রাখবে, তোমার মায়ের মন সাবধানি। দেখো, উনি নম্বরটা নিজের পার্সোনাল ডায়েরিতে টুকে রেখেছেন। আমি নিশ্চিত জানি না রেখেছেন কি না। তবে উনাকে স্টাডি করেছি আমি। দৃঢ়বিশ্বাস, নম্বরটা উনি ফেলে দেবেন না।
মামা, ফোনের ব্যাপারে কি মাকে কিছু বলব? নম্বর চাইতে গিয়ে যদি টেনশনে পড়ে যান? যদি আবার আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন?
একটু ভাবলেন ফারুক সাহেব। ঠিকই বলেছে রিয়া। মায়ের কাছে জানতে গিয়ে আবার মাকে জটিলতার জালে জড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। আপাতত মাকে না জানানোই ভালো। সিদ্ধান্তটা যুক্তিসঙ্গত।
ফারুক মামা বললেন, ঠিক আছে। মাকে জানিয়ো না। তুমি নম্বরটা নোট করে আমাকে একটু পরে জানাও। বলেই লাইন কেটে দিলেন তিনি।

অ্যাটেন্ডিং কল থেকে নম্বরটি টুকে রাখল রিয়া। সময়ও। এর আগের আননোন অ্যাটেনডেন্ট কলগুলো বের করে দেখে নিল। একই নম্বর থেকে বহুবার কল এসেছে।
কললিস্ট থেকে নম্বরটি কলটাইমসহ টুকে নিল রিয়া। ফারুক মামাকে আবার ফোন করে ডিটেইলস জানিয়ে দিলো।
এখন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। বিপদে ভেঙে পড়েনি। রেজা মামার উপদেশ এবং সাহস দুটোই কাজে লেগেছে।
বিপদ দেখে ভেঙে পড়লে সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেত না। উদ্যোগ নিয়েছে। নিতে পেরেছে ও। আপাতত এটুকু সফলতা। দেখা যাক, এই সিঁড়ি বেয়ে পুরো সফলতা পাওয়া যায় কি না।
রেজা মামাকে ফোন করতে ইচ্ছা হলো। পাশাপাশি যূথীর কথাও মনে পড়ে গেল। আপন মামা যূথীর বয়ফ্রেন্ড। বিস্ময় লাগে। কমন ঘটনা না এটা। এমন ঘটনা আবার অস্বীকারও করা যায় না। যূথী তো নিজের মামার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে না। ভেতরে ভেতরে সমাজে নিশ্চয়ই এমন কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। ঘটার সুযোগ বেশি থাকায় ঘটছে। যূথীর বলা-কথা মনে পড়ল। যূথী বলেছে, ওই সময় মনে হয় না উনি মামা। মনে হয় বয়ফ্রেন্ড। মনে হয় তিনি পুরুষ। আমি নারী। মনে হয় আমাদের সম্পর্ক নারী-পুরুষের সম্পর্ক।
কী ভয়াবহ দর্শন! কী অনৈতিক জীবনবোধ! চমকে উঠল ভাবতে গিয়ে। ভাবনা থামাতে পারছে না। ভাবনা আছড়ে পড়ছে রেজা মামার ওপর। তিনি তো আপন মামা না। মুনার মামা। পরপুরুষ। পরপুরুষ নিয়ে ভাবা তো অনৈতিক না। পরপুরুষের জন্য আকর্ষণ আসতে পারে। আকর্ষণটা নৈতিক হওয়াই তো স্বাভাবিক।
রিয়া নিজেকে খুঁজে দেখতে লাগল। রেজা মামার জন্য আকর্ষণ টের পাচ্ছে। আকর্ষণের ধরন কেমন? বুঝতে পারছে না। নারী-পুরুষের আকর্ষণ? ভাবতে সাহস পেল না। বরং মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মমতার আকর্ষণ। স্নেহের আকর্ষণ। উনার মমতা ও স্নেহের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে পৌরুষদীপ্ত গোপন কোনো তাড়না?
মধ্যবয়সি সুদর্শন মামার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ, কথাবার্তা স্মার্ট। মনে হয় না তার এত বয়স হয়েছে। মনে হয় না তার জীবনে কোনো ফাঁক আছে। মনে হয় না কোনো শূন্যতা আছে মামার।
মামার শূন্যতা কী? জানতে হবে। মামার প্রতি কৃতজ্ঞ ও। কৃতজ্ঞতার আড়ালে শ্রদ্ধা আছে। অন্য কোনো অনুভূতিও জাগছে মনে হয়। মনে হওয়া বিষয়টা চেপে মনের অতলে ঠেসে দিলো ও। আপাতত মামার শূন্যতা জেনে পূর্ণ করার উদ্যোগ নেবে। কৃতজ্ঞতার জবাব দেবে রিয়া। যতটুকু সম্ভব ততটুকু করতে পিছপা হবে না। ভাবতে ভাবতে ঘরের ভেতর থেকে ড্রয়িংরুমে এসে টিভি অন করল। চ্যানেল আইয়ে ন’টার খবর চলছে। ইদানীং খবর দেখতে ইচ্ছা করে না। তবুও টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। টিভি স্ক্রিনে আগুন জ্বলছে। গাড়ি পুড়ছে। ইরাকে গাড়ি-বোমা হামলায় কয়েকশ লোক মারা গেছে। আমেরিকান সৈন্যরা মরছে। ইরাকিরা মরছে। সাদ্দামের বিচার চলছে। মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ধ্বংস। কেবলই ধ্বংস। কিছুদিনের মধ্যেই সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
মনের ঘরটাও কি পুড়ে গেছে? আগুন জ্বলছে গোপন ঘরে? রিয়ার মনে প্রশ্ন আসতে থাকে।
প্রশ্নের ক্রমাগত আক্রমণ থেমে গেল হঠাৎ।

নিজের ঘরে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ধীরপায়ে ফিরে আসে ও।
মুনার ফোন। কল অ্যাটেন্ড করে হ্যালো না বলেই রিয়া সরাসরি প্রশ্ন করে, কোথায় তুই?
আমি একটা ফটোসেশনে আছি। পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম। মুনা জবাব দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে, তুই কোথায় এখন?
এখনো বাসায়।
মুনা ক্ষেপে ওঠে, এখনো বাসায় কেন? তোর না বকুলতলায় যাওয়ার কথা।
যাওয়ার কথা ছিল। যাইনি। যেতে ইচ্ছা করছে না।
আবার ‘ইচ্ছা করছে না’র গাধার পিঠে চেপে বসেছিস? ধমক দিয়ে প্রশ্ন করল মুনা।
রিয়া চুপ থাকে। জবাব দিলো না।
মুনা আবার প্রশ্ন করে, কুসুম কোথায়?
ও বকুলতলায়। পরিচিত একজনের ডাকে ছুটে গেছে। আমাকে নিয়ে যায়নি। ভোরে চলে গেছে, আমি তখন ঘুমিয়েছিলাম। আমাকে জ্বালায়নি।
ওকেই আমি জ্বালিয়ে ছাড়ব? তোকে না-নেওয়ার মাশুল দিতে হবে।
থাক। ওকে জ্বালাস নে। ও খুব খুশিতে আছে। কারও সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেড়াক। ডিস্টার্ব করিস না।
ঠিক আছে। তুই বকুলতলায় চলে যা। রেজা মামাকে ফোন করে দিচ্ছি। ফটোসেশন শেষ করে আসছি আমি। কথা শেষ করে লাইন কেটে দিলো মুনা।
রেজা মামার কথা শুনে ধক করে উঠল রিয়ার মন।
এমন লাগল কেন? বুঝতে পারল না ও।
রেজা মামার ওপর মুনার একটা কমান্ডিং ভয়েস আছে। এই ভয়েসের অর্থ কী? মামার ওপর ভাগ্নির অধিকারবোধ, নাকি যূথীর মতো কোনো জাদু কাজ করে?
ছি! কী ভাবছে! ভালোমানুষটাকে নিয়ে এমন ভাবনা মনে আসা অন্যায়। মন ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেয় ও।
রেজা মামাকে ফোন করার ইচ্ছা জাগে। পরক্ষণেই কোনো এক অজানা বাধা পেয়ে বসে মনে। ফোন না-করে বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি নেয় রিয়া।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন