কর্পোরেট গাম্ভীর্য এবং আমার দুর্বল আত্মবিশ্বাসের গল্প
আবদুর রহমান সালেহ
‘আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিতে আসবেন না। কোনো দরকার নেই আপনার সহযোগিতার। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য আমার বাবা-মা-বোন আছেন। তারাই যথেষ্ঠ।’
চেনা মানুষের অচেনা আওয়াজ শুনে ঘোর কাটিয়ে উঠতে অনেকটা দেরী হচ্ছিল আমার। হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত আচরণেরই বা কী মানে হতে পারে? কয়েকদিনের আন্তরিক সম্পর্কের ডায়েরির পাতা উল্টাই আমি। যে ডায়েরির অধ্যায়গুলোয় খুব একটি তিক্ততার অভিজ্ঞতার বর্ণনাও দেখা যাচ্ছে না। কিছু কিছু কর্পোরেট অফিসে সচরাচর নোংরা পরিবেশ থাকে, সদ্য যোগদানকৃতদের পরিস্থিতি বুঝে উঠতে অনেকটাই বেগ পেতে হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই। নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে কেউ যাতে বিব্রত না হয়, এর সব আয়োজনই করে থাকি আমি। যতটা সম্ভব হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে অফিসের পরিবেশকে ‘কমফোর্ট জোনে’ নিয়ে যেতে যত যা আয়োজন লাগে করি। কেউ কেউ অবশ্য আমার এই বিষয়গুলোকে ‘বেশ হালকাভাবে’ নেন। বলেন যে, একটু গম্ভীর হতে শিখুন। সবার সাথে এত সহজভাবে মিশবেন না। এটা ঠিক না।
কর্পোরেট অফিসের ফরমাল নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে আমি সবার সাথে সর্বোচ্চ সদাচরণের এবং বিশেষ করে আনন্দঘন পরিবেশ নিয়ে যাতে সবাই কাজ করতে পারে সেভাবেই আগাতে থাকলাম। দুয়েকজন বিষয়টি নেতিবাচকভাবে নিলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ সহকর্মী বিশেষ করে সদ্য যোগদানকৃতদের কাছে আমি ‘আপন মানুষের’ ভূমিকায়ই উপস্থাপিত হতে লাগলাম। বিব্রতকর পরিস্থিতি দ্রুত কাটিয়ে সবাই খুব সহজেই কমফোর্ট হতে লাগলো। বিষয়টি আমার কাছে তুমুল আনন্দের, ভালো লাগার অনুভূতি দিচ্ছিল। নতুন কাউকে কর্মস্থলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েও যে আনন্দ উপভোগ করা যায়, এটা আমার ভাবনার অতীত ছিল। এর বড় কারণ হচ্ছে, কর্পোরেট অফিসে কাজের অভিজ্ঞতা আমার নেই বললেই চলে। সর্বদা ভ্রমণ মুডে থাকা এই আমি ৯টা-৫টা অফিস করছি, শুধু নয়টা-পাঁচটাই নয়, গভীর রাতেও দায়িত্ব পালন করছি। এটা তো আমার কাছে বড় বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। কর্পোরেট অফিস সংস্কৃতি বুঝতে তাই কিছুটা দেরি হচ্ছিল আমার। ভাবনার জটিলতা কিংবা কঠিন করে ভাবার মতো সময় এবং ইচ্ছে কোনোটাই আমার মাঝে না থাকায় আমি আমার মতো করেই দিন পার করছিলাম।
সবার সুখ-দুঃখের গল্প শুনি। গল্প শুনি নিজের জেদকে টিকিয়ে রাখতে সুদূর খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছে ক্যারিয়ার গড়তে কেউ কেউ। অদম্য সহকর্মীদের জেদের গল্প শুনে উজ্জীবিত হই। বুঝতে দেই না খুব একটা। মনের অনুভূতি এক রকমের, বাস্তবের উপস্থিতি খুব সহজ, খুব স্বাভাবিক। মনে মনে উচ্ছ্বাসের উপলব্ধি, অথচ হাসি-ঠাট্টায় সময় পার করে বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দিচ্ছি না বলে উপস্থাপিত হচ্ছি। বেশ ভালো লাগে আমার এমন লুকোচুরিতে। মনের সাথে লুকোচুরি। অন্যকে বুঝতে না দিয়েও কিছু কিছু উপলব্ধিও যে উপভোগ্য হতে পারে, তা তো আমার জানা থাকার কথা নয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি, তাই হয়তো মানুষের বিভিন্ন অদম্য ইচ্ছা জয়ের গল্পও এভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়নি।
নতুন সহকর্মীদের কেউ কেউ যখন গল্প করতে করতে আপন মানুষদের পর্যায়ে নিয়ে সবকিছুই শেয়ার করতে লাগলো। তখন আর তাদের শুধুই সহকর্মী বলে মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এরা আমার খুব কাছের কেউ। সব সম্পর্কের যে কোনো নাম থাকতে হবে, এমনটা ভাবি না আমি। আমি শুধু জানি, এরা আমার সাথে দুঃখ শেয়ার করছে। নিজেদের যাপিত জীবনের না বলা কথাগুলোও অকাতরে বলে যাচ্ছে। তার মানে এরা ‘আপনজন’। আপনজন ভেবেই তো এতসব বলছে। তাদের শুধুই সহকর্মী ভাবার সুযোগ নেই।
গোয়েন্দা কাহিনির বেশ কিছু বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই গোয়েন্দা কাহিনি পাঠের সূত্র ধরে শুরুতেই কারো কথা বিশ্বাস করতে নেই কিংবা একপক্ষের কথা একবাক্যেই বিশ্বাস করতে নেইসহ নানাবিধ সন্দেহজনক বিষয়বস্তু মাথায় পূর্ব থেকেই সেট করা ছিল। যে কারণে সহকর্মীদের সুখ-দুঃখের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেও তাদের কথাগুলো সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য কি না, তা যাচাইয়ের তাগাদা অনুভব করলাম। যতটা সম্ভব চেষ্টাও করলাম, যে কথাগুলো বলা হচ্ছে; তা সত্যিই সত্য কি না। স্রেফ দীর্ঘমেয়াদে আন্তরিকতা অটুট রাখার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল কিছুটা ‘ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপও’। এই হস্তক্ষেপে না ছিল অসৎ কোনো উদ্দেশ্য, না ছিল সহকর্মীদের জন্য কোনো অমঙ্গল ভাবনা।
দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস। নেতিবাচক কথা বললে মানুষ মেজাজ খারাপ করে হলেও তার আসল রূপটা দেখিয়ে দেয়। বিভিন্নভাবে মানুষের আসল স্বরূপ উদঘাটন করতে চাইলে নেতিবাচক কথা বলে মানুষকে খেপিয়ে দেওয়া যায় এ মন্ত্রটা জানা ছিল। সেই চেষ্টাটুকু করেও যখন তুমুল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেলাম, শিখলাম সহনশীল আচরণের মাধ্যমেও যথাযথ জবাব দেওয়া সম্ভব। সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের, তখন আর সহকর্মীদের নিয়ে নেতিবাচক ভাবনার সুযোগ পুরোপুরিই ছিল অনুপস্থিত। সব দিক থেকে যখন তারা একে একে পাস করে যাচ্ছিল, বিপত্তিটা বেঁধেছে ঠিক সেই সময়টাতে এসে।
পূর্বেই লিখেছি, সব সম্পর্কের যে নাম থাকতেই হবে, আমি তার পক্ষপাতী নই। যে কারণে আপনজন শব্দটির ব্যাখ্যাও জানার চেষ্টা করিনি। আমি আমার নবাগত সহকর্মীদের আপনজন ভেবেই দিন পার করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। আমি যাদের একচেটিয়া আপনজন ভেবে বসে আছি, তারা কি মন থেকে আমাকে আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছে? না যা ব্যবহার আমার সাথে করা হচ্ছে, তা শুধুই ফর্মালিটি মেইনটেইন? ভালো ব্যবহার করতে হবে বলে ভালো ব্যবহার করে যাওয়া?
কোনটা ভালো হবে আর কোনটা খারাপ, এ পরামর্শগুলো যখন আগ বাড়িয়ে ক্রমাগত দিয়েই যাচ্ছিলাম। চোখে আঙুল দিয়ে শেখাচ্ছিলাম, কীভাবে কার সাথে কতটুকু মিশতে হবে, কতটুকু সদাচরণ করতে হবে, কতটুকু আন্তরিকতা দেখাতে হবে; ঠিক সেই সময়টাতে খুব কাছের একজন মুখ ফসকে বলেই ফেললেন, ‘আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দিতে আসবেন না। কোনো দরকার নাই আপনার সহযোগিতার। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য আমার বাবা-মা-বোন আছে। তারাই যথেষ্ঠ।’
আমি যখন আপনজনের অধিকার নিয়ে যে সহকর্মীর ভালোর জন্য পরামর্শগুলো দিচ্ছিলাম, ততদিনে সিনিয়র হিসেবে আমার আন্তরিক আগ্রহের কারণেই তারা অফিসে তাদের ‘কমফোর্ট জোন’ তৈরি করে নিতে পেরেছিল। তাদের কেউ কেউ এটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে, এখন আর তাকে অতটা ভ্যালু না দিলেও চলবে। এই সিনিয়রটা তো অত বেশি প্যাঁচগোজও বুঝে না। তাই অহেতুক আর তার পরামর্শ শুনলেই কি আর না শুনলেই বা কি?
অফিসে হাতেগোনা যে দুয়েকজন আমাকে গম্ভীর হতে বলেছিল, সবার সাথে সহজভাবে মিশতে না করেছিল, সেই থেকে তাদের দিকে আমি আর আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি নিয়ে তাকাই না।
এসইউ/জেআইএম