গুলজার হোসেনের ‘গরিবের বিদ্বেষ’
প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি গুলজার হোসেন গরিব। লেখেন খেটে খাওয়া মানুষের কথা। তুলে আনেন সমাজের নিচুতলার মানুষদের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের ছবি। ‘গরিবের বিদ্বেষ’ তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ের মোট কবিতা আছে ছাব্বিশটি। প্রত্যেকটি কবিতায় মেহনতি মানুষের আশা আকাঙ্খার ছবি ফুটে ওঠেছে। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন আবহমান গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি।
বইয়ের শুরুর কবিতার নাম ‘আমি বাঙালি’। আমরা বাঙালি হিসেবে কেন গর্ব করবো এই কবিতায় সেটাই বলা হয়েছে। কবি বিশ্বের বুকে আমাদেরকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে স্বীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে বলেছেন। কবির ভাষায়-
‘আমি বাঙালি আমি বাঙালি
বলো বিশ্ব বিরল সিংহনাদে’
এরপর একে একে বাঙালির গর্বের বিষয়গুলো তুলে ধরে পরিশেষে বাংলা মায়ের কোলে ফিরে আসার কথা বলেছেন-
‘এসো সবুজ সোনায় আপনার এদেশ সাজাতে,
সারা বিশ্বের অন্ধকারে! বাঙালি প্রদীপ জ্বালাতে।
এসো হে বঙ্গাধিকারী বুকে হাত রেখে বলি,
আমি বাঙালি আমি বাঙালি আমি বাঙালি।’
‘মধ্যরাতের বৃষ্টি’ কবিতায় কবি পূর্ণিমা রাতে রাত জেগে গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্য দেখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ‘দুঃখিত তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি’ কবিতায় কবি ভালোবাসার স্বরূপ উন্মোচন করে তার প্রেয়সীকে ভালো না বাসতে পারার কারণ তুলে ধরেছেন। কবির ভাষায়-
‘ভালোবাসা হলো বহু যত্নে লালন পালন করা কিছু,
তিল তিল করে গড়ে তোলা কোন অনুভূতি,
ভালোবাসা মানে একটি চারাগাছ
বিরাট বৃক্ষে রূপান্তর করা।’
‘হে নারী’ কবিতায় কবি দৃঢ় কণ্ঠে নারীর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন। নারীর শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলী বর্ণনার পাশাপাশি নারীকে আহ্বান করেছেন নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে। কবির ভাষায়-
‘নারী তুমি জন্ম দাও ঘুমন্ত সেই কাঙ্খিত সভ্যতা
তুমি নও অবলা ঢেকো না পরাজয়-ব্যর্থতা
শোনো হে নারী শোনো
পুরুষের মতো এ জগতে নারীরাও মানুষ যেনো’
‘বাবা’ কবিতায় কবি জনকের প্রতি অকুণ্ঠচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কবি তার জনককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন প্রথম হাঁটতে শেখানোর জন্য, প্রথম অক্ষর লেখানোর জন্য, আলোর ভুবন দেখানোর জন্য, জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই কবি তার বাবাকে পৃথিবীর সেরা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
‘আরেকটু দুঃখ দাও তো’ কবিতাটা এক কথায় অসাধারণ। এমন একটা শিরোনাম দিয়ে যে আমাদের জনম দুঃখী বাংলা মায়ের আকুতি প্রকাশ করা সম্ভব সেটা আমার ধারণাতেও ছিলো না। এই কবিতায় বাংলা মা বলেছেন তার দুঃখের কাহিনি। দুঃখ পাওয়ায় যেন তার নিয়তি। কবির ভাষায়-
‘তুমি আরেকটু দুঃখ দিয়ে
জয় করো, জয়বাংলার জয়।’
‘বিষ্ণু হামিদ’ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কবিতা। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কবিকে খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছে তাই তিনি লিখেছেন-
‘এক সত্তার দুইটি খণ্ড করেছিল যেসব জানোয়ার,
মন বলেছে তাদের বুকে হরদম শুধু লাথি মার।’
‘শ্রমিকের মুক্তি’ কবিতায় কবি শ্রমিকের জীবনের দুঃখ গাঁথা তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজের তাদের অবমূল্যায়নের বিষয়টিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কবির ভাষায়-
‘জীবন চাকা ঘুরে চলেছে পায়নি পথের শেষ
ঘুরেফিরে শুধু পায়ের পাপোস এটাই বুঝি বেশ।’
‘একুশে নিবেদন’ কবিতায় কবি মাতৃভাষার দাবি আদায়ের কাহিনি চিত্রায়িত করেছেন। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন একুশের ভাষা শহীদদের। তাদের সাহসের প্রশংসা করতে গিয়ে কবি লিখেছেন-
‘হিম্মৎ কার কণ্ঠে তালা লাগে
মায়ের ভাষায় কথা বলায়?’
‘বাবুর দৃষ্টি’ কবিতায় কবি গরিবের প্রতি ধনীর দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টা তুলে ধরেছেন। কবির ভাষায়-
‘গেও মূর্খ কুলি মজুর এরা কি কখনো মানুষ?
আমার মতো বাবু দেখলে হয় টাকার নেশায় বেহুঁশ।
ধনীরা কখনো গরিবের ব্যথায় হয় না সমব্যথী
লক্ষ্য তাদের বিলাসিতা আর দৃষ্টি টাকার প্রতি।’
‘আমরাই ওদের দেশে বাস করি’ কবিতায় কবি বাংলাদেশের শ্রেণি বৈষম্যকে তুলে ধরেছেন। নগর এবং গ্রামের জীবনযাপনের যে বিস্তর ফারাক সেটাও বর্ণনা করেছেন। কবি বলেছেন গ্রামের মানুষেরাই যেন আসলে শহরের মানুষদের দেশে বাস করে। শহরের জীবনযাপনের চিত্র আঁকতে গিয়ে কবি লিখেছেন-
‘ওরা কথা বলে মিষ্টি করে কোকিলের মতো
ওরা হাসি দেয় পূর্ণিমার চাঁদের মতো’
আবার গ্রামের মানুষদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন-
‘আমরা কথা বললে মুখ থেকে দুর্গন্ধ বেরোয়
গা থেকে লাশ পঁচা ঘামের গন্ধ বিশ্রী করে তোলে
প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস।’
‘তোমরা করা’ কবিতায় কবি সেসব মানুষদেরকে তাদের শেকড় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন যারা জন্মভূমির সকল সুবিধাদি ভোগ করেও জন্মভূমিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। কবির ভাষায়-
‘এতো কিছু সত্ত্বেও তোমরা
অবহেলা অপমান করো
হেয় প্রতিপন্ন করো মাটি ও মাতৃভাষাকে,
রক্তে আনা স্বাধীনতাকে।’
এরপর কবি নিজেই সেসব মানুষদের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে-
‘তোমরা দেশবিরোধী
তোমরা ভাষাবিরোধী তোমরা স্বাধীনতার বিপক্ষের লোক।’
যে কবিতার নামে বইটির নামকরণ সেটার বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় কবি বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান গরিবদের প্রতি ধনীদের যে অবজ্ঞা তার চিত্রই তুলে ধরেছেন। ধনীরা কখনওই গরিবদের ক্ষুধা নিবারণ করতে আসেনি বরং বারবার তাদেরকে পুঁজি করে সম্পদের অঢেল পাহাড় গড়েছে। এমনকি স্বয়ং বিধাতাও যেন গরিবদের অবহেলা করেন, দূরে ঠেলে দেন। কবির ভাষায়-
‘যুগ যুগ ধরে আমারি মতো ডাকিলেন কতজন
ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে পাশে আসেনি তো মহাজন।
আরাকান বা ফিলিস্তিনি বা আফ্রিকান,
শত শত বছর ডাকছে তারা আসেনি মেহেরবান।’
ধনী গরিবের এই ব্যবধান যেন পৃথিবীর চিরায়ত সত্য। বংশ পরম্পরায় মানুষ ধনী আবার বংশ পরম্পরায় মানুষ গরিব। এই অলিখিত নিয়মই যেন চলে আসছে সৃষ্টির আদি থেকে। কিন্তু কবি ধনীদেরকে মালিক জ্ঞান না করার দৃঢ় প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন একইসাথে। কবির ভাষায়-
‘নবীর বংশে নবী হয়েছে রাজার ছেলে রাজা,
আমরা ঠিকই আগের মতো আছি হেয় হীন প্রজা।
গরিবের বিদ্বেষ মিথ্যা করো জ্ঞান মাঝে থাকা প্রভু?
ভুলেও যেনো তোমাকে মালিক মিথ্যা বলি না কভু।’
কবি ও কবিতায় কবি তার কবি হয়ে ওঠার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন। কবির ভাষায় সৃষ্টির সবকিছুর মধ্যে কবি ও কবিতার অস্তিত্ব আছে। কবিরাই পারেন যুগের অচলতা দূর করতে। কবির ভাষায়-
‘পৃথিবীর যত প্রাণী আছে সকলেই হলেন কবি,
কেউ কবির কবি বা মৌলিক কবি, বিশ্বে কবি সবই।
যুগে যুগে যুগ পরিবর্তন, করেছে কবিগণ,
যুগোপযোগী ভাব যা আছে, কবিতার সৃজন।’
এভাবে প্রত্যেকটা কবিতা নিয়েই আলাদাভাবে আলোচনা করা যায়। পাঠক তারই বই পড়লে গ্রামের এক মুঠো শান্ত স্নিগ্দ্ধ বাতাসের পরশ পাবেন সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর কবিতার ভাষা খুবই সহজবোধ্য তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তবে শব্দের ব্যবহার নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের গুলজার হোসেন কবি নজরুলের মতো বিদ্রোহী শব্দগুলোই বেছে নিয়েছেন যাতে পাঠকের মস্তিষ্কে আলোড়ন তৈরি হয়, হৃদয় হয় কম্পিত। গুলজার হোসেনের জীবনযাপন এবং সেখান থেকে কবি হয়ে ওঠার গল্প এখন কমবেশি সবারই জানা। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে গুলজার হোসেন যেন আমাদের সময়ের দুখু মিঞা।
এমআরএম/এমএস