ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

কবি ও কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব

আবু আফজাল সালেহ | প্রকাশিত: ০৪:০৭ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২১

কবিতার যথার্থ সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কবিতার রহস্য এখানেই। আর রহস্য থাকাতেই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘কোনো কবিকে এ ধরনের প্রশ্ন করা অনেকটা কোনো মহিলাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করার মতো।’ কবিতা সম্পর্কে বলতে গেলে ভিন্ন ভিন্ন কবির ভিন্ন মতামত পাওয়া যাবে। একজন সুন্দর রমণীকে কবিতা হিসেবে বলতে পছন্দ করি। অর্থাৎ শ্রেষ্ট যা কিছু তাকেই আমরা কবিতা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি; গর্ববোধও করি। কবিতার এখানেই সার্থকতা, এখানেই শ্রেষ্ঠত্ব। কবিতার নির্মাতারা সে কারণেই সেরা হিসেবেই সর্বত্র বিবেচিত হন।

কবিতা পাঠে আনন্দ পাই। শুরু হয় আনন্দ দিয়ে। কবিতা পাঠ শেষ হলে একটি বার্তা পাই, তাতে আমরা প্রজ্ঞাবান হতে পারি। রবার্ট ফ্রস্টের মতে, কবিতা হচ্ছে Begins in delight and ends in wisdom। আমরা জানি, গাঁথুনি-চিত্রকল্প মিলেই চমৎকার কাব্যশৈলী সৃষ্টি হয়। রচনার উৎকর্ষতার জন্য অলংকার প্রয়োগের যৌক্তিকতা অনেক বেশি। ভালো সাহিত্যের প্রধান গুণ হচ্ছে পাঠককে লেখকের কাছে নিয়ে যাওয়া। তাই তথাকথিত দুর্বোধ্যতা ছেড়ে খুব সাধারণ কথার ছন্দে কবিতা রচনা করলে পাঠকের মন জয় করা সম্ভব হবে। রচনার মহত্ব ও ঐশ্বর্যমহিমা বা প্রভাবিত ক্ষমতা তৈরি করতে রূপকল্পনা কার্যকরী পদক্ষেপ। এটি একটি মানসিক ধারণা। আধুনিক কবিতায় রূপকল্প অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ। তাই কবিতায় কল্পনার পাখা জুড়ে দিতে হবে। কল্পনা যতদূর বিস্তৃত হবে; ততদূরই কবিতার সার্থকতা। পি বি শেলী বলেন, ‘poetry is the expressions of the imagination.’ (A defence of poetry)

শব্দের খেলা হচ্ছে কবিতা। কবিতায় শব্দের প্রকৃত অর্থ থেকে ভিন্ন হলে কবিতার আরও মান বাড়ে। পাঠক যদি পড়ে বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য ভাবে, সেখানেই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব। ভিন্ন ভিন্ন পাঠক কবিতার অর্থ যত ভিন্ন খুঁজবে; ততই ভালো হবে। কবিতার এ রহস্য কবিতাকে সার্থক করে তুলবে। শব্দের প্রয়োগেই কবিতার সার্থকতা নিহীত। জুতসই শব্দ নির্বাচন, উপমা ও অলংকার নির্মাণ, রূপতত্ত্ব, রসাস্বাদন, ছন্দ প্রভৃতি কবিতার পার্থক্য তৈরি করে। এগুলোর প্রয়োগে যতটা মুন্সিয়ানা দেখানো যাবে, কবিতা ততটাই ভালো ও সার্থক হবে। বাক্যের স্বাভাবিক পরম্পরা এড়িয়ে শব্দ ও ধারণার ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। কবিরা শুধু কল্পনাকেই প্রকাশ করতে পারেন না, তারা ‘সিভিল সোসাইটি’কেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে যান কবি। এ গুণই অন্যসব পেশা-শ্রেণি থেকে মহিমান্বিত করে।

কবিতা সৃজনশীল। কবিতা অবলম্বন করে অল্প কথায় বিরাট ব্যাখ্যা করা যায়। কবিতা ব্যতিত অল্প কথায় বড় ব্যাখ্যা খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়। একটি কার্টুন বা চিত্র অনেক সময় বড় মেসেজ দেয়। কিন্তু কবিতার চেয়ে সেটিও কোনো ক্ষেত্রে বেশি পাতাজুড়ে হয়। কোনো ক্ষেত্রে একটি বোমার চেয়েও কবিতাংশ বেশি কার্যকর। আমাদেরসহ বিভিন্ন জাতির সংগ্রাম ও দাবি আদায়ে কবিতাংশ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী বলেও প্রমাণিত। কবি পথ দেখান। সব শ্রেণি-পেশাকেই। প্রায় সব সমাজে কবি ও কবিতাকে সমীহ করা হয়। কবিকে সময় সচেতন হতে হবে। সময়কে এড়িয়ে ক্লাসিক বা কালজয়ী কবি হওয়া যায় না। যারা সমকালীন সময়কে এড়িয়ে যান; তারা টিকে থাকতে পারেন না! অনেকে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা আনতে পারেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ সরাসরি আসেনি, তবে তাঁর ‘মহা পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় মহাবিশ্বের ঘটনা, বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পরোক্ষভাবে এসেছে।

প্রাচীনযুগে কবিতার প্রচলন ছিল। চর্যাপদ কবিতা। বাংলা গদ্যের প্রচলন আধুনিক যুগে। আগের যুগে কবিকুলের স্থান ছিল রাজসভা। রচনা করতেন মহাকাব্য, পুঁথি, মর্সিয়া। এসব গীত হতো জনতার মাঝখানে, মুখে মুখে। কিন্তু বেশিরভাগ সামন্তীয় শাসকই ছিলেন দখলদার, দস্যু, অত্যাচারী প্রকৃতির। ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক চেঙ্গিস খান। অমরত্ব পাওয়ার আশায় পাশবিক এ শাসক শেষ জীবনে পাগল হয়েছিলেন। অবশেষে তিনি চৈনিক ঋষি, মহাস্থবির কবি চাং চুংকে তার দরবারে এনে অনেক লোভ দেখিয়ে জানতে চান অমরত্ব পাওয়ার উপায়। আগের দিনের রাজা-বাদশাগণ অসহায়ত্বের সময় শেষপর্যন্ত কবির কাছেই ফিরে যেতেন। কঠিন পরিস্থিতিতে এখনও তাই। প্রচার ও খ্যাতি লাভের আশায় কবিতা লেখা যায় না। এরূপ হলে তিনি টিকে থাকতে পারেন না! কবিতা লেখার কাজ নয়। কবিতা অবলীলায় হয়ে ওঠে। এরপর কষ্টিপাথরে মেপে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেন পাঠকসমাজ। প্রকৃত কবি ইতিহাসে স্থান চান না, তিনি ইতিহাস তৈরি করেন। সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতা সর্বাপেক্ষা পরিশীলিত। সৎ কবি কখনোই অতিকথনে বিশ্বাসী নন।

ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। অথচ পাঠক যদি সেগুলো বুঝতে পারে বা গভীরে প্রবেশ করার আগ্রহ থাকে, তবে সেই কবিতা সার্থক। প্রতীক বা উপমা ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যকে পাঠককে অনুধাবন করাতে পারাই ভালো কবিতার লক্ষণ। আবার অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে অর্থহীন করে তুলতে পারে। ভারসাম্য বজায় রেখে কবিতা-রচনা করতে পারায় কবির সার্থকতা লুকিয়ে আছে। বিশেষ ধারা বা প্যাটার্ন কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। কবির স্বর বা ফর্মে ভিন্নতা আনতে না পারলে টিকে থাকা সম্ভব নয়। যদি কবির নামবিহীন কবিতা পড়ে কবির নাম বলতে পারেন, তখনই বুঝতে হবে সেই কবির স্বর বা ফর্মে ভিন্নতা বা নতুনত্ব আছে। অতি সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, কবিতা বা সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া। পাঠক আনন্দের পাশাপাশি প্রজ্ঞাবান হবেন। সাহিত্যের উৎকর্ষতার ওপর নির্ভর করে পাঠককে লেখকের কাছে কতদূর টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম। হুট করে বললেই কবিতা লেখা সম্ভব নয়। কবিতা বা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে অনেক কিছু ভাবতে হয়, অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়। আবার কিছু গুণাগুণ আবার সহজাত। অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে কৌশলের অবলম্বন করা হয়, এটি অবশ্য গৌন বিষয়। লিখতে লিখতে, অভিজ্ঞতার পরম্পরায় ও প্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে আপনা-আপনি কবিতা ও সাহিত্য ধরা দেয়। তাই বলা হয়ে থাকে, কবিতাকে লেখা যায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।

ফিট ফর দ্য ফিটেস্ট- ডারউইনের এ তত্ত্ব হচ্ছে টিকে থাকার যোগ্যতা। সব ধরনের প্রাণির জন্যই পৃথিবী প্রতিকূল। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে হলে যোগ্যতররা টিকে থাকবে। যোগ্যতমের জয় হবে। কবিদের ক্ষেত্রেও তাই। প্রতিকূলতাকে সরাসরি অথবা কৌশলে পরিহার করে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারাকে যোগ্যতা বলে। কবিতার ভাষা ও স্বর যত শক্তিশালী হবে; কবিতা ততই শক্তিশালী ও হৃদয়গ্রাহী হবে। চয়ন, ব্যবহার, অলংকার প্রয়োগে কবি কবিতায় উৎকর্ষতা আনয়ন করেন। সব অমানবিক অত্যাচার ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কবিতাই একমাত্র সোচ্চার--সেটি কবির মুখে, সংগ্রামীর মুখে বা পাঠকের মুখেই হোক না কেন! কবিতাকে যারা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন; তারা আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

কবিতা আজও বেঁচে আছে; বেঁচে থাকবে অনাদিকাল। যেভাবে অনেকের কবিতা এখনও বেঁচে আছে নির্বিঘ্নে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

সহায়কসূত্র
১. An appology for poetry by Sir Philip Sidney
২. On the sublime by Longinus
৩. লঙ্গিনাসের সাহিত্য-তত্ত্ব: বদিউর রহমান।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন