মায়াবতী: পর্ব ১৬
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
যূথী বসেছে রিয়ার মুখোমুখি।
আপা! বলেই চুপ হয়ে থাকে।
বলো। থেমে আছো কেন?
তোমাদের রেজা মামা কেমন?
কেন, এ প্রশ্ন করছ কেন?
মামা নিয়ে আমার ভীতি আছে।
ভীতি! কেন, মামাকে ভয় পাবে কেন?
আছে। কারণ আছে। আগে বলো, তোমাকে সব কথা বলা যাবে?
হ্যাঁ, যাবে।
কনফিডেন্টলি বলা যাবে? যূথী আবারও জানতে চায়।
একশ ভাগ কনফিডেন্টলি বলতে পারো। তার আগে বলো, আমাকে বলতে চাইছ কেন?
জানি না। মনে হয়েছে তোমাকেই শেয়ার করা দরকার কথাটা।
কেন এমন মনে হলো?
তোমার সঙ্গে আমার একটা মিল আছে।
কী মিল?
কষ্টের মিল।
কষ্ট?
হ্যাঁ। কষ্ট, ভীষণ কষ্ট। তুমিও একটা কষ্টে আছো, ঠিক না?
রিয়া জবাব দিলো না। যূথীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কষ্টের কথা বলো।
যূথী মলিনমুখে বলল, আমি একজনকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা তো অপরাধ না। ভালোবাসা হতেই পারে। তোমার-আমার বয়সটাই তো ভালোবাসার।
তার সঙ্গে আমার সেক্স হয়েছে। জড়তাহীন স্বীকারোক্তি।
এই স্বীকারোক্তির ব্যাখ্যা জানা নেই। কী বলবে রিয়া বুঝতে পারল না। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা নেই। তবে জানে সে, বিপরীত সেক্সের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। দোষের কিছু না। রিয়া হোঁচট খেল স্বীকারোক্তি শুনে। তারপরও প্রশ্ন করল, জোর করে হয়েছে, নাকি নিজের ইচ্ছায়?
নিজের ইচ্ছায়।
তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? আঠারো পেরোলে ‘নিজের ইচ্ছায় সেক্স হলো অ্যাফার্মেশন অ্যান্ড মিনিংফুল রিলেশনশিপ’―একটি বৈজ্ঞানিক আলোচনায় শুনেছিলাম কথাটা। তাছাড়া তুমি তো তোমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সেক্স করেছ।
কিন্তু আপা, বয়ফ্রেন্ডটা হচ্ছে আমার মামা।
ঝম করে যেন গেস্টরুমের ঝাড়বাতি সশব্দে ফেটে গেছে। ঝিমঝিম করে ওঠে রিয়ার মাথা। দেহে একটা ঘূর্ণি টের পেল ও, মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না আর। একটু সময় নেয়। তারপর শান্তকণ্ঠে বলে, কী ধরনের মামা?
আপন মামা। আবারও সহজ স্বীকারোক্তি।
ইজ ইট পসিবল? রিয়া রিঅ্যাকশন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রশ্ন করে বসল।
পসিবল। মামাই আমার বয়ফ্রেন্ড। মামাকেই আমি ভালোবাসি।
বলো কী?
সত্যি বলছি।
বাঁধন জানে?
না। আর কেউ জানে না। আমি তোমাকেই বললাম প্রথম।
তুমি বললে মামা নিয়ে ভীতি আছে। এখন বলছ, মামাকে ভালোবাসো। কোনটা সত্যি?
দুটোই সত্যি।
মামার সঙ্গে রিলেশন তো অনৈতিক।
জানি। এজন্যই ভীতি।
তবে সরে আসছ না কেন?
সরতে পারছি না। তীব্রভাবে আকর্ষিত হয় দেহমন। যখন উনি কাছে আসেন, মনে হয় উনি মামা নন। মনে হয়, এক সফল পুরুষ।
সফল পুরুষ?
হ্যাঁ। উনি ইতালি থাকেন।
তাহলে দেখা হয় কীভাবে? রিলেশন হলো কীভাবে?
আমার জন্য ছুটে আসেন। বছরে এক-দুই মাস থেকে চলে যান। গল্প করতে করতে কীভাবে যেন রিলেশন হয়ে গেল।
বলো কী!
সত্যি বলছি।
তুমি কি সরে আসতে চাও?
চাই। আবার চাই না। পারি না সরে আসতে।
হেল্প চাও কারোর। কোনো মনোচিকিৎসকের?
চাই। এজন্য বিষয়গুলো তোমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা হয়েছে। শুনেছি তুমি হেল্প নিয়েছ।
হ্যাঁ। নিয়েছি।
ভালো আছো?
ভালো থাকার চেষ্টা করি। ভালো আছি।
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সেক্সের কথা বলেছিলে। তোমাকে কি সন্ত্রাসীরা ইচ্ছার বিরুদ্ধে রেপ করেছিল?
যূথীর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেল রিয়া। চারপাশের মানুষ কি তবে অতদূর পর্যন্ত চিন্তা করছে? মাথা জ্যাম হয়ে গেল। তবু রিয়া শান্ত থেকে বলল, না। রেপ করেনি। ওরা ছিল ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ওরা আব্বুর কাছ থেকে টাকা পেতে চেয়েছিল। আটকে রেখে নয়, ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল।
ন্যুড ছবি তুলেছিল?
যূথী কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে বসছে। নিজের একান্ত কথা উজাড় করে বলে একদম ইজি হয়ে গেছে সে। একদম সহজ হয়ে গেছে। তাই সরাসরি প্রশ্ন করছে। করতে পারছে।
রিয়াও উত্তেজিত হচ্ছে না। অসংযত হচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে টলে উঠছে ও। নড়ে উঠছে। তবুও স্বাভাবিক স্বরে বলল, না। পুরো ন্যুড না। উপরের অংশের ছবি তুলেছে।
পুরো ন্যুড না। আধাআধি ন্যুড। এটাও তো ভয়ের ব্যাপার। ভয় সামাল দিচ্ছ কীভাবে? যূথী জানতে চায়।
পাত্তা দিচ্ছি না ভয়কে।
পাত্তা দিচ্ছ না মানে কী? ওরা যদি ছবিগুলো অনলাইনে ছেড়ে দেয়?
দিলে দেবে। এ নিয়ে ভয় পাই না। ভয় পাই আব্বুকে নিয়ে। আম্মুকে নিয়ে। উনারা জানলে তো হার্টফেল করবে।
উনারা জানেন না?
না। জানে না। রেজা মামা, ফারুক মামা, উনারা সামাল দিচ্ছেন।
ফারুক মামাটা কে?
রেজা মামার বন্ধু। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার।
ও! তুমি তো ওদের সাপোর্ট পাচ্ছ।
হ্যাঁ, পাচ্ছি।
আমি কার সাপোর্ট পেতে পারি?
তুমি আমার সাপোর্ট পাবে। তোমাকে একজন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। যাবে?
যাব।
ভয় পেয়ো না। তোমার মনের আবেগ নিয়ন্ত্রণ হলেই সমস্যা শেষ। আমার সমস্যা তো ব্যাপক। সোশ্যাল প্রবলেম হতে পারে।
আমার সমস্যাও জটিলতার বাইরে না।
কীরকম জটিলতা?
মনে হয়, মামণি কিছু টের পেয়েছে।
কীভাবে মনে হলো?
মামা দেশে এলে মামণি অস্থির হয়ে যান। ঘুমাতে পারেন না সারারাত। কেমন যেন করেন। পুরো অস্বাভাবিক। আবার মামা চলে গেলে খুশি হন। একদম স্বাভাবিক হয়ে যান। মামণির আচরণ দেখে সন্দেহ হয়, মনে হয় উনি আঁচ করেছেন কিছুটা।
ও! তাহলে তো বিপদ। তোমাকে আরও সংযত হতে হবে। সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।
সংযত হতে পারছি না। ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারছি না। ভেবে রেখেছি, নিজেকে শোধরাতে না পারলে ইতালি চলে যাব।
না। ঠিক হবে না। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাবে। এমন ভাবনা শাসনে রাখো। দূরে রাখো।
রিয়া নিজের কথা ভুলে গেল। যূথীর সমস্যা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল। ইতালি গেলে মেয়েটা একদম শেষ হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবে―ওকে ফেরাতে হবে। ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। মুখ ফুটে বলল, আমি তোমার পাশে আছি। ইউ আর মাই জুনিয়র ফ্রেন্ড। ওকে?
যূথী খুশি হয়। হালকা হয়। ভেতরের রুদ্ধ আবেগের ঘোর থেকে মুক্ত হয়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো এই মুহূর্তে নিজেকে আকাশে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। খুশিতে ও জড়িয়ে ধরল রিয়াকে।
এ সময় বসার ঘরে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে। হইচই শোনা যাচ্ছে।
মম এসেছে। বিন্দু এসেছে। ওদের পেয়ে সবার মাঝে বাঁধভাঙা আনন্দজোয়ার আসে।
রিয়া ও যূথী গেস্টরুম থেকে বের হয়ে এলো বসার ঘরে।
তারাও আনন্দযজ্ঞে শরিক হয়ে গেল।
বোঝার উপায় নেই, একটু আগে দুজন ঘুরে এসেছে জীবনের অচিন্ত্যনীয়, অবিশ্বাস্য রিক্ততা এবং তিক্ততায় ভরা অধ্যায়ের ওপর দিয়ে।
চলবে...
এসইউ/এমএস