ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ১৫

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০২:২৮ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

গাড়ি এসে নন্দনের সামনে দাঁড়াল। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে চলে যাবে ড্রাইভার। ওদের নামানোর জন্য দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এখানেও ভিড়। অল্প সময়ের জন্য সামনে দাঁড়ালেন বয়স্ক এক গার্ড; দরজার হ্যান্ডেল ধরে টান দিলেন তিনি।
দিয়েই উহ্ করে হাত সরিয়ে নিলেন। ভাঙা হ্যান্ডেলে হাতের চামড়া ছিড়ে গেছে। গার্ডের আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।
রিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। খারাপ মন নিয়ে নন্দনের মূল ফটকের সামনে দাঁড়াল ওরা। শাঁ করে স্লাইডিং গ্লাসের পাটাতন খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাল ওরা। বাঁধনকে দেখা যাচ্ছে না।
কুসুম বলল, চল রূপ প্রসাধনী ব্লকের দিকে যাই।
ওইখানে থাকবে বলেছে?
না। স্পেসিফাই করেনি! তবে ধরে নিচ্ছি, ওইখানেই বাঁধন কাটাবে বেশি সময়। রূপবতী বাঁধনের শখই হলো রূপসামগ্রী কেনা।
রিয়া খুব কনফিডেন্টলি বলল, আরে না। ও এসেছে দুবাই থেকে। ব্যাগভর্তি করে নিশ্চয়ই সব নিয়ে এসেছে।
বলতে বলতে এগোতে লাগল রিয়া। কুসুমও।

প্রসাধনসামগ্রী ব্লকে খুব ভিড়। অনেক রূপবতীর ভিড়।
বাঁধনকে দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে চোখ ঘোরাচ্ছে ওরা।
আচমকা রিয়াকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল বাঁধন। টুক করে ওর গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো। হকচকিয়ে রিয়া মুহূর্তেই ঝলসে উঠে বাঁধনকে জড়িয়ে ধরল।
উল্লাসের মাঝেও গলার স্বর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হচ্ছে। ভদ্র পরিবেশে উল্লাস প্রকাশ করা অশোভন। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে সহজ হয়ে গেল সবাই।
কুসুম বলল, বাঁধন আমারটা কই?
তোরটা কই, মানে?
মানে ওই যে, রিয়াকে দিলি। আমাকে দিবি না?
চুুমু?
হ্যাঁ। বলেই নিয়ন্ত্রিত হাসিতে বাঁধনের হাত ধরল কুসুম। উল্লাস কোনোমতেই থামতে চায় না।
রিয়া বলল, বাঁধন আমরা তোর নতুন নাম দিয়েছি। জানিস?
না তো। কী নাম?
চুমুবতী। রূপবতী বাঁধনের নাম চুমুবতী।
আবারও হাসিতে উথলে ওঠে বাঁধন। আবারও নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে।
যেভাবে মমকে চুমু খেলি, যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করলি, ওটা ছিল পুরো প্রতিযোগিতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য। আমি মনে মনে তখন তোর নাম দিয়েছিলাম আনন্দবতী।
বাঃ! দুটো নতুন নাম উপহার পেলাম। চুমুবতী। আনন্দবতী। খুব মজার ব্যাপার তো! থ্যাঙ্কস দোস্ত। তোরাও তো আনন্দবতী। আমার আনন্দকে তোরা নিজের আনন্দ করে নিয়েছিস। এটাই তো আমার বড় পাওয়া।
আরে। এত ফর্মাল হচ্ছিস কেন। ধন্যবাদের কী হলো?
না। কিছু না। আয় ওইদিকে যাই। ওখানে আমার কাজিন আছে। চট্টগ্রাম থেকে এসেছে। ওকে কেনাকাটায় হেল্প করছি। আয়। বলতে বলতে দুজনকে নিয়ে এলো সামনের ডেস্কের বাঁ পাশে।

বাঁধন পরিচয় করিয়ে দিলো, এ হচ্ছে যূথী। আমার ছোটো কাজিন। আর এরা হচ্ছে রিয়া এবং কুসুমকলি―দুজনই আমার দোস্ত।
যূথী উচ্ছসিত হয়ে বলে ওঠে, আপনি রিয়া! আপনার অনেক গল্প শুনেছি!
দপ করে নিভে গেল রিয়া। ‘গল্প’ শব্দটা আচমকা শট্সার্কিট ঘটিয়ে দিলো। মনের ভেতরে আলোড়িত উল্লাস মুহূর্তের মধ্যে হোঁচট খেল। কুসুমকলি বুঝতে পারল সব। রিয়ার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাঁধন টের পেল না গোপন পরিবর্তন। যূথীর মুগ্ধচোখের চাউনিও টের পেল না কিছুই।
যূথী থেমে থাকল না। আর একধাপ এগিয়ে গিয়ে রিয়ার হাত ধরে বলল, আসুন আপা, আপনিও আসুন। আমি কিছু কসমেটিক্স কিনব। আমাকে চয়েস করে দিন।
যূথী কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ‘গল্প’ শব্দটি ব্যবহার করেনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সহজাত ভঙ্গিতে বলেছে কথাটা। এ কারণেই জড়তাহীন সে, প্রাণবন্ত। বুঝেও রিয়ার মন ছোটো হয়ে গেছে।
অনেক বিউটি প্রোডাক্টস সামনে জড়ো করেছে যূথী। ল্যাকমে-৩, সানব্লক, ময়েশ্চারাইজার লোশন, ল্যাকমের নেইলপলিশ, কাজল, আইশ্যাডো, ব্লাসন, ফেস পাউডার এবং তৈলাক্ত ত্বকের জন্য ল্যাকমের নতুন প্রোডাক্ট ম্যাট পারফেক্ট। এছাড়াও হাতের কাছে জড়ো করেছে এভার ইয়ুথের ফেসওয়াশ এবং প্যানটিন হেয়ার ফল কন্ট্রোল শ্যাম্পু।
যূথী গুরুত্ব দিলো রিয়াকে। আপা তুমি বলো। তুমিই চয়েস করে দাও।
রিয়া নিভে গেলেও অন্ধকারে ডুবে যায়নি। যূথীর উচ্ছাসের আলোয় আবার গতি ফিরে পেতে থাকে। স্বাভাবিক স্বরে বলল, তুমি ল্যাকমের রূপসামগ্রী জড়ো করেছ। ইউনিলিভার বাংলাদেশে এসব পণ্য আমদানি করেছে। ওদের অসংখ্য প্রোডাক্টের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় প্রোডাক্টগুলো তুমি বাছাই করেছ। আর ম্যাট পারফেক্ট তো সবাই কিনছে।
তাহলে কি সব নিতে পারি? যূথী আবার প্রশ্ন করল।
বাঁধন তুই বল। তুই তো রূপবিশেষজ্ঞ হয়ে গেছিস। তুই সিলেক্ট করে দে। রিয়া দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চায় বাঁধনের কাঁধে।
না। না। তোরা সিলেক্ট কর। আমি হচ্ছি ওর ঘরের মানুষ। ঘরের মানুষের মতামতের চেয়ে তোদের মতামতের গুরুত্ব বেশি। কী বলো, যূথী?
যূথী কাউকে ছাড়তে চায় না। ও চট করে জবাব দেয়, না। না। তোমার মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। এক কাজ করো, তোমরা সবাই মিলে ঠিক করে দাও। কুসুমকলির হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলল, তুমি কথা বলছ না কেন? তোমার পছন্দ হয়নি?
কুসুমকলি ওর গাল টিপে দিল বলল, তোমার চয়েস দেখে তো আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। এভার ইয়ুথের ফেসওয়াশটা বেশ জনপ্রিয়। প্যানটিন শ্যাম্পু পপুলার, কন্ডিশনার বেশ মানসম্মত, আমাদের আবহাওয়ার উপযোগী বলে জানিয়েছেন রূপবিশেষজ্ঞরা।
সব নিতে চাই। নেব? যূথী আবারও সোল্লাসে প্রশ্ন করে।
নাও সব নিয়ে নাও। বাঁধন উৎসাহ দেয় যূথীকে।
সঙ্গে সঙ্গে যূথী অভিমান করে বলে, তা তো নিতে বলবে। দুবাই জয় করে এলে। আমার জন্য কিছুই আনলে না।
বাঁধন ওর আক্রমণে ভেঙে পড়ল না। নিভে গেল না। হেসে হেসে রিয়া আর কুসুমের উদ্দেশে বলল, আর বলিস না। আমার লাগেজ উধাও হয়ে গেছে। মিসিং। এয়ারপোর্টে কী দুরবস্থা। অবশ্য লাগেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভুল করে দিল্লি চলে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে লাগেজ পাব আশা করছি।
থাক। আমাদের যুক্তি দিতে হবে না। বোঝাতে হবে না। এখন যূথীর বিল তুই দে। ছোটো বোনের জন্য কিছু আনতে পারলি না, যুক্তি দিয়ে তা খণ্ডন করা উচিত না।
বাঁধন বলল, বিল আমিই দিচ্ছি। ধরে নিলাম প্রোডাক্টগুলো সবার পছন্দ হয়েছে, কী বলিস তোরা?
সবাই হেসে ওঠে।
হাসার অর্থ হচ্ছে অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।
তুই বিল দিলে পছন্দ আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। বলল কুসুম।
সবাই আবারও হো-হো করে হেসে ওঠে।

সবাইকে নিয়ে নন্দনের ভেতর থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল বাঁধন। বাঁধনের পরনের কালো জিন্সপ্যান্ট, কালো ড্রেস এবং কালো স্লিভলেস গেঞ্জি। গেঞ্জিটির লেন্থ ছুঁয়ে আছে কোমরের বেল্ট।
চওড়া বেল্টের রং সাদা। তার মাঝে মারবেলের মতো বসানো কালো গোলাকার বৃত্ত। কাজলটানা চোখ, গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগানো বাঁধনের আউটলুক হাইফাই। একটু এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে এলো বাঁধন। রিয়া ও কুসুমকে উদ্দেশ করে বলল, নতুন গাড়ি গিফ্ট পেয়েছি। আব্বু গাড়িটা গিফ্ট দিয়েছে, টয়োটা ক্যামরি। চল আমার গাড়িতে চল। ফ্রেন্ডদের মধ্যে তোদের নিয়ে প্রথম সেলিব্রেট করি।
কুসুম জানে, নতুন প্রজন্মের টপ সোসাইটির ইয়াংদের টপ ক্রেজ হচ্ছে টয়োটা ক্যামরি। গাড়ির স্পোর্ট লুক, ক্রুজ কন্ট্রোল বৈশিষ্ট্য ক্যামরিকে পরিণত করেছে তারুণ্যের উন্মাদনায়। রিয়াকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কুসুম বাঁধনকে বলে ফেলল, চল ক্যামরিতে চড়েই যাই।
বাঁধন খুশি হয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। মুঠোফোনে কল পাঠাল ড্রাইভারকে। মুঠোফোনের দিকেই তাকিয়ে হাঁটছিল সে। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেল। উদোম বাহুতে একটা গুঁতো খেয়ে চোখ তুলে দেখে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক ইয়াং চ্যাপ।
মুহূর্তের ডিসিশনে বাঁধন ছুটে গেল যুবকটির সামনে। ক্ষুব্ধচোখে তাকিয়ে বলল, দাঁড়ান।
কুসুম, রিয়া ও যূথী দেখতে পেয়েছে দৃশ্যটা। ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধনকে গুঁতো দিয়েছে বজ্জাত ছেলেটা। রিয়াও চট করে ছুটে গিয়ে বাঁধনের পাশে এসে রুখে দাঁড়াল। কুসুম ও যূথীও ছুটে এসে দাঁড়াল পাশে।
আচমকা অ্যাটাকে ভড়কে গেল যুবক। কোনো জবাব না দিয়ে ছুট দেয়। একদৌড়ে রাস্তায় নেমে যায় সে। রাস্তায় আরও কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের সঙ্গে ভিড়ে যায়। নন্দনের গার্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
ফুঁসতে থাকে বাঁধন। হারামজাদা বলে স্বগতোক্তি উগলে আসে।
মেয়ে দেখলেই গায়ে হাত দিতে ইচ্ছা হয়। শুয়োর! রিয়ার মুখ থেকেও স্বগতোক্তি বেরিয়ে আসে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটে গেছে বিশ্রী ঘটনাটা।
বাঁধন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। রিয়া, কুসুম, যূথীও শান্ত হয়। ওদের মুখে কথা নাই। সবাই চুপ। স্তব্ধ।

এ সময় টয়োটা ক্যামরি এসে সামনের লবিতে দাঁড়াল।
বাঁধন বলল, সবাই গাড়িতে ওঠ। পেছনের সিটে ওঠ। আমি সামনে বসছি।
কুসুম বলল, রিয়া তোর ড্রাইভারকে ফোনে বলে দে, বাঁধনদের বাসায় আসতে।
রিয়া নিজেদের ড্রাইভারকে মেসেজ পাঠিয়ে সবাইকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। কারও মুখে কথা নেই।
গাড়িতে বসে মুগ্ধ হয়ে গেল কুসুম। তারুণ্যের প্রতীক ২৪০০ সিসি ভিভিটিআই ইঞ্জিনের ক্যামরিতে আছে ডুয়্যাল এসআরএস এয়ার ব্যাগ, ক্যাটা লাইটিক কনভার্টার, পাওয়ার স্টিয়ারিং, অ্যান্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম, মুন রুফ, অ্যালার্মসহ অ্যান্টি থেফট সিস্টেম।
এসব বৈশিষ্ট্যের কথা একটা প্লেটে লেখা আছে। পেতলের প্লেটটা লাগানো আছে ড্রাইভারের সিটের পেছনে। কুসুম লেখাগুলো পড়ে সবার মুখের দিকে তাকাল। কারোর মুখে হাসি নেই। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশে থমথমে মুখ নিয়ে সবাই বিমূঢ় হয়ে আছে।
কুসুমকলি নীরবতা ভাঙে, এত বিমর্ষ হওয়ার কিছু নেই। ইভটিজিং করেছে ওই বজ্জাতটা। এটাই ওর বৈশিষ্ট্য। এটাই ওর দোষ। কুরুচিপূর্ণ আচরণের জন্য বখাটেটাই দায়ী। ওর আচরণে আমরা কেন আহত হব? সবাই কথা বলো। চুপ করে আছো কেন?
যূথী বলে, সত্যিই তো। চুপ থাকলে আমাদের পরাজয়।
রিয়া বলল, মোটেই আমাদের পরাজয় না। দেখলে না ছেলেটা কীভাবে বিড়ালের মতো পালিয়ে গেল!
বাঁধন বলল, এটাই তো প্রথম না। যেখানে যাই, এমন পরিস্থিতির ফেস করতে হয়। তবে খোলা জায়গায় এমনটা সাধারণত ঘটে না। ভিড়ের মধ্যে এমন বীভৎসতা ঘটে। রুচিপূর্ণ শপিং সেন্টারে এমনটা আশা করা যায় না। বাঁধনের মুখ থেকে বিস্ময়, হতাশা ও ক্রোধ ঝরে পড়ে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
কুসুমকলি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। গাড়ির দিকে রিয়ার মনোযোগ টানার জন্য বলল, দেখ রিয়া, কী অসাধারণ গাড়ি!
গাড়ির প্রতি রিয়ারও ঝোঁক আছে। নতুন মডেল এলেই খুঁটিয়ে দেখে সে। খোঁজ নেয়। তবে নতুন মডেল পেতেই হবে, এমন কোনো ক্রেজ নেই। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রিয়া দেখছে গাড়ির ভেতরের লুক।
কুসুম বলল, বাঁধন এখানে একটা নতুন টার্ম লেখা আছে, ক্রুজ কন্ট্রোল।
বাঁধন বলল, হুঁ।
হুঁ বলেই থেমে থাকে বাঁধন। ওর উচ্ছাস চাঙা হচ্ছে না।
টের পেয়ে কুসুম আবার জানতে চায়, ক্রুজ কন্ট্রোল বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
বাঁধন এবার আপন খোলস থেকে বেরিয়ে আসে। ভেতরের বিমূঢ়তা কেটে যেতে থাকে। অনেকটা স্বাভাবিক স্বরে বলল, একটা নির্দিষ্ট স্পিড উঠিয়ে ক্রুজ কন্ট্রোলটি অন করে দিলে সেই স্পিডে গাড়ি চলতে থাকবে।
মডেল কি নতুন? রিয়া এবার জানতে চায়।
একদম নতুন না। আবার নতুন, বলা চলে। ইতোমধ্যে এ মডেল সাড়া জাগিয়েছে।
গাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে বাঁধনের স্পিডও বেড়ে গেছে। এই স্পিডের আর পতন হবে না, জানে কুসুম। ক্রুজ কন্ট্রোলের গতিময় ছন্দের মতো বাঁধনের ছন্দও এখন থাকবে একই তালে।
বাঁধনের গতি সাধারণত একই তালে থাকে। জীবনের পতনকে নেমে যাওয়া মনে করে না, উত্থানকেও মনে করে না আকাশে ওড়া। এই বাঁধনের বিজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ভাবতে লাগল রিয়া। এমন একজন ফ্রেন্ড যার পাশে আছে তার আবার পরাজয় কী? তার আবার শঙ্কা কী?
বাঁধন মাথা ঘুরিয়ে রিয়াকে উদ্দেশ করে বলল, তোর প্রবলেম সলভ্ড হয়েছে?
রিয়া হেসে দেয়। হাসিতে প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেল না বাঁধন। হ্যাঁ-ও নেই, না-ও নেই। রিয়ার এই ভঙ্গিটা খুব চেনা। চেনা রিয়ার আড়ালে আছে অচেনা রিয়া।
বাঁধন বার বার বলছিল, তোর মধ্যে অচেনা আরেকটা রিয়া আছে। ওটার খোলস ঝেড়ে ফেল।
বিষয়টা নতুন করে টেনে আনার চেষ্টা করছিস বাঁধন। কুসুম থামিয়ে দিলো ওকে।
থাক। এ প্রসঙ্গ নিয়ে পরে আলাপ করব।
বাঁধন চুপ হয়ে যায়।
যূথী বলল, আপা তোমার কথা শুনব বাসায় গিয়ে। বলবে আমাকে? রিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে যূথী।
আবারও হাসল রিয়া। হাসিতে জবাব এবার খুঁজে পাওয়া গেছে। যূথী বুঝতে পেরেছে, রিয়া আপা তাকে তার গল্প বলবে।

গাড়ি চলে এসেছে বাসায়। গেট খুলে ওরা ঢুকে গেছে পার্কিং লবিতে।
অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে লবিতে।
এত গাড়ি এলো কোত্থেকে? গাড়ি থেকে নেমে গার্ডকে জিজ্ঞেস করল বাঁধন।
গার্ড বলল, আপনাদের বাসায় মেহমান এসেছে।
কে?
জানি না, আপামণি।
অনেক মেহমান?
না। দুজন এসেছে।
তাকে ফোন করেনি। জানায়নি। নিশ্চয়ই মেহমানরা আমার কেউ না। নিশ্চয় ওরা বাবা-মায়ের পক্ষের কেউ হবে।
বাসায় ঢুকে উল্লসিত হয়ে উঠল বাঁধন।
মুনা এসেছে, রেজা মামাও সঙ্গে এসেছে। কুসুমকলি ও রিয়াও খুশি উল্লসিত হয়ে উঠল।
রেজা মামার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে রিয়া। ভাবখানা এই, আপনি এসেছেন দেখে ভালো লাগছে। মুখ ফুটে কিছুই প্রকাশ করল না ও।
মুনার দিকে তাকিয়ে কুসুম বলল, কিরে এদিকে আসবি বলে জানাসনি তো?
জানালে তো সারপ্রাইজ দেওয়া হতো না। এজন্য খুঁজে ফিরে এখানে হাজির হয়েছি।
রিয়া বলল, আমাদের বাসায় গিয়েছিলি?
মুনা বলল, না। তোদের ল্যান্ডফোনে রিং করেছিলাম। বুয়া বলল, তুই আর কুসুম বাঁধনদের বাসায় গিয়েছিস। ব্যস, মুহূর্তের ডিসিশনে বাঁধনদের বাসার উদ্দেশে রওনা হয়েছি।
গুড। ভেরি গুড ডিসিশন। রিয়া প্রশংসা করে মুনার।
মামা, আপনাকে তো স্বতঃস্ফূর্ত মনে হচ্ছে না। কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। কুসুম কথা বলতে বলতে রেজা মামার দিকে তাকাল।

এ সময় বাঁধন নিজের ঘরে গেছে। যূথী ঢুকেছে গেস্টরুমে। রিয়াও বাঁধনের ঘরে ঢোকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
রেজা মুখ খোলে, অন্যরকম লাগার কারণ আছে।
কী কারণ মামা?
বন্ধু ফারুককে বদলি করা হয়েছে। বলেছিলাম এর আগে।
তো অসুবিধে কোথায়? উনার তো বদলির চাকরি। বদলিকে তো তিনি সহজভাবে নেবেন।
তা ঠিক আছে। ভাবছি, রিয়ার হুমকিদাতাদের কথা। ওরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ফারুক খবর পাঠিয়েছে। রিয়াকে সাবধানে থাকতে বলেছে। ওর প্রতি নজর রাখতে খবর পাঠিয়েছে।
আপনি বলেছিলেন, বদলি হলেও কোনো অসুবিধে হবে না।
বলেছিলাম, তবুও মনে উদ্বেগ বেড়েছে। সন্ত্রাসীরা যদি ওর বাবাকে ফটোর কথা বলে দেয়, ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে? ওর মা যদি জানতে পারেন?
জানানোর স্কোপ পাবে সন্ত্রাসীরা?
পেতেও পারে।
উত্তর শুনে শঙ্কিত হয়ে গেল কুসুম।
শঙ্কা আগে থেকে পেয়ে বসেছিল মুনার মনে। মুনার সুবিধা হচ্ছে কোনো শঙ্কা, উদ্বেগ অশান্তি বেশিক্ষণ ঠাঁই দেয় না মনে। উড়িয়ে দেয়। ওর প্রকৃতিই এমন ধাঁচের। সহজে উড়িয়ে দিতে পারে।
বাঁধন ওর মাকে নিয়ে এসে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
এ সময় ভেতর থেকে রিয়াও এসে যোগ দেয় সবার সঙ্গে।
ওঃ! রিয়া! তুমি এসেছ! বিস্ময় নিয়ে তাকালেন বাঁধনের মা, আইরিন খান।
জি আন্টি। চলে এলাম।
খুব ভালো করেছ। তোমার সমস্যা সব মিটেছে?
প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে কুসুমকলি, রেজা মামাও। রিয়া আচমকা তাল হারিয়ে ফেলে। তবু হাসে। কুসুম বেশ বুঝতে পারে, রিয়ার এ হাসি স্বাভাবিক না। এটা কষ্টের হাসি। মুখের দিকে তাকালে অন্যরাও বুঝতে পারত। রেজা মামাও বুঝেছে।
বাঁধন বলল, মা, কথা বাড়িয়ো না। বাসায় আজ গেট টুগেদার হয়ে যাক। মম, বিন্দুদেরও খবর দিই। ওরাও চলে আসুক। সবকিছু তুমি অ্যারেঞ্জ করো। বাপিকেও খবর দাও।
কুসুম প্রশ্ন করল, আঙ্কেল কোথায়?
বাঁধন উত্তর দেয়, আছে কোথাও।
উনি আমাদের মধ্যে ফ্রি হতে পারবেন তো? কুসুম জানতে চায়।
বাঁধন এবার ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে বলে, মাই ড্যাড ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। হি ইজ এ গুড বয়। হি ক্যান অ্যাডজাস্ট এভরি হোয়ার। কথাশেষে গর্বিত ঢঙে সবার সামনে বসে পড়ল।
রিয়া দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ও বসল।
ইজি ড্রেসে এমন সময় যূথী এসে সামনে দাঁড়াল?
রিয়া পরিচয় করিয়ে দেয়, যূথী এসো পরিচিত হও। উনি হচ্ছেন মুনার মামা, আমাদের সবার রেজা মামা। আর এ হচ্ছে মুনা।
যূথী হেসে দেয়। উল্লসিত হাসি নয়। নিয়ন্ত্রিত হাসি। হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ। মুনা আপার কথা শুনেছি। রেজা মামার কথাও শুনেছি। রেজা মামা বাঁধন আপার বড়ো ফ্যান, তাও জানি।
ওরে বাবা! আমাদের পুরো সার্কেল দেখি তোমার নখদর্পণে।
যূথী বিজ্ঞের মতো হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকায়। সহজ হতে পারছে না সে এই পরিবেশে। কেন পারছে না, নিজেও জানে না। একসময় কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি কি একটু বেয়াদবি করতে পারি?
যূথীর প্রশ্ন শুনে সবাই একযোগে অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল?
বেয়াদবি তো কেউ জানান দিয়ে করে না। করলেও সেটা বেয়াদবি হয় না। সেটা হচ্ছে ভালো আদব, ভালো ব্যবহার। এমন বেয়াদবি করার অনুমতি তুমি প্রশ্ন করেই অর্জন করে নিয়েছ। বলল রিয়া।
রিয়ার হাত চেপে ধরে যূথী।
আপা। আমার সঙ্গে আসবে। তোমার সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলব।

রিয়া আপত্তি না করে উঠে যায় যূথীর সঙ্গে। গেস্টরুমে ঢোকে।
কুসুম শঙ্কিত। মনে মনে ভাবল, যূথী নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত ‘গল্প’টা জানতে চাইবে। চাইলে রিয়ার মনের স্বাভাবিক তার ছিঁড়ে যাবে। কষ্ট পাবে। আরও ভাবল, না, যূথীকে ছাড় দেওয়া যাবে না। ভেবে উঠে দাঁড়াল। ওদের অনুসরণ করতে উদ্যত হয়।
মুনা বলল, বস। এখানে বসে থাক। তুই ওদের পিছে যাচ্ছিস কেন?
কুসুম দপ করে আবার বসে পড়ে। মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। মামার সঙ্গে চোখাচোখি হয় ওর। চোখ নামিয়ে নিল মামা।
এ সময় উচ্ছসিত বাঁধন এসে বসার ঘরে সবার সঙ্গে আসন নেয়।
মুনা বলল, এত উচ্ছাস কেন রে বাঁধন!
বাঃ! তোরা সবাই এসেছিস, মামাকে এনেছিস। তাছাড়া মম এবং বিন্দুও আসছে। উচ্ছসিত হব না!
বাঁধন হঠাৎ খেয়াল করল, রিয়া নেই। জানতে চায়, রিয়া কোথায়?
যূথী নিয়ে গেছে রিয়াকে। রিয়ার সঙ্গে আলাদা কথা বলবে।
ঠিক আছে, ওরা কথা বলুক। তোরা বোর ফিল করিস না। এনজয় কর। আমি একটু আসছি। মাকে হেল্প করব। ম্যাটার অব টেন মিনিটস। ঠিক আছে? বলেই বাঁধন উঠে যায়।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন