যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
সৈয়দ রিফাত
একরাশ ঝুম বৃষ্টির পর শ্রাবণের আকাশে যেন জ্যোৎস্নার মেলা বসেছে। কার্তিকপুরের বড় মাঠের দু’পাশের জঙ্গল যেন ঝলসে যাচ্ছে সে আলোয়। প্রকৃতির অপরূপ রূপ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে।
মাঠের মাঝ বরাবর ছায়াপথ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন রশিদ মিয়া। রেজিস্ট্রি আফিসের কেরানি। সচরাচর কাজ শেষ করে রাত আটটা নাগাদ ঘরে ফেরার পথ ধরেন। আজকের হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড় দেরি করিয়ে দিলো ঘণ্টা দুয়েক। দীর্ঘদিনের সঙ্গী সাইকেলটাকে দু’হাতে আকড়ে মন্থর গতিতে পথ পেরোচ্ছেন তিনি। যেন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কোনো রূপকথার রাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা। দু’পাশের উপচে পড়া দুধের মত জ্যোৎস্নার প্রতিফলন দেখে হঠাৎই যেন কেমন উদাস বোধ করলেন তিনি। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছেন, এত হিসেব নিকেশ করেছেন অফিসের, দপ্তরের—অথচ নিজের জীবনের জমা খরচের হিসেবের সময়টাই যেন করে উঠতে পারেননি কখনও। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর জন্য রেখে যাওয়ার মত সেরকম সম্বলও কিছু করতে পারেননি এতগুলো বছর ধরে।
এসব ভাবতে ভাবতেই তার পুরোনো মরচে ধরা পঙ্ক্ষীরাজে চেপে বাড়ির পথে এগোচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই তীব্র লণ্ঠনের আলো চোখে পড়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক লহমায় রূপকথা থেকে ছিটকে পড়ে গেলেন যেন বাস্তবের মাটিতে। চারজন ষণ্ডা প্রকৃতির লোক ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাকে। দু’জনকে চিনতে বেগ পেতে হলো না, একজন তারই জ্ঞাতি ভাই জমির আলী; অপরজন রুপাইহাটির গুণ্ডা নিতাই ঘোষ। বাকি দু’জনকে কস্মিনকালেও দেখেননি তিনি। গালভাঙা আফিমখোরের মত লিকলিকে চেহারা। দু’জনেরই পরনে ফতুয়া, মালকোচা করা ছেড়া ধুতি। একজনের হাতে মাছ মারা কোচা, অপরজনের হাতে বড়সড় একটা বল্লম।
হঠাৎ জমির এগিয়ে এসে হাত ধরে তুলতে তুলতে বলল, ‘আহারে, আহারে লাগেনি তো বড়ভাই?’ তীব্র ঝাঁঝালো স্বরে রশিদ মিয়া জবাব দিলেন, ‘এসবের মানে কি?’ পেছন থেকে ভারিক্কি কণ্ঠে নিতাই ঘোষ বলে উঠলেন, ‘এই, ভগবানের দয়ায় দাদা কেমন আছেন? সেটাই জানতে এলুম।’ রশিদ মিয়া উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে হাটুর ধুলা-ময়লা ঝেরে তার পঙ্ক্ষীরাজকে তুলে নিয়ে কাপা স্বরে বললেন, ‘পথ ছাড়ো জমির।’ জমির রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল, ‘তুমি মাটি ছাড়লে আমিও পথ ছেড়ে দিবো।’ রশিদ মিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘ওই জমিতে আমার বা তোমার কোনো অধিকার নেই জমির। ওটা আমার কাছে গচ্ছিত রাখা অন্য একজনের আমানত। আমি আমানতের খেয়ানত করতে পারবো না।’
তীব্র ভ্রুকুটি দেখা দিলো জমিরের চেহারায়। হিসহিসে কণ্ঠে বলে উঠল, ‘রাখো তোমার নীতিকথা, আজ এই মুহূর্তে তোমাকে ওই জমি ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে হলেও।’ রশিদ মিয়া যেন একটু ধাক্কা খেলেন, তবে ভয় পেলেন না। জীবনে কখনও নীতির সঙ্গে আপস করেননি তিনি। আজও করবেন না। নিতাই ঘোষ লণ্ঠনের আলোয় একটি বিড়ি ধরিয়ে বিকৃত স্বরে বলে উঠল, ‘আরে দাদা, কেন বেচেইন করছেন, ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দিন না। আমার আবার রক্তারক্তি ভালো লাগে না।’
এই গা ছমছমে পরিবেশে হঠাৎই রশিদ মিয়া যেন বিপদ টের পেলেন। শিরদাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার। পেছনে দাঁড়ানো রোগা দু’জনের হাতের কোচার দিয়ে তাকিয়ে তিনি হঠাৎই যেন আভাস পেয়ে গেলেন, আজ কী হতে চলেছে তার সঙ্গে। মুহূর্তের মধ্যে ধাতস্থ হয়ে কর্তব্য ঠিক করে নিলেন তিনি। এক ধাক্কায় জমিরকে সরিয়ে তিনি প্রাণপণ দৌড়াতে লাগলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা চারজন প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিতাই ঘোষের দাগী গলার স্বর পাওয়া গেল, ‘পালাতে দিস না।’ পেছন পেছন কোচা উচিয়ে দৌড়াতে লাগলো গালভাঙা চেহারার দু’জন। দৌড়াতে গিয়ে রশিদ মিয়া টের পেলেন সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ায় হাটুতে তীব্র ব্যথা পেয়েছেন তিনি। পেছন ফিরে দেখলেন, কোচা হাতে দুই মৃত্যুদূত যেন ক্রমশই ব্যবধান কমিয়ে আনছে। তবুও থামলেন না। জীবনের সমস্ত শক্তিটুকু যেন নিংড়ে ফেলছেন আজ। দৌড়াতে দৌড়াতে বিনয়দের ঠিক পুকুর পাড়ে পৌঁছে যাবেন। এমন সময় তিনি হঠাৎই যেন আঁতকে উঠলেন, সারাশরীরে যেন আচমকাই বিদ্যুৎ খেলে গেল। দাঁড়িয়ে পড়লেন রশিদ মিয়া। বুকের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলেন, ডানপাশটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে আছে কোচার মাথা। হঠাৎই নিজেকে ব্যথা-জরামুক্ত আবিষ্কার করলেন তিনি। পরবর্তীতে বামপাশ দিয়েও একইভাবে তীব্র গতিতে ঢুকে গেল প্রাগৈতিহাসিক বল্লম। ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত ছিটকে বেরিয়ে ভিজিয়ে দিতে লাগল তার সমস্ত শরীর। এরপর কয়েক মুহূর্ত তিনি শুধু টের পেলেন যেন, খুব গরম একটা অনুভূতি তার ভেতর উন্মুক্ত যাওয়া-আসা করে তার সারাশরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। নিতাই ঘোষ একটি মোটাসোটা পাটের বস্তা ছুড়ে দিলো।
আফিমখোর দু’জন বস্তায় ভরে ফেলল রশিদ মিয়ার ক্ষত-বিক্ষত প্রাণহীন দেহ। পরক্ষণেই খুব ভারি কিছু পানিতে পড়ার শব্দ হলো। পুকুরের পানিতে তীব্র আলোড়নে রশিদ মিয়ার শরীরে যেন সামান্য প্রাণের সৃষ্টি হলো। হঠাৎই যেন চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেলেন আকাশের গোল রূপালি থালার মত চাঁদটার সঙ্গে যেন তার ক্রমশই দূরত্ব কমে আসছে। অপার্থিব একটি আরাম বোধ করছেন তিনি শরীরে। যেন জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটা মিলে গেছে। এখন আরামদায়ক আলস্য ভরা শরীরে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে পড়বেন তিনি। ক্রমশই টলটলে শীতল পানিতে মানব বস্তা তলিয়ে যেতে শুরু করল। সাথে পৃথিবীর বুকে তলাতে থাকলো গোল থালার মত পঞ্চমীর রূপালি চাঁদটাও।
লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এমএস