শ্রাবণের উৎসব, শ্রাবণের উদযাপন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদ্ধিক দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সমস্ত রচনায়। ‘গীতাঞ্জলি’র শেষ পর্যায়ে ১৫৭তম কবিতায় কবি বলেন, ‘দিবস যদি সাঙ্গ হল/না যদি গাহে পাখি/ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে/—এ বার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি’। জানা যায়, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগ পর্যন্তও কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। কবির শেষ বিদায়ের দিন কয়েক আগে ১৪ শ্রাবণ জোড়াসাঁকো রোগশয্যায় শুয়ে রানী চন্দকে লিখে নিতে বলেছিলেন—‘তোমার সৃষ্টির পথ/রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে,/হে ছলনাময়ী’।
১৮৮২ সালের শ্রাবণ মাসে রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিবাহসভায় বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থের প্রশংসা করেন এবং নিজের গলা থেকে ফুলের মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে এই ব্যক্তিগত সম্মান তাঁর জীবনে অসীম গুরুত্ব বহন করে এনেছিল বলে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন। এবার বিভিন্ন বছরের শ্রাবণ মাসের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যাক—যা কবি ও সাহিত্যকে স্মরণীয় করে রাখতে ভূমিকা পালন করে।
১৮৯৪ সালের শ্রাবণ মাসে কবি শিলাইদহে আসেন। এখান থেকে ২২ শ্রাবণ তিনি চিঠি লিখছেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীকে। চিঠিটির কিছু অংশ—‘এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক।... জীবনের যে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গুপ্ত, সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখনকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে। এখনকার দিনগুলো তার সেই অনেক কালের পদচিহ্ন-দ্বারা যেন অঙ্কিত।’ (ছিন্নপত্র)।
১৮৯৬ সালে ৮ আগস্ট কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দেন তাঁদের সম্পত্তির। এ-ও রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক সুদূরপ্রভাবী ঘটনা। ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষণিকা’ প্রকাশিত হয় শ্রাবণেই। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘...মরার পরে চাইনি ওরে অমর হতে/অমর হব আঁখির তব সুধার স্রোতে।’ আবার ‘ক্ষণিকা’র শেষ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘থাকব না ভাই থাকব না কেউ/থাকবে না ভাই কিছু।/সেই আনন্দে যাও রে চলে/কালের পিছু পিছু।’
শ্রাবণে লেখা এমন সব পঙক্তি মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলের এক প্রতিবাদ সভায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত বর্ষামঙ্গলে রবীন্দ্রনাথের ৯টি নতুন গান পরিবেশিত হয়। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো: ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে’, ‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে’, ‘পুব সাগরের পার হতে কোন’, ‘একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধরে’, ‘বৃষ্টি শেষের হাওয়া কিসের খোঁজে’ প্রভৃতি। জীবনের গভীর উপলব্ধির অনুরণন রয়েছে গানগুলোতে।
১৯২৯ সালের ১২ থেকে ২২ শ্রাবণের মধ্যে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘তপতী’ নাটক। ১৩৪৭ সনের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪০) অর্থাৎ প্রয়াণের ঠিক আগের বছর রবীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা এসে সম্মানিত করেন। এ বিশেষ দিনে রবীন্দ্রনাথের একটি নতুন গান গাওয়া হয়। গানটি হলো ‘বিশ্ব বিদ্যা তীর্থ প্রাঙ্গণ কর মহোজ্জ্বল আজ হে’। কাঠফাটা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের পর বৃষ্টি সবার কাছেই আরাধ্যর বিষয়। তাই ‘বর্ষামঙ্গল’ এ সময়টার জন্যই বরাদ্দ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ও কবির প্রিয় শিষ্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে একটা পড়া গল্প শোনা যায়। ১০৩৯ সাল। শ্রাবণ আসন্ন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান-পাগল ছাত্রটির কাছে দুষ্টুমি করে বলেছিলেন, ‘এ বারে তো বর্ষামঙ্গল হবে না। পুরনো গানে বর্ষামঙ্গল করবে না’। পরদিনই সকালে ছাত্রটিকে দিলেন নতুন গান ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’। পরদিন আরও একটি গান, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। রবিঠাকুর প্রিয় ছাত্রকে আরও একটি বর্ষার গান লিখে উপহার দিয়েছিলেন ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা’।
২২ শ্রাবণ দিনটি নিয়ে আরও কত কথাই লেখা আছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক নানা বইপত্রে। ১৯২৫ সালের ২৫ বৈশাখ শান্তিনিকেতন উত্তরায়ণের উত্তরপূর্ব কোণে নিজের হাতে কবি পাঁচটি বৃক্ষ—অশত্থ, আমলকি, অশোক, বেল ও বট চারা রোপণ করে বৃক্ষরোপণ উৎসবের শুরু করেন। এখন ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিনটিকে স্মরণ করে ‘বৃক্ষরোপণ উৎসব’ প্রচলিত শান্তিনিকেতনে। ছেলেমেয়েরা বাসন্তি রঙের ধুতি ও শাড়ি পরে ফুলের গয়নায় সজ্জিত হয়ে কবির ‘বৃক্ষবন্দনা’ গানটি গাইতে গাইতে বৃক্ষরোপণ পর্ব যেখানে হবে, সেখানে উপস্থিত হন—‘মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও শূন্যে/হে প্রবল প্রাণ/ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে/হে কোমল প্রাণ.../মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে/হে মোহন প্রাণ’।
যে গাছ রোপণ করা হবে, সেটিকে চতুর্দোলায় আনা হয়। শাঁখ বাজিয়ে মাঙ্গলিক মন্ত্রোচারণ ধ্বনিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়। এরপর আশ্রম সংগীত। ২২ শ্রাবণের পরের দিন শ্রীনিকেতনে ২৩ শ্রাবণ সকালে দুটি হালচাষের বলদকে সাজিয়ে মাঠে আনা হয়। শ্রীনিকেতনের এ ‘হলকর্ষণ উৎসব’ ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ/আমার মন ভুলায় রে’ এবং ‘ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে’ (নবগীতিকায় সংকলিত) দুটি গান গেয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথি হাল ধরেন।
কবির তিরোধান দিনটি উপলক্ষ করে ভারত সরকার ১৯৫০ সাল থেকে কবির প্রচলিত বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটি পালন করে চলেছে দেশজুড়ে। বৃক্ষরোপণ নিয়ে একটি কবিতা সেই অনাগত মৃত্যুচেতনার আভাষ দেখা যায় কবির লেখায়, ‘হে তরু, এ ধরাতলে/রহিব না যবে/সে দিন বসন্তে/নব পল্লবে পল্লবে/তোমার মর্মরধ্বনি/পথিকেরে কবে/ভালোবেসে ছিল কবি/বেঁচে ছিল যবে।’
‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখেছেন—‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর! আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/জীবন আমার এত ভালবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়/মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়’। কবি জীবনের শেষ চার বছর অসুস্থ ছিলেন। ১৯৩৭ সাল থেকেই তার দীর্ঘকালীন অসুস্থতার সূত্রপাত। অবশেষে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ বেলা ১২টা ১০ মিনিটে লোকান্তরিত হন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/জিকেএস