ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী : পর্ব ১৩

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০৩:৪০ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২১

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

চৌদ্দ.
আজ প্রথম আলাদা করে দেখা হবে কুসুমকলির সঙ্গে। কুসুমের মায়াময় চোখের টান ভেতর থেকেই টের পায় মাহিন।
বেলা এগারোটায় ধানমন্ডি লেকের পশ্চিম পাড়ে রবীন্দ্রসরোবরের দক্ষিণ পাশের বটতলায় অপেক্ষা করবে কুসুম। মোবাইল ফোনে বারবার বলে রেখেছিল ওর আগেই মাহিনকে পৌঁছাতে হবে। কুসুম একা কোথাও এভাবে যায়নি। এবারই প্রথম যাবে। এক যুবকের সঙ্গে দেখা হবে। কথা হবে। ভেতরের যুদ্ধ টের পায় ও। এ যুদ্ধ মোকাবিলায় অনভিজ্ঞ কুসুমকলি বলেছিল, আমার ভয় করছে।
মাহিন বলেছিল, কেন, আমাকে কি বাঘ মনে হচ্ছে?
কুসুম হেসেছিল। ‘বাঘ’ শব্দের গুরুত্ব তাকে হাসিয়েছে ঠিক। ভেতরে ভেতরে সমান তালেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
কুসুমের জবাব না পেয়ে মাহিন বলেছিল, ভয় পেয়ো না। আমি হরিণ হয়ে থাকব। বাঘ হব না।
কুসুম সঙ্গে সঙ্গে হেসে হেসে প্রশ্ন করেছিল, রবীন্দ্রনাথের সোনার হরিণ? সে তো ধরা যায় না, পালিয়ে বেড়ায়।
মাহিনও হাসে। হাসতে হাসতে বলেছিল, ধরতে চাও?
কুসুম লজ্জা পেয়ে সংকুচিত হয়ে বলেছিল, হাত দিয়ে ধরতে চাই না। মন দিয়ে ধরতে চাই।
হো-হো করে হেসেছিল মাহিন।
কুসুমকলি হাসির উল্লাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।
দ্রুতই বলেছিল, ঠিক সময়ে আসবেন কিন্তু। নইলে ক্ষতি হয়ে যাবে।
কী ক্ষতি হবে?
বড় ক্ষতি। অনেক বড় ক্ষতি হবে।
মাহিন জানতে চেয়েছিল, কার ক্ষতি? আমার?
কুসুমকলি জবাব দিয়েছিল, না। আপনার না। আমার।
কুসুমের শেষ কথা কানের ভেতর ঢুকে আছে। মাঝে মাঝে তা শুনতে পাচ্ছে মাহিন। হুবহু কুসুমের কথামালা কানের ভেতর ঢেউ তুলছে। মনে মনে হাসতে থাকে ও।

রিকশায় বসে এগিয়ে আসছে মিরপুর রোড ধরে। অবরোধের কারণে গাড়ি চলছে না। মিরপুর থেকে রিকশায় আসছে। সারি সারি রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যরকম ঢাকা। অন্যরকম মিরপুর রোড। অন্যরকম অনুভূতি। সব মিলিয়ে মাহিনের অন্য মন জেগে উঠেছে।
রাপা প্লাজার সামনে থেকে জটলা শুরু।
মাইকে বক্তৃতা চলছে। শত শত মানুষের ভিড়, চৌদ্দ দলের আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের ভিড়। দাঙ্গাপুলিশ দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধভাবে। এখান থেকে রিকশা আর সামনে এগোতে পারছে না। ট্র্যাফিক সার্জেন্ট সাতাশ নম্বর রোডের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে রিকশা বহর। মাহিনের রিকশাটাও ওই পথে ঘোরাতে বাধ্য হয় চালক।
হাতের ঘড়ি দেখল মাহিন। সাড়ে দশটা বাজে।
রিকশায় চলাচলেও বিঘ্ন হতে দেখে ভয়ে কেঁপে ওঠে ও। ঠিক সময়ে রবীন্দ্রসরোবরে পৌঁছানো যাবে তো? ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কুসুম বলে রেখেছে। কী ক্ষতি হবে খোলাসা করেনি। নিজের মনে শঙ্কা জাগে। তবুও ভেঙে না পড়ে সাহস নিয়ে মাহিন বলল, রিকশাওয়ালা ভাই, বুঝেসুঝে যান।
রিকশাওয়ালা বলল, যাইতে পারব মনে হয় না। ওই দেহেন এই রাস্তা ধইরাও খণ্ড মিছিল আসতাছে।
মিছিল দেখে আচমকা ঘাবড়ে গেল মাহিন। নিজেকে নিয়ে শঙ্কা নয়। ঠিক সময়ে যথাস্থানে পৌঁছানোর অনিশ্চয়তা খামচে ধরে ওকে। গতকাল টিভি নিউজে এক ব্যবসায়ী নেতার বলা কথা মনে পড়ে। নেতা বলেছেন, ক্ষতির কথা। প্রতিদিনের হরতাল-অবরোধে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পকারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। এর মধ্যে উৎপাদন খাতে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা, ব্যবসায় দৈনিক লেনদেনে ক্ষতি হয় এক হাজার কোটি টাকা, কাঁচা তরকারি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে ক্ষতি হয় আরও ৫০০ কোটি টাকা। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। হরতাল-অবরোধ না, একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান চান ব্যবসায়ী নেতারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন, রাজনৈতিকদের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যে যার অবস্থানে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কে রুখবে তাঁদের ক্ষতি? দেশের কথা বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না মাহিন। এ মুহূর্তে নিজের ক্ষতির কথা ভাবতে লাগল। নিজেকেই পুষিয়ে নিতে হবে নিজের ক্ষতি।
রিকশাওয়ালাকে বলল, ভাই ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যান। আমাকে দ্রুত ধানমন্ডির আট নম্বর ব্রিজের কাছে পৌঁছাতে হবে। ভাড়া বাড়িয়ে দেবো, খুশি করে দেবো আপনাকে। দ্রুত চালান।
রিকশাওয়ালা একদম স্বাভাবিক। অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষটার অনুত্তেজিত স্বর মাহিনকে নাড়া দিল। সে-ও চুপ হয়ে গেল। পশ্চিম থেকে ২৭ নম্বর রোড ধরে মিরপুর রোডের দিকে মিছিল এগিয়ে আসছে। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে বাঁ পাশের এক গলিতে।
রিকশাওয়ালা ভালো কাজ করেছে। মাহিনের মনে ধৈর্য তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারাও অন্তত একটা ভালো কাজের নজির রেখে যেতে তৎপর।
রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনায় বঙ্গভবনে উপদেষ্টাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেছিলেন অন্তত একটা ভালো কাজ করে যাওয়ার জন্য। এ আহ্বান প্রত্যেক উপদেষ্টাকে আকৃষ্ট করেছে। তারা তৎপর।
মাহিন জানে, তাদের তৎপরতার খবর। মহৎ কাজের তৎপরতা অন্যের মনেও মহৎ কাজ করার বীজ রোপণ করে। এই বীজ মাহিনের মনেও রোপিত হয়েছে।
মাহিন এখন নিজের জন্য ভালো কিছু করতে চায়। নিজের জন্য এই মুহূর্তের ভালো কাজ হচ্ছে যথাসময়ে রবীন্দ্রসরোবরে পৌঁছানো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভালো কাজ হচ্ছে যথাসময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। এ লক্ষ্যে সামনে এগোতে হবে। তাহলে অবরোধ উঠে যাবে। মানুষের ভোগান্তি কমবে। মাহিনরা যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছতে পারবে। ছোট-বড় ক্ষতি রোধ হবে।

রিকশা চলতে শুরু করেছে। ২৭ নম্বর রোড এখন অনেকটা ফাঁকা। মিছিল ক্রস করে চলে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে রিকশা। মাহিনের মনের উদ্বেগ কেটে গেছে। রিকশার গতির সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে জেগে ওঠে স্বস্তির ঢেউ। এ ঢেউয়ে এখন ভাসছে মাহিন। অপেক্ষায় থাকবে কুসুম। দ্রুত যেতে হবে কুসুমের কাছে। দ্রুত যেতে হবে মূল লক্ষ্যে। লক্ষ্যেই আছে শান্তি, প্রশান্তি।
ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে নানা পথ ঘুরে এগিয়ে চলেছে রিকশা।
হাতে আর বেশি সময় নেই। এগারোটার বেশি বাকি নেই।
মনে হচ্ছে ধীরে চলছে রিকশা। মনে হচ্ছে রবীন্দ্রসরোবর অজস্র মাইল দূরে। মনে হচ্ছে এ সময়ে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব না।
হতাশা জেগে উঠল মনে। ঢিপঢিপ বেড়ে গেল বুকে।
কুসুমকলির প্রথম চাওয়া অনুযায়ী মাহিনকেই আগে পৌঁছাতে হবে।
কুসুমের প্রথম চাওয়া কি তাহলে পূরণ হবে না?
রিকশা ছুটছে, বেশ জোরে ছুটছে। রাস্তা ফাঁকা। মাহিন বলতে লাগল, রিকশাওয়ালা ভাই, একটু তাড়াতাড়ি।
রিকশাওয়ালা চলন্ত অবস্থায় মুখ ফেরায়।
মুখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, আপনি একজন অকৃতজ্ঞ লোক! দেখছেন না, কত দ্রুত ছুটছি।
মাহিন লজ্জা পেল। আসলে মাহিনের ভেতর আরেক মাহিন জেগে উঠেছে। বুঝল ও। এই মাহিন হবে সৎ। কথা দিয়ে কথা রাখবে। এ মাহিন হবে আদর্শ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কোনো পরাজয় ছোঁবে না ওকে। এ মাহিন হতে চায় তেমন গতিময়, তেমনই তারুণ্যময়।
রিকশাওয়ালা কি আর বুঝবে এ কথা!
মনে মনে রিকশাওয়ালার উগ্র চাউনিকে ক্ষমা করে দেয় মাহিন।

আট নম্বর রোডের ব্রিজের দক্ষিণ মোড়ে এসে রিকশা থামে।
সাবাশ ভাই। দেরি হয়নি। সঠিক সময়ে হাজির হয়েছি। ধন্যবাদ। এই নিন। এটা নিন। পুরোটা আপনার জন্য। বলতে বলতে মাহিন একশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয়।
রিকশাওয়ালা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
একলাফে মাহিন ঢুকে গেল রবীন্দ্রসরোবরে।
দুই লাফেই চলে এসেছে রবীন্দ্রসরোবরের মধ্যখানে। এখান থেকে দেখা যায় দক্ষিণ পাশের বটগাছ। নির্বাচিত বসার জায়গা খালি। এখনো আসেনি কুসুম। টেনশন কমে গেল। বুকে জাগল শান্তি।
এগোতে লাগল বটগাছটার দিকে। গাছটার চারপাশজুড়ে হাঁটুসমান উঁচু পাকা প্ল্যাটফর্ম। মানুষ এখানে বসে আড্ডা দেয়। জুটিরা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে পার করে মধুর কিছু মুহূর্ত। অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য। খোলামেলা নিরাপদ পার্কের মধ্যে সিকিউরিটি বেশ ভালো। দেখা করার জন্য জায়গাটা এ কারণেই বেছে নিয়েছিল মাহিন।
বুকে শান্তি নিয়ে কুসুমের আসার পথ চেয়ে বসে ও।
কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার।
তিন সুঠাম জোয়ান সামনে এসে দাঁড়াল। ওদের পরনে সাদা ড্রেস।
তিনজন তিন পাশে দাঁড়িয়েছে।
তিনজনের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে আকস্মিক ভয় পেল মাহিন। ভয় পেলেও ঘাবড়ে যায়নি। নার্ভাস হয়ে ভেঙে পড়েনি। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল ও।
তিনজনের একজন সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কী নাম?
মাহিন।
কী করেন?
বুয়েটে পড়ি।
পরিচয়পত্র আছে?
না। সঙ্গে নেই। জবাব দিয়ে জমে যায়নি মাহিন। পাল্টা প্রশ্ন করে, এসব জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
এখানে ঢোকার সময় আপনার আচরণ রহস্যময় মনে হয়েছে। এটা নিরাপদ এলাকা। আমরা এখানকার সিকিউরিটি রক্ষার দায়িত্বে আছি। এজন্য জিজ্ঞাসা করছি।
জ্বি। জিজ্ঞাসা করুন।
আর জিজ্ঞাসা নয়। চেক করতে চাই।
করুন।
একজন মাহিনকে চেক করা শুরু করল। কাজ শেষ করে নিরাপদ ঘোষণা করল ওকে।
সরি। আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।
না। ডিস্টার্ব না। ঠিক করেছেন। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে জানতে চাইছি, এত কড়াকড়ি চলছে কেন? মাহিন ব্যক্তিত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে বসল।
এখানে ঢোকার মুহূর্তে আপনার আচরণ অন্যরকম মনে হয়েছিল। সবাইকে চেক করি না। সন্দেহভাজনদের চেক করি।
সন্দেহভাজন এখানে আসবে কেন? কী সন্দেহ করেন?
একটু সামনে এখানে বাস করেন দেশের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার নিরাপত্তার জন্যই এ ব্যবস্থা।
ওহ! বলেই চুপ হয়ে গেল মাহিন।

তিন জোয়ান দ্রুতই সরে গেল।
অল্প সময়ের ব্যাপার। নিজেকে সন্দেহভাজনের দলে ভিড়িয়েছে মাহিন।
কেন এমন হলো?
তবে কি ওর কাছে গোপন কোনো আগ্নেয়াস্ত্র আছে? বোমা আছে? তাকে কি আত্মঘাতী বোমা বহনকারী মনে হয়েছে?
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করে নিজেই হেসে ওঠে।
মনে মনে বলে, আছে। বোমা আছে। বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি বিধ্বংসী অন্য এক বোমা। ভালো লাগার বোমা। ভালোবাসার বোমা। এই বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবে না ও। লুকিয়ে রাখবে বুকের ভেতর। সিকিউরিটির লোকজন টের পায়নি। ধরতে পারেনি। বোমা থাকলে আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যাবেই। এ অস্বাভাবিকতা সহজে কুসুমকলির সামনে ফুটতে দেওয়া যাবে না। ভালোই হলো―বুকের ঘরে বোমা বিস্ফোরণের আগেই বাস্তবের বোমার খবর পেয়ে গেছে ও। ওই বোমা থেকে নিরাপদ নন রাজনৈতিকেরাও। তবে নিজের বুকের ঘরে লুকোনো বোমা থেকে কুসুমকে রক্ষা করবে ও। ভাবতে লাগল সামনে তাকিয়ে।
হঠাৎ ঘাড়ে কোমল হাতের স্পর্শ টের পেল মাহিন। চমকে পেছন ফিরে তাকাল। মাহিনের চমকের দাপটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠল পেছন থেকে আসা কুসুমকলি।
ভয় পেয়েছেন? কুসুমকলির প্রশ্ন।
হ্যাঁ। পেয়েছি।
কীসের ভয়?
কোমল বোমার ভয়।
সেকি! কোমল বোমা আবার কী?
গরম বোমা সঙ্গে থাকলে কোমল বোমারও দরকার হয়।
কোমল বোমা কোথায়? গরম বোমাই বা কোত্থেকে এল? কুসুমকলির প্রশ্নে আছে হাসির ঝিলিক।
একটু আগে সিকিউরিটির লোকজন চেক করছিল, বোমারু মানব ভেবেছিল আমাকে।
কুসুম বলল, ঠিকই ভেবেছে তারা। আপনি আসলেই একটা মানব বোমা। এ বোমায় উড়িয়ে দিতে পারেন মানবমন।
তোমার মন কি উড়িয়ে দিয়েছি? গুঁড়িয়ে দিয়েছি? মাহিনের সরাসরি প্রশ্ন।
কুসুমকলি খিলখিল করে হাসতে লাগল। প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। মনে মনে ভাবল, উড়ে গেছি। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি। এ খবর আপনাকে জানানো যাবে না।

প্রথম সাক্ষাতের পর অনেকবার টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। সিনিয়র হিসেবে অনুমতি নিয়েই মাহিন ‘তুমি’ বলা শুরু করেছে। কুসুমকলি ‘তুমি’ বলছে না। ‘আপনি’ বলেই দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। তবে মনের ভেতর দূরত্ব নেই। ভেতরে ভেতরে মাহিনের রোশনির প্লাবনের তলে ভেসে গেছে ও। এ মুহূর্তে যখন কাঁধে স্পর্শ করেছে, মাহিনের দেহের উত্তাপ ছুঁয়ে গেছে তার দেহ। অণু-পরমাণুতে ঘটে গেছে বড় বিপ্লব। এ বিপ্লবের ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানে না মাহিন।
কোনো এক দুরন্ত শক্তি ভেতর থেকে চুম্বক-টান তৈরি করে দিয়েছে, হাতটা আপনা-আপনি মাহিনের কাঁধে উঠে গেছে, ছুঁয়ে দিয়েছে ও কীভাবে! ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল।
কুসুমকলিকে সবাই বলে লজ্জাবতী পাতা। সেই লজ্জায় কুঁকড়ে থাকার কথা ছিল। অথচ কুঁকড়ে থাকেনি। সাবলীল ভঙ্গিতে বাড়িয়েছে হাত। এ হাত কি জাদুর পরশ পেয়েছে? কূলকিনারা করতে না পেরে অবাক হয়ে ও তাকিয়ে থাকে নিজের হাতের দিকে।
মাহিন বলল, আমি কথা রেখেছি। ঠিক সময়ে এসেছি। তোমার আগে এসে বসে আছি।
কুসুমকলি এবার রহস্যময় হাসি হাসিমুখে বলল, না আপনি আগে আসেননি। আমিই আগে এসেছি। ওই যে দূরে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম ফুচকাওয়ালার পাশে। ভাবখানা ফুচকার অর্ডার দিচ্ছি।
তাহলে কি হেরে গেছি আমি? ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক?
হারেননি। আপনাকে হারাতে ইচ্ছা হয়নি। তাই নির্ধারিত স্থানে আগে বসিনি।
ওহ! জয়ী হওয়ার সুযোগ দিয়েছ?
তা বলতে পারেন। তবে সুযোগ দিয়ে বোধ হয় ভুল করেছি। ভুলের মাশুল দিয়েছি।
কী মাশুল?
ওই যে, নিরাপত্তারক্ষীরা লোকজন আপনাকে নাজেহাল করার সুযোগ পেল?
তুমি দেখেছ?
দেখব না কেন? দেখেছি। এখানে আসতে আসতেই ওরা চলে গেল।
না। নাজেহাল হইনি। ওরা তো ওদের কাজ করবে। এটা ওদের ডিউটি।
না। সে কথা না। আমি থাকলে নিশ্চয়ই আপনাকে সন্দেহ করত না। চেক করত না। বলতে বলতে মন খারাপ হতে থাকে। নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকে কুসুমকলি।

মাহিন লক্ষ্য করল চাঁদমুখ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপের কালো ছায়া পানির ওপর মেঘের চলমান ছায়ার মতো ঢেকে দিয়েছে মুখ।
মাহিনের মনে চটুল বুদ্ধি জাগে। ওকে হাসাতে হবে। কৌশলী হয় ও। কৌশলী হয়ে বলল, বলেছিলে ‘মন দিয়ে ধরবে’। তোমার কথা রাখোনি। হাত দিয়ে ধরে ফেলেছ আমাকে। ছুঁয়ে দিয়েছ।
ছোঁয়ার কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে অন্যরকম আলো ছড়িয়ে গেল। মলিন মুখের আঁধার কেটে যেতে লাগল। আবার ঝলমল করে ফুটতে লাগল কুসুমের মুখের মায়াবী লাবণ্য। মায়ার আলো ছড়িয়ে রক্তিম হতে লাগল মুখ। ওই মুখে এখন ভর করেছে লজ্জা। রক্তিম লজ্জার অন্য এক আলো ফুটে উঠেছে, ওই আলোয় ম্লান হয়ে গেছে চোখের আলো।
তা দেখে মাহিনের মন ভরে গেল। বিস্ময়কর আনন্দ-ঢেউ জেগে উঠল মনে। এত সুন্দর কুসুম! এত সুন্দর! এ সৌন্দর্য ধারণ করার যোগ্যতা আছে কি নিজের! ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে ও তাকিয়ে থাকে লাবণ্যময়ী কুসুমের দিকে।
কুসুম লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
মাহিন তাকিয়ে আছে কুসুমের দিকে। চুপিচুপি চেয়ে থাকে। একসময় চপল হাসি নিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে জিতিয়ে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছ? না-কি আমি গোপনে গোপনে জয়ী হয়ে গেছি।
কুসুম বলল, আমি আপনার জয় দেখতে চাই।
মাহিন বলল, এ মুহূর্তের জয় দেখেছ?
কুসুমের লাবণ্য আরও ঝলমল করে ওঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে আলতো করে বলল, এটা জয়ের সূচনা হতে পারে। পুরোপুরি জয় না। আরও বড় জয় চাই। বড় জয়।
মাহিন বলল, তুমি চাইলে আমি পারব। তুমি পাশে থাকলে যেকোনো জয় ছিনিয়ে আনা কঠিন হবে না।
কুসুমকলির মন ফুলে ওঠে, গর্বে বুক ফুলে ওঠে। উঁচু মন নিয়ে বলল, অবশ্যই পারবে।
পারব? কুসুমের মুখের কথা লুফে নিয়ে প্রশ্ন করে মাহিন।
অবশ্যই পারবে।
আমি জয়ী হয়ে গেছি। পুরোপুরি জয়ী হয়ে গেছি। চিৎকার জুড়ে দিয়ে নাচতে থাকে, লাফাতে থাকে মাহিন।
এত লাফাচ্ছেন কেন? কীভাবে জয়ী হয়েছেন?
একটু আগে আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছ। তোমার ভেতরে আমার আসন তুমিতে গেড়ে বসেছে। ‘পারবে’ শব্দটা ব্যবহার করেছ। দুবার ব্যবহার করেছ।
নিজেকে দেখো তুমি। নিজেকে বোঝো। নিজেকে বুঝলে দেখবে কোমল বোমার বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। গরম বোমার বিস্ফোরণের আর প্রয়োজন নেই।

নিজের ভেতরের বোমার খবর লুকিয়ে রাখতে পারল না মাহিন। সবকিছু জানান দিয়ে গেছে কুসুমকে। কুসুম টের পেয়ে গেছে মাহিনের ভেতরের খবর। ভেতরে এখন আসন পেয়েছে কুসুম, কেবলই কুসুমকলি।
কুসুমকলি কেবল শুধু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়নি। মন দিয়েও ছুঁয়ে ফেলেছে। মনও ধরেছে। ধরাধরিতে জয়ী হয়েছে। এ জয় মাহিনের জয়। আধাআধি নয়। পুরোপুরি জয়।
মাহিন বলল, আজকের দিনটা সেলিব্রেট করতে চাই।
কুসুমের মুখে কোমল হাসি লেগেই আছে। হাসিমুখে বলল, সেলিব্রেট কি হচ্ছে না!
একটু অন্যরকম সেলিব্রেট চাই।
অন্যরকম আবার কি! এ মুহূর্তটা কী অন্যরকম না? এরকম অনুভূতি কি অন্যরকম অর্থে পাওয়া না?
সেটা ঠিক। এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। শ্রেষ্ঠ দিন। শ্রেষ্ঠত্বটা অন্যরকমই। মেনে নিলাম কথাটা।
কুসুম জোর করে মানাতে চায়নি। কুসুমের কাছে এটা শ্রেষ্ঠতম দিন না। প্রথম দেখার দিনই অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। ওইদিনই ভেঙে গেছে কুসুম। টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। খানখান হয়ে গিয়েছিল। ওইদিনই গুঁড়িয়ে গিয়েছিল ও। পত্রিকা বুকে জড়ানো অশ্রুসিক্ত তারুণ্য ওইদিন নরম বুকে গরম বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছিল। ততটা কি বুঝতে পেরেছিল মাহিন? পারেনি। এখন মনে হচ্ছে ওইদিন মাহিনের চোখে ধরা পড়েছিল ও। চোখ পুরোপুরি খুলে দিতে পারেনি। ধীরে ধীরে খুলেছে মাহিনের চোখ। এখন ওই চোখে দুর্নিবার টান। এ চোখকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। নিরুত্তাপ কণ্ঠে কুসুম বলল, আর কীভাবে সেলিব্রেট করতে চাও। তুমিতে নেমে এল ও। এবার ইচ্ছাকৃতভাবে তুমি বলা শুরু করল। সেলিব্রেশন কাকে বলে বুঝিয়ে দিতে চায় কুসুমকলি।

মাহিনের মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। শান্তি বাড়তে থাকে। ‘তুমি’ সম্বোধনে একদম গলে যায় ও। অন্যরকম হয়ে যায়।
মুগ্ধ বিহ্বলতায় ও নিজের হাতে তুলে নেয় কুসুমকলির একটা হাত। নরম হাতের ছোঁয়া শিরশির করে ছুটে বেড়াতে লাগল পুরো দেহে। চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইল মাহিন।
লেকের এ পাড়ে অন্য কোনো জুটি নেই। কেউ নেই আশেপাশে। ওরা দুজন। কেবলই দুজন, পাশাপাশি দুজন। ওপরে গাছের ঝাঁকড়া পাতার আড়ালে পাখির বাসা। পাশেই কড়ইগাছের শ্যামল কোমল ছায়া শুয়ে আছে টলোমলো পানিতে। গাঢ় নীলচে পানি ক্রমশ হালকা হয়ে মিশে গেছে ওই পাড়ে। লেকের পূর্ব পাড়ে একজোড়া জুটি বসে আছে। তারা দেহের সঙ্গে দেহ লাগিয়ে বসে আছে। চোখ খুলে তাকিয়ে আছে কুসুম। পূর্ব পাড়ের দৃশ্য এ পাড়ে নিজের ভেতর বইয়ে দিচ্ছে গোপন আরেকটা ধারা। ওই ধারার বেপরোয়া আলোড়নে অভিভূত কুসুম। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে পাখির ওড়াউড়ি।
সেলিব্রেশন! অ্যান্ড জুবিলেশন! প্রিয় একটা ব্যান্ড মিউজিক নিজের মনের নিভৃতে বাজতে লাগল। একটু পর কুসুমের মনে হতে থাকে মাহিন সোনার হরিণ না। বনের দুর্ধর্ষ বাঘ। এ বাঘ ঢুকে গেছে মনের গহিন অরণ্যে।
মাহিনকে সোনার হরিণ বানাতে চায় না কুসুমকলি। মনের হরিণ বানাতে চায়। এ হরিণ পালাবে না। দূরে সরে যাবে না। এ হরিণ ধরা যাবে। ছোঁয়া যাবে। এ হরিণ বাস করবে নিজের গোপন ঘরে...

মাহিন একদম চুপ, কুসুমের কোমল হাত ধরে বসে আছে। নড়ছে না। টলছে না। মনের মধ্যে আন্দোলিত হতে থাকে কবি তসলিমা নাসরিনের কবিতার প্রিয় একটি ছন্দ :
‘ইচ্ছা করে মরে যাই
মরে গিয়ে জল হই
তুমি যদি সে জল স্পর্শ করো।’

চলবে...

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন