ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

‘শবর নৃগোষ্ঠী: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ-একটি জাতিপ্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৩৭ পিএম, ২৫ মে ২০২১

ড. আহমেদ সুমন

‘শবর নৃগোষ্ঠী: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ-একটি জাতিপ্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন আখতার হোসেন। গ্রন্থটি মূলত লেখকের পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে রচিত। তিনি প্রত্নতাত্ত্ব বিভাগ থেকে শবর নামক জনগোষ্ঠী নিয়ে নিবিড় গবেষণা সম্পাদন করেন। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে নৈঋতা ক্যাফে। ২০২১ সালে মার্চ মাসে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত এ গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন কাজী মো. মহসীন। গ্রন্থের প্রারম্ভে সারসংক্ষেপে বগুড়া জেলার গাবতলী ও সোনাতলা উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলায় বসবাসরত শবর নৃগোষ্ঠী নিয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণার তথ্য-উপাত্ত কথা তুলে ধরা হয়।

সাতটি অধ্যায়ে রচিত এ গ্রন্থে বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র শবর নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐহিত্য, জীবনাচার ইত্যাদি বিবৃত হয়েছে। এ গ্রন্থে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি গবেষণায় কোথাও ৩৫টি আবার কোথাও ৫৫টির অধিক নৃগোষ্ঠীর বসবাসের উল্লেখ রয়েছে। তাদের মধ্যে মধ্যে ‘শবর’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অন্যতম। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আলোচনা ও গবেষণা হলেও এখন পর্যন্ত ‘শবর’ নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে এখনও গবেষণা হয়নি। আখতার হোসেন রচিত এ গ্রন্থে ‘শবর’ নৃগোষ্ঠীর দীর্ঘ ঐতিহাসিক পদযাত্রার দিকগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ গ্রন্থে বলা হয়, বর্তমানে ‘শবর’ নৃগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় বসবাস করে। মৌলভীবাজারের কয়েকটি চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রয়েছে শবররা। তবে তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাদের সংখ্যা ১৫০০-২০০০ এর মতো হবে।

গ্রন্থে শবর নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়, প্রথমদিকে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র এলাকায় ‘শবর’ নামক নৃগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। কালের বিবর্তনে উত্তরবঙ্গের ‘শবর’ নৃগোষ্ঠী বিলীন হয়ে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভিতর সাংঙগীকৃত হয়। বর্তমান ‘শবর’ নৃগোষ্ঠী যাদের পূর্বপুরুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা থেকে চা শ্রমিক হিসেবে অভিবাসিত হয়ে মৌলভীবাজারস্থ চা বাগানে স্থিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে মৌলভীবাজারেই তারা বসবাস করে আসছে। ‘শবর’ নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে চর্যাপদ, মহাযান, জোহা, মহাভারত ও কাহ্নবীসহ বিভিন্ন সাহিত্যে আলোচনা করা হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকার শবররা গৃহী বা কৃষিজীবী থেকে বস্ত্রবয়নে দক্ষতা অর্জন করে তন্তুবায়ী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করে।

এ গ্রন্থে আরও বলা হয়, সেন শাসনামলে ব্রাক্ষণ্যবাদের নির্মম বর্ণ বৈষম্যের নিষ্পেষণে হিন্দু সমাজের বর্ণ বর্হিভূত অবস্থানে পতিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তন হলেও বঞ্চনার শিকার হতে অব্যাহতি লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের প্রভাবে এই তন্তুবায়ী শবররা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পেশাগত কারণে মুসলিম জোলা হিসেবে সমাজে স্থান পায়। মুসলিম সমাজেও জোলারা শ্রেণিবৈষম্যের শিকার হয়। বিশেষ করে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে। ফলে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সমাজে তাতি বা জোলা সম্প্রদায় প্রান্তিক অবস্থানে বিরাজ করেছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ে দেবীর প্রসাদ বা ভোগের অন্যতম উপাদান কবরী কলার প্রচলন শবরদের থেকে গৃহীত হয়েছে। এমনকি দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, স্বরসতীপূজা,শবরোৎসবসহ অনেক পূজাই শবরদের লোকাচার থেকে গৃহীত হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম জোলাদেরও অনেক নিয়মকানুন ইসলাম ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূ না হলেও জোলাদের নিজস্ব লোকাচার দীর্ঘদিন বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জোলারা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ সময় হতে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৫ সন অব্দি ‘জোলা পাড়া’ নামক গ্রামে একত্রিত হয়ে বাস করে আসছিল। তবে তারা এখন আর তাতের কারবার পেশার সাথে জড়িত নয়।

শবরদের পূজা-পার্বণ সম্পর্কে এ গ্রন্থে বলা হয়, শবরদের রয়েছে বনপূজা, পাহাড়পূজা, ফাগোয়া’র (রং খেলা) মতো নিজস্ব উৎসব। রয়েছে কয়েকটি গোত্র- বিশুদ্ধ শবর, সৌরাহ শবর, লোথা শবর, খাবিয়া শবর, গন্ধ শবর, জারা শবর, ভীম শবর ইত্যাদি। সাধারণত শবরদের এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের বিয়ে হয় না। প্রত্যেক শবর গোত্রেরই রয়েছে নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতি। কিন্তু সময়ের স্রোতে শবরদের মধ্যেও এসেছে পরিবর্তন। এখন শবরদের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিবাহ প্রচলন শুরু হয়েছে। লেখাপড়ায় আগ্রহী হচ্ছে অনেক শবররা, সরকারি চাকরির প্রতিও ঝুঁকছে। বসবাসেও এসেছে পরিবর্তন-পাহাড়ের পাদদেশ ছেড়ে কলোনিতে বাস করছে এখন শবররা। তরুণ প্রজন্ম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হচ্ছে। বর্তমানে শবরদের মধ্যে মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ফেসবুক ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়।

গ্রন্থের উপসংহারে সময়ের ¯্রােতে শবর জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগানোর দিকগুলো তুলে ধরা হয়। এখানে বলা হয়, যারা কৃষি জমিতে কাজ করতো, তাদের পোষ্যদের মধ্যে এখন কেউ কেউ লেখাপড়া করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে।

সেনাবাহিনীতেও তারা চাকরি করছে। তরুণ সম্প্রদায়েরের মধ্যে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি তথা মোবাইল ফোন, ইমেল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদি নিউ মিডিয়ার সঙ্গে পরিচিতি হচ্ছে। শবর সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের রীতি-নীতি ও জীবনসংস্কৃতিতে শ্রদ্ধাশীল হলেও শবরদের মধ্যে এখন অনেকে পূর্ব পুরুষের পেশা হিসেবে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ না করে সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরি করতে প্রত্যাশি। গবেষক আখতার হোসেন গ্রন্থটিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শবরদের অনালোচিত বিষয়াবলি তুলে ধরে তাঁরে সরজমিন প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় উচ্চতর শবরদের নিয়ে গবেষণা হয়নি বললেই চলে। শবরদের নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো গ্রন্থও নেই। শবর সম্প্রদায়কে বিশদভাবে জানার জন্য আখতার হোসেনের এ গ্রন্থটি-ই প্রথম গ্রন্থ বলা যায়। গ্রন্থটি অনুসন্ধিৎসু পাঠক মহলে এবং নতুন গবেষকদের তথ্য-উপাত্তের কাজে সহায়ক হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী শবর সমন্ধে জানতে আগ্রহী পাঠকের কাছে গ্রন্থটি সাদৃত হতে পারে।

এইচআর/জেআইএম