ভালোবাসার রূপান্তর : আদি-অন্তে প্রেমবন্দি জীবন
ভালোবাসার কি রূপান্তর হয়? এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া বোধ করি সম্ভব নয়। অনেকেই এই প্রশ্নের হ্যাঁ-বোধক উত্তরের সঙ্গে বিরোধিতা করবেন। আবার অনেকে রূপান্তরের সপক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। এর কারণ, আমাদের যে যাপিত জীবন তা একদিকে যেমন নানা বাঁকে পরিপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি বহু বর্ণিল। তাই এ জীবনকে নির্দিষ্ট ছকে ফেলে পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন।
কাজী এনায়েত উল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘ভালোবাসার রূপান্তর’। প্রথম হলেও উপন্যাসে সূচনালগ্নের বালখিল্যতা নেই। লেখকের জন্ম ষাটের দশকের শেষভাগে। ব্যক্তি জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, পরিমিতি বোধ গভীরভাবে উপন্যাসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। উপন্যাসের পরিবেশ সৃষ্টি, চরিত্র রূপায়ন, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবমনের অন্তর্দ্বন্দ্ব চিত্রণে লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দৃশ্যময় বর্ণনাশৈলীর কারণে উপন্যাসের চরিত্রগুলো পাঠক কেবল পাঠ-ই করেন না, দেখেনও যেন। ফলে ‘ভালোবাসার রূপান্তর’ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শাহানা। পার্শ্বচরিত্রের মধ্যে শাহানার মা ফারহানা রহমান ফিনা, প্রেমিক শাহেদ এবং ফিনার প্রাক্তন প্রেমিক রাহাত আহমেদ প্রধানতম। উপন্যাসের পথরেখায় এর বাইরেও কিছু অপ্রধান চরিত্র রয়েছে। অপ্রধান হলেও লেখক চরিত্রগুলো সৃষ্টি করতে অযত্ন করেননি।
অর্থনীতির ছাত্রী শাহানা। মা ফারহানা রহমান ফিনা। বাবা মারা গেছেন। মায়ের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাস শুরু। শাহানা মায়ের সঙ্গে যায়নি। মায়ের আলমারি ছিলো শাহানার কাছে অভেদ্য, রহস্যময়। আলমারির ভেতর কী আছে সে জানে না, মা-ও তাকে কখনো বলেনি। এবার চট্টগ্রাম যাওয়ার পূর্বে মা ফিনা তার কাছে আলমারির চাবি দিয়ে গেছেন। শাহানাও আগ্রহের তুঙ্গে থেকে আলমারি খোলে। সেখানে কাঠের বাক্সে মেলে কিছু পুরাতন চিঠি। চিঠিগুলো প্রায় চল্লিশ বছর আগে ফ্রান্স থেকে পাঠিয়েছেন ফিনার প্রেমিক রাহাত আহমেদ। চিঠি পড়ে শাহানা বুঝতে পারে, তার মায়ের সঙ্গে রাহাত আহমেদের প্রেম হয়েছিল সত্য, কিন্তু রাহাত ফ্রান্সে চলে যাওয়ায় সে প্রেম আর পরিণতি পায়নি। মা কখনো শাহানাকে তার ভালোবাসার কথা জানায়নি। সে আরেক রহস্য।
চিঠি পড়ে শাহানা ফেসবুকে রাহাত আহমেদকে খুঁজতে শুরু করে এবং পেয়েও যায়। তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও লেখক। একপর্যায়ে শাহানার সঙ্গে রাহাত আহমেদের দেখা হয়। তখনো বিষয়টি মাকে জানায়নি শাহানা। কেবল জানে তার প্রেমিক শাহেদ। একসময় মাকে জানিয়ে শাহানা রাহাত আহমেদকে ঘুরতে নিয়ে যায় মধুপুরে, তাদের নিসর্গবাড়ি বনছায়ায়। বনছায়া শাহানাদের পারিবারিক একটি প্রজেক্ট, উদ্দেশ্য আদিবাসীদের আত্মসামাজিক উন্নয়ন। সেদিন রাহাত আহমেদের জন্মদিন ছিল। ফিনার পরোক্ষ ভূমিকায় বনছায়ায় ব্যতিক্রমী আয়োজনে রাহাতের জন্মদিন উদযাপন করা হয়।
শাহানার দৃষ্টিতে রাহাত আহমেদের ব্যক্তিত্বকে অনেক আকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য মনে হয়। সে তার সঙ্গ উপভোগ করে। একই সঙ্গে প্রেমিক শাহেদের আচরণে সে বিরক্ত। তার মতে শাহেদ ব্যাকডেটেড। তার মধ্যে কৌতূহল, দ্বিধা-সঙ্কোচ রয়েছে প্রচণ্ড মাত্রায়। তার মন-মানসিকতা জটিল কমপ্লেক্সে ভরা। এ কারণে সে ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে চায়। তার ইচ্ছে প্যারিস যাবে। ইচ্ছেটা তৈরি হয়েছে রাহাত আহমেদের কারণেই। ইতোমধ্যেই বয়সের ভেদ ভেঙে শাহানা রাহাতকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? বন্ধু না-কি প্রেমিক?
উপন্যাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শাহানা ও রাহাত আহমেদের সম্পর্কটি রহস্যময়। মাত্র তিন দিনের প্রত্যক্ষ দর্শনে তাদের সম্পর্ক ঠিক বন্ধুত্বে থাকেনি, বরং আরও অগ্রসর হয়েছে। বিশেষত, শাহানার অপরিসীম মুগ্ধতা ও আচরণ, শাহেদ ও রাহাত আহমেদের তুলনা-বিষয়ক আলোচনা তাদের সম্পর্কটিকে প্রেমের দিকে ধাবিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। উপন্যাসের শেষে রাহাত আহমেদ ফ্রান্সে চলে যাবেন। তাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাচ্ছে শাহানা। লেখক তখনকার বর্ণনা দিচ্ছেন : ‘শাহানা পরিণত মনস্ক মায়াবতী এক তরুণী। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। ...এবার সবচেয়ে প্রিয় ভরসার মানুষটিকে বিদায় দিতে হবে তাকে। শাহানা নিজের সবটুকু ভার শূন্য করে রাহাতকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। রাহাত তাকে আরেকবার আদর করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।’ এই দৃশ্যে প্রতীয়মান যে, মা ফিনার প্রাক্তন প্রেমিক রাহাত আহমেদ হয়ে উঠেছে শাহানার ভরসাস্থল ও ভালোবাসার মানুষ। অর্থাৎ ভালোবাসার রূপান্তর ঘটেছে। যদিও লেখক সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। অবশ্য এই না-বলা রহস্যই উপন্যাসের সৌন্দর্য।
এ উপন্যাসে লেখকের ভাষাভঙ্গি প্রশংসনীয়। গতিময় গদ্যে তিনি উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একই সঙ্গে উপন্যাসে লেখকের পর্যবেক্ষণ, রুচিবোধ ও বিস্তৃত বর্ণনা উপভোগ্য। উপন্যাসে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের উপস্থাপনও যথাযথ। বৃষ্টি, বৃক্ষ, ফুল, বন, পাখি কিছু বাদ পড়েনি। লেখক বিভিন্ন পর্বে কবিতার পঙক্তি ব্যবহার করেছেন। কখনো রবীন্দ্রনাথের ‘একটি শিশির বিন্দু’, কখনো ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মহুয়া পালার অংশবিশেষ। কবিতার পঙক্তিগুলো চরিত্র চিত্রণে বাড়তি আবেদন যুক্ত করেছে। আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের কথা না বললেই নয়—চিঠি ও ফেসবুক। উপন্যাসের সূত্রপাত চিঠিকেই উপজীব্য করে। অন্যদিকে বিস্তার ফেসবুকের মাধ্যমে। মায়ের সযতনে সংরক্ষণে রাখা চিঠি পড়েই শাহানা রাহাত আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পরে ফেসবুকের মাধ্যমেই তাদের যোগাযোগ হয়। চিঠি ও ফেসবুক—দুটি দুই সময়ের যোগাযোগ মাধ্যম হলেও এ উপন্যাসে এর অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। উপন্যাসের কোনো কোনো স্থানে ঘটনা খুব দ্রুততর এগিয়েছে, এটি কিছুটা মন্থর হতে পারতো।
উপন্যাসের কয়েকটি স্থানে দার্শনিক উপলব্ধি রয়েছে। শাহানার চিন্তার গভীরে থাকা ভাষ্যগুলো এরকম : ‘আমরা কেউই প্রথমত প্রথম জায়গা নিয়ে থাকি না। এই যে এখন আমি যেখানে আছি দাঁড়িয়ে, বসে অথবা শুয়ে—হয়তো স্থির হয়ে আছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, আমরা পলে পলে সরে যাচ্ছি অনেক দূরে। কারণ পৃথিবী স্থির নয়। ...ছুটে চলা জাহাজ অথবা পৃথিবী নামক গ্রহ তার কাজ করতে থাকে, আমরা তাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি না।’ এই যে ‘আমরা কেউই প্রথমত প্রথম জায়গা নিয়ে থাকি না’, সরে যাই—এমন দাশর্নিক চেতনার কারণেই ‘ভালোবাসার রূপান্তর’ ঘটে।
‘ভালোবাসার রূপান্তর’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন হিমেল হক। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২০। ৮৮ পৃষ্ঠা। মূল্য ২০০ টাকা।
এসইউ/এমএস