টাইটানিকের বেঁচে যাওয়া ৬ চীনা নাবিকের গল্প
জেমস্ ক্যামেরনের ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র ‘টাইটানিক’ আমি একাধিক বার দেখেছি। ১৯৯৭ সালের এই চলচ্চিত্রে, আমার বিচারে, সবচেয়ে টাচি দৃশ্য হচ্ছে নায়ক জ্যাকের মৃত্যু। দুর্ঘটনার পর টাইটানিক যখন ডুবতে শুরু করে, তখন প্রেমিকা রোজকে বাঁচাতে জ্যাক সম্ভাব্য সবকিছুই করে। এদিকে রোজ লাইফবোটে জায়গা পেয়েও, জ্যাককে ছাড়া বোটে উঠতে অস্বীকৃতি জানায় ও থেকে যায় প্রেমিকের সঙ্গে। তারপর যখন টাইটানিক পুরোপুরি ডুবে গেল, তখন জ্যাক ও রোজ—দু’জনই অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। রোজের গায়ে তবু্ও একটা লাইফ জ্যাকেট আছে। কিন্তু জ্যাকের গায়ে তা-ও নেই। জ্যাক তখন মরিয়া প্রেমিকাকে বাঁচাতে। সে একসময় খুঁজে পায় জাহাজের একটি ভাঙা দরজা। ভাসমান দরজায় সে তুলে দেয় রোজকে। নিজেও উঠতে চেষ্টা করে। কিন্তু ছোট দরজার পক্ষে দু’জনকে বহন করা সম্ভব নয়! জ্যাক বুঝতে পারে, শুধু একজনের পক্ষেই এভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। সে নিজে মৃত্যুকে বেছে নিয়ে প্রেমিকাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বরফশীতল পানিতে জমে মারা যায় জ্যাক। ভাসমান দরজার উপর কোনো রকমে বেঁচে থাকে রোজ। একসময় একটি লাইফবোট ফিরে এসে উদ্ধার করে রোজকে।
টাইটানিক চলচ্চিত্রের এই সবচেয়ে টাচি দৃশ্যটি চিত্রায়ন করতে পরিচালক জেমস্ ক্যামেরন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বাস্তবের টাইটানিকের একজন চীনা যাত্রীর দ্বারা। ওই চীনা যাত্রী ঠিক এভাবেই নিজেকে রক্ষা করেছিলেন ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিলের মধ্যরাতে, হিমশীতল আটলান্টিক মহাসাগরে।
সেই রাতে টাইটানিকের দেড় হাজারের বেশি যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। এর মূল কারণ, টাইটানিকে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক লাইফবোটও ছিল না। দাম্ভিক নির্মাতারা হয়তো ভেবেছিলেন, যে-জাহাজ কোনোদিন ডুববেই না, সে-জাহাজে এতো বেশি লাইফবোট রাখার প্রয়োজন কী! আবার এও শোনা যায় যে, তৎকালীন সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিধি অনুসারে ঠিক যতগুলো লাইফবোট থাকার কথা ছিল, ঠিক ততগুলো লাইফবোটই জাহাজে ছিল। তবে, বাস্তবে সেটা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
টাইটানিক ছিল ব্রিটেনের হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানির একটি যাত্রীবাহী জাহাজ। এটি তৈরি হয় বেলফাস্টের ‘হারল্যান্ড অ্যান্ড ওল্ফ’ শিপইয়ার্ডে। নির্মাতা তখন গর্ব করে বলেছিলেন, টাইটানিক কোনোদিন ডুববে না। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল গর্বে মাথা উঁচু করেই তৎকালের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ টাইটানিক, ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথের নেতৃত্বে, আনুমানিক ২২২৪ জন যাত্রী নিয়ে ব্রিটেনের সাউথহ্যাম্পটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। যাত্রীদের মধ্যে অনেক ধনী ও তথাকথিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শত শত অভিবাসীও, যারা নতুন জীবনের সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন। বলা বাহুল্য, যাত্রীদের মধ্যে ৮ জন চীনা নাবিকও ছিলেন। এদের মধ্যে ৬ জন সেদিন নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন, অনেকটা নিজেদের সাহসিকতা ও বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে। কিন্তু টাইটানিক নিয়ে রচিত বিভিন্ন ইতিহাসে তাদের কথা বলতে গেলে অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে। টাইটানিক চলচ্চিত্রের পরিচালনক জেমস্ ক্যামেরন বলেছেন, চীনাদের সাহসিকতার গল্প কেন যেন কেউ বলেনি বা বাদ দিয়েছে।
অনেকে বাদ দিলেও, খোদ জেমস্ ক্যামেরন চীনা নাবিকদের সাহসিকতার গল্প বলেছেন। না, তার টাইটানিক চলচ্চিত্রে সেসব নাবিকের কথা উঠে আসেনি। চলচ্চিত্রে কোনো চীনা চরিত্র দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে, ক্যামেরনের প্রযোজনায় ‘দা সিক্স: দি আনটোল্ড স্টোরি অব আরএমএস টাইটানিকস চায়নিজ প্যাসেঞ্জারস’ নামক তথ্যচিত্রে ইতিহাসের ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা ৬ চীনা নাবিকের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে।
টাইটানিক চলচ্চিত্রের নায়ক জ্যাক ও তার বন্ধু জুয়া খেলে জাহাজের টিকিট জিতেছিলেন। সেই টিকিটের কল্যাণে অপ্রত্যাশিতভাবেই তারা টাইটানিকের প্রথম ও শেষ সমুদ্রযাত্রায় সামিল হবার সুযোগ পায়। আর বাস্তবে যে ৮ চীনা নাবিক ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল টাইটানিকের তৃতীয় শ্রেণির যাত্রী হয়েছিলেন, তাদের টিকিট কেটেছিল সংশ্লিষ্ট নিয়োগদাতা কোম্পানি। সবাই জানেন, যাত্রার মাত্র ৪ দিন পর ‘আনসিঙ্কেবল’ টাইটানিক একটি বিশাল বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। ডুবতে বিশাল এ জাহাজটির প্রায় ২ ঘণ্টা লেগেছিল। হতে পারে, এই দীর্ঘ সময় নিজেদের রক্ষায় কাজে লাগাতে পেরেছিলেন চীনা নাবিকরা।
আগেই বলেছি, ৮ জন চীনা নাবিকের মধ্যে ৬ জন সেদিন নিজেদের জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে লি পিং, ছাং ছিফ, লিং হি ও আলি লাম একটি ফোল্ডিং লাইফবোটে উঠতে সক্ষম হন। টাইটানিক পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, জাহাজের শেষ লাইফবোটে ওঠার সুযোগ হয় ছোং ফু’র। আর ফাং লাং অথৈ সমুদ্রে খুঁজে পান জাহাজের একটি ভাঙা দরজা। সেই দরজার উপর—ঠিক চলচ্চিত্রের নায়িকা রোজের মতো—তিনি ভেসে ছিলেন এবং একসময় তাকে সে অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, ঠিক যেভাবে উদ্ধার হন রোজ। তথ্যচিত্র ‘দা সিক্স’র পরিচালক আর্থার জোন্স মুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, সেদিন ৮ জন চীনা যাত্রীর মধ্যে ৬ জন নিজেদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন; অন্যভাবে বললে, ৭৫ শতাংশ চীনা যাত্রী সেদিন প্রাণে বেঁচেছিলেন!
এই ৬ চীনা নাবিক সেদিন—জেমস্ ক্যামেরনের ভাষায় তাদের ‘উদ্ভাবনপটুতা’র কারণে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তবে, তাদের দুর্দশার শেষ হয়নি। টাইটানিকের অন্য অনেক বেঁচে-যাওয়া-যাত্রীর মতো তাদের নিউইয়র্কের এলিস দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তাদের ঠাঁই হয়নি। কারণ তখন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী ও বিতর্কিত ‘চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’ কার্যকর ছিল। আইনে চীনা অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই আইনেই ৬ চীনা নাবিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত হন। তারা একটি ফলের জাহাজে করে হাজির হন কিউবায়। কিউবা থেকে তারা ফিরে যান আবার ব্রিটেনে।
১৯১৪ সালে ছাং ছিফ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে লন্ডনের একটি অচিহ্নিত কবরে সমাহিত করা হয়। আলি লামকে একসময় হংকং বা শাংহাইয়ে নির্বাসিত করা হয়। তার সম্পর্কে বা তার সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। লিং হি একটি জাহাজের নাবিক হিসেবে কাজ নিয়ে ভারতে যান। তার সম্পর্কেও আর কিছু জানা যায়নি। আর ছোং ফুকে আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। কারণ এ নামে আরও অনেকের অস্তিত্ব ছিল। তাই ঠিক কোনজন যে টাইটানিকের ছোং ফু, তা বলা মুশকিল। এদিকে লি পিং অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে কানাডায় পৌঁছান এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। আর এ ৬ জনের মধ্যে একমাত্র ফাং লাং অনেক কাল পরে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সুযোগ পান এবং সেখানে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
টাইটানিক ডুবেছিল ১০৯ বছর আগে। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক বাদে আরএমএস কারপেথিয়া নামক আরেকটি জাহাজ সমুদ্রে বিভিন্নভাবে বেঁচে থাকা টাইটানিকের আনুমানিক ৭১০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে। ১৯৮৫ সালে সমুদ্রের ১২,৪১৫ ফুট গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে মার্কিন নেভি; উদ্ধার করা হয় হাজার হাজার শিল্পকর্ম, যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। টাইটানিক নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে অনেক গ্রন্থ, চলচ্চিত্র, গান। দুর্ঘটনা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সর্বশেষ মারা যান মিলভিনা ডিন, ২০০৯ সালে। টাইটানিকডুবির সময় তার বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। আর মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। খবরটিও তখন বিশ্বব্যাপী ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। বস্তুত টাইটানিককে নিয়ে বিগত শত বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু সেই ৬ চীনা নাবিকের সাহসিকতার গল্প কেউ বলেনি। তাদের বিরুদ্ধে বরং মিথ্যাচার হয়েছে।
শত বছর পর এসে বেঁচে যাওয়া ৬ চীনা নাবিকের ‘উদ্ভাবনপটুতা’ বা সাহসিকতার কথা জেমস্ ক্যামেরনরা বলছেন। কিন্তু শত বছর আগে তাদের মুখে কালিমা লেপনের অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন তাদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেওয়া অনেক মিথ্যার মধ্যে একটি ছিল এমন: চীনা নাবিকরা মেয়েদের পোশাক পরে লাইফবোটে স্থান করে নিয়েছিলেন। এখনো এ ধরনের অনেক গুজব প্রচলিত আছে। ‘দা সিক্স’ তথ্যচিত্রে এমন মিথ্যাচার খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন জেমস্ ক্যামেরন ও আর্থার জোন্স।
আলোচ্য তথ্যচিত্রে ফাং লাংয়ের ছেলে টম ফং এর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার পিতাকে স্রেফ জাতিগত পরিচয়ের কারণে বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছিল। পিতা তার সারাজীবন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে ছিলেন। টাইটানিক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া চীনা নাবিকদের সবাই বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন—যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে। তাদের উত্তরসূরিদের অনেকেই বেঁচে আছেন। কিন্তু তারা তাদের পূর্বসূরিদের ওপর হওয়া অত্যাচার-নির্যাতনের গল্প শেয়ার করতে চান না। হতে পারে, তারা ক্যামেরার সামনে এসে নিজেদের এক্সপোজ করতে ভয় পান। বর্ণবাদী আচরণের শিকার তারাও কমবেশি হয়েছেন ও হচ্ছেন। এখন সেটা আরও বাড়ুক, সেটা তারা চান না।
তবে টম ফং ব্যতিক্রম। তার বাবা খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন সমাজের বর্ণবাদ ও বিদ্বেষ থেকে রেহাই পাননি। পিতার সত্য গল্প তুলে ধরতেই টম ফং ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। তিনি চান, তার পিতা এবং টাইটানিক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ৬ চীনার সত্যিকারের কাহিনি বিশ্ববাসী জানুক।
শত বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল, এখনো আছে। এখন আর চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট নেই। কিন্তু চীনা-আমেরিকান তথা এশিয়ান-আমেরিকানদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব মার্কিন সমাজে স্পষ্টভাবেই রয়ে গেছে। সম্প্রতি সেই বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে ভয়ঙ্করভাবে। এ কথা সত্য যে, মার্কিন সমাজের বৃহত্তর অংশ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। তবে সেখানে বর্ণবাদীরা এখনো অনেক শক্তিশালী। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে তথাকথিত ‘হোয়াইট সুপ্রেমেসিস্ট’ বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তাণ্ডব বিশ্ব দেখেছে। এখন বাইডেন আমলে তাদের অপতৎপরতা হয়তো খানিকটা কমবে। কিন্তু মার্কিন সমাজের এই ক্যান্সার সহসা সারবে বলে মনে হয় না। টাইটানিক ডুবেছিল শত বছর আগে। তখনো মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ ছিল, এখনো আছে। টাইটানিকের মতো এ ক্যান্সার একদিন ধ্বংস হবে কি-না, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)। ই-মেইল: [email protected]।
এসইউ/এএসএম