মায়াবতী : পর্ব ০৩
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি।
দুই.
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। শীত শীত লাগছে ঘরে। গায়ে চাদর মুড়িয়ে হাঁটু পেটের মধ্যে গুঁজে ঘুমাচ্ছে রিয়া। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে ও। আজ প্রায় ন-টা বেজে যাচ্ছে, তবু ঘুম ভাঙছে না।
রাহেলা চৌধুরি রিয়ার ঘরে ঢোকেন। জানালার পর্দা সরিয়ে দেন। বাইরে আলো নেই। রোদ নেই। তবুও আঁধার-আলো পরশে ঘরের অন্ধকার ভাব কেটে গেছে।
মেয়ের কাছে এলেন তিনি। অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়ে।
পিঠের দিকে চাদর সরে আছে। মমতামাখা হাতে চাদর ঠিক করে দিলেন। কপালের ওপর থেকে কয়েকটি চুল মুখের ওপর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। চুলগুলো ঠিক করে দিতে যাচ্ছিলেন। হাত বাড়িয়েছিলেন। পরক্ষণেই হাত সরিয়ে নেন তিনি।
ল্যান্ডফোনের টোন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ফোন বেজে উঠেছে।
ফোনের শব্দে ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে দ্রুত তিনি বসার ঘরে এসে রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরে চুপ হয়ে থাকলেন। মুখে হ্যালো জাতীয় কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। ইদানীং এমন অভ্যেস হয়েছে। উটকো ফোন থেকে বাঁচার জন্যই এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
অপরপক্ষ থেকে কোনো সাড়া আসছে না।
অনেকক্ষণ রিসিভার কানের কাছে ধরে রাখলেন তিনি। লাইন কেটে দিচ্ছেন না।
রি! কথা বলো। চুপ করে আছো কেন? তুমি যেমন চাও আমি তেমন হব। কথা বলো। অপরপ্রান্তে এক তরুণকণ্ঠ। কণ্ঠে আকুলতা আছে।
আকুলতা কতটুকু মৌলিক বোঝার চেষ্টা করেন রাহেলা চৌধুরি। কোনো জবাব না দিয়ে কথা শুনছেন তিনি।
আমি কথা দিচ্ছি আর পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে ঘুরব না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। ফ্রড না আমি। আমার বাবার বিরাট ব্যবসা আছে। তোমার মা-বাবা রাজি হবেন নিশ্চয়।
ছেলেটার কথা শুনে রাহেলা চৌধুরির মাথা জ্যাম হয়ে গেল। নিজের মধ্যে উদ্বেগ ঢুকে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে লাগলেন তিনি। ধমক দিয়ে বললেন, এই ছেলে, কী নাম তোমার? বাবার নাম কী?
লাইন কেটে গেল। কেটে যাওয়ার শব্দ পেয়েও থামতে পারছেন না রাহেলা চৌধুরি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন। একসময় রিসিভার রেখে মেয়ের ঘরে ঢুকে দেখেন মেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছে। এত বেলা করে ঘুমাতে দেওয়া উচিত না।
মেয়ে কি তবে বখাটের পাল্লায় পড়েছে। ছেলেটা পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। বাবা ব্যবসায়ী। উহ্। ভাবতে পারছেন না তিনি।
টেনশনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ বেড়ে গেল। ক্ষোভ গিয়ে পড়ল মেয়ের ওপর।
ওঠো রিয়া। আর কত ঘুমাবে। ওঠো।
গলা বেশ চড়া, বেশ অনিয়ন্ত্রিত। উগ্র।
ঘুম ভেঙে গেল রিয়ার। মায়ের চড়া গলা একদম পছন্দ না।
চোখ খুলেই ধমকে ওঠে রিয়া, চিৎকার কোরো না। ঘুমাতে দাও।
আর কত ঘুমাবে? ওঠো। রাহেলা চৌধুরির গলা এবার আরও চড়ে গেল।
মায়ের এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত রিয়া। আজকের আচরণ একটু বেপরোয়া মনে হচ্ছে। ভিন্ন মনে হচ্ছে। ক্রোধ সামলে উঠে ঘুম জড়ানো চোখে বাথরুমে ঢুকল।
বাথরুমে বসেই নিজের হ্যান্ডসেটের রিংটোন শুনতে পেল রিয়া।
একবার বেজে থেমে গেছে।
আবার বাজতে লাগল।
রাহেলা চৌধুরি সেটটা তুলে নিলেন হাতে।
ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠা নম্বরের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত হয়ে গেল ওনার মুখের প্রকাশভঙ্গি। গতকাল যে নম্বর টুকে রেখেছিলেন, এটা সেই নম্বর।
এই ছেলে রিয়াকে ডাকে ‘রি’ বলে!
রাগে, শঙ্কায় রিরি করে ওঠল রাহেলা চৌধুরির শরীর।
এ সময় রিয়া বাথরুম থেকে সামনে এসে দাঁড়াল।
রাহেলা চৌধুরি মুখ ফসকে ক্রোধ নিয়ে বলে বসেন, এটা কার নম্বর?
সেট হাতে নেয় রিয়া। মায়ের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন শুনে তারও রাগ চড়ে যায়। সেটের দিকে না তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, আমার ছেলেবন্ধুর নম্বর। ওকে আমি ভালোবাসি। এনিথিং রং টু ইউ?
মুখের ওপর আচমকা এমন ঝোড়ো উত্তর পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন রাহেলা চৌধুরি। দপ করে নিভে গেল তার রাগ। বোকার মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে রিয়া বলল,
হ্যাঁ। রিয়া বলছি। কেমন আছো তুমি?
রি! তুমি আমার কল রিসিভ করলে? উল্লসিত হয়ে পড়ে টেলিফোনের অপরপ্রন্তের তরুণটি।
হ্যাঁ। কেন রিসিভ করব না। রিয়া বলল, রিয়েলি আই লাভ ইউ।
আমাকে বিয়ে করবে?
একশোবার করব। আমি রাজি। যেদিন বলবে সেদিনই তোমার কাছে চলে আসব। কথা শেষ করে লাইন কেটে রিয়া খাটের ওপর নিজেকে ছুড়ে দিল। চাদর মুড়ে নিজেকে আড়াল করল। দেহ আড়াল হলেও মন আড়াল হলো না। অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঝলসে উঠছে রাগ। চাদরের ভেতর ফুঁসতে লাগল ও। মায়ের সন্দেহের চোখ ওর দেহে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।
অপমানে পুড়ছে দেহ। পুড়ছে মন।
মা তাকে সন্দেহ করে। এর চেয়ে ভয়াবহ কথা কী হতে পারে! মাঝে মাঝে নিজেকে নিজেই খামচে ধরে। নিজের মুখেই আঁচড় বসিয়ে দেয় রিয়া।
সবাই বলে কী মায়াবতী! এমন মেয়ে লাখে একটা মেলে না। ছেলেরা তো পঙ্গপালের মতো পেছনে লাগে। পিঁপড়ের দল খাবারের গন্ধ পেলে যেমন লাইন ধরে এগোয়, ছেলেরাও তার পেছনে তেমনি লাইন ধরে। কত ছেলেকে আর অবজ্ঞা করা যায়। ফেরানো এত সোজা না। লেগেই থাকে ওরা। জোঁকের মতো লেগে থাকে। ওদের ক্রেজ সামাল দেওয়ার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একজনের সঙ্গে ঝুলে পড়লেই বরং রক্ষা। বলা যাবে, নো ভ্যাকেন্সি।
ভাবতে ভাবতে রাগ কিছুটা কমে এল, অপমানের জ্বালাও। শান্ত হতে লাগল মন। ও ডাইনিং টেবিলে এলো নাশতা খেতে। সাজানো আছে সব। একা একা খেতে বসে। পরোটা, মুরগির গোশত রেঁধেছে বুয়া। বাটিতে মুরগির ঝোল―একটা রানের মাংস। একটা বুকের অংশ। রিয়া নিজেকেই যেন দেখছে বাটিতে। কেউ যেন খেতে বসেছে তাকে। মায়াবতী রিয়াকে চিবাচ্ছে, কল্পনার চোখে দৃশ্যটি দেখতে লাগল ও।
তিন.
মুঠোফোনে রিয়ার কণ্ঠ শুনে চিৎকার দিয়ে ওঠে মুনা। প্রশ্ন করল, তুই কোথায়? বেঁচে আছিস!
রিয়া বলল, বেঁচে আছি?
যাক বাঁচালি। মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
মামণি কেমন আছে? বাপি? রিয়া শীতল গলায় জানতে চায়।
আন্টি শয্যাশায়ী। তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে রাখা হচ্ছে। আঙ্কেল থানায় জিডি করেছেন। পাগলের মতো তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
একটু চুপ থাকে রিয়া। কথা বলতে পারছে না। বুক ভেঙে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। বাবার জন্য কষ্ট। মায়ের জন্য কষ্ট।
মুনা আবার প্রশ্ন করল, তুই নিজে ভেগেছিস, নাকি মাস্তানরা তুলে নিয়ে গেছে?
মায়ের ওপর রাগ করে এক মজনুর কাছে চলে এসেছিলাম।
মজনু মানে? মুনার কৌতূহলী প্রশ্ন।
আসল মজনু না। নকল মজনু। মাদকাসক্ত। ওদের দলের সবাই আমাকে আটকে রেখেছে। কোথায় রেখেছে বুঝতে পারছি না।
মুনা আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে। কাঁপতে থাকে ভয়ে।
মুনার চিৎকার শুনে রেজা এগিয়ে আসে। হ্যান্ডসেটটি হাতে নেয়।
কে বলছেন? রেজা ভারী গলায় জানতে চায়।
মুনা চিৎকার দিয়ে বলে, রিয়া। রিয়া। মামা, রিয়া ফোন করেছে। ওকে বখাটে মাস্তানরা আটকে রেখেছে।
মুনার কথা শুনতে পেল রিয়া। সেট অন আছে।
মামা আবার প্রশ্ন করল, রিয়া, কোথায় তুমি? লোকেশন বলো?
মামার কণ্ঠ শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রিয়া। নিজের ভেতরের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে যায়।
জানি না মামা, কোথায় জানি না। একজনের পকেট থেকে মোবাইল ফোনসেট সোফায় পড়েছিল এককোণে। ওই মোবাইল থেকে কল করেছি। ওরা এখন বাইরে গেছে। একটু পরে আবার আসবে। আমাকে বাঁচান মামা। কেন যেন আপনার কথা প্রথম মনে হয়েছে। এ কারণে মুনার নম্বরে ফোন করেছি।
তুমি ভয় পেয়ো না। ভেঙে পোড়ো না। শক্ত থাকো। মোবাইল কল ট্রেসিং করে আমরা লোকেশন জেনে যাব। পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার আমার বন্ধু। তোমাকে দ্রুতই আমরা উদ্ধার করে নিয়ে আসব।
কথা শেষ করে রেজা লাইন কেটে দেয়। রিয়াকে উদ্ধারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মামার কথা শুনে সাহস জাগে রিয়ার মনে। মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের মমতার কথা মনে পড়ে।
মা বকাঝকা করতেন ঠিক। মায়ের বকাঝকা রাগ-অভিমান আর সবকিছুর উলটো পিঠে ছিল কেবল রিয়ার শুভকামনা। রিয়াকে বড়ো করা। এমন মায়ের ওপর কি রাগ করা যায়? অভিমান করা যায়?
যায় না। ভাবতে ভাবতে কাঁদতে লাগল রিয়া। বদ্ধঘরের ভেতর অসহায় লাগছে নিজেকে। চারপাশ থেকে দেয়ালগুলো যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। দেয়াল ভেঙে ওকে বেরোতে হবে, বখাটেদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। রেজা মামা আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন ভেঙে না পড়তে।
রিয়া ভাঙবে না।
মনের জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে তাকে কৌশলী হতে হবে। বুদ্ধি খাটাতে হবে। বুদ্ধি দিয়েই জয় করতে হবে এ বিপর্যয়। শক্ত হয়ে চোখের পানি মুছতে লাগল রিয়া। নিজের ভেতর অন্য রিয়া জেগে উঠছে। এই রিয়া অনেক শক্ত। অনেক বাস্তববাদী। এই রিয়া শিক্ষা পেয়েছে―আবেগ না, বুদ্ধি দিয়েই জয় করতে হবে চারপাশের জঞ্জাল, জটিলতা।
রিয়ার চোখে শূন্যতা ভেসে ওঠে। শূন্য বৃত্তের পরিধিতে ভেসে উঠছে এক পূর্ণ জীবনের রেখাচিত্র। ওই পূর্ণতার প্রতি বড়ো লোভ জাগে রিয়ার মনে।
চলবে...
এসইউ/এএসএম