মায়াবতী
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রিয়া। ওর মুখে ফুটে আছে মৃদুহাসি। ওর চোখও হাসছে। পুরো দেহ হাসছে।
রিয়ার চোখ বড় বড়। টানাটানা। টানা চোখের ভ্রু প্ল্যাক করেছে ও। স্ট্রেইট প্ল্যাকে মুখের ওপর ফুটে আছে রূপের দ্যুতি, মোহনীয় মায়া। ভ্রুর নাচনে টলে টলে উঠছে মায়ার ঢেউ।
খোলা জানালা দিয়ে হালকা বাতাস ঢুকছে ঘরে। বাতাসে নড়ছে ওর পরনের শাড়ির আঁচল। তাঁতের শাড়িটার ডিজাইনে আছে বৃত্তের আকারে ছোটো ছোটো খোপ। সবুজ ও ঘিয়ে রঙের সিরিজ খোপের শাড়ির আঁচল নিচের দিকে টেনে ধরে ও সামনে তাকিয়ে দুই কদম এগিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকাল একবার।
গলায় পরেছে মেটালিক জুয়েলারি। গয়নাটা বেশ বড়ো। কানের দুল তুলনামূলক ছোটো। দুলটা বাঁ হাতে ছুঁয়ে মাথাটা একবার ঘুরিয়ে নিল রিয়া। হাত-খোঁপা করেছে ও। খোঁপায় গোলাকারে গুঁজে দিয়েছে বেলিফুল। সাজানো ফুলের বৃত্তের মাঝে গিটার ও চুমকির ডিজাইন দারুণ মানিয়েছে ওকে।
ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে রিয়ার দিকে এগিয়ে এল কুসুমকলি। কাছে এসে হাত ধরে মুগ্ধ চোখে রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কী দেখছিস? চপল ভঙ্গিতে জানতে চায় রিয়া।
কিছু না। কিছু না। আরও চটুলভাবে উত্তর দিল কুসুমকলি।
ওরা দুই বান্ধবী। একই অ্যাপার্টমেন্টের উপরে-নিচে ফ্ল্যাটে থাকে। একসঙ্গে বেড়াতে যাবে দুজন। আজ ওদের বান্ধবী মুনার জন্মদিন। জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ওরা।
এ সময় রিয়ার মা, রাহেলা চৌধুরি সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চমকে উঠে তাকালেন কুসুমকলির দিকে।
রাহেলা চৌধুরির মনে কাঁপন জাগল। উদ্বেগে টলে উঠলেন তিনি।
কেন কাঁপন, কেন উদ্বেগ―বুঝে উঠতে পারছেন না। ভেতর থেকে ধেয়ে এসেছে অজানা শঙ্কা। মুখের পেশিতে ভাঁজ পড়ে গেছে। প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে উৎকন্ঠার ছাপ, চোখের ঘূর্ণিতেও ফুটে উঠেছে ভয়। গাঢ়স্বরে জানতে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবে তোমরা ?
কুসুমকলি সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
আন্টি, আমরা লালমাটিয়া যাব। মুনার জন্মদিন আজ। বলতে বলতে রাহেলা চৌধুরির হাত ধরল সে।
কুসুমের হাতের ছোঁয়া পেয়ে বাস্তবে ফিরে এলেন মিসেস চৌধুরি। তার মনে হালকা স্বস্তি জাগে। মুখের রেখায় মৃদুহাসি ফুটে ওঠল। তিনি এবার তাকালেন ওর খোঁপার দিকে। ফ্রেঞ্চ রোল খোঁপা করেছে কুসুমকলি। চিকন ঘাড়ে চুল নেই। চুল সব উঠে আছে উপরের দিকে, অনেকটা শূন্যে গোলাকারে বসে আছে চুলের খোঁপাটা। কুসুমও রিয়ার শাড়ির মতো একই তাঁতের শাড়ি পরেছে। দুই তরুণীর দিকে তাকিয়ে মায়ের মনে এবার বিস্ময় জেগে ওঠে। দুজনেই হালকা মেকআপ নিয়েছে। মেকআপে কোনো বেইস ব্যবহার করেনি ওরা। চোখে কাজল ও মাশকারা লাগিয়েছে কেবল।
সাধারণত শাড়ি পরে না ওরা। আজ পরেছে। সেজেছে। সাজুগুজু অবস্থায় দুজনকে নতুন লাগছে। দুই অপ্সরী যেন নেমে এসেছে সামনে।
আচমকা ঘোর কেটে গেল রাহেলা চৌধুরির। সনাতন মায়ের মন সামনে এসে দাঁড়াল।
একা যাবে তোমরা ?
একা কেন আন্টি ? আমরা তো দুজন। দুজনই যাব।
না। সে কথা বলছি না। বলছি বাসার আর কেউ যাবে না সঙ্গে ?
না আন্টি। আমাদের সব বান্ধবী আসবে মুনার বাসায়। আমাদের একটা গেট টুগেদার হবে আজ। খুব মজা করব দল বেঁধে।
ইয়ে, মানে বলছি কি আমি কি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি ?
কুসুমকলি হাসল। রিয়া এবার সামনে এসে মায়ের হাত ধরে বলল।
কেন মামণি, তোমার যাওয়ার প্রয়োজন কেন ?
না। এমনি। তোমাদের সঙ্গে আমিও একটু ঘুরে এলাম। তোমরা বাইরে গেলে তো একদম একা হয়ে যাই। বোর লাগে।
আহা! মামণি, এটাই তো জীবন। আমরা তোমার কাছে থাকলে আনন্দ পাবে। দূরে গেলে টেনশন হবে, বোর লাগবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
তা ঠিক। তবুও তোমাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করছে।
রিয়া এবার গলার স্বর শক্ত করে বলল, যেতে চাও যাবে। কিন্তু কেন যেতে চাও, সত্যি কথাটা বলতে হবে।
সত্যিই তো বললাম।
না, সত্যি বলোনি।
সত্যি বলেছি। জোর দিয়ে বললেন মিসেস চৌধুরি।
রিয়া আরও জোরে বলল, তুমি আসলে আমাদের বিশ্বাস করতে পারছ না। আসলে আমাদের ফ্রিডম দিতে চাও না, রুদ্ধ করে রাখতে চাও ? ঠিক না, মামণি ?
মেয়ের গলার জোশ দেখে দমে গেলেন রাহেলা চৌধুরি। আবার মেয়ের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। কী রূপবতী, কী মায়াবতী মেয়েটা আমার! অনুভব করে বুকের ভেতর সুখের পরশ টের পেলেন তিনি। সুখ পেলেও স্বস্তি পেলেন না। সুখের সঙ্গে মিশে আছে অস্বস্তি। রূপবতী দুই মেয়েকে একা ছাড়তে চান না তিনি। ভেতর থেকেই চান না। কেন চান না, জানেন না।
মরিয়া হয়ে ওঠলেন তিনি। বাধা না দিয়ে কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করেও। কৌশলী হতে পারছেন না। সরাসরি বলে ফেললেন, একটু কি অপেক্ষা করলে হয় না? ড্রাইভার বাইরে আছে। তোমার বাপিকে নিয়ে বারিধারা গেছে। উনি ফিরলেই গাড়ি নিয়ে যেয়ো।
রিয়ার কণ্ঠ আরও চড়ে যায়।
আমরা রিকশায় যাব। গাড়িতে যাব না। বুঝেছ ?
তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি, গাড়িতে যেয়ো।
কুসুমকলি এবার বলে, ঠিক আছে আন্টি। আমাদের গাড়ি নিয়ে যাব।
না। গাড়িতে যাব না।
রিয়া ধমক দেয় কুসুমকে। চড়া গলায় জেদ নিয়েই বলল, রিকশায় যাব। চল।
বলেই কুসমের হাত ধরে গটগট করে বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। টেনে নিয়ে এল কুসুমকে।
রাহেলা চৌধুরি বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। মন খারাপ করে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। দরজার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকালেন তিনি। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখে ফুটে ওঠে একধরনের শূন্যতা। শূন্যতা পূরণ করার কোনো উপায় নেই। অদৃশ্য শূন্যতায় কী যেন হাতড়ে বেড়ালেন তিনি। কিছুই পেলেন না খুঁজে। দরজা লাগিয়ে ফিরে এলেন বসার ঘরে। টিভি অন করা। টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা বাক্য―‘সে-ই বুদ্ধিমান যে নিজের সমালোচনা করতে পারে।’
মিসেস চৌধুরি একপলক তাকালেন টিভি স্ক্রিনের দিকে। টিভি অফ করে সোফায় বসে নিজের সমালোচনা করতে লাগলেন মনে মনে।
সত্যিই কি মেয়ের স্বাধীনতা হরণ করতে চান ?
সত্যিই ওকে রুদ্ধ করতে চান ?
না। উত্তর খুঁজে নিলেন মনে মনে।
মেয়ের স্বাধীনতা হরণ করতে চান না, মেয়েকে আটকে রাখতে চান না। মেয়ে বড়ো হোক, অনেক বড়ো হোক―এ চাওয়ায় কোনো খাদ নাই। মেয়ে বুঝতে পারেনি। তাই এমন কঠিন কথা বলে গেছে। মেয়ের কল্যাণ চান। মঙ্গল চান। ভালো চাইতে গিয়ে মেয়েকে বুকে আগলে রাখতে চান। মেয়ের বিপদ হতে পারে―এ শঙ্কা থেকে তাকে একা যেতে দিতে চাননি। এটাই সত্যি।
নিজেকে বুঝতে পেরে স্বস্তি পেলেন তিনি। মেয়ে যা-ই ভাবুক না কেন, মনের ভেতরের ভাবনা নিজেকে স্বস্তি দেয়। নিজের আলোয় ভরে ওঠে মাতৃ-মন। আর তখনই বাসা ঝলমল করে ওঠে। খুশিমনে শোবার ঘরে এলেন। শোবার ঘরের উত্তর দিকের অর্ধেক জুড়ে দেয়াল নেই। রয়েছে সøাইডিং ডোর। এ দরজা জুড়ে রয়েছে ভারি পর্দা। ঘিয়ে রঙের পর্দা টেনে নিলেন একপাশে। স্লাইডিং ডোরও খুলে দিলেন। আলোয় ভরে ওঠল ঘর।
শোবার ঘরের পাশেই বারান্দা।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার ফুলের টবগুলো দেখা যায়। অর্কিড ফুলের ভক্ত রাহেলা চৌধুরি। ফুলের টবের সারিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি অর্কিড। লাল, নীল, সাদা, খয়েরি ও হলুদ ছাড়াও বিভিন্ন রঙের মিশ্রণে বারান্দা রঙিন হয়ে আছে। এগুলো রাহেলা চৌধুরির কালেকশন। গত একমাস ধরে ফুল ফুটে আছে। শুরু থেকেই একই রকম সতেজ রয়েছে সব ফুল। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন রাহেলা চৌধুরি। সাধারণত মন খারাপ হলে তিনি বারান্দায় আসেন। ফুলের যত্ন করেন। ফুলের পরিচর্যা করতে গিয়ে মন ভালো হয়ে যায়। এখন ভালো মনেই এসেছেন তিনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন শুভ্র-হলুদ ফুলের দিকে। বিদেশি ফুল বলে নয়, ছোটোবেলা থেকেই রাহেলা চৌধুরির অর্কিড ফুল পছন্দ। ভার্সিটিতে পড়ার সময় কত ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। দেবদারু, রেইনট্রি, আম, জাম, তেঁতুলগাছেও অর্কিড ফুল ঝুলে থাকতে দেখেছেন। তখন থেকেই এ ফুল ভালো লাগত। এ দেশেই অর্কিড জন্মে। অনেকে জানে না।
সবাই বিদেশি ফুল হিসেবে অর্কিড ভালোবাসে। আর রাহেলা ভালোবাসেন দেশি ফুল হিসেবে। কোনো ফুল এতদিন তাজা থাকে না। অর্কিড ফুল থাকে। এ কারণে অর্কিডই তার প্রিয়। মেয়েদের তাজা থাকতে হয়। মøান হলে চলে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তরতাজা থাকা প্রয়োজন। যতদিন প্রাণ ততদিন তাজা। অথচ আমাদের দেশের মেয়েরা কত দ্রুত ম্রিয়মান হয়ে যায়। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়ে ঝরে যায়। সামাজিক উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষয়ে যায়। ব্যক্তিজীবন টানাপোড়েনে ঝলসে যায়। ঝলসে গেলে চলবে না। ফুলের মতো তাজা থাকতে হবে। মেয়ের জীবনও তাজা রাখতে হবে। মেয়ের অভিজ্ঞতা কম। ভুল করতে পারে। ইদানীং ফোন আসে বেশি। বেশি বেশি কথা বলে। কোন বখাটের সঙ্গে জড়িয়েছে কে জানে ? এ চিন্তায় ডুবে থাকে তার মন।
ভাবনায় ছেদ পড়ে। শোবার ঘরে মোবাইল ফোনসেট বেজে ওঠে। রিয়ার সেট। সেটের রিংটোনটা অর্পূব। রিয়া ফোন রেখে গেছে। রাগ করে বেরিয়েছে বাসা থেকে। ভুলে গেছে সঙ্গে নিতে।
রাহেলা চৌধুরি সেটটি হাতে নিয়ে ইয়েস বাটনে টিপ দিয়ে কানের কাছে ধরলেন। মনিটরে কোনো নাম ভেসে ওঠেনি। অর্থাৎ অপরিচিত কেউ ফোন করেছে। কোনো জবাব না দিয়ে সেটটা কানের কাছে ধরে চুপ করে আছেন তিনি।
হ্যালো। ফিসফিস শব্দ ভেসে এল। ছেলেকণ্ঠ। রাহেলা চৌধুরি জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকেন।
হ্যালো। হ্যালো। কথা বলো রিয়া, প্লিজ, কথা বলো ‘রি’!
রাহেলা চৌধুরির বুক ধক করে ওঠে। মুহ‚র্তের মধ্যে কপাল ঘেমে ওঠে। বুকের ঢিপঢিপ বেড়ে যায়। মাথা জ্যাম হয়ে যায়। এমন আদুরে স্বর! ছেলেকণ্ঠ। রিয়াকে ডাকছে ‘রি’ বলে! যা ভেবে শঙ্কিত ছিলেন তাই ঘটেছে। মেয়ে নিশ্চয় প্রেমে পড়েছে।
হায় হায় করে ওঠল মায়ের মন। জবাব না দিয়ে দ্রুতই তিনি রিজেক্ট বাটনে টিপ দিলেন।
উদ্বেগে ঝাঁকি খেলেন। মেয়ে প্রেমে পড়েছে এ কারণে নয়। কোন বখাটের পাল্লায় পড়েছে, এ চিন্তাই তাকে শঙ্কিত করে তোলে। ছেলেটা, ভালো হতে পারে, এমন ইতিবাচক চিন্তা মাথায় আসেনি। নিশ্চয় ছেলেটা খারাপ। ড্রাগ অ্যাডিক্ট কি না কে জানে। আজকাল মাদকের ছোবলে পর্যুদস্ত উঠতি তরুণ-তরুণীরা। পত্রিকায় প্রায়ই খবর ছাপা হয়। বাজে চিন্তার জালে জড়াতে লাগলেন তিনি।
খাবার ঘরে এলেন রাহেলা চৌধুরি। ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঠান্ডা পানি পান করলেন। আবার ফোন বেজে ওঠে। হাতেই আছে সেটটা। নম্বরটা এবার মনে মনে আওড়ালেন কয়েকবার। তারপর টুকে রাখলেন কাগজে।
শোবার ঘরে এলেন তিনি। হঠাৎ মাথায় চিন্তা এল, ওরা দুজন কি এখন মুনার জন্মদিনের পার্টিতে গেছে ? নাকি অন্য কোথাও? অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি ওদের ? প্রেমে পড়লে তো মেয়েরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে। বলতে বাধ্য হয়। ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার।
কুসুমকলির নম্বরে ফোন করলেন তিনি। নিজের ফোনসেট ব্যবহার করেছেন।
কুসুমকলি ফোন রিসিভ করে বলল, আন্টি। আমরা ঠিকমতো পৌঁছেছি।
কোথায় পৌঁছালে ?
লালমাটিয়ায়। মুনার বাসায়। কেন আপনাকে বললাম না, মুনার বাসায় যাব ?
হ্যাঁ, বলেছিলে। রিয়া নিজের মোবাইল সেট রেখে গেছে বাসায়। ওকে জানাও।
ওর সঙ্গে কথা বলবেন ?
দাও। কথা বলি।
রিয়া এগিয়ে এল। প্রথমে কথা বলতে চায়নি সে। সবার সামনে ‘সিন ক্রিয়েট’ করার কোনো ইচ্ছা হয়নি, তাই ফোন রিসিভ করে মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, বলো মা। কী বলবে।
কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুমি সেটটা রেখে গেছ, জানাতে ফোন করেছি।
হঠাৎ রিয়ার সেটের কথা মনে হলো। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি। আরও ঠান্ডা স্বরে বলল, অফ করে তোমার কাছে রেখে দাও।
মা আবার প্রশ্ন করলেন, কখন আসবে ?
কখন আসব মানে ? কিছুক্ষণ আগেই তো বাসা থেকে বেরিয়েছি।
এতক্ষণ মাথা ঠান্ডা ছিল। এবার মায়ের প্রশ্ন আবার গরম করে দিল মেজাজ। ঝাঁঝাল স্বরে বলল, যখন খুশি আসব। পেছনে লেগে থেকো না তুমি।
না। লেগে থাকার কথা না। জানতে ইচ্ছা হলো। জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম। আর জিজ্ঞেস করব না।
ঠিক আছে রাখি এবার।
না, রেখো না। মুনাকে দেবে একটু?
কেন মুনাকে কেন? ওর বাসায় এসেছি কি না যাচাই করে দেখতে চাও?
না। তা নয়। রাহেলা চৌধুরির গলা শীতলই আছে।
মিথ্যা বললেন তিনি, ওকে উইশ করব। দাও। ওকে সেটটা দাও।
উইশ করার কথা শুনে দমে গেল রিয়া। সেট মুনাকে দিল ও।
মুনা রিয়ার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। ওর চোখেমুখে ফুটে আছে আনন্দের হাসি।
মুনার উচ্ছ্বাসও রিয়ার মন ভালো করতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে মুনাকে উইশ করা মায়ের ইচ্ছা নয়। রিয়ার প্রতি সন্দেহ ঝালাই করে নেওয়াই মায়ের আসল উদ্দেশ্য। ভাবতে গিয়ে আনন্দঘন পুরো পরিবেশই তার কাছে তেতো ঠেকছে। কিছুতেই মনে আনন্দ ফিরে আসছে না। পদে-পদে মা তাকে ঘিরে রাখতে চায়। বাধা দিতে চায়। স্বাধীনতা দিতে চায় না। বিশ্বাস করতে চায় না। এসব ভাবনা আরও জটিল হচ্ছে। মনের জেদ রাগ কষ্টও বেড়ে যাচ্ছে। গুম হয়ে এককোণে চুপচাপ বসে থাকে।
সবাই আনন্দ করছে। লো ভলিউমে বেজে চলেছে রবীন্দ্রসংগীত, আমার পরান যাহা চায়...
মুনাদের বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলে আছে একটা বিরাট ডিজিটাল পোস্টার। পোস্টারে জীবন্ত হয়ে আছে ঘন বনাঞ্চল। মাঝে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনী ঝরনা। ঝরনার দুই পাশের পাহাড় ঘেঁষে ঝুলে আছে গাছের বড়ো বড়ো শেকড়বাকড়। প্রকৃতির কাছে এলে মানুষের মনের জানালা খুলে যায়। এখন ঘরে বসেও যেন প্রকৃতির গহিন অরণ্যে ঢুকে পড়েছে রিয়া। মনের জানালা খুলে গেছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। শব্দের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির উদোম সৌন্দর্যের সঙ্গে মনে মনে সে কথা বলতে লাগল, জীবনের গভীর নৈকট্যে এসে থমকে গেল ও।
মাথায় হঠাৎ হাতের ছোঁয়া টের পেল রিয়া। চোখ ঘুরিয়ে দেখল একজন সুপুরুষকে। সুদর্শন। মধ্যবয়সি কেউ। মুখে মৃদুহাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
মন খারাপ ? সুপুরুষটির ভরাট স্বর, মায়াবী প্রশ্ন।
চমকে ওঠল রিয়া। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে বলল, না, মন খারাপ না। পোস্টারটা দেখলাম। ভালো লাগছিল। মুগ্ধ হয়ে সৌন্দর্যের ভেতর ডুবে ছিলাম।
ভালো, ভালো। খুব ভালো। প্রকৃতির দিকে তাকাতে হয়। তাকালে বোঝা যায় প্রকৃতি কত সুন্দর। সুন্দর খুঁড়ে না দেখলে নিজের মন সুন্দর হয় না। তুমি সুন্দর মেয়ে, মিষ্টি মেয়ে। জানো ?
রিয়া লজ্জা পেয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, আমি রিয়া, আপনাকে তো চিনলাম না। আগে তো মুনাদের বাসায় কখনো দেখিনি।
আমি মুনার ছোটো মামা। দেশের বাইরে থাকি। গতকাল এসেছি।
ওঃ! আপনি তো রেজা মামা, তাই না ?
হ্যাঁ। মুনা বলেছে বুঝি আমার কথা।
বলেছে। অজস্রবার বলেছে। আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনি তো জাপানে থাকেন ?
হ্যাঁ।
খুউব ভালো লাগছে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে।
আমি সাধারণ মানুষ। তোমাদের আড্ডায় আমাকে নিয়ে আলাপ হয়েছে শুনে খুশি হলাম। থ্যাঙ্ক ইউ।
ওয়েলকাম মামা। আমরা আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আসুন, সবার মাঝে আসুন। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল রিয়া। মামাকে নিয়ে আড্ডার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হইহই করে ওঠল।
পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক বড়ো বিজ্ঞাপন দেখছিল সবাই। লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় কে হবে দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা। এখন তিনজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে―বাঁধন, মম, বিন্দু। তিনজনকে ঘিরে আলাপ চলছিল। দেশজুড়ে আজ ওদের নিয়েই ঘরে ঘরে চলছে জল্পনাকল্পনা।
মুনা ছুটে এল রেজা মামার দিকে। বলো মামা, এ তিনজনের মধ্যে কাকে ভোট দেবে তুমি। কে হতে পারে দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা ?
মামা হেসে ওঠে বলল, কেন, আমাকে প্রশ্ন করছ কেন ?
তুমি নিভৃতচারী, শিল্পীমানুষ। নিভৃতচারী একজন তার শৈল্পিক চোখে বিচার করবে। এটাই আমার দাবি।
আবারও সবাই হইহই করে ওঠল। মুনার দাবির প্রতি একযোগে সম্মতি জানাল। রেজাকে চেপে ধরে তারা বলল, মামা আপনাকে বলতেই হবে। এখানে আপনি একমাত্র পুরুষ। পুরুষের চোখে আমরা দেখতে চাই। ভবিষ্যতের দারুচিনি দ্বীপের নায়িকাকে।
রেজা ছাড়া পেল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনটি মুখ দেখার চেষ্টা করে যেতে লাগল। বাঁধনকে দেখল, মমকে দেখল, বিন্দুকে দেখল। তারপর পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে তাকাল উপস্থিত সবার মুখের দিকে।
আমার মনে হয়, গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করল, যদি এই তিনজনের মধ্যে রিয়া থাকত, তাহলে রিয়াই হতো দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা।
আবারও সোল্লাসে লাফিয়ে ওঠল সবাই। কুসুমকলি ছুটে গিয়ে রিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
মামার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রিয়ার মন ধক করে কেঁপে ওঠে। আনন্দ, না শিহরণ, বুঝতে পারল না ও।
মুনা হঠাৎ চুপ হয়ে গেছে। আনন্দ-আলোর ঝলমলো একটা বাতি আচমকা নিভে গেছে। কেউ খেয়াল করতে পারেনি। মুনার মনের কোণে ঈর্ষার এক পোঁচ কালি বসে গেছে। তবু হাসি বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
মামা কল্পনার চোখ থেকে ফিরে এসো। এ তিন ছবির দিকে তাকাও। বলো, ওদের মধ্যে কে বিজয়ী হবে ?
রেজা মামা খুব মনোযোগী হয়ে আবারও দেখল তিন সম্ভাব্য নায়িকাকে। চোখের চাউনি, চোখের ঘূর্ণি, দাঁতের ঝিলিক এবং মুখের মায়াবী লাবণ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞাপনচিত্রটির ওপর আঙুল ঠেকিয়ে বলল, এই-ই হবে দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা।
আবারও সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠল। বাঁধনকে মামা বিজয়ী হিসেবে দেখেছে। বাঁধন ওদের বান্ধবী। দুবছরের সিনিয়র হলেও অন্তরঙ্গ বান্ধবী, তুই তোকারি সম্পর্ক। মামা বাঁধনকে চিনত না। মামার চোখে নিজেদের বান্ধবীকে পেয়ে সবাই খুশি হয়ে গেল।
এবার রিয়া খুশি হলো না। উপরে উপরে খুশি হলেও ভেতরে কেমন যেন কষ্ট পেল। মামার চোখে বাঁধনকে দেখতে চায়নি মন। নিজে বাঁধনের জন্য এসএমএস করেছে। এখন বাঁধনের জন্য কেমন ঈর্ষা জেগে উঠছে মনে। এই অনুভ‚তির অর্থ কী! আনন্দের বদলে কেন কষ্ট জেগে উঠল। ভালোবাসার বদলে কেন রাগ জেগে উঠল। কিছুই বুঝতে পারল না রিয়া। (চলবে)
এইচআর/জেআইএম