ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

দেওয়ান শামসুর রকিব : বাস্তব জীবনের বহুমুখী গল্পকার

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:২৫ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২০

ঝুমালিয়া চাকমা

লেখক, কবি ও নাট্যকার দেওয়ান শামসুর রকিবের গল্প জীবনমূলক বয়ান; বাস্তব জীবনের বহুমুখী আখ্যান। প্রায় গল্পেই জীবন বাস্তবতার প্রচলিত রূপটি তুলে ধরেছেন। যা এক শিল্পগুণ সমৃদ্ধ অনন্যতা অর্জন করেছে। গল্পের ধরন ও শব্দের প্রয়োগ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য। গল্পের বিষয়বস্তুও যুগোপযোগী। হৃদয়ঘটিত কিছু গল্প পাঠককে একটি ঘোরবৃত্তে ফেলে দেবে। একজন প্রকৃত গল্পকারের সব রকম বৈশিষ্ট্য ‘নয় গল্পে’ খুঁজে পাওয়া যায়।

বাস্তব জীবনের প্রকৃতির এই গড়া ভূমিতে প্রতিটি মানুষই ভিন্ন; ভিন্ন তার রুচিবোধ ভিন্ন তার চারপাশের দেয়াল এবং ভিন্ন তার পদচারণা। প্রত্যেকেই নিজস্ব পৃথিবীর সাথে স্বকীয়ভাবে বসবাস করলেও জীবনের একটি পর্যায়ে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু মুহূর্তের জন্য বাস্তবতার নিষ্পেষণে পিছু হটে। বস্তুবাদী ভরা সমাজের এই যাতাঁকলে পিষ্ট হয়ে সহজ-সরল ভালোবাসায় ভরা কোমল হৃদয় কখনো কখনো হয়তো কঠোরতমভাবে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে এবং জীবনকে উপভোগ করে। ‘প্রতিশোধ’ গল্পটি তারই একটি উদাহরণ। গল্পটির প্রতিটি কোণায় কোণায় টানাপড়েনের ক্ষেত্রগুলোকে তিনি স্পষ্টভাবে একিভূত করে তার এক বিশাল রূপ রসের মাত্রায় সংযোগ স্থাপন করেছেন। ভার্সিটির লাইফে জুনায়েদকে এভাবে অপমান করে তার ভালোবাসাকে অসম্মান করা মিথিলার আদৌ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না হয়তো। ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। তাহলে জুনায়েদ আনস্মার্ট বলে সে কি সুন্দরী মেয়েদের ভালোবাসা, সাহচার্য পাবে না? মিথিলার এই অবমাননা জুনায়েদের জীবনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। যা একপর্যায়ে আত্মসম্মানবোধের সূচনা ঘটেছে এবং চূড়ান্তপর্যায়ে প্রতিশোধের রূপ নিয়েছে। আত্মসম্মানবোধ থেকে অহংবোধ, আত্মঅহংকারের এবং রীতিমত ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। সেটাও কখনো হয়তো কাম্য নয়।

লেখক গল্পটিতে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন, আত্মসম্মানবোধ বাস্তব জীবনে কতোটা অর্থবহ। আত্মসম্মানবোধ নিয়ে যেমন একদিকে সাফল্যের উচ্চ শিখড়ে সহজে পৌঁছানো যায় এবং অন্যদিকে তার বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া, যা ক্যারিয়ার সূচনায় বিপর্যয়ের সমতুল্য। গল্পে ভার্সিটির জীবনে মিথিলার প্রতি জুনায়েদের অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা এবং জুনায়েদের ভালোবাসাকে প্রথমবারেই অবাঞ্চিত ঘোষণা এবং দীর্ঘ চার বছরের যাত্রাবিরতিতে এভাবে জীবন গড়ার কাঙ্ক্ষিত সময়টুকুতে তাদের কাকতালীয়ভাবে সাক্ষাতটি নিয়তির একটি খেলা মাত্র। জীবনে ঘাত, প্রতিঘাত, সংঘর্ষ, উত্থান, পতন ইত্যাদি বিচিত্র সব অনুভূতি সমন্বিত হয়ে জন্ম হয় বিশেষ শিল্পরীতি। তেমনি একটি নির্দশন চোখে পড়ে মিথিলার জীবনে। যা তার ক্যারিয়ারে যথেষ্টভাবে বিমিশ্র প্রতিক্রিয়ার রূপ দিয়েছে। প্রতিটি মানুষের একেকটি গোপন এবং দুর্বল দিক রয়েছে। যেটা মানুষ কখনো প্রকাশ করতে সাহস পায় না। আড়ষ্টতা গেড়ে বসে। ঠিক এমনি একটি আড়ষ্টতা জুনায়েদের মনের মধ্যেও কাজ করেছিল। মিথিলা যদি বন্ধুদের সামনে জুনায়েদের ভালোবাসাকে অবজ্ঞা না করতো, তবে হয়তো মিথিলার প্রতি জুনায়েদের তীব্র প্রতিশোধের দাবানল জ্বলে উঠতো না।

তেমনই আরেকটি প্রতিরূপ গল্প ‘অফিস জিনিয়া ও একটি বিকেল’। গল্পে সমাজের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা কিছু বাস্তব চরিত্র, যে চরিত্রগুলো হঠাৎ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মত জ্বলে ওঠে কোনো কিছুর পুর্বাভাস না জানিয়ে। দেওয়ান শামসুর রকিব মানে সমাজের কিছু চিরাচরিত কাহিনিরূপ। বাস্তবধর্মী এবং শিল্পগুণ সমৃদ্ধ দুইটি ছোটগল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী প্রকৃতির সহজাত বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ার মত। চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভূমিকার স্পর্শ ও গন্ধ নির্দেশিত হয় গল্প দুটিতে। জিনিয়ার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের চাকরিটা গল্পের প্রেমিকের নয়, প্রেমিকের মাতা-পিতার অপছন্দের। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এমন অনেক প্রতিরূপ ঘটনা প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিটি মেয়ের জীবনে দৃশ্যমান। কতজন পারে ক্যারিয়ারের জন্য ভালোবাসার বন্ধনকে অস্বীকার করতে? অবজ্ঞা করতে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করেও মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে, সমাজে সাম্যতা বজায় রেখেছে। নিজস্বতা বলতে সবারই কিছু না কিছু থাকে। মেধা, মনন, যোগ্যতা ও পারদর্শিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে নারী জাতির সর্বদা আপ্রাণ প্রচেষ্টা। সন্দেহবাতিক কঠিন একটা রোগ। ভিত্তিহীন অবিশ্বাসগুলো যত বেশি মনের মধ্যে বাসা বাঁধবে; তত দ্রুত বিশ্বাসের মুত্যু হয়। অনবদ্য লেখক প্রতিটি গল্পে অবলীলায় ফুটিয়ে তুলেছেন সেটা।

আরও একটি দিক গল্পে প্রকাশ পেয়েছে- জিনিয়ার বিচারে সব পুরুষই এক। কিন্তু সব মেয়েও তার ব্যতিক্রমী নয়। পুরুষালী সহজাত বৈশিষ্ট্য জিনিয়ার সামনে প্রকাশ না ঘটলেও মনে মনে হাসানও সেটা অবচেতন মনে ধারণ করে আসছে। যার প্রমাণ মেলে এ কথোপকথনটিতে- জিনিয়া যখন হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা সকলে এক। প্রত্যুত্তরে হাসান কোনো বিরোধিতা করেনি। কিন্তু মনে মনে বলল, না! আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই আসিনি। বলতে গিয়েও সে বলতে পারল না। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েদের সাহচার্য, নির্জনে দেখা করার প্রস্তাব হাসানের মনকে শুধু আন্দোলিত করেনি, রীতিমত অফিসের বসের কাছে একমাত্র রিলাই ব্যক্তি হয়েও মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে। জিনিয়ার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাবে এই ভেবে। গল্পটিতে মজার বিষয় হলো- জিনিয়া হাসানকে নির্ভর করেছে। যেহেতু হাসান অন্য কলিগ থেকে আলাদা এবং জিনিয়া মূলত প্রলুব্ধ করেছে অফিসের বসের কাছে মিথ্যা কথা বলতে।

অপরদিকে লেখক দেওয়ান শামসুর রকিব তার আরেক গল্প ‘বার-এ বসে শোনা গল্প’তে বাস্তব জীবনে মৃত্যু ভয় প্রতিটি মানুষকে অজান্তে অবচেতন মনে এমনভাবে তাড়িত করে, তার একটি দৃশ্যপথ অঙ্কন করেছেন। মৃত্যুভয় মূলত এমন একটি ব্যাধি, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় থেনথোফোবিয়া বলে অভিহিত করা হয়। একটি পর্যায়ে মৃত্যুভয় ধীরে ধীরে প্যানিক অ্যাটাকে রূপ নেয়। অথচ প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়কে সহজে আলিঙ্গন করার মানসিকতা গুটিকয়েক মানুষেরই থাকে। তেমনি এক ব্যক্তিত্ব মাহবুব আনাম। মস্তিষ্কের নিউরনে সর্বত্র মৃত্যুচিন্তা গল্পের মূল চরিত্র মাহবুব আনামকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে, যেন ‘অতি মৃত্যুভয়ে ভীত নন তিনি’। গল্পের শেষান্তে তিনি বলেছেন- মৃত্যুই সত্য। অর্থাৎ মৃত্যু সে যতই কঠিন হোক না কেন, তাকে সহজেই মেনে নিতে হবে। মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া পবিত্র একটি নাম মৃত্যু। প্রকৃতির এবং নিয়তির একটি গৎবাধা নিয়মের মধ্যেই মৃত্যুর অবস্থান। যার সৃষ্টি আছে; তার ধ্বংস অনিবার্য। জন্ম নিলে মরতে হবে। জীবনের পূর্ণতার নামই মৃত্যু। গল্পে মাহবুব আনাম অবিবাহিত, আত্মীয়-স্বজন, পরিজনের মধ্যে মা-বাবা, ভাই-বোনরা আছেন। বর্তমান-অতীত নিয়ে কোনো ক্ষেত্রেই তার পিছুটান নেই। এক ভিন্নধর্মী চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছেন লেখক চরিত্রটির মধ্যদিয়ে। মৃত্যুভয় থেকে পালানোর জন্য যেমন প্রস্তুতি দরকার; তেমনি ভয়ের সাথে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য সাহস নামের বিশেষণটিও অতীব জরুরি। সেই সাথে প্রয়োজন সংগ্রামের মত উপাদানটিও। গল্পে মাহবুব আনাম মৃত্যু থেকে পালানো নয়, মূলত জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন।

ভিন্ন ধারণা পোষণকারী লেখক দেওয়ান শামসুর রকিব তার গল্পেই ক্যারিয়ার গড়ার জন্য টিপস উপস্থাপন করেছেন। একটি হলো চাকরি পরিবর্তন। অন্যটি হলো রিস্ক নিয়ে এগোনো। বিষয়টি একেবারেই ফেলনা বা অস্বীকার করার মতো নয়।

লেখক এখানে আরও অত্যন্ত সুষ্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন মদ্যপানের খারাপ অভ্যাস বিষয়ে। মানুষ তো অভ্যাসের দাস। যদি অভ্যাস মানুষের দাস হয়, তাহলে সে দাস আমৃত্যু তেড়ে আসবে। অভ্যাস গঠন প্রক্রিয়াটি একটি সূত্র নির্দেশ করে। যা আমাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে। আমরা যা কিছুর অভাববোধ করি, তখনি আমরা স্বভাবতই একটি কার্যপ্রণালী অনুসরণ করি। যা আমাদের প্রশান্তি এনে দেয়। অস্থিতিশীল একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। মদ্যপানে বমির মত একটি বাজে, বিশ্রী, দুর্গন্ধ, খারাপ জিনিস শরীর থেকে প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে জেনেও মাহবুব আনাম মদ্যপান করে থাকেন, যেন অভ্যাসটাই দাস হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, টিপস দিতেও প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তা-ও তিনি জানেন। আমার মতে, লেখক তার ব্যতিক্রমধর্মী এ গল্পে বোঝাতে চেয়েছেন, মৃত্যু নদীর মত বহতা এবং একমাত্র মুত্যুরই কোনো ‘মৃত্যু’ নেই।

দেওয়ান শামসুর রকিবের গল্পে মানুষের গল্প পাওয়া যায়; সমাজ-রাষ্ট্র, প্রকৃতিসহ নানা বিচিত্র বিষয় পাওয়া যায়। এ কারণে সব ধরনের পাঠকের কাছে সমান পরিচিত। আশা নয় বিশ্বাস, দেওয়ান শামসুর রকিব যদি গল্পে অধিক সময় দেন; পাঠকমহলে খুব তাড়াতাড়ি আরও সমাদৃত হবেন।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন