ঢাকাইয়া দিন ঢাকাইয়া রাত : জীবনের উপাখ্যান
ঢাকাইয়া মানুষের আদি ও প্রচলিত কথা বলার ধরন, বৈচিত্রে ঠাঁসা জীবন, ধ্যান-ধারণা ও দাম্পত্য কলহ আর নর-নারীর সমূহ দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকার উপাখ্যান ‘ঢাকাইয়া দিন ঢাকাইয়া রাত’। ঢাকায় প্রচলিত বুলি, জীবনাচরণ আর নারী-পুরুষের চিরন্তন কাম-বাসনা ছাড়াও অন্যসব উপকরণ পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখবে বইটি।
উপন্যাসের নারী-পুরুষের প্রতিটি চরিত্রে ফুটে উঠেছে মনুষ্যপ্রাণে চাষাবাদ হওয়া বৈধ অথবা নিষিদ্ধ কথামালা। একেকটি চরিত্র বিপরীতমুখী হলেও চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা এক ও অভিন্ন। কখনো গভীর প্রেম, বিচ্ছেদ অথবা যৌনাকাঙ্ক্ষা দেখালেও প্রতিটি চরিত্রে কৌশলে তৃপ্তির ঢেকুর গেলাননি। অতৃপ্তিই যেন কাহিনির গতি সঞ্চার করেছে। নিজের চমৎকার রসবোধ চরিত্রগুলোর মুখে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক মাহাবুব রেজা।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মাসুদ। সংসার উদাসীন। প্রতিদিন বাংলা মদ খেয়ে টাল হয়ে বাড়ি ফেরে। যে কারণে স্ত্রী রেশমার সাথে সংসারও টেকেনি। বন্ধু উলফত পানের দোকানি। দু’জনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দু’রকম। দু’বন্ধুর ঝগড়াটে কথায় চমৎকার রসবোধ লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন নানা ঢঙে।
পাড়ার চা দোকানদার রহমত। একদিন সকালে চা খেতে গিয়ে দেখে দোকানে বসে আছে রহমতের ছেলে। ইদ্রিস লস্করকে দোকানের কাছে আসতে দেখেই রহমতের ছেলে জানতে চায়, ‘চাচা চা খাইবেন?’ লস্কর উল্টো প্রশ্ন ছোড়ে, ‘ভাতিজা তুমাগো দোকানে কি সুন্দরবনের মুধু বেচো?’ ‘না চাচা মধু বেচুম ক্যালা?’ ‘তাইলে আমারে যে কইলা চাচায় কি চা খাইবেন?’ এভাবেই উপন্যাসের ঘটনার পরতে পরতে সুকৌশলে রসবোধ ঢেলে দিয়েছেন লেখক।
উপন্যাসের বিদ্যমান প্রতিটি চরিত্রে রয়েছে কোনো চিত্রশিল্পীর তুলিতে বিবিধ রঙের আঁচড়। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি পুরুষ চরিত্র কাদা মেখেছে ভিন্নপ্রেমে। অবশ্য নারী চরিত্রগুলোও পিছিয়ে নেই। উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র মাসুদ, স্ত্রী রেশমা। কামনার নহর বয়ে চলে আঙ্গুরবালা আর উল্কারানী যখন চোখের পাতায় ভাসিয়ে দেয় অঙ্গনাচন। মাসুদের বন্ধু ও বোনাই ইদ্রিস লস্কর। গাড়ি চালক ইদ্রিস লস্কর অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ায় হোসনে আরা ক্ষোভ ধরে রাখতে পারে না। স্বামীর বিরুদ্ধে নালিশ দিতে গিয়ে উলফতের সঙ্গে হয় গোপন আঁতাত। যেন তপ্ত রোদে ছায়া হয় একখণ্ড মেঘ।
অপরদিকে জুলেখার অঙ্গপ্রেমেও মশগুল উলফত। মাসুদের মা পেয়ারি বেগম অপেক্ষায় প্রহর গোনে তৃতীয় প্রজন্মের। কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হয় না তো বটেই আপেক্ষ যেন দীর্ঘ হতে থাকে। কার্তিক দয়ালের বউ উল্কারানী। বাংলা মদের ব্যবসা করে এ দম্পতি। উল্কারানী তার রূপের লোভ আর কথার বাহানায় কৌশলে কাস্টমার ধরে রাখে। কিন্তু শেষ অবধি উপন্যাসের কোনো চরিত্রই ভাবনার চূড়ান্তে পৌঁছতে পাড়ে না। অথবা কম-বাসনা থেকে যায় অপূর্ণ।
ঔপন্যাসিক চরিত্রগুলো দিয়ে নিজের শক্তিশালী লেখক সত্ত্বা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘সকালবেলা ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনের চেহারার মধ্যে একধরনের স্নিগ্ধতা থাকে। ইদ্রিস লস্কর চা খেতে খেতে মানুষজনের সেই স্নিগ্ধতা দেখে।’
উপন্যাসে ঢাকাইয়া গালি উপস্থাপন হয়েছে সাবলীল ভাষায়। ঢাকা শহরের আঞ্চলিক কথা কোনো নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা নয়, তাই বুঝতে সহজ হয়। যদিও লেখক খুব প্রাঞ্জল ভাষায় পুরো উপন্যাসের যবনিকা টেনেছেন। পাঠক বইটি পড়তে পড়তে ভাববেন, চরিত্রগুলো কোনো না কোনো সময় পরকীয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে।
অথচ উপন্যাসের শেষ সাড়ে তিন লাইনে অপূর্ণতা ঢেলে দিয়েছেন লেখক। বলেছেন, ‘মাসুদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উলফতের দিকে। সে যতোবার উলফতকে দেখে ততবারই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে উল্কারানীর মুখ। আর উলফত মাসুদের দিকে না তাকিয়েও দেখতে পায় একটা ঘর, সেই ঘরের বিছানায় হোসনে আরা সেজেগুজে বসে আছে।’
এভাবেই গল্পের প্রতিটি চরিত্র মুখে বলে এক আর ভাবে আরেক। যার অন্তরালে গোপন লক্ষ্য। যা চিরন্তন ও শ্বাশত। অবৈধ প্রেম কতভাবে শাখা-প্রশাখা গজাতে পারে তার চিত্রায়ন, বিচিত্র জীবন আর পুরান ঢাকার মানুষের গালাগালির সংমিশ্রণ বাইটির নামকরণও স্বার্থক। তেমনি সুখপাঠ্য।
বই: ঢাকাইয়া দিন ঢাকাইয়া রাত
লেখক: মাহাবুব রেজা
প্রকাশক: অনিন্দ্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১২০ টাকা
প্রকাশকাল: ২০১৯
এসইউ/জেআইএম