তপন বাগচীর গানের খাতা
ঝর্ণা মনি
১.
‘আমায় নহে গো, ভালোবাসো, শুধু, ভালোবাসো মোর গান
বনের পাখিকে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।’
ভালোবাসা কিংবা ভালো লাগা ঠিক কেমন? এর সংজ্ঞা আজও খুঁজছেন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরা। অনেকের মতে, ভালোবাসা সংজ্ঞায়িত করা যায় না, তবে উপলব্ধি করা যায়। ঠিক তেমনি গান কি? গান কেমন? চিরন্তন এ প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। একেও উপলব্ধি দিয়ে ভালো লাগা-ভালোবাসা দিয়ে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। শিল্পের প্রতি দাবিই এই ভালোবাসা। এর বাইরে শিল্পের কাছে দাবি নেই। গানের কাছে দাবি নেই। কবিতার কাছে দাবি নেই। সেই দাবি মেটানোর তৃষ্ণা নিয়েই কবি কবিতা লেখেন। গীতিকার গান লেখেন। গানের স্বরলিপিতে সুরের ঝংকার তোলেন।
এমনই বুকভরা তৃষ্ণা নিয়ে শিশু বয়সেই কবিতায় হাতেখড়ি হয় তপন বাগচীর। কবিতা থেকে গদ্য, সাহিত্য, গবেষণা, প্রবন্ধ, গান- কী নেই তার সোনালি ঝুলিতে। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ঋদ্ধ সাহিত্যের ঝুলি। স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ হটানো আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কবিতা লিখতেন তপন বাগচী। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষার্থী তপন বাগচী সহযোদ্ধাদের নিয়ে টিএসসিসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিতেন কবিতা পাঠ কিংবা গানের আসরকেই। সাহিত্যপ্রেমের শেকলে বাঁধা পড়ে স্কলারশিপ পেয়েও পড়তে যাওয়া হয়নি রাশিয়ায়। জীবন-জীবিকার কারণে বার কয়েক পেশা পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি নেশার। সুবিশাল ক্যানভাসে সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে একের পর এক সৃষ্টি করছেন গান, কবিতা, ছড়া, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা। সাহিত্যের সব ক’টি অঙ্গনে বিচরণ করছেন প্রবল প্রতাপে।
ড. তপন বাগচী পাঠককে চমকে দিয়ে নয় বরং পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন বর্ণনার স্বচ্ছতার মধ্যদিয়ে। পাঠককে কাছে টানতে চেয়েছেন পাঠকের কৌতূহলী দৃষ্টিতেই। ভাষার ক্ষেত্রে নতুন ভঙ্গি খুঁজেই এগিয়ে যাচ্ছেন নিজ রচনার কক্ষপথে। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ড. বাগচীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত নেই। রচনাশৈলীকে তিনি যেমন একদিকে দেখেছেন হৃদয়ের উৎসারণ হিসেবে; তেমনই সাহিত্যের এ শাখায়ও শব্দ, তাল, লয়, ছন্দ নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। আর এ উৎসারণের সৎ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার লেখায়-
‘বৃষ্টি যখন আকাশ থেকে নামে
তোমার খবর পাই তখনই ভাঁজ করা নীল খামে।
ছোট্টবেলার জল-থইথই মাঠে
আজও যদি বৃষ্টি মেখে আমার দুপুর কাটে।
দোষ কি বলো, এই ভোলামন সেথায় যদি থামে!’
(বৃষ্টি যখন আকাশ থেকে নামে/ তপন বাগচী)
স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা এ গানের শেষ চরণে ঝরে পড়ে খেদোক্তি। কৃষ্ণ প্রেমে বিরহীনি রাধার মতোই এ যুগের রাধার মন উতলা হয় প্রিয় বিরহে। কলঙ্কের হার গলায় পড়ে কুলবিনাশী আকুল প্রাণ গেয়ে ওঠে-
‘আমি নাকি কুলবিনাশী, কুলে দিছি দাগা
কুল ছাড়িয়া পথে আইলাম, হইলাম হতভাগা।
কূলের আশায় কুল ত্যাজিলাম, পেলাম না তার দেখা
কারো ছোঁয়ায় হয়নি বদল, আমার হাতের রেখা
সরলা কয় স্বস্তি কেবল- তার জন্য রাত-জাগা।’
২.
জীবন কেমন? জীবন আমাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে ফেলবে সেটা আমরা কেউই জানি না। সেই না জানা থেকেই ড. তপন বাগচী তার গানকে নিয়ে প্রবেশ করেছেন শিল্পের চিরায়ত ভুবনে। যেখানে তিনি যোগ করতে চেয়েছেন অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে জীবনসম্পর্কে অনুভূতি। আর তারই সামষ্টিক রূপ তুলে ধরেছেন গানের কলিতে-
‘পাগল তোমার নিজের বাড়ি, আর কতকাল থাকবে সুদূর-
একই গাঁয়ের পথিক এসে পায় না খুঁজে সারা দুপুর।
অধীন বেড়ায় তোমায় খুঁজে
কে পারে তা নিতে বুঝে
কেমনে বলি মনের কথা, কেবল বেরোয় বেসুরো সুর।’
তার গান আমিত্বময়। গানের কলিতে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। তার ভাবনা স্বচ্ছ। বর্ণনার প্রয়োজনে যে শব্দ সামনে এসেছে তাকেই ধারণ করেছেন তার গীতিকাব্যে। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার পরিচিত মুখ তপন বাগচীর আধুনিক সময়ের লেখায় যেসব শব্দমালার ব্যবহার রয়েছে, তার প্রায় সবই অনায়াসে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের দক্ষতায়। অন্ত্যমিলের দিকে তার ঝোঁকও লক্ষ্যণীয়। তিনি নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাননি। ফলে প্রতিনিয়ত তার ভাবনার জগতে নদীরপাড় ভাঙার মতো ভাবনা এসে উঁকি দিয়েছে। যা দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন গানের খাতার নিজস্ব বেলাভূমি। তবে সেই নির্মাণ কষ্টকল্পনার সমাহার নয়। বরং তার গানের মধ্যে রয়েছে প্রতিশ্রুতি-
‘কলঙ্ক অলঙ্কার লইয়া
এই গলায় পরাই।
সে আমার জীবন রে বন্ধু,
তারে আমি চাই।
পুড়ছি কালার রূপের ছটায়
লোকে যদি নিন্দা রটায়
লক্ষ্য থেকে আমায় হটায়
সাধ্য কারো নাই।
সামনে দেখি অথই সাগর
পারের মাঝি রসিক নাগর
আমার লাইগা রয় উজাগর,
ধন্য আমি তাই।
ভালবাসি- নাই সন্দেহ
সঁপেছি পায় এই মন দেহ
তপন ছাড়া অন্য কেহ,
জানতো না তো ভাই।’
৩.
বিষয়গত দিক থেকে বাংলা কবিগান, মরমী গান, বাউল গানের ধারা যে রাধারমন দত্ত, লালন ফকির, বিজয় সরকার, হাসন রাজার ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না বলে সে পথে হাঁটেননি তিনি। বরং পূর্বসূরীদের ধারা অক্ষুণ্ন রেখেই নিজস্ব ভাবনার সাগরে অবিরাম সাঁতার কেটে নিজস্ব শব্দচয়ন, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করেছেন অনুপম গানের ভুবন। ওই ভুবনে তিনি নিজেই রাজার রাজা। যিনি নিজেই ভবের হাঁটে কাচের দামে স্বর্ণ বিকান। আবার লালন ফকিরের মতো বাড়ির পাশে আরশিনগর খুঁজে না পেয়ে সুর বাঁধেন আপন মনে। তপন বাগচী তার গানের খাতার ক্যানভাসে সুনিপুণ তুলিতে চিত্রিত করেন কাব্যিক শিল্প। যা শিল্পী হিসেবে নিজেকে মনের আনন্দে তুলে ধরেছেন মুগ্ধ শ্রোতাদের মাঝে। শব্দশৈলীর নিপুণ কারুকাজে কাব্যময় তুলিতে উপস্থাপন করেছেন বাউল মনের ঈশ্বর দর্শন তত্ত্বকে। এখানে শ্রোতারা লালন ফকিরের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন ড. বাগচীর। লালনের মতো তিনিও খুঁজে বেড়াচ্ছেন আরশিনগরের সেই আরাধ্য পড়শিকে-
‘খুঁজতে গেলি আরশিনগর
একলা কেন সন্ধ্যারাতে
বুঝি না তোর আসল চলন
সুর বেঁধেছিস কোন্ ধারাতে!
কুড়োস কি তুই মুক্তা-মাণিক
ছেউড়িয়ার ওই রাঙ্গা ধুলায়
ক্লান্তি তোকে ধরলে ঠেসে
বাউলা বাতাস সোহাগ বুলায়
পড়শীনাগর রইলো বসে
কালিগঙ্গার কত্ঢারাতে।
বুঝলি না তুই ভবের হাটে
কাচের দামে স্বর্ণ বিকায়
রাখবি যারে গলায় তুলে
সেই তো ঝোলে শখের শিকায়
নাই রে ছায়া, এই সরলার
চায় না সেথায় মন দাঁড়াতে।’
৪.
বনের পাখি গান গায় আপন আনন্দে। কেউ তার গান শুনলো কি না, তা কাউকে মুগ্ধ করলো কি না, সেই ভাবনা থেকে বনের পাখি গান গায় না। ড. তপন বাগচীকে প্রথাগতভাবে মুগ্ধতা তৈরির মোহ থেকে লেখায় নিজেকে টেনে আনেননি। ব্যক্তিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় দায়বোধ থেকেই তার লেখার সঙ্গে সখ্য। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের আন্দোলনের সময় যেভাবে কলমকে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র হিসেবে; তেমনি ২০১৩ সালে বিশ্বকাঁপানো শাহবাগ আন্দোলনেও কলমই ছিল তার হাতিয়ার। তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনে তার বিপ্লবী গান, কবিতা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জাগ্রত ঐক্য, মহান একাত্তরে বাঙালির পরাজিত শক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের প্রতি দেশবাসীর তীব্র ঘৃণা-ক্ষোভের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘প্রজন্মের এই বন্ধুরা আজ জেগে আছে আগেভাগে
ভয় নেই কোনো, সকলেই আছি, একসাথে শাহবাগে।
অশুভের প্রতি সকলের ঘৃণা হয়েছে তীব্র তীর
এই জমায়েতে হাজির সকলে জাতির তরুণ বীর
এরাই দেশের যোগ্য মানুষ, আর কোন্ নেতা লাগে!
ক্ষোভের আগুন দিকে দিকে আজ সারা দেশ জুড়ে জ্বলে
এই জনতাকে থামানো যাবে না, দাবি না পূরণ হলে
ভরসা রয়েছে তরুণের ডাকে জাতির বিবেক জাগে।’
প্রকৃতির সহজাত প্রবৃত্তি- প্রেম, ভালোবাসা, বিদ্রোহের পাশাপাশি দেশের অগণিত মানুষের মতো ড. তপন বাগচীর স্বপ্নও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা। বৈষম্যহীন সম-অধিকার সমাজ। যে সমাজে মানুষের পরিচয় থাকবে ধনী-গরিব, জাতি-বর্ণ হিসেবে নয়, শুধুই মানুষ হিসেবে। কারণ সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী মানুষের জন্য। সুস্থ-সুন্দরভাবে সমান অধিকার নিয়ে সবার মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। সম-অধিকার আদায়ের আজন্ম বিপ্লবী ড. বাগচী তাই লিখেছেন-
‘যারা বুনে দেয় বিভেদের বীজ, তারা তো বন্ধু নয়
সমতায় যারা বসবাস করে, তারাই মানুষ হয়।
এই দুনিয়ায় কে আপন আর কে পর জানি না ভালো
জানি শুধু এই সবাই মানুষ কেউ নয় সাদা-কালো
সকল মানুষ একজাতি আজ এই হোক পরিচয়।
সকলের আছে সম-অধিকার,
সকলে থাকবে সুখে
পরহিতে কাজ করার চিন্তা
রাখবে তো পুষে বুকে।
পৃথক থাকবে আচারে বিচারে, পৃথক পোশাকে-চলনে
পৃথক থাকবে খাবারে রুচিতে, পৃথক থাকবে বলনে।
তবু কেউ কোরো ছোট-বড় নয়, সকলের হোক জয়।’
ড. তপন বাগচীর ভেতরে বয়ে চলা যে সুর ও ছন্দ, যে বোধ ও ভাবনা, সৃষ্টির যে উৎসব তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তা প্রকাশে তিনি আপসহীন। মহাকাল সেই মুগ্ধতা ধরে রাখবে কি না তার বিচারের ভার সময়ের হাতে, আগামীর কাছে। সমকালীন সৃষ্টি সম্পর্কে শেষ কথা থাকে না। বলা যায় না। শিল্পের পথই এমন, তাকে অতিক্রম করতে হয় যোজন যোজন দূরত্ব। সেই দূরত্ব তিনি নিজেই অতিক্রম করবেন সৃজনশীল সৃষ্টির মাধ্যমে- এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।
এসইউ/এএ/এমএস