অদম্য শেখ হাসিনা: জাতির প্রেরণার উৎস
রনি রেজা
মানুষ তার কর্মগুণে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। ছাড়িয়ে যায় নিজেকে। বিরাজ করে সবার মাঝে। আজ যে শেখ হাসিনার আলোচনা করা হচ্ছে- তিনি এখন শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা নন। তিনি ১৮ কোটি মানুষের ভরসার স্থল, বিশ্বনন্দিত নেতা, জাতির প্রেরণার উৎস। যিনি এক ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়েছেন রাজপ্রাসাদ। প্রমাণ করেছেন নিজেকে বারবার।
একাত্তরে পরাজয়ের পর যখন পাকিস্তানি হানাদাররা এদেশ ছাড়ে তখন রয়ে যায় তাদের দোসররা। চলতে থাকে চক্রান্ত। যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট। দেশ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। চলতে শুরু করে উল্টো পথে। স্বাধীনতা অর্জনকারী বাঙালির সামনে পড়ে থাকে একটি রাষ্ট্রের ধ্বংসস্তূপ। সেখান থেকে উদ্ধারের প্রয়াসে ১৯৮১ সালে স্বৈরাচার সরকারের নিষেধাজ্ঞা, মৃত্যুভয়, সমস্ত অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।
তখন দেশে ফেরা নিয়ে বিখ্যাত নিউজউইক সাময়িকী এক সাক্ষাৎকারে তাকে বলেছিল, প্রবল স্বৈরাচারী শাসকদের বিরোধিতার মুখে আপনার দেশে ফেরা কি ঝুঁকিপূর্ণ হবে না? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সাহসিকতা এবং ঝুঁকি এই দুই-ই জীবনের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিকল্পহীন শর্ত। প্রকৃতপক্ষে জীবনে ঝুঁকি নিতে না পারলে এবং মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ (পৃষ্ঠা-৩৫)
হ্যাঁ, সেদিন তিনি ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন বলেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঝেড়ে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণের তিনটি পূর্বশর্ত পূরণ করে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছে বাংলাদেশ। মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সক্ষম হয়েছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে। ব্যক্তিগতভাবেও রয়েছে শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বহু অর্জন। আন্তর্জাতিকভাবে ‘ভ্যাকসিন হিরো’, ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’, ‘স্টেটম্যান’, ‘ইস্টার অব ইস্ট’, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এরই মধ্যে। সব মিলিয়ে আজ শেখ হাসিনা অনন্য দৃষ্টান্ত। ইতিহাসের অংশ।
সেই কাজটিই স্থায়ী করতে যেন একটি খুঁটি স্থাপন করলেন আরিফুর রহমান দোলন। সম্পাদনা করলেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিশিষ্টজনের মূল্যায়ন গদ্য, পদ্য ও স্মৃতিচারণের সংকলন ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ বইটি। বইটিতে সূক্ষ্মভাবে শেখ হাসিনার সফলতার গল্প তুলে আনার চেষ্টা চালিয়েছেন সম্পাদক। শেখ হাসিনার শিক্ষক আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে এ প্রজন্মের লেখক হাবিবুল্লাহ ফাহাদ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সবার মূল্যায়নই মলাটবন্দি করেছেন তিনি।
বইটির শুরুতেই সৈয়দ শামসুল হক ও হাবীবুল্লাহ সিরাজীর দুটি কবিতায় শেখ হাসিনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। স্থান পেয়েছে ৬০টি প্রবন্ধ। শেষে লেখক শেখ হাসিনার তিনটি লেখাও সংযুক্ত করা হয়েছে। একজন শেখ হাসিনাকে যথাসম্ভব তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখায় যেমন ছাত্রী শেখ হাসিনার কথা উঠে এসেছে, তেমনি তোফায়েল আহমদ, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, রোকেয়া প্রাচীর কলমে চিত্রিত হয়েছে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা।
লেখক শেখ হাসিনাকে তুলে ধরেছেন ড. আতিউর রহমান, অজয় দাশগুপ্ত ও আনিসুল হক। ক্রিকেটপ্রেমী হাসিনাকে দেখিয়েছেন আকরাম খান। তার প্রেরণার গল্প শুনিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নারীর অগ্রযাত্রার দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন মোহাম্মদ জমির। এ ছাড়া উঠে এসেছে তার সাহসিকতা, নেতৃত্বগুণ, সফলতার গল্প।
বইটি পাঠের সময় সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝবেন এটি অল্প পরিশ্রমের ফসল নয়। সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় প্রতিটি লেখা সংগ্রহ এবং সম্পাদনা করা হয়েছে। কিছু লেখা এক জায়গায় করে মলাটবন্দি করলেই যে সম্পাদকের দায় শেষ হয় না; সেটি স্পষ্ট হয়েছে। হওয়া যৌক্তিকও। আরিফুর রহমান দোলন সম্পাদক হিসেবে প্রমাণিত। বাংলাবাজার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার (কলকাতা) হিসেবে কাজ শুরু করা স্বনামধন্য এ সাংবাদিক বর্তমানে তিনটি গণমাধ্যমের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সাপ্তাহিক এই সময়, দৈনিক ঢাকা টাইমস ও অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকা টাইমস২৪ডটকমের সম্পাদক তিনি।
বইটিতে শুধু শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে অপাঠ্য কোনো লেখার স্তূপ যে এটি নয়; সেই ভরসা জন্মে সম্পাদকের নাম দেখেই। সম্পাদকও সেই জায়গায় সচেতন ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। অভিজ্ঞ শেখ হাসিনাকে তুলে ধরেছেন অতিযত্নে।
আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়’ প্রবন্ধে শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতার কথা আলোকপাত হয়েছে এভাবে- ‘তিনি (শেখ হাসিনা) তাঁর পিতাকে দেখেছেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশে চোর ও বিশ্বাসঘাতকদের দৌরাত্ম্য দেখেছেন। তিনি মানুষের মধ্যে অমানুষ দেখেছেন। বন্ধুর বেশে শত্রুকে দেখেছেন। প্রাণশত্রুকে মাথায় টুপি পরে বিনীত হয়ে একেবারে তাদের পায়ে পায়ে ঘুরতে দেখেছেন। এই জীবনে তাঁর অভিজ্ঞতা তো কম নয়। তিনি ধুলা থেকে গড়ে তুলেছেন গণতন্ত্রের প্রাসাদ।’ (পৃষ্ঠা: ৪৩ ও ৪৪)
উল্লিখিত অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনা যথাযথ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন; তা প্রবন্ধটি পাঠে স্পষ্ট হয়। মূলত ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের ভাগ্য। পূরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ‘শেখ হাসিনা বলেই বাংলাদেশের বদলে যাওয়া’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশ কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল, শেখ হাসিনার সেই তত্ত্ব বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে যেতে হবে। প্রায় তিন দশক আগে নিজের জীবনসংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর ‘ওরা টোকাই কেন’ (১৯৮৯) গ্রন্থে শেখ হাসিনা লিখেছিলেন, ‘আমার চলার পথটি কখনোই সহজ নয়। বহু চড়াই-উৎরাই পার হতে হচ্ছে। নানা সমস্যা চোখে পড়ে। দুঃখ-দারিদ্র্যক্লিষ্ট আমাদের সমাজজীবনের এই দিকগুলো সবাই চিন্তা করুক। সমাজ ও দেশ উন্নয়নের কাজে রাজনৈতিক ও মানবিক চেতনার সবাই উজ্জীবিত হয়ে উঠুক, এটাই আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।’ (পৃষ্ঠা: ৮৬ ও ৮৭)
আজকের শেখ হাসিনা একদিনে হয়ে ওঠেননি। স্বাধীনতার স্থপতির কন্যা হওয়ার কারণে যে তাঁর পথচলা সহজ ছিল; এমনও নয়। বরং বাধা-বিপত্তি বেশি ছিল। তার ভেতর দিয়েও তিনি এগিয়েছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন আমাদের ভরসার স্থল। এই হয়ে উঠতে একটি চ্যালেঞ্জিং জীবন তাঁকে পার করতে হয়েছে, যা আমাদের সবার জানা অতি জরুরি। সেই কাজটি সহজ করে দেওয়ার জন্য সম্পাদকের ধন্যবাদ প্রাপ্য। বইটির বহুপাঠ কামনা করছি।
বইয়ের নাম: অদম্য শেখ হাসিনা
সম্পাদক: আরিফুর রহমান দোলন
প্রকাশক: এই সময় পাবলিকেশন্স
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২০
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ৬০০ টাকা।
আলোচক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।
এসইউ/এএ/জেআইএম