আবুল মনসুর আহমদ : সমাজ সংস্কারে অবিচল
‘গল্প-উপন্যাসে যা পারিলাম না, প্রবন্ধে-নিবন্ধে তা সমাধা করতে উদ্যত হইলাম। আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা স্বাধীন ‘বাংলা-দেশ’ যাই হউক ভাষা-সাহিত্য কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম-পাকিস্তান ও অপরদিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এসব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত। দেশের লেখক সাহিত্যিকদের তা বুঝাইবার জন্য ইংরাজি-বাংলা মাসিক-দৈনিক কাগজে প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলাম। একাধিক সাহিত্য সম্মিলনীতে, বাংলা একাডেমির ও একুইশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রদের সভায় ভাষণ পড়িতে লাগিলাম। এর সবগুলিই হয় দৈনিক কাগজ নয় ত একাডেমি পত্রিকায় তৎকালে প্রকাশিত হইয়াছিল।
আমার প্রতিপাদ্য ছিল এই যে রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৭ সালে যে দেশ ভাগ হইয়াছিল, কালচারের দিক হইতেও ওটা ঠিকই হইয়াছিল। পাকিস্তানী আমলে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকিয়াও পূর্ব-পাকিস্তান শুধু ভাষায় নয়, আর্ট কালচারের ব্যাপারেও, অবশিষ্ট পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশ তেমনি তার কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে পশ্চিম-বাংলা-ভারত হইতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রই আছে। চিরকাল থাকিবে।’ (শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, ৫ম সংস্করণ জুন ১৯৯৯)
দেখা যায় আবুল মনসুর আহমদ একুশ শতকের গভীর চিন্তাবিদ হিসাবে বিশেষ করে ব্যঙ্গ সাহিত্যকেই বেছে নিয়েছিলেন সকল অনাচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার রূপে। পশ্চাদমুখী জীবন বিমুখ দৃষ্টিকোণ দেখে তিনি প্রতিবাদ করেছেন লেখায়। বহুমুখী এই প্রতিভা সাহিত্যচর্চা, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ওকালতির কারণে নানা জায়গার নানা মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। দেখেছিলেন জীবনকে খুব কাছ থেকে। অন্তঃসারশূন্য মুসলমান সমাজের পশ্চাদমুখী দৃষ্টিকোণ, জনসেবার নামে দেশবাসীকে বঞ্চনার প্রচেষ্টা তিনি অতি গভীর ও নিবিড়ভাবে দেখতে ও বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ব্যঙ্গ সাহিত্যকে তাঁর দেশসেবার আদর্শ বাহন-হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন। রচনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হাসির সৃষ্টি করলেও লেখকের মর্মভেদী কান্না, কখনো স্পষ্ট, কখনও প্রচ্ছন্ন থেকে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তিনি হেসেছেন, হাসিয়েছেন, কিন্তু হৃদয় নিংড়ানো কান্নাও কেঁদেছেন প্রচুর। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার চরণের সাথে সাথে তাঁর অনুভূতির কিছুটা মিল তাঁর রচনায় দেখা যায়। ‘বাইরে রবে হাসির ছটা, ভিতরে রবে অশ্রুজল’।
দেখা যায় সৃষ্টিশীলদের কলম বা তুলিতে সব সময় সময়ের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তার অমর স্কেচে একেঁছেন দুর্ভিক্ষের চিত্র, কবি ফররুখ আহমদ তার বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতায়, আবুল মনসুর আহমদ ব্যঙ্গ গল্পেগল্পে। তার প্রায় লেখায়, দুর্ভিক্ষের চিত্রের সাথে দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ীদের চিত্র, মৃত মানবতা ও চেতনার চিত্র যথাযথ তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। সামাজিক বিশ্বাস, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে আবুল মনসুর আহমদ তীব্র আঘাত হেনেছিলেন।
আবুল মনসুর যখন শিক্ষা তথা রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন; তখন সারা বাংলায় অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলেনের জোয়ার। তার অভিঘাতে সারা বাংলায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আগে থেকে কম-বেশি সন্দেহ অবিশ্বাসের অস্তিত্ব থাকলেও কংগ্রেস-খিলাফত আন্দোলনের জোয়ার সাময়িকভাবে হলেও তা পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। টানাপোড়েন ছিল। তবে পরবর্তী কয়েক বছর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি আবুল মনসুরের মত অন্যদের চেতনায় কংগ্রেসের সাথে সহমত রেখে চলার প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি প্রাধান্য বিস্তার করেছিল মুসলিম শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের উদ্যোগে বেঙ্গল প্যাক্টের প্রভাব তাঁর জীবনকে ভাবধারাকে গভীর করে তুলেছিল।
ফলে প্রকাশিত তাঁর রচনায় ব্যক্তিক বিশ্লেষণের সাথে সাথে জীবন্ত হয়েছে সামাজিক নানা সমস্যা। সংকটে সমাধানের পথ বাতলে দিতে চেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সব স্থানে তিনি যে সফল সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়ার কারণে কখনো-কখনো সে দলের পক্ষ নেওয়াতে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচকরা এনেছেন পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। কখনো কখনো কোথাও কিছুটা বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো সমাজ সমস্যা তথা জাতীয় টানাপোড়েনের রাজনৈতিক ধারার অসামান্য ইতিহাস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
আমাদের সমাজের আত্মপ্রতারণা এবং হীন্মন্যতার বিরুদ্ধে কষাঘাত হেনেছেন তা দুর্লভ। লোকজ শব্দ সম্ভারকে গদ্য সাহিত্যে অসামান্য দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে তিনি নতুন একটি গদ্যধারার জন্ম দিয়েছেন। তাঁর এ গদ্যে কেবল বাংলাদেশের কথকতারই প্রভাব নেই, আমাদের জনগণের সরল জীবনাচার ও সূক্ষ্ম রসবোধেরও গভীর প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর সাহিত্যের ভাষা এসব কারণেই যেমন সাবলীল এবং বেগবান হতে পেরেছে, তেমনি মণ্ডিত হয়েছে নিজস্ব একটি স্বাতন্ত্র্যে।
স্বাতন্ত্র্য ভাবনায় আবল মনসুর দেশের সাহিত্যিকদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইমার্সন মার্কিনীদের লিখে এবং বলে এ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন-‘স্বকীয়তা ধর। অনুকরণ ছাড়। অনুকরণ আত্মহত্যার শামিল। স্বকীয়তাতেই মুক্তি।’
আর সে কারণেই সময়ের বুকে বলতে আবুল মনসুর আহমদ উপস্থাপিত হয়, বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের অকুতোভয়, সংশপ্তক যোদ্ধাদের প্রতি এক ফোঁটা নৈবেদ্য হিসেবে। আবুল মনসুর আহমদ নামের যে বটবৃক্ষ- সময়ের মধ্যে থেকে সব সহজযোগ নাগালে থাকা স্বত্বেও, সময়ের অনাচারের বিরুদ্ধে, অবিচল বটের মতো স্থির ছিলেন। যিনি অসাম্প্রদায়িক, সত্য উচ্চারণে সাহস রাখেন- তাঁর অমূল্য স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা।
লেখক: কবি, গবেষক ও আহ্বায়ক, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ।
এসইউ/এএ/জেআইএম