নজরুলের কবিতা: অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী মানস
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা (১৯২২)। কবির অনুপম নিদর্শন বিদ্রোহী কবিতা। যা এ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত আছে। এ কাব্যে বিদ্রোহী মনোভাব ফুটে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমানদের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। দোলন-চাঁপা (১৯২৩) কাব্যে প্রেম ও বিদ্রোহ পাশাপাশি। অবশ্য নজরুলের অনেক কবিতায় এমন। যেন, ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’। বিষের বাঁশি ও ভাঙার গান কাব্যগন্থ দুটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। ছায়ানট ও পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ দুটি ১৯২৫ সালে প্রকাশিত। ১৯২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে দৌলতপুরে আকবর খানের বাড়িতে থাকাকালীন কিছু কবিতা ছায়ানটে স্থান দেওয়া হয়েছে। শিশুতোষ ‘চিরশিশু’ কবিতাটি ছায়ানটে আছে। সাম্যবাদী (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় বেশিরভাগই মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ঝিঙে ফুল সাধারণত শিশুতোষ। শিশুদের উপযোগী ১৩টি ছড়া-কবিতা স্থান পেয়েছে। ফণিমনসা (১৯২৭) ও সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৮) কাব্যে প্রেম ও প্রকৃতি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯২৯ সালে রচিত হয় দুটি কাব্যগ্রন্থ; চক্রবাক ও সন্ধ্যা। চক্রবাকের বেশিরভাগ কবিতা প্রেম বিষয়ক। আর বিদ্রোহভাব ফুটে উঠেছে সন্ধ্যা কাব্যের কবিতাগুলোতে। এ কাব্যের মতো গ্রন্থে-লিখা (১৯৩০) কাব্যেও বিদ্রোহীমূলক কবিতার প্রাধান্য রয়েছে। প্রলয় শিখা ১৯৩০ সালে প্রকাশিত অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। নতুন চাঁদ (১৯৪৫) ও শেষ সওগাত (১৯৫৮) কাব্য দুটির বেশিরভাগ কবিতাও বিদ্রোহী ভাবের। কিছু অন্য কবিতাও আছে। ঝিঙে ফুলের পর আর একটি শিশুতোষ কবিতাপ্রধান কাব্যগ্রন্থ সঞ্চয়ন (১৯৫৫)। শিশুতোষ কবিতা-ছড়ায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এনেছেন নতুনত্ব। ঝড় (১৯৬০) কম আলোচিত একটি কাব্য।
নজরুলের কাব্যগুণ: সাহিত্যের আত্মা রস। যা নজরুলের কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থিত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, ‘ইমোশন বা মানসিক অবস্থার রূপান্তরিত ভাবই রস।’ আলঙ্কারিকদের মতে, কাব্য নির্মাণ কৌশলে তিনটি ভাগ হচ্ছে- বিভাব, সঞ্চারী ভাব ও অনুভব। এখান থেকে নব রস সৃষ্টি। নজরুলের কবিতায় ‘বীর রস’ প্রবলভাবে উপস্থিত। ‘আমি’-ই নজরুলের বড় বীর রসের উদাহরণ। বিদ্রোহী কবিতাজুড়ে বীর রস। বিভিন্ন কবিতায় প্রবল দেশপ্রেম থেকেও বীর রস পাওয়া যায়। ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুলের ক্রোধ দেখা যায় কবিতায়। এসব ক্ষেত্রে রুদ্র রসের উপস্থিতি দেখা যায়। নজরুলের কবিতায় আর একটি রসের উপস্থিতি রয়েছে- বীভৎস রস। শত্রুর প্রতি ঘৃণা কবির অনেক কবিতাতেই রয়েছে। মূলত কবি নজরুলের কবিতায় বীর-রুদ্র-বীভৎস রসের উপস্থিতি বেশি। নজরুলের কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ অনেক বেশি। অন্তানুপ্রাস তো আছেই; তাঁর মতো বৃত্তানুপ্রাসের প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়। যমকের ব্যবহারও বেশ কিছু কবিতায় পাওয়া যাবে। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার কবিকে করেছে অনন্য। আর বক্রোক্তি তো কবির অস্থিমজ্জায়। অনাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বক্রোক্তির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’ বিদ্রোহী কবিতার এ ছত্রেই তাঁর প্রেম ও বিপ্লবের সহাবস্থানের কথা বুঝিয়েছেন। কাব্যের নামকরণেও তা বোঝা যায়। বিদ্রোহী কবিতার ১৩৯ ছত্রে প্রেম-বিদ্রোহ পাশাপাশিই চলেছে। আমি বিদ্রোহী, আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা ইত্যাদির মতো অসংখ্য অলঙ্কার, চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা আছে। সবগুলো কবিতাই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যভিত্তিক। মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লেখা কবিতাগুলো হচ্ছে- কামালপাশা, আনোয়ার, রণভেরী, শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানি ও মোহররম। হিন্দু-ঐতিহ্যপ্রধান কবিতাগুলো হচ্ছে- বিদ্রোহী, ধূমকেতু, প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বরধারিণী মা ও আগমনী। এর মধ্যে কেন, সমস্ত কবিতার মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠকের হৃদয়ে অন্যরকম স্থান পেয়েছে। শিল্পগুণে অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এই একটি কবিতা বিশ্লেষণ করতে গেলে, সাহিত্যের সব অনুষঙ্গ টানতে হবে। সাহিত্য রস-গুণ-অলঙ্কারের প্রায় সব শাখা আলোচনা হয়ে যাবে। অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি বিদ্রোহী কবিতায়। অন্তানুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাসসহ ধ্বনি নিয়ে খেলেছেন নজরুল। কানে মধুর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন- (১)‘...আমি চল-চঞ্চল ঠমকি-ছমকি/পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি/ফিং দিয়া দিই তিন দোল!/আমি চপলা-চপল হিন্দোল।/...আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,/আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।/...আমি সন্নাসী, সুর সৈনিক,/আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক;/...আমি ক্ষ্যাপা দুর্ব্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,/আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!’ (বিদ্রোহী)
অলঙ্কারের যুতসই প্রয়োগ দেখা যায় নজরুলের অন্যান্য কবিতায়-
(১) ‘...ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই/অসূর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!...হিংসুটে ঐ জীবগুলো তাই নাম ডুবালে সৈনিকের,/তাই তারা আজ নেস্তা-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের! (কামাল পাশা)
(২) ‘...হৈ হৈ রব/ঐ ভৈরব/হাঁকে, লাখে লাখে/ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে/লাল গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে/ওই পালে পালে,...’(আগমনী)
নজরুলের সাম্যবাদী ও অসাম্প্রদায়িক রূপ: ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। মানুষ যদি অন্তরাত্মাকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শেখে, নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রমাণের জন্য ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। কিন্তু আজকের বাংলার বাস্তবতা উল্টো ‘সবার উপরে ধর্ম সত্য মানুষ সেখানে নাই’! নজরুল এসবের অবসান চেয়েছেন। গড়তে চেয়েছেন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক-সমাজ; শোষণমুক্ত বিশ্ব। নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কী হতে পারে! মসজিদে গজল আর ইসলামি সংগীত আর মন্দিরে শ্যামাগীতি; সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের শীর্ষ দু’ধর্মেও অনুসারীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের পরেই প্রিয় সংগীত! ভাবা যায়! বিশ্বের আর কোনো সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বা আইডলের কাছে এমন হয়নি। ইসলামি সংগীত, হামদ ও নাতগুলো চমৎকার। হিন্দুদের জন্য রচিত শ্যামাসংগীতও দারুণ জনপ্রিয়। কবি নজরুল ভাবতেন মুক্তির জন্য ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় স্বাধীনতার দাবি আগেই করেছিলেন। ভারতবাসীকে স্বাধীনতার দাবি করতে উৎসাহিত করেন গানে, এভাবে- ‘আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।/এই দুলালাম বিজয়-নিশান, মরতে আছি-মরব শেষ। ‘ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায়, ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কখন সর্বনাশী?’
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। মানুষের কল্যাণে ধর্ম সৃষ্টি। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ-ত্রাসন সৃষ্টি করা হয় বলে কবি নজরুল মনে করতেন। কার্ল মার্ক্সের ‘আফিম তত্ত্ব’র মতো নজরুল বললেন, ‘কাটায় উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা,/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা,/ভাঙি ‘মন্দির’, ভাঙি মসজিদ,/ভাঙিয়া গীর্জা গাহি সঙ্গীত-/এক মানবের এক রক্ত মেশা’-(বিংশ শতাব্দী, প্রলয় শিখা)। যেন সত্যেন্দ্রনাথের ‘কালো আর ধলা বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা’র মতো। আর একটা কবিতাংশের কথা উল্লেখ করাই যায়। ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,/আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভু।/তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’ সাম্যবাদী কাব্যের ‘মানুষ’ কবিতায় স্রষ্টার প্রতি ‘ভুখা মুসাফির’র আত্মকথন। কবি নজরুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্র অঞ্চলের প্রধান দুটি ধর্মের অনাচার-অসাম্যের প্রতি সমান আঘাত হেনেছেন। মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের তথাকথিতদের ওপর আক্রোশ ঝরে পড়েছে কবিতার পরতে পরতে। তাঁর কবিতায় ‘মানুষ’ই মূখ্য উপজীব্য। অসাম্প্রদায়িক এমন সাহিত্যিক বিশ্বে বিরলই।
‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাদের সম্মানিত করেছেন নজরুল। ‘মা’ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন। ‘কালের চরকা ঘোর,/দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে চড়ে দেড়শত চোর’। নজরুলের এমন বাণী প্রতিধ্বনিত হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবের ‘সাড়ে সাত কোটি কম্বলের মধ্যে আমারটা কই’ বলার মধ্যেই। ‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর’। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ভাঙা-গড়ার খেলা দেখিয়েছেন। আবার ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’ কবিতায় বলেন, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা,/ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/সৃষ্টি নব পূর্ণিমা।’ হিন্দুদের ঐতিহ্য ব্যবহার করে ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির প্রার্থনা করেছেন কবি।
‘নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই’ অথবা ‘পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম, অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন, তারা নিপীড়িত, এই এক পরিচয়’ বলে স্বাধীনতা চেয়েছেন। শোষণ-পীড়িতের অবসান চেয়েছেন। ‘একতাই বল’ হিসাবে অগ্রসর হতে বলেছেন। ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো বিভাজন চাননি তিনি। বিভাজন থাকলে স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। কৃষকের চোখে নজরুল বলেছেন, ‘আজ জাগরে কৃষাণ সব ত গেছে, কিসের বা আর ভয়,/এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়’ (কৃষাণের গান)। এমন অভয় বাণী নজরুলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। হাতুরি ও শাবল শ্রমিকের প্রতীক। এ দুটির মাধ্যমেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। এ দুটি অনুষঙ্গ নিয়েই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্র দিলেন নজরুল এভাবে, ‘ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল!/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল... মোদের যা ছিল সব দিইছি ফুঁকে,/এইবার শেষ কপাল ঠুকে!/ পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকেরে!/আবার নতুন করে মল্লভূমে/গর্জাবে ভাই দল-মাদল!/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল।’ সর্বহারা কাব্যের ‘ধীবরদের গান’ কবিতায় নজরুল বলেন, ‘ও ভাই নিত্য নতুন হুকুম জারি/করছে তাই সব অত্যাচারীরে,/তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়/আমরা মৎস্য পেলে।’ এমন আরও কিছু কবিতাংশ-
(১) ‘তোমার অট্টালিকা,/কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লেখা।’
(২) ‘বেতন দিয়াছ? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল।’
(৩) ‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে আমরা রহিব নিচে,/অথচ তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।’
নজরুলের সর্বহারা ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। ‘সর্বহারা’ কবিতায় শেষের দিকের কবির আহ্বান: ‘...মাঝিরে তোর নাও ভাসিয়ে/মাটির বুকে চল!/শক্ত মাটির ঘায়ে হউক/রক্ত পদতল।/প্রলয়-পথিক চলবি ফিরি/দলবি পাহাড়-কানন-গিরি;/হাঁকছে বাদল ঘিরি ঘিরি,/নাচছে সিন্ধুজল।/চল রে জলের যাত্রী এবার/মাটির বুকে চল।।’ (সর্বহারা)। শ্রমিকের ঘামে সভ্যতা তৈরি। কিন্তু তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। এ অবস্থা নজরুলের আগে বা তাঁর সময়েও বিদ্যমান ছিল। বর্তমানেও এ বৈষম্য বিদ্যমান। এ ব্যাপারে নজরুলের কঠিন আহ্বান: ‘...আমরা পাতাল খুঁড়ে খনি/আনি ফণীর মাথার মণি,/তাই পেয়ে সব শনি হ’ল ধনী রে।/এবার ফণি-মনসার নাগ-নাগিনী/আয় রে গর্জে মার ছোবল।/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল...’ (শ্রমিকের গান)। ছাত্রসমাজকেও একত্রিত হতে বলেছেন। কোনো অধিকার আদায় বা আন্দোলন-সংগ্রামে যুব ও ছাত্রসমাজকে জেগে উঠতে হয়। দেখা যায়, সব যুগেই ছাত্রদের বলিদান করা হয়। বিপথে নিয়ে দাবি আদায় থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। তারুণ্যশক্তিকে সবাই ভয় পায়। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উল্লেখিত কবিতায় বলেন: ‘মোদের কক্ষ্যচ্যুত ধূমকেতু-প্রায়/লক্ষ্যহারা প্রাণ,/আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর/নিত্য বলিদান।/যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন/আমরা পশি নীল অতল।/আমরা ছাত্রদল।।’ ছাত্রদের কল্যাণেই ইতিবাচক বিশ্ব দেখা সম্ভব। কবি ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে কবিতাটির শেষে বলেন- ‘আমরা রচি ভালোবাসার/আশার ভবিষ্যৎ,/মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়/আকাশ-ছায়াপথ।/মোদের চোখে বিশ্ববাসীর/স্বপ্ন দেখা হোক সফল।/আমরা ছাত্রদল।।’
সবার উপরে মানুষ সত্য ও স্বাধীনতা চেতনা: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’- এ উপলব্ধিকে প্রতিষ্ঠিত করতে কবি নজরুল কবিতায় লেখেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ অথবা বলতে পারি, ‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ (সাম্যবাদী)। সাম্যবাদী কাব্যের বারাঙ্গনা, কুলি-মজুর, মানুষ, রাজা-প্রজা, নারী, পাপ, চোর-ডাকাত প্রভৃতি কবিতায় সাম্যবাদী নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আর উচ্চারণে ছিল অগ্নিবর্ষা। প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। আলোচ্য কবিতাংশগুলো তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ। শোষণ-নিপীড়িত মানুষকে জাগাতে নজরুল লেখেন, ‘এই সব মুঢ় ম্লান মূক মুখে/দিতে হবে ভাষা, এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে/ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’ শাসক-প্রজা বা শোষক-শোষিতের মধ্যকার পর্বতসম ব্যবধান কমাতে কবিতা লিখেছেন তিনি। কবিতার সুরে সবাইকে জাগাতে চেষ্টা করেছেন। ‘আজকের মতো বলো সবাই মিলে-/যারা এতদিন ছিল মরে তারা উঠুক বেঁচে,/যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে,/তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’
দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানকারীদের সিদ্ধান্তের সঠিকতা তুলে ধরেছেন। নিহতদের বীর ও শহীদ আখ্যা দিলেন। ‘মৃত্যু এরা জয় ক’রেছে কান্না কিসের?/আব জমজম আনলে এরা, আপনি পিয়ে কলসি বিষের!/কে ম’রেছে? কান্না কিসের?/বেশ ক’রেছে?/দেশ বাঁচাতে আপনারি জান শেষ ক’রেছে!/বেশ ক’রেছে/শহীদ ওরাই শহীদ!’ ইংরেজ দুষ্টু সৈনিকদের প্রতি ঘৃণামিশ্রিত বাণী দিলেন, কবিতায়- ‘হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,/তাই তারা আজ নেস্তা-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের!/পরের মুলুক লুট ক’রে খায় ডাকাত তারা ডাকাত!/তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!’ ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’- মানুষের কথা, মানবতার জয়গানই মূখ্য হিসাবে ধরা দিয়েছে। গান, কবিতা ও প্রবন্ধে মানবতা লক্ষ্য করেই রচিত হয়েছে। নারী হিসাবে কাউকে অবমূল্যায়ন করেননি। বরং প্রতিবাদী কণ্ঠেই লিখছেন। সর্বহারা কাব্যের ‘ধীবরদের গান’ কবিতায় নজরুল বলেন, ‘ও ভাই নিত্য নতুন হুকুম জারি/করছে তাই সব অত্যাচারীরে,/তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়/আমরা মৎস্য পেলে।’
বিষের বাঁশি কাব্যগন্থের ‘শিকল-পরার গান’ নামীয় রক্তগরম করার কবিতা ও অসাম্প্রদায়িক কবিতা ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। নজরুল জেলে থাকাকালীন লিখলেন: ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।/এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।’ এটি এ কাব্যের ‘শিকল-পরার গান’ কবিতার অংশ। আমরা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এ কবিতাটি স্লোগান বা গান হিসাবে পরিবেশন করি। গানটি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। শিল্পীদের মুখে বা ছাত্রসমাজের মুখ থেকে কম্পিত এ গান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে। ইংরেজদের লক্ষ্য করে কবি নজরুল বললেন: ‘তোমারা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;/সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়!/ মোরা আপনি ম’রে মরার দেশে আনব বরাভয়,/মোরা ফাঁসি প’রে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল।।’ শত্রুর বিপক্ষে এমন সাহসী উচ্চারণ! ভাবা যায়! নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। এমন অনেক সাহসী উচ্চারণ তিনি করেছেন। ফলে বারবার জেলও খেটেছেন। তাঁর পাঁচটি বই নিষিদ্ধও করেছে ব্রিটিশ শাসকরা।
শিশুতোষ নজরুল: ‘ভোর হল দোর খোল/খুকুমণি ওঠরে/ঐ ডাকে যুঁই শাঁখে/ফুলখুকী ছোটরে’ ছড়াটি কে শোনেননি! এরকম আরও অনেক শিশুতোষ ছড়া লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি। ছোটদের জন্য বেশ কিছু ছড়া ও কিশোর-কবিতা, গান লিখেছেন। গ্রামের সাধারণ দৃশ্য ও শিশুদের পছন্দমতো বিষয় বেছে নিয়ে দারুণ ও সাবলীল ছড়া/কবিতা লেখেন। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ঝিঙে ফুল সাধারণত শিশুতোষ। ঝিঙে ফুল (১৯২৬) তাঁর সমকালের শিশুসাহিত্যের বিবেচনায় এক বিস্ময়কর নাম। শিশুর মনন-জাত প্রসূত চিন্তাভাবনার প্রকাশ যা সাবলীল ও শিক্ষণীয় কিন্তু শিশু উপযোগী, মজার।
প্রথমেই নাম কবিতায়, ‘ঝিঙে ফুল’এ- ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল।/সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-ফুল/ঝিঙে ফুল। দারুণ বর্ণনা। রং এবং ফুল একইসাথে শিশুমনকে দোলা দেয় এবং শিশুমনে গ্রন্থিত হয়। ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেননি এমন লোক পাওয়া যাবে না! কী সুন্দরভাবেই না কবি উপস্থাপন করলেন! যা শিশুর মনোজগতের এক অদ্ভুত চলচ্চিত্রকে উপস্থাপন করে। পুরো কবিতাটিই কাঠবিড়ালীকে উদ্দেশ্য করে খুকির সংলাপে রচিত। একটি পেয়ারার জন্য খুকির আগ্রহ, তার আবেগ, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ফুটিয়ে তুললেন। প্রথমে কাঠবিড়ালীর সঙ্গে বন্ধুতার আয়োজন, তারপর তাকে খুশি করে তার কাছ থেকে পেয়ারা পাওয়ার চেষ্টা। কবি ‘কাঠবিড়ালী’কে নিয়ে লিখে ফেললেন চমৎকার একটি ছড়া। ছড়াটি হলো: ‘কাঠবিড়ালী! কাঠবিড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু?/লাউ?/বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?’ তারপর খুকি (অঞ্জলি নামের এক মেয়েকে দেখে কবির অনুভূতি) বলল- ‘ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!/আমিও খুব পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও...’। ‘লিচু-চোর’ কবিতায় বর্ণিত হয়েছে সহজ-সরল গ্রামীণ জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে আছে কোনো এক কিশোর লিচু চুরি করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়া তারপর মিথ্যা না বলার/চুরি না করার প্রতিশ্রুতি।
‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কি বাস, করলে তাড়া,/বলি থাম, একটু দাঁড়া!/পুকুরের ঐ কাছে না/লিচুর এক গাছ আছে না... যেই চড়েছি/ছোট এক ডাল ধরেছি,/ও বাবা, মড়াৎ ক’রে/পড়েছি সড়াৎ জোরে!/পড়বি পড় মালির ঘাড়েই’। দারুণ সাবলীল ও রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা! এতো সহজ-সরল ভাষায় কয়জনে লিখতে পেরেছেন? কলকাতার স্কুলে যাওয়া দু’শিশু রোজ পাঠশালায় যেত। একজন ছিল দারুণ বেঁটে আর মোটা, অন্যজন টিনটিনে শুকনো আর ছিপছিপে লম্বা। অনেকটা তালপাতার সেপাইয়ের মতো। এ দুজনকে দেখে নজরুল এতটাই মজা পেয়েছিলেন, একদিন হঠাৎই তিনি লিখেছিলেন: ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়/ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যায়/বেঁটে খাটো নিটপিটে পায়/ছের চলে কের চায়/মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হলো ইসলামি সংগীত তথা গজল। আমাদের রণসংগীত ‘চল চল চল’ তাঁর লেখা। ‘সংকল্প’ কবিতা কে না জানে! শিশুমনের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা তুলে বিশ্বজয়ের কথা তুলে ধরেছেন এ কবিতায়। কবি বিশ্বকে মুঠোয় পুরে দেখতে চেয়েছেন। ‘সংকল্প’ কবিতার শেষ এমনই,‘...হাউই চড়ে চায় যেতে কে/চন্দ্রলোকের অচিনপুরে;/শুনব আমি, ইঙ্গিত কোণ/মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।/পাতাল ফেড়ে নামব আমি/উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,/বিশ্বজগৎ দেখব আমি/আপন হাতের মুঠোয় পুরে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি নজরুলের মধ্যকার সম্পর্ক: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি নজরুলের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নজরুলের পিতৃতুল্য, গুরুর মতো। কবিগুরুও নজরুলকে স্নেহ করতেন। প্রথম কারাবন্দি হওয়ার পর রবিঠাকুর তাঁর বসন্ত নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। গোরা নাটকের গানের গীতিকার রবীন্দ্রনাথ; সুরকার নজরুল। নজরুলও কিছু সাহিত্য রবিঠাকুরকে নিবেদিত করেছেন। ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরুলের কাঁধের ব্যাগে ‘গীত বিতান’ থাকত বলে নজরুলের নাতি অরিন্দম কাজী সাক্ষাৎকারে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘দাদু (নজরুল) ধুতি-পাঞ্জাবি পছন্দ করতেন। রঙিন চশমা দেখলে চঞ্চল হয়ে উঠতেন।’ আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, তাদের একে অপরের প্রতি বোঝাপড়া ভালোই ছিল। নাহলে এমন সম্ভব নয়। ১৯৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ‘আকাশ বাণী’ রেডিওতে শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। নবযুগ পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সৈনিক হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কাজী নজরুল।
বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে এই কবি বাঙালির চৈতন্যে প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা দিলেন; তিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। লিখলেন হিন্দু-মুসলমান মিলনের বহু কবিতা ও গান। ‘অসহায় জাতি ডুবিছে মরিয়া, জানে না সন্তরণ/কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’(কাণ্ডারী হুঁশিয়ার)
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/এএ/জেআইএম