ড. তপন বাগচীর সাক্ষাৎকার- শেষ পর্ব
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুবেল আনছারের সহযোগিতায় সমকালের আলোচিত এই সাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক সাবরিনা আফরিন সিলভী—
সাবরিনা আফরিন সিলভী: লেখক না হলে কী হতেন? অন্য কোনো পেশা আপনাকে বেশি টানে?
তপন বাগচী: লেখক না হলে কী যে হতাম, তার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, আমি কি লেখক হয়েছি আদৌ? লিখলেই কি লেখক হওয়া যায়? তাহলে দলিল-লেখককেও লেখক বলা হতো! লেখা ছাপা হলেই কি লেখক বলা যায়? তাহলে সব সাংবাদিক কেন লেখক নন? বই লিখলেই কি লেখক হওয়া যায়? তাহলে নোট-গাইড বইয়ের লেখককেও লেখক বলা হতো। সংবাদপত্রের চিঠিপত্র-কলামের লেখকদের কি লেখক বলা হয়? যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি; তখন জগন্নাথ হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রার্থী হলেন এক বড় ভাই। তিনি হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র। প্রচারপত্রে তিনি তিনি ‘বিশিষ্ট লেখক’, ‘জাতীয় সংবাদপত্রের নিয়মিত লেখক’ এরকম পরিচয় ব্যবহার করেছেন। তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! তখন জগন্নাথ হলের ছাত্রদের মধ্যে পত্রিকায় লিখতেন অগ্রজ বাদল ঘোষ আর আমি। আর কারো লেখা তো সাহিত্য-সাময়িকী কিংবা ছোটদের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতে দেখিনি। তো আমি ওই দাদাকে জিগ্যেস করলাম, দাদা আপনি কোন পত্রিকায় লেখেন? দাদা জবাব দিলেন, ‘দৈনিক সংবাদ ও ইত্তেফাকে তো প্রতি সপ্তাহে আমার লেখা ছাপা হয়।’ এই দুই পত্রিকার সাপ্তাহিক কলামগুলো তো নিয়মিত পড়ি! অনিরুদ্ধ, গাছপাথর, সত্যদর্শী, দর্শক এরকম ছদ্মনামের বাইরে যাঁদের কলাম-নিবন্ধ ছাপা হতো, তাঁরা তো খুবই বিখ্যাত মানুষ! আর আমার হলের এক বড় ভাই লেখেন প্রতি সপ্তাহে, অথচ আমি জানি না, তা কী করে হয়! নিজের অজ্ঞতাকে মোচন করার জন্যই আবার প্রশ্ন করলাম, ‘দাদা, আপনার কলামের নাম কী?’ দাদা বিস্মিত হয়ে জবাব দিলেন, ‘কেন আপনি পড়েননি আমার লেখা? আমি তো চিঠিপত্র কলামে লিখি।’ দাদা প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন কোনো কোনো সংবাদপত্রে। চিঠিপত্র কলামে লিখে যদি লেখক হওয়া যেত, তবে আমার ওই দাদা এই দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের তালিকায় থেকে যেতেন। আজকে চার কুড়ি বইয়ের লেখক হয়েও নিজেকে লেখক বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করি। ‘আমি লেখক’ এরকম না বলে ‘আমি একটু লেখালেখি করি’-এই মাত্র পরিচয় দিতে পারি। তাই লেখক না হলে কী হতাম, সেটি বলার সাধ্য আমার নেই। তবে, মনে হয় অন্য কিছু হওয়ার সুযোগ খুব কম ছিল। আমার বাবা তুষ্টচরণ বাগচী লেখালেখি করতেন। কোনো বই বের হয়নি। তাঁর প্রয়াণের প্রায় ১০ বছর পরে ৭ খানা পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করি একটি পরিত্যক্ত ট্রাঙ্ক থেকে। কী কারণে যে তিনি তা বই আকারে বের করেননি, কিংবা আমাকেও কেন বলেননি প্রকাশ করতে, তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। পিতার লেখক পরিচয়ে নয়, পুত্র তাঁর নিজের যোগ্যতায় লেখক হয়ে উঠুক, হয়তো এই ছিল তাঁর চাওয়া। তাই পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে বলতে পারি, আমি এক লেখকপিতার সন্তান। লেখাই আমার নিয়তি! পছন্দনীয় অন্য পেশার কথা জানতে চেয়েছেন? তার আগে বলি, লেখা কিন্তু আমার পেশা নয়। লেখা আমার জীবিকা নয়। আমার পেশার সঙ্গে লেখার বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমার পেশা আমার লেখালেখির সহায়ক। লেখার ভূত মাথায় না চাপলে আমার তো বিজ্ঞানী কিংবা কৃষিবিজ্ঞানী হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবছর গণিত এবং তা ছেড়ে দিয়ে পরের দুই বছর পরিসংখ্যানে অনার্সও পড়েছি। কিন্তু লেখার ভূত আর রাজনীতির পোকা মাথায় না থাকলে হয়তো অঙ্কের মাস্টার নয়তো সংখ্যাতত্ত্ববিদ হয়ে উঠতাম। কিংবা সব ছেড়ে-ছুড়ে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পুরোদস্তুর কৃষক হয়েই বাকি জীবন কাটাতাম!
সাবরিনা আফরিন সিলভী: শিশুসাহিত্য চর্চায় অবদানের জন্য কোন কোন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন?
তপন বাগচী: শিশুদের ভালোবাসাই তো বড় পুরস্কার। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর বিভাগে ভর্তি হই; তখন আখতার সুলতানা আপা ছিলেন আমাদের শিক্ষক। খুব আদুরে কণ্ঠ। মাতৃসুলভ আচরণ। আমার তখন ‘শুভর শখের গোয়েন্দাগিরি’ বইটি বেরিয়েছে। আপাকে বইটি দিয়েছি। বাচ্চাদের বই আপা পড়বেন, সেই জন্য নয়, আমি যে লিখি সেটি জানানোর জন্য দিয়েছি। কয়েকদিন পরে ক্লাসের ভেতরেই আপা বললেন, ‘তপন, তোমার বইটি আমার মেয়েকে পড়ে শুনিয়েছি। ওর খুব ভালো লেগেছে’। এই যে আপা বললেন তার মেয়ের ভালো লেগেছে, এটি তো আমার কাছে বড় এক পুরস্কারের মতোন। একবার দেশে মঙ্গার প্রকোপ হয়। সারা দেশে মঙ্গা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিদিন পত্রিকায় মঙ্গার খবর পড়ি। তো, ওইসব খবর নিয়ে আমি লিখে ফেললাম ২৮টি ছড়া, যা জ্যোতিপ্রকাশ থেকে গৌতম ঘোষের অলঙ্করণে গ্রন্থিত হয় ‘মঙ্গা আসে ঘরের পাশে’ (২০০৮) নামে। বইটি ওই বছর ‘এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করে ওই বছরের সেরা ছড়াগ্রন্থ হিসেবে। এম নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন বিচারকদের কাছে বই পাঠান প্রচ্ছদ ও ইনার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলে। অর্থাৎ বিচারকগণ লেখকের নাম দেখে পক্ষপাতের সুযোগ নিতে পারেন না। তাই এই পুরস্কারটি বেশ গ্রহণযোগ্য। এরপর ছোটদের উপযোগী করে আমি আব্বাসউদ্দীনের জীবনী লিখি। আমার এই ‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ’ বইটি অগ্রণী বাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৫) লাভ করে। এছাড়া জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি যে লাভ করেছি, তার মধ্যে শিশুসাহিত্যিকসত্তা তো সক্রিয় ছিলই। সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো শিশুরা আমার লেখা পড়ে, শিশুরা আমার লেখা ভালোবাসে। শিশুপাঠকের ভালোবাসার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী আছে?
সাবরিনা আফরিন সিলভী: আপনার শিশুসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন ভারতের এক গবেষক। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
তপন বাগচী: একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুকুমার বড়ুয়া ও আমার ছড়াসাহিত্য নিয়ে এমফিল গবেষণার জন্য রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল। কিন্তু গবেষণাটি মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে কলকাতার ‘সব্যসাচী’ পত্রিকার সম্পাদক আমার শিশুসাহিত্যের উপর আলোচনা করেন যা তাঁর ‘তপন বাগচীর সাহিত্য : চকিত বীক্ষণ’ গ্রন্থে স্থান পায়। এরপরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অনুপম হীরা মণ্ডল ‘সাহিত্যেও তপন বাগচী: বিচিত্র বিভাকর’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। তাতেও আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এছাড়া পবিত্র সরকার, অমল ত্রিবেদী, দেবদাস আচার্য, সুনির্মল চক্রবর্তী, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, ওমপ্রকাশ ঘোষরায়, সতীশ বিশ্বাস, সুকুমার চৌধুরী, রাশেদ রউফ, চন্দনকৃষ্ণ পাল, সমীর আহমেদ, ড. আখতারুজ্জাহান, নীলাদ্রিশেখর সরকার, অমিত মজুমদার, আফম মোদাচ্ছের আলী, নাসরীন মুস্তাফা, পৃত্থীশ চক্রবর্তী, অর্কজ্যোতি ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ সরকার প্রমুখ লেখক ও গবেষক আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু ২০২০ সালে আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ রচনা করছেন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও নদিয়ার ‘তিতলি’ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ। তিনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েও আমার সাহিত্য নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এমন উদারতা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে খুব বেশি আছে বলে মনে পড়ছে না। তিনি আমার ‘কবি ঠাকুর ছবি ঠাকুর’ বইয়ের ভূমিকাও লিখেছেন। তাই বলে গোটা একটা বই? আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। তাঁর লেখা ‘শিশুসাহিত্যেও তপন বাগচী : বর্ণময় আলোকদ্যুতি’ বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার শোভাপ্রকাশ। আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে বই লিখেছেন আমার চেয়ে খ্যাতিমান এক শিশুসাহিত্যিক। এর ভূমিকা লিখেছেন কবি ও ছড়াকার মুহম্মদ নূরুল হুদা। এর চেয়ে বড় সম্মান একজন শিশুসাহিত্যিকের জীবনে আর কী হতে পারে। আমি গর্বিত, আমি ধন্য।
সাবরিনা আফরিন সিলভী: আমাকে অনেকখানি সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হলো।
তপন বাগচী: তোমাকে নিয়ে আসার জন্য তোমার শিক্ষক ড. রুবেল আনছারকে ধন্যবাদ। কীভাবে গবেষক তৈরি করতে হয়, তা তিনি হাতে-কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন। আর তোমার সঙ্গে আলাপের সূত্রে আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে কিছু কথা বলার সুযোগ পেলাম। তাই তোমাকেও ধন্যবাদ। আর যাদের জন্য এই লেখা প্রকাশ করছ, অনাগত সেই পাঠকদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।
এসইউ/এমএস