ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

গল্পকে সন্তানরূপে মানুষ করতে হয়

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:১৪ পিএম, ২৯ মে ২০২০

মানিকরতন শর্মা

পরস্তাব বা কিস্সা অঞ্চলভেদে যে যেমনভাবে বলুক না কেন, মোদ্দাকথা হচ্ছে স্বল্প বা দীর্ঘ কাহিনি উপস্থাপন করা। এই বিষয়টি সেই প্রাচীনকাল থেকেই পরম্পরায় চলে এসেছে। তবে গল্প বলার ঢং একেক লেখকের স্বরে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ‘এক যে ছিল এক রাজা। রাজার দু’রাণী। এক রাণী সরল প্রকৃতির। অন্য রাণী শঠ চিন্তার অধিকারিনী। এই দুই রাণীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এভাবে এগুতে থাকে কাহিনি।’ এটা সরল আখ্যান। ছুটে চলা গতানুগতিক কাহিনি। গল্প বলার ঢং হওয়া চাই আকর্ষণীয়। কোনো কোনো গল্পকার গল্পের মূল বক্তব্যটা শুরুতেই কয়েক লাইনে পাঠককে ধরিয়ে দেন ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। আবার কোনো কোনো গল্পকার ক্লাইমেক্সটা গল্পের শেষ ক’টি লাইনে বা শব্দে উপস্থাপনে প্রয়াস পান।

অনেক সময় পরিচিত কাহিনিও গল্পকারের শৈল্পিক ভাবনা ও শব্দ-উপমায় শিল্পমান অর্জন করে।
২০২০ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’। দেবব্রত সেনের ১৭টি গল্প নিয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ। এবার গল্পগুলো ছেকে দেখা যাক—
বৃটিশ পরবর্তী যুগেই মূলত অঞ্চলভেদে সম্প্রদায়ভিত্তিক শরণার্থী বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। শরণার্থীর স্রোত একবিংশের উন্নত সামাজিক পৃথিবীতেও বন্ধ হয়নি। গল্পকার তার প্রথম গল্প ‘উদ্বাস্তু’ শিরোনামেই সেটা উপস্থাপন করেছেন। শরণার্থীরা জীবনভর কোথাও ভালো থাকে না। দেহ-মনে আর্থিক দুষ্টচক্রে সমাজবদ্ধতায় কোথাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে না। পৃথিবীর সংখ্যালঘুরা যে যেখানেই থাকে, মনস্তাত্বিকভাবে শরণার্থীর ভয় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

‘আশঙ্কা’ গল্পে এক অসম সম্পর্কের কথা বললেন লেখক। তথাগত আধুনিক জীবনভিত্তিক কাহিনিতে ক্ষমতা-দাম্ভিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ ‘আশঙ্কা’ গল্পটি। ড্রাইভার ইউনুসকে গল্পকার সাক্ষীগোপাল হিসেবে সৃষ্টি করেছেন পাঠককে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।

আমাদের সমাজে দুই শ্রেণির শিশু রয়েছে। এক শ্রেণির শিশু রয়েছে ঘর-দুয়ারে মায়া-মমতায় বেড়ে ওঠে। আরেক শ্রেণির শিশুরা রয়েছে যাদের ঠিকানা উদোম পথ। যে পথের স্থায়ী কোনো মেইল নম্বর বা ঠিকানা থাকে না। আমাদের বৈষম্যধারার সমাজের অন্যতম মূখপাত্র ‘সমীর’ নামের পথ শিশুটি। গল্পকার দেবব্রত সেন ‘একটি পথ শিশুর স্বপ্নের সিঁড়ি’ নামক গল্পে কোটি কোটি পথশিশুর মাঝে ‘স্বপ্নের সিঁড়ি’ অর্জনকারী চরিত্র। তাকে ঘিরে অন্যসব শিশুরাও সামনে এগিয়ে যাবে তার একটা বার্তা গল্পকার এখানে তুলে ধরেছেন।

তবে ‘শ্লীলতাহানির পরে’ গল্পটি সাম্প্রতিক ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী ‘নূসরাত’ হত্যার ছায়াকাহিনি। এই গল্পের গাঁথুনি অত্যন্ত সাদামাটা মনে হয়েছে। গল্পটি নির্মাণে গল্পকার একটু ভাবাবেগে তাড়িত ছিলেন মনে হয়।

গল্পকার বেশ ক’বছর অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মভিটা শহরে কাটিয়েছেন। তাই তিনি তিতাসকে ভুলতে পারেননি। পারেননি তিতাসের ধীরু মিয়াকেও। তবে গল্পের সংলাপে প্রকৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। যেমন- গল্পের প্রথম তেইশতম লইনে: ‘খলায় এহনও পানি রইছে’। এখানে ‘খলায়’ শব্দটি ‘হলায়’ হবে। কেননা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘খ’কে ‘হ’ হিসেবে উচ্চারণ করে। সুতরাং ‘হলায়’ হবে। ‘ধীরু মিঞার দিনকাল’ মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। বর্তমান সমাজে ধীরু মিঞার সংখ্যা কম নয়। ৭১ শুধু স্বাধীনতাই এনে দেয়নি; কিছু পতিত লোকেরও অবৈধপথে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে। যে মানুষগুলো আজও পাকিস্তানি আত্মা বহন করে চলেছে।

আজকাল-রোগ আর রোগীকে নিয়ে অপরিসীম দৌরাত্ম্য চলে ডায়াগনস্টিক নেটে। অপরিপক্ক ডাক্তার সর্বোপরি ভুক্তভোগীর হেনস্থা থামার কোন লক্ষণ নেই। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে এ রমরমা ব্যবসা। ভুল চিকিৎসা চলছেই। আমাদের চিকিৎসা পরিকাঠামোতে এক অরাজকতা বিরাজ করছে। কোনরূপ দায়বদ্ধতা নেই। এই সেক্টরে নেই কোন ন্যূনতম মানবিকতাবোধ। সর্বত্রই এক বিশৃঙ্খলার ডামাডোল ধ্বনিত হচ্ছে। ‘নিষ্কৃতি’ গল্পেও দেবব্রত সেন আমাদের সকলের চেনাজানা সেই চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছেন।

গল্পকারের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ জয়দুল হোসেন। যার সংস্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছেন তিনি। এমন ব্যক্তিকে ঘিরে গল্প হবে না, সেই লোভ সামলাতে পারেননি লেখক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমির কর্ণধার কবি জয়দুল হোসেন। তার সাহিত্য জার্নিটাও কম নয়। লেখক কর্মসূত্রে সংস্কৃতির শহরে বসবাস করার সময় কবি ও গবেষক জয়দুল হোসেনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। তারপর থেকেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সাহিত্য সম্মেলনে আগরতলা ভ্রমণের খণ্ডাংশ এই গল্পের পটভূমি। ‘শিলচর লোকাল’ গল্পটি জয়দুল হোসেনকে লেখকের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

গল্পে ‘আনন্দ’ চরিত্রটি লেখকের অভিন্ন সত্তা। তারই ছায়াকাহিনি ‘পথের শেষে’ গল্পটি। স্বার্থবাদী কিছু উচ্চাভিলাষী ছাত্র-ছাত্রী আছেন, যারা উচ্চডিগ্রি অর্জন করে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকেন। ভোগ বিলাসের মোহমায়ায় জীবনকে বিলিয়ে দেন। কিন্তু আনন্দ তাদের দেখানো সেই পথে হাঁটেননি। এই জন্য ধন্যবাদ তাকে। মা ও স্বদেশ আনন্দের কাছে অখণ্ড অস্তিত্ব। তাই ভালোবাসার অমোঘ টানেই চলে এসেছে সে। আনন্দের এরূপ দায়বদ্ধতাকে স্যালুট জানাই। গল্পকার গল্পটিকে মা ও স্বদেশ প্রেমে স্নাত করেছেন।

‘পথে চলে যেতে যেতে’ গল্পটি ‘ভয়, মাটি, পোকা, জিয়নকাঠি, জয়ন্তী, মসজিদের মাইকে শ্মশানের ডাক’- এমন ছয়টি ছোট ছোট শিরোনামে নির্মিত। গল্পকার মনের কোণে উঁকি দেওয়া খণ্ডিত কাহিনিগুলো একটি সুতায় উপস্থাপন করেছেন।

গ্রন্থের শিরোনাম গল্পটা ইন্দিরার পারিবারিক ও রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাহিনি নিয়ে এগিয়েছে। গ্রামীণ ভঙ্গুর অর্থনীতি, সামাজিক অনিশ্চিয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব উঠে এসেছে ‘তখনও যায়নি ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ গল্পে। গল্পে এক অসহায় আহত মুক্তিযোদ্ধার টানাপড়েন আর্থিক জীবনকথা তুলে ধরেছেন লেখক।

‘অমলের একটি নিজস্ব সকাল’ গল্পটি অমলের প্রেমাভাষ নির্ভর। গল্পে পাঠককে একটু ভাবনায় ফেলে দিয়েছেন গল্পকার। এখানেই সার্থকতা।

নির্বাচন উত্তর ভোলা জেলার এক ভয়াবহ চিত্র ‘রাজলক্ষ্মী’ গল্পটি। এটি একটি পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। পূর্বেও এরূপ ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতিত একটি সম্প্রদায়ের দেশমাতৃকা ছেড়ে যাওয়ার নির্মম একটি গল্প। সমাজে এরূপ ঘটনা লেখকের মনে দাগ কেটেছে। পাঠক হিসেবে আমরাও এরূপ চিত্র আর দেখতে চাই না।

স্থানীয় ও রোহিঙ্গার মধ্যে দ্বন্দ্বর বহিঃপ্রকাশ ‘রোহিঙ্গা’ গল্পে। মূলত কাজের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব। আশ্রয়দাতাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে আশ্রিতরা। রোহিঙ্গারা অনেকদিন হলো এসেছে। ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয়দের শান্তির ঘুম বিনাশ করে দিচ্ছে। এমন একটি সমাজ তথা আন্তর্জাতিক সমস্যার অর্ন্তদ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন ছাপ্পান্ন লাইনের ‘রোহিঙ্গা’ গল্পে।

‘মেয়েটি রোদের তলায় একা’ এককথায় চমৎকার গল্প। তিনটি চরিত্রের পজিটিভ চিন্তা ও মানবিকতা বোধ মাত্র ছেচল্লিশ লাইনে অত্যন্ত দক্ষতায় লেখক তুলে ধরেছেন। দেবব্রত সেন অনিমেষ হয়ে একটা লড়াই করা নারীর প্রতি শ্রদ্ধার্পণ করেছেন। পড়ে তৃপ্তি পেলাম। এরূপ গল্প সচরাচর দেখি না।

দোকানদার আর স্বামী শুভময়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে। টীলটী স্বামী নামক ব্যক্তির কাছ থেকে যেমন ঠকেছেন; তেমনি বহুদিন পর স্বামীর বাড়ির এলাকার মানুষ দোকানদারের কাছ থেকেও ঠকেছেন। এই ঠকাঠকির মধ্যে যে সম্পর্ক সেটাই লেখক গল্পের উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরেছেন।

হিমাদ্রীর কৈশোর জীবনের কাহিনি ‘বেলা অবেলা’ গল্পটি। পুষ্পিতা হিমাদ্রীর পিসতুত বোন। তাকে আবর্তিত করে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করা। আর সহপাঠী চাঁদনীর প্রতি ভালোবাসার আবেশ নিয়ে শেষ হয় গল্পটি।

এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের পরিবর্তন তো হবেই। পরিবর্তনের ছোঁয়া যেমন প্রকৃতিতে ঘটে; তেমনি মন-মানসিকতায়ও হয়। গ্রন্থের শেষ গল্প ‘পরিবর্তন’। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ বুর্জোয়ার পক্ষে। খোদ অঞ্জনার পিতা-মাতাও। রঞ্জনের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। সমাজে রঞ্জন বড়ই একা। গল্পকার রঞ্জনের ভাবাদর্শকে তুলে ধরার পাশাপাশি তাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও চিত্রায়িত করেছেন। বামের শত্রু ডান। এ গল্পটা এখনো চলমান।

গল্পকার দেবব্রত সেন অত্যন্ত যত্ন করে, সময় হাতে নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। ফলে গল্পগুলো পাঠককে পড়তে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে। একালের পাঠককে মাথায় রেখে গল্পের দৈর্ঘ্য নির্মাণ করেছেন। সচেতন লেখকরা গল্পের প্রয়োজনে কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যান। অযথা অন্তঃসারশূন্য কথার পিঠে কথা বসিয়ে কাহিনি নির্মাণ করেন না। ফ্ল্যাপে প্রকাশক আকমল হোসেন নিপুর কথামালা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যত্ন নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রচ্ছদ শিল্পমান সম্পন্ন। চার ফর্মার গ্রন্থটির মূল্য দেড়শ টাকা।

লেখক: গল্পকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন