ঈদ
সালমা সিদ্দিকী
রাত পোহালে ঈদ। ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রানু। সকাল হলেই প্রতিবেশীদের ঘরে কত কিছু রান্না হবে। অথচ ঈদের দিনে ভালো-মন্দ একটু কিছু রান্না করতে না পারলে বাচ্চাগুলোকে কিভাবে সামলাবে সে? ঘরে তো একটা ফুটো পয়সাও নাই! তার ওপর ধার-দেনা হয়ে আছে প্রচুর। কারো কাছে চাইবে যে, সে জো নেই। সীমাহীন দারিদ্র্যের উপর এই করোনা দুর্যোগ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছে। কোথাও গিয়ে ত্রাণের জন্য হাত পাততে আত্মসম্মানে বাঁধে। অথচ প্রয়োজন তো থেমে থাকে না।
ট্রাকের চাপায় ভ্যানচালক স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিন সন্তান নিয়ে রানুর সংসার। বাড়িতে সেলাই মেশিন বসিয়ে দর্জির কাজ করে। উঠানে শাক-সবজি বুনে, হাঁস-মুরগি পেলে-পুষে কোনো রকমে টেনেটুনে চলে। ঘিওর বাজারের মডার্ন টেইলার্সের মালিক গৌর খলিফার সাথে সুসম্পর্ক থাকায় ঈদ পার্বণে কিংবা এমনিতেই যেকোনো সময় অর্ডারের চাপ বেশি হলে তাকে দিয়ে কন্ট্রাক্টে কিছু কাজ করিয়ে নেয়। এতে বাড়তি একটু রোজগার হয়। এ ছাড়া সারা বছর গ্রামের বৌ-মেয়েদের ব্লাউজ, পেটিকোট, মেক্সি, জামা সেলাই করেই চলতে হয়। এখন কয়মাস হলো করোনার কারণে কাজ-কর্ম সব বন্ধ, কোনো রোজগারপাতি নেই। এরমধ্যে ঈদ এসে পড়াতেই এ দুর্দশা। অবুঝের মতো একবার মাথায় এলো, এদের ঘুম যদি কাল সারাদিন না ভাঙতো! গোটাকতক ঘুমের ওষুধ পানিতে গুলিয়ে খাইয়ে দেবে না-কি কয়েক চুমুক? পরক্ষণেই মনে হলো, ‘ছি ছি। কী ভাবছি এসব!’ সাত-পাঁচ ভাবনায় ক্লান্ত রানু ঘরময় চড়কির মতো ঘুরতে থাকে। কী করি? কী করি? কিন্তু মেলায় চড়কি যেমন ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা উপরে উঠে গিয়ে আবার ধপাস করে নিচে নেমে পড়ে, রানুর চিন্তাগুলোও তেমনি কোনো একটা উপায় পেতে পেতেও শূন্য ফল নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কখন যে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, একটু বোধহয় ঝিমুনিও চলে এসেছিল। মেজ মেয়েটার কান্নার শব্দে সজাগ হয়ে ওঠে। এই মেয়েটা খুবই দুরন্ত আর বেশি বিরক্ত করে। বড়টা মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরে চুপচাপ থাকে আর ছোটটা এতো ছোট যে, ওকে ম্যানেজ করে ফেলা যায়। এই মেজটাই যা সমস্যা। ঠিক যা ভেবেছিল তা-ই, বিছানায় পেসাব করে ঘুম ভেঙেছে আর মাকে বসে থাকতে দেখে এখন মনে পড়ে গেছে যে, তার ঈদের জামা কেনা হয়নি। এই রাতের বেলায় তাই কান্না জুড়েছে জামার জন্য। বাকিদের ঘুম ভেঙে যাবে বলে রানু তাকে যতই আদর করে বোঝাতে যায়, মেয়ে গলার জোর আরও বাড়িয়ে দেয়। উপায় না দেখে দুম করে এক কিল বসিয়ে দেয় পিঠে। এতে অবশ্য কাজ হয়, মার খেয়ে আর মায়ের কঠিন চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ে গলার স্বর খানিকটা কমায়, আস্তে করে মায়ের আরও কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, আমাগো কি তাইলে এবার ঈদ হইবো না? জামা দিও না ঠিকাছে। কিন্তু সেমাই রাইন্ধা দিবা না? পোলাও-গোস্ত খামু না?’
মেয়ের প্রশ্নে তীরবিদ্ধ পাখির মতো ছটফটিয়ে ওঠে রানু। মেয়েকে কোল থেকে ছাড়িয়ে হাতমুখে পানি ছিটিয়ে নেয়। সাহাপাড়ার শুক্লার মার কাছে যাওয়ার মনস্থির করে। পাড়ার সব অভাবগ্রস্ত নারীর অসময়ের মুশকিল আসান হলো এই শুক্লার মা। যদিও তাকে লাভ বেশি দিতে হয়। টাকা ধার নেওয়ার বিপরীতে কিছু না কিছু মূল্যবান জিনিস বন্ধক রাখতে হয়। তবু বিপদগ্রস্ত নারীরা সেসব হিসাবে ধরে না। দরকারের সময় টাকাটা পাওয়া যায়, এটাই তাদের কাছে অনেক। এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েই বন্ধকি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে শুক্লার মা। আর ভাবনার সময় নেই, ভোর হয়ে এসেছে। ট্রাঙ্কের তালা খুলে একমাত্র সোনার গয়না, তার মায়ের দেওয়া চুড়িটা বের করে ব্যাগে ভরে নেয়। মৃত্যুর সময় মায়ের গা থেকে খুলে নেওয়া গয়নার ভাগাভাগিতে এই চুড়ি সে পেয়েছিল। এরপর কত দুঃখ-কষ্ট এসেছে; বিধবা হয়েছে, খাওয়া-পরার অভাব, অসুখ-বিসুখ—কিছুতেই চুড়িটা হাতছাড়া করার কথা ভাবতে পারেনি। মায়ের শেষ স্মৃতি। ইচ্ছা ছিল বড় মেয়ের বিয়েতে এটা দিয়ে নানির দোয়া হিসাবে যত্ন করে রাখতে বলবে।
আঁচলে চোখ মুছে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে দ্রুত পা বাড়ায়। শুক্লার মার কাছে চুড়িটা বন্ধক রেখে যে করেই হোক কিছু টাকা আজ তার দরকার। যদিও জানে, এই বন্ধক রাখা মানে আসলে বেচে দেওয়াই। কেননা টাকা ফেরত দিয়ে এ জিনিস ফিরিয়ে নেওয়ার সামর্থ তার হবে না। তবু বেচে দিতে মন সায় দিলো না। বন্ধকই রাখবে সে। মায়ের স্মৃতি কি আর বেচে দেওয়া যায়! লম্বা টানে বুকভরে শ্বাস নিয়ে স্মৃতির মায়া কাটালো রানু। উঠানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে ঢেকে-ঢুকে জোরে পা চালালো। ঈদের নামাজ শুরুর আগেই টাকা নিয়ে বাজার-সদায় করে ঘরে ফিরতে হবে।বাচ্চাগুলোর ঈদ হবে না, তা কি হয়? হবে, নিশ্চয়ই হবে।
এসইউ/জেআইএম