মায়াকাঁটা
সালমা সিদ্দিকী
: ঘুমাওনি এখনও?
: উহুঁ... ঘুম আসছে না, দেবব্রতর গলা ধরে মোহাবিষ্ট হয়ে শুয়ে আছি।
: মানে!
: মানে আবার কী? দেবব্রত বিশ্বাসের গান শুনছি... ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়, আধোখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়। লাজে-ভয়ে-ত্রাসে, আধো বিশ্বাসে- শুধু আধোখানি ভালোবাসা, শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা।’.... কদিন থেকে এই বুড়ো একেবারে মাথার ভিতর জেঁকে বসেছে, তাড়াতেই পারছি না।
: উফ্! তোমার কথাবার্তা হুট করে কেউ শুনলে স্ট্রোক-ফোক করে বসবে নিশ্চিত।
: আপনি তো আর নতুন শুনছেন না, ভয় কী? তারপরও সন্দেহ থাকলে প্রেসারটা চেক করে নিন।
: হা হা হা... তুমি না, সত্যিই!
: আজ আমার লেখা ছাপা হয়েছে, পড়েছেন?
: না তো, কৈ লিংক দাও, পড়ি।
: দেবো না, আপনি খুঁজে পড়ে আমাকে পাঠানুভূতি জানাবেন।
: আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলেই খুশি?
: হুম, না মানে আপাতত।
: কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র প্রায় শেষ করে ফেলেছি, বাব্বা কী কঠিন! উনার গদ্যের ভাষাটাই আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র।
: হুম, শেষ করো। তোমার ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে।
: এই তো করে ফেলবো, আপনি কী পড়ছেন আজ?
: ঢোঁড়াই চরিত মানস, সতীনাথ ভাদুড়ী। পড়া না থাকলে পড়ে নিও। ভালো লাগবে।
: হুম, ভালো বই। ওটা পড়েছি আগেই। একটা বিষয় খেয়াল করেছেন? পাঠরুচির মিল, এই বই পড়ার আনন্দটুকুই আমাদেরকে সেতুর মতো সংযুক্ত রেখেছে, না হলে কবেই ভেসে যেত সব।
: আমার উপর তোমার অনেক রাগ, না মৌলি?
: নাহ্... আমি অভিযোগ করতে পারি না। তাই কোন রাগ নেই। তবে কয়েকটা ইচ্ছা আছে।
: ইচ্ছা?
: হুম... ইচ্ছা। সেই বিদঘুটে সন্ধ্যা-বিকেলটা মনে আছে? সেদিন আমার শাড়িতে বিঁধে যাওয়া চোরাকাঁটাগুলো তুলে একটা কৌটায় ভরে রেখেছি। আপনাকে উপহার দেবো বলে। মনদেয়ালে কাঁটার মত গেঁথে থাকা ওই বেহিসেবি বিকেল-সন্ধ্যাটাকে উপড়ে ফেলে দেওয়ার এটা একটা প্রতীকী উপায়।কৌশলও বলতে পারেন।
: পাগলি মেয়ে! ওই সন্ধ্যাটাকে তুমি বিদঘুটে বলছো? আমি তো সে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত এখনও অনুভব করতে পারি। পাশাপাশি আমরা দুজন, সামনে লেকের পানিতে অস্তমিত সূর্যের ছায়া, অদিতি মহসীন গেয়ে চলেছেন: ‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে, সারাপ্রহর আমার মনের মাঝে...’ আমার জীবনে অমন সন্ধ্যা আর আসেনি মৌলি, বিশ্বাস করো।
: ওহ্... আরেকটা ইচ্ছা, মনে হয় অদিতি মহসীনের ওই গানের প্রতিটি কথাকে একেকটা নুড়ি পাথর বানিয়ে আপনার দিকে ছুড়ে মারি, রক্তাক্ত করি; আমার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের মতো।
: এতো ক্ষোভ? ঠিক আছে আর কিছুই পুষে রাখতে হবে না। চলো, কবে চাও? তোমার ইচ্ছা পূরণ করবে, এসো।
: ‘মায়া’ একটা অদ্ভুত অনুভূতি মামুন! কখনও কখনও এটা ভালোবাসার চেয়েও শক্তিশালী। আমি যদি আপনার উপর থেকে মায়াটা তুলে নিতে পারতাম! তবে হ্যাঁ... প্রিয় গন্ধ, স্পর্শের জন্য আমার ভেতরে যে হাহাকার তা আপনার ভেতরেও আছে জানি, সেটাকে আরও খানিকটা উসকে দেওয়ার প্ল্যান করেছি।এই ধরুন, সূক্ষ্ম যন্ত্রণা দিয়ে নিজে খানিকটা সুখানুভূতি লাভের চেষ্টা আর কি!
: কিভাবে সেটা?
: ধরুন, দুম করে একদিন দেখা করবো। তারপর নর্থ এন্ডে কফি খেয়ে তিনশ ফিট দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত যাবো ঠিক আগের মতো। আপনি ড্রাইভ করবেন, আমার খোলা চুল উড়ে গিয়ে পড়বে আপনার নাকে, মুখে। পরিচিত ঘ্রাণে উতলা হবেন কিন্তু স্পর্শ করতে পারবেন না। এই না পারার আফসোস তাৎক্ষণিক এবং অনেকদিন পর্যন্ত আপনার মনে খচখচ করবে। আর এই খচখচানির কথা ভেবে আমি সুখ অনুভব করবো।
: উফ... উফ... উফ... কত কিছু ভাবো! অথচ আমাদের যৌথতার সুনির্মল দিনগুলো ফিরিয়ে আনার কথাটাই শুধু ভাবো না। আমাকে কষ্ট দিতে এতো কষ্ট করে কৌশল বের করার দরকার আছে? এমনিতেই পুড়ে খাক হচ্ছি, বোঝ না? এই যে আনফ্রেন্ড করে রেখেছো। তোমার কোনো খবর জানতে পারি না, ফোন ধরো না, গলাটাও শুনতে পাই না। সম্বোধনটাও তুমি থেকে আপনি করে ফেলেছো, কেবল দয়াপরবশ হয়ে মাঝেমধ্যে ইনবক্সে সাড়া দাও- এটুকুই যা শান্তি। অনেক তো হলো সোনা, এবার এসো তিক্ততা ভুলে দুজন মিলে চেনাপথে হাঁটি পুনর্বার, চারহাতে আনন্দ কুড়াই।
: আমাদের ‘সম্পর্ক’ এক জটিল সমীকরণে রূপ নিয়েছে মামুন। ভালোবাসাটা উবে গেছে কিন্তু মায়াটুকু লেগে আছে। জোর নেই অথচ সুখের মতো একটা যন্ত্রণা আছে। এও এক ধরনের আনন্দই।
: তোমার সাথে যুক্তিতে পারে সাধ্য কার? তবে যদি মন চায় তাকে বাধা দিও না। তাকে এগিয়ে যেতে দিও গন্তব্যের দিকে... দেখবে দু’হাত ভর্তি কৃষ্ণচূড়া নিয়ে পথের শেষে আমি দাঁড়িয়ে।
: ঘড়ির দিকে তাকান, আমার ঘুম পাচ্ছে, রাখছি।
: আবার পালিয়ে যাচ্ছো?
: নাহ্... পালিয়ে আর কোথায় যাবো? ওই যে বললাম মায়া-ওটা যতদিন আছে, পালিয়েও তো শান্তি নেই।যাই হোক, অনেক রাত হলো, ঘুমান এবার। শুভরাত্রি।
: হুম... ভালো থেকো, শুভরাত্রি।
এসইউ/এমএস