গাজী সাইফুলের গল্প : একজন রূপন্তি
অনেকটা ঝোঁকের মাথায় পরপর দু’টো ডারবি সিগারেট ধরায় সে। ভদ্রলোক কবি আলী প্রয়াস এখনও আসছেন না। ব্যাপার কি! হিমাদ্রি অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জামালখান মোড় প্রেসক্লাব পর্যন্ত আসতেই এরই মধ্যে ভিজে সে ন্যাতনেতে হয়ে আছে। ঠান্ডাটা এতক্ষণে হাড় বেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। এখন প্রায় সন্ধ্যের ধরধর। বৃষ্টিতে দুনিয়ারাজ্যের সব লোক এসে জুটেছে এই আধ—চিলতে সামিয়ানাটার নিচে। সাড়ে ছ’টায় চট্টেশ্বরী রোডের হাটখোলায় প্রোগ্রাম হবার কথা। আর, এরই মধ্যেই ঝড়-বৃষ্টির উপদ্রব। মেজাজটা!
-‘কিরে চা’ দিতে এতক্ষণ লাগে?’ গলাটা কেমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে হিমাদ্রির।
-‘জ্বে ভাইজান দিতাছি। কদ্দুর ধৈর্য্য ধরেন।’ বলেই মাটির চুলোর জালটা বা’হাতে আরেকটু উসকে দেয় আনিস। আগুনটা আরো হনহনিয়ে ধরে ওঠে। চায়ের পানিটা এতক্ষণে ফুটতে শুরু করেছে। চুলোর উপর বসানো জাম্বো সাইজের দু’টো কেতলি হতে পানির গুটগুট আওয়াজ আসছে। আনিস খুব সাবধানে কেতলির ঢাকনা উল্টোয়। বইয়াম থেকে মোটকরে চায়ের লিকার ছাড়ে কেতলিতে।
হাতের আধখাওয়া সিগারেটে আবার টান দিতে যাচ্ছিল; এরই মধ্যে আলী প্রয়াস ভদ্রলোক এসে হাজির। মুখে এ মুহূর্তে থমথমে দু’নম্বুরে একটা হাসি স্পষ্ট। আজ চকচকে গিয়া রঙের একটা ফতুয়া পরেছেন, সাথে জিন্স। জুতোজোড়া খুব সম্ভবত আজই কিনেছেন। ক্যাজুয়াল এখনও চকচক করছে স্বচ্ছ আয়নার মত। তাকালেই সেখানে নিজের চেহারা স্বষ্ট ভেসে উঠছে। সাথে মাথায় হাইফাই রকমের একটা ক্যাপও পরে আছেন।
-‘কখন এলে?’
-‘অনেক্ষণ হল।’
-‘ও আচ্ছা।’
-‘এত্ত দেরি করলেন যে? প্রোগ্রাম তো সাড়ে ছ’টায়। এখন সাতটা!’ বলেই একটা তরল অপ্রস্তুত হাসি দেয় হিমাদ্রি।
-‘যাব না। একটু ইস্টিশনে যেতে হবে এখন। আজ রূপন্তি আসছে, ওকে রিসিভ করতে হবে।’
-‘রূপন্তি! সে কে?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় হিমাদ্রি।
-‘এক কলিগের মেয়ে। আজই আসছে। কিছুদিন আমার এইখানেই থাকবে। নিডি মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল একবার। পরে হাজবেন্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।’
-‘ও আচ্ছা। বিয়ে করেননি আর?’
-‘না।’
-‘আপনি তো ব্যাচেলর থাকেন! এখনও বিয়ে করেননি! এভাবে একা একটা মেয়ে ব্যাচেলর বাসায় থাকবে?’
আলী প্রয়াস এবার হৃষ্টচিত্তে নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন; ‘এটা কোন ফ্যাক্টর না। পুরো ব্যাপারটাই হল বিশ্বাসের উপর।’
-‘জ্বি।’ এমন কথার প্রত্যুত্তরে তেমন কোনো প্রতিবাদ জানাল না হিমাদ্রি।
এরপর লোকাল টেম্পুতে করে দু’জন ইস্টিশনে পৌঁছে। এখন চারদিকে বেশ রমরমা একটা আচ্ছন্ন অন্ধকার। বৃষ্টিতে ইস্টিশনের পিচ্ছল রোডগুলো আরো পিচ্ছল হয়ে আছে। দু-একবার পা হড়কে গিয়েছে এরই মধ্যে।
এই মুহূর্তে আলী প্রয়াস লোকটি চার নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে মালবোরো সিগারেট ফুঁকছেন। উনি সবসময় সিগারেট খান না। তবে আজ এক বিচিত্র কারণে খাচ্ছেন। মানুষ এমনই। প্রবল সুখেই মানুষ নিজের অপছন্দের কাজগুলো করতে পছন্দ করেন। উনিও হয়ত আজ কোনো বিচিত্র কারণে সুখি।
হিমাদ্রি প্লাটফর্মের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইস্টিশনে চারপাশের মানুষদের বিচিএ কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কিছু ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। চটের একটা বস্তার উপর সাপের মত কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ সাপ খেলানো সুরে কাঁদছে। শব্দটা কানের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় স্টেশনে তেমন লোকজন নেই। বেশ নিরিবিলি।
দৃষ্টিটা সরিয়ে আনে আলী প্রয়াস ভদ্রলোকের দিকে। উনি এখনও সিগারেট ফুঁকছেন। অন্ধকারে আগুনের ফুল্কিটা কয়লার আংটার মত গাঢ় হয়ে ওঠানামা করছে। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যায় হিমাদ্রি।
-‘কোন ট্রেনে আসবেন উনি?’
-‘মহানগর গোধুলিতে। এতক্ষণে অবশ্য চলে আসার কথা। ভৈরব জংশনে মালবাহী কোন একটা ট্রেন যেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে। ইস্টিশন মাস্টারের ওদিকটায় গিয়েছিলাম, উনিই জানালেন।’ বলেই হালকা গলায় হাসার চেষ্টা করলেন।
-‘হুঁ।’
ঝিরঝির একটা বাতাস বইছে। ঠান্ডা হাওয়া। এরপর অনেকক্ষণ হল চুপচাপ দু’জনে পাশাপাশি যাত্রী ছাউনিতে পেতে রাখা কাঠ চিড়ে বানানো বেঞ্চিতে বসে রইল। ব্যস্ততাহীন কিছু অলস সময়!
এরপর আলী প্রয়াস কী মনে করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লেন। গরম নিশ্বাসটা হিমাদ্রির পাশ ঘেঁষে চলে যায়। যাত্রী ছাউনির পাশেই একটা প্রকাণ্ড মান্দাল গাছ। বাইরে এখন চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে। জ্যোৎস্নায় সরসর করছে চারদিক। সেই আলোয় মান্দাল গাছের ছায়া পড়েছে। ছায়াটা একটু দীর্ঘ। তিনি সেই ছায়াটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। এরকম জ্যোৎস্নায় মন খারাপ হয়ে যায়।
-‘ওদিকটায় যাবে? রাস্তায় হাঁটব। ট্রেন আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।’
-‘এখন ক’টা বাজে?’
-‘পৌনে ন’টা।’
হিমাদ্রির চা খেতে ইচ্ছে করছিল। ঘাড়ের পেছনের শিরাটা কেমন চিনচিন করছে। ইস্টিশনের সাথেই লাগোয়া বেশ কয়েকটি পান সিগারেট ও চায়ের দোকান। হাঁটতে হাঁটতে তাই ওদিকটায় গেল দু’জন।
কবি আলী প্রয়াস এখন আবার সিগারেট ধরিয়েছেন। দু’ঠোঁটের উপর সিগারেট রেখে অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকছেন। সেদিকে একটা মেয়ে ব্যাপারটাকে খুব ইন্টারেস্টিং ভাবে উপভোগ করছে বেশ খানিকটা সময় ধরে। পাশে বসে থাকা অন্য মেয়েরা অবশ্য সেদিকে ঠিক ওভাবে লক্ষ্য করছে না। বেশ কয়েকবার চোখ পড়তেই হাসির আভাটা চোখ এড়িয়ে যায় না ঠিক।
অনেক মেয়েরই হাসি রোগ আছে। কারণে অকারণে তারা হাসে। আঠারো-উনিশ বছরের মেয়েরা বিচিত্র কারণে হাসবে এতে অবাক হবারও কিছু নেই। ওরা জানে হাসলে এদের সুন্দর দেখায়। চিবুক আর গালে টোল পড়ে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে। দৃষ্টি কেমন মুহূর্তেই স্বচ্ছ দেখায়। কেউ আবার জানে সে রূপসী নয়। গায়ের রং মাজা রঙের। সেও হাসে এক অতীন্দ্রীয় নারীময়তায়।
রাত সোয়া দশটায় তুর্ণা-নিশিথা ছেড়ে যাবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। মেয়েগুলো খুব সম্ভবত ঢাকার যাত্রী। ওরা পিছু পিছু স্টেশন অবধি এলো।
হিমাদ্রি কিছুটা ইতস্তত করে, ‘আচ্ছা রূপন্তি মেয়েটি দেখতে কেমন?’
-‘কেন?’
-‘এমনি। তেমন কোনো কারণ নেই। দেখা হলে বর্ণনা মিলিয়ে দেখব ঠিক আছে কি-না! হা হা হা!’
-‘হুঁ, সুন্দর।’
-‘কতটা সুন্দর?’ বলেই ফোঁড়ন কাটল হিমাদ্রি।
-‘অনেকটা। চাঁদনির মত!’
-‘আপনার সাথে শেষ কখন দেখা হয়েছিল?’
-‘ঠিক মনে নেই অবশ্য! অনেকটা সময় আগে।’ হিমাদ্রি লক্ষ্য করল উনার কণ্ঠটা কেমন শ্লথ হয়ে এলো। রূপন্তির কথা বলতে গিয়ে মনে হলো তিনি কেমন অকারণেই ঘামিয়ে উঠছেন। সন্ধ্যের অন্ধকারের মত লজ্জার আভাটা চোখেমুখে ভর করছে একটু একটু করে।
পৃথিবীতে অনেক পুরুষ মানুষ অনেকটা আওভরা ধরনের। অনেকটা সময় ধরে কোনো নারীকে বিশেষভাবে পছন্দ করছে, তবে নিজের পছন্দের কথা কখনোই সামনাসামনি বলতে পারছে না। আচ্ছা রূপন্তি মেয়েটি কি উনার বিশেষ পছন্দের কেউ!
রূপন্তি নামের মেয়েগুলো বিচিত্র কারণে দেখতে অসম্ভব রূপবতী হয়। মজার ব্যাপার এমন রূপবতী মেয়েগুলো আয়নায় নিজের রূপ দেখে আঁতকে ওঠে না। যতটা আঁতকে ওঠে সে নারীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি।
এই তো গত বৈশাখে, আলী প্রয়াস ভদ্রলোক শাড়ি কিনবেন। কাউকে সঙ্কোচে বলতে পারছেন না। ফারজানা মুনিয়ার সাথে অনেকটা সময় ধরে একপাক্ষিক একটা অনুভূতি গাঢ় হয়ে উঠেছে। সামনে গেলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে কিছুই বলতে পারছেন না! মেয়েটি কি এমন উপলব্ধির কথা বুঝতে পারছে না? হয়তো পারছে। খেলছে ভূতের গলির মত!
‘কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে, মোহ মেঘে অন্ধ করে রাখে;
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না?’
ইস্টিশনে পিছু পিছু আসা ও মেয়েগুলোর মধ্যে কেউ একজন গাইছে। এ দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতই। মনটা কেমন হঠাৎ উদাস হয়ে যায় আলী প্রয়াসের।
ক্ষণিক বাদেই প্লাটফর্মে সূক্ষ্ন একটা মৃদু আলোর রেখা স্পষ্ট হতে শুরু করল। আলোটা ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে এসে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমেই।
শি ই ই ই শি শি ই ই ই-ট্রেনটা মুহূর্তেই এসে থেমে গেল।
মুখটুক কুঁচকে তিনি রূপন্তিকে খুঁজছেন। খুঁজলেন অনেকটা সময় ধরে। চাঁদনির মত কেউই বগির স্টেয়ার বেয়ে নেমে এলো না।
হিমাদ্রির দিকে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। আলী প্রয়াস গম্ভীর গলায় বলল, ‘হিমাদ্রি রূপন্তিকে তুমি দেখতে পেয়েছ?’
-‘চাঁদনির মত কাউকেই দেখিনি!’ এই কথায় তিনি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। এমন ক্রাইসিস সময়ে কেউ এমন খামখেয়ালি আচরণ করে! ক্রমেই একটা অস্থিরতা শিরা-উপশিরা বেয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছাতে লাগল।
কেউ একজন অনেকক্ষণ হলো ডাকছেন। ‘এই যে উঠুন, এই যে-ট্রেন লাস্ট ইস্টিশনে চলে এসেছে। এবার নেমে পড়ুন। এই যে উঠুন!’ আলী প্রয়াসের ঘুম ভাঙে। সত্যিই ট্রেন বটতলী ইস্টিশনে এসে পৌঁছে গিয়েছে। এখন পুরো শরীর বেয়ে ঘামের একটা সরু স্রোত নামছে। সাথে প্রান্ত পলাশ ছিলেন। চিন্কি আন্তানায় সে নেমে যায়। এরপর কখন যে তন্দ্রা এসে যায় ঠিক মনে নেই।
আলী প্রয়াস বগীর স্টেয়ার বেয়ে প্লাটফর্মে নেমে এলেন। বাইরে এসে দেখেন আকাশে সত্যিই আজ তীব্র জ্যোৎস্না। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ। সামনে তাকালেন। আঠারো বছরের হিমাদ্রি ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। সে এগিয়ে এসে স্যুটকেসটা হাতে নেয়।
-‘এত দেরী হল যে?’
কথার জবাব দিলেন না তিনি। ঘোরটা ঠিক এখনও কাটেনি। এরপর কিছুটা অবাক করে দিয়ে, আলী প্রয়াসের হাতে থাকা নীল পাড়ের শাড়িটার দিকে দেখিয়ে, হিমাদ্রি কৌতূহল ভরে আবারো জানতে চায়;
-‘শাড়িটা কার জন্য?’ বুকটা কেমন মুহূর্তেই হু হু করে ওঠে!
এসইউ/পিআর