বিরুদ্ধকাল
সালমা সিদ্দিকী
গার্মেন্টসে কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকায় নিজের নাম দেখে দিশেহারা মতিন। গত তিন মাসের বকেয়া বেতনের ব্যাপারেও পরিষ্কার করে কিছু জানায়নি। বাড়িওয়ালা ঘর ভাড়ার তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুলেছে। মুদি দোকানের বাকি। বাড়িতে পোয়াতি বউটার ডেলিভারির ডেট এসে গেল প্রায়। সেখানেও একটা খরচা আছে। কী করে যে কী হবে? সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে বিছানায়।
সাভার নামাবাজার এলাকার ওয়াল টিনশেড ঘরটায় সারি সারি অনেকগুলো রুম। রান্নাঘর, কল, টয়লেট- যৌথ ব্যবহারের শর্তে একটা করে রুম ভাড়া নিয়েছে গার্মেন্টস কর্মী, ড্রাইভার, দোকানের কর্মচারী এ রকম বেশকিছু স্বল্প আয়ের মানুষ। এরা আবার প্রতিটা রুমেই দুই-তিন জন করে সহকর্মী, পরিচিতদের সাবলেট দিয়ে ভাড়া বা খাওয়া শেয়ার করে চলে। ফলে খরচ অনেকটা সেভ হয়। খরচ বাঁচানোর এই কৌশল এলাকার সবার জানা। মূলত এখানে এভাবেই সবাই বাস করছে। বাড়িওয়ালারা অল্প পয়সা বিনিয়োগে যেনতেন ঘর তুলে মাস শেষে অনেকগুলো টাকা পাচ্ছে এতেই সন্তুষ্ট। সেখানে কে থাকছে, কতজন থাকছে-সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।
মতিনের রুমে চারকোণায় চারটা চৌকি পেতে ওরা তিনজন সহকর্মী আর কামরুল ড্রাইভার থাকে।
কামরুল ওদের গ্রামেরই ছেলে, ব্যাংক টাউনের এক বাসায় চাকরি করতো; ডিউটি বলতে তাদের দুটো বাচ্চার স্কুল আর কোচিংয়ে আনা-নেওয়া। ভালোই চলছিল এতদিন। কিন্তু করোনার উপদ্রবে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় দুই মাস হলো ওকে না বলে দিয়েছে। সেদিন রুমে ফিরে খুব বিষণ্ন ছিল ছেলেটা, হাত কামড়াচ্ছিল বারবার। কিন্তু ইদানিং কেমন রহস্যময় আচরণ করছে। অনেক রাতে রুমে ফেরে। আবার ভোরবেলা বেরিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘টুকটাক রোজগারের পথ খুঁজি, সবই কপাল। প্যাট তো আর লকডাউন বুঝে না!’
অবশ্য কানাঘুঁষা শোনা যাচ্ছে, কামরুল ছিনতাই করে। লকডাউনের কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে যেসব মানুষ একটু বেশি রাত বা ভোরবেলায় গাবতলী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে হাঁটতে থাকে। তাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তুলে হেমায়েতপুর দিয়ে শহীদ রফিক সেতুর কাছে নিয়ে সুযোগমতো জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। একজন সিএনজি চালকের সাথে মিলে সে এ কাজ করছে।
ক্ষণিকের জন্য মতিন ভাবে কামরুলের সাথে কথা বলবে। ঘটনা সত্যি হলে তাকেও দলে নিতে অনুরোধ করবে। দৈনিক খাওয়ার খরচটুকু দিলেই চলবে। পকেটে ধারের একশ টাকাটা ফুরাতে কতক্ষণ? এরপর তো না খেয়ে থাকতে হবে। উফ্, মাথাটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে!
- কিরে ব্যাডা, ঠাডা পরা মাইষের লাহান বইয়া আছো ক্যা? করোল্লা ভাইরাসে ধরছে? মুবাইলডা বাজদেয়াচে হোন না?
রুমমেট সান্টুর কথায় চমকে উঠে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে কান্নাকাটি, বিলাপের সুর শোনা যায়। ছোট বোন রুণা কাঁদতে কাঁদতে জানায়,
- মোগো সব শ্যাষ অইয়া গ্যালে বাইয়্যা। পুহুইর গনে নাইয়্যা উডারকালে পাচার খাইয়া রক্ত ভাঙ্গা শুরু অইছেলে। লগে লগে হাসপাতালে নিছি। এত কইরা আত-পাও ধরলাম, তবু ভর্তি নেলে না, কুনু গোলামের পুত ধারে আইলে না। হারাদিন রক্তের উপরে ভাইস্যা ভাবি মোর চইল্যা গ্যালে। ও বাইয়্যা গো...
দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে মতিন। তার গলার কাছ থেকে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চায়।
এসইউ/পিআর