ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

জুলফিকার রবিনের ‘সোলেমানি খাবনামা’

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪১ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২০

১.
একটা সতর্কীকরণ স্বপ্ন দেখে হিদাসের ঘুম ভেঙে গেল। সতর্কীকরণ না বলে বলা যায় ভবিষ্যদ্বাণীমূলক। স্বপ্নে সে দেখলো, একটা নদীর পারে সে তার মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে এবং তিনি উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন— ‘হিদাস, আগামী সোমবার তুই মারা যাবি!’ বাক্যটা দৈববাণীর মত আকাশে একটা প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল। কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই আজানের শব্দে হিদাসের ঘুম ভেঙেছে। হিদাস লক্ষ্য করলো তার হাত-পা কাঁপছে। একটু বমি বমিও লাগছে। অতিরিক্ত ভয় কিংবা দুঃখ পেলে ওর এমন বমি আসে। ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল হিদাস। এই তো কিছুদিন আগে ‘সোলেমানি খাবনামা’ নামের একটি বইয়ে সে পড়েছে, রাতের শেষভাগের অধিকাংশ স্বপ্ন সত্য হয়। বইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় স্বপ্নটা সত্য হওয়ার সম্ভবনা আরও বেড়ে গেছে। হিদাস কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। সে কি এই মুহূর্তে বাসার সবাইকে ডেকে বিষয়টা জানাবে, না-কি কাউকে কিছু না জানিয়ে নীরবে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেবে? গত ৩-৪ বছরে যদিও জুম্মা আর ঈদের নামাজ ছাড়া কোনো নামাজই সে পড়েনি, তথাপি আজকে হিদাস ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

২.
আজ সোমবার। স্বপ্নের বক্তব্য অনুযায়ী আজ তার মৃত্যুদিন। গত দুইটা দিন সে বাসা থেকে বের হয়নি। কলেজ, কোচিং সব বাদ। একটা মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের আবার কীসের পড়াশোনা। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো করতে পারেনি সে। বাসার সবাই তার এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করলেও কেউ তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। আসলে এই পরিবারের সবাই একটু গম্ভীর প্রকৃতির। কে কথা বলছে আর কে বলছে না এটা নিয়ে ভাবাটা এখানে সময়ের অপচয়। ড্রয়িং রুমে একটা সোফায় চুপচাপ বসে টিভিতে সৌদি আরবের একটা চ্যানেল দেখছে সে। সেখানে কাবা শরীফের তাওয়াফ দেখানো হচ্ছে। টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মাথায় এখন ঘুরছে, সে কীভাবে মারা যাবে এবং মৃত্যুর পর তার সাথে কী কী ঘটবে। গতকাল এ সংক্রান্ত একটা বইও সে পড়া শুরু করেছিল। বইয়ের নাম ‘মৃত্যুর পরে কবরের খবর’। বইয়ের বর্ণনা এতটাই ভয়ানক যে প্রথম অধ্যায়ের পর সে আর পড়ার সাহস পায়নি। হিদাস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠিক ১২টা বাজে। সে ঠিক কখন মারা যাবে এবং কী কারণে মারা যাবে এটা বুঝে উঠতে পারছে না। স্বপ্নে মৃত্যুর সময়টা বললে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে তাকে থাকতে হতো না।

৩.
হিদাস ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা পাশের রুমের টিভিতে উচ্চশব্দে খেলা দেখছে। ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা ৬ এর ঘর অতিক্রম করলো। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। হিদাস বুঝতে পারছে না তার মৃত্যুটা চাঁদের হিসেবে হবে না-কি ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। যদি চাঁদের হিসেবে হয়, তাহলে সূর্যাস্তের আগেই তার মারা যাওয়ার কথা। কেননা আরবি নিয়মে সূর্যাস্ত পর্যন্তই সোমবার। হিদাস হাতের কর গুণে তওবা পড়া শুরু করল। দুইশত একবার পড়া শেষ হওয়ার সাথেই মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ল। ওর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। তাহলে কি সে আজ মারা যাচ্ছে না? কিন্তু খুশি হতে গিয়েও ঠিক যেন খুশি হতে পারল না। কেননা ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সোমবার শেষ হতে এখনো ৫ ঘণ্টার মত দেরি আছে।

৪.
এ বাসায় রাতের খাবার খাওয়া হয় ১০টার মধ্যে। হিদাস পেটব্যথার অজুহাতে রাতের খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাসার সবাই টিভিতে খেলা দেখা নিয়ে ব্যস্ত। ৩৬ বলে আর ৪১ রান করলেই বাংলাদেশ দল জিতে যাবে। হাতে আছে ৩টি উইকেট। ক্রিকেটের অসম্ভব ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও হিদাস খেলায় মন দিতে পারছে না। খেলায় জিতলে তো আর তার কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে না। বরং সে এক হুজুরের ওয়াজে শুনেছে, প্রতিযোগিতামূলক কোনো খেলা দেখা তো দূরের কথা, তার আলোচনা যেখানে হয় সেখানে বসে থাকাও হারাম। হিদাস ড্রয়িং রুম থেকে উঠে চলে গেল। ১২টা বাজতে আর ৩০ মিনিট বাকি। আচ্ছা, সে কি বাসার সবাইকে ডেকে তার এই অস্থিরতার কথা জানাবে। কিন্তু কোনো কারণে যদি সে মারা না যায়, তাহলে সবার কাছে সে লজ্জায় পড়ে যাবে। হিদাসের গলা শুকিয়ে আসছে এবং একই সাথে বিরক্তও লাগছে এটা ভেবে যে, কেন এখনো সে মারা যাচ্ছে না। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা ঊনষাট মিনিটেই তাকে মারা যেতে হবে না-কি!

৫.
সময়টা কিছুতেই কাটতে চাচ্ছে না। এমন অনিশ্চয়তা তার কাছে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন বলে মনে হচ্ছে। হিদাস ঘরের দরজা বন্ধ করে জায়নামাজে সেজদায় পড়ে গেল। একবার জুম্মার বয়ানে সে শুনেছিল, সেজদা অবস্থায় মারা গেলে বিনা হিসেবে বেহেশতে যাওয়া যায়। সেজদায় সে অবিরত কালেমা পড়ে যাচ্ছে। সমস্যা একটাই, সময়টা দেখা যাচ্ছে না। একবার ভাবলো মাথা তুলে দেখবে ১২টা বাজে কি-না। কিন্তু ভয় ভয় করছে। হঠাৎ পাশের রুম থেকে ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ বলে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। মগ্নতায় আকস্মিক ছেদ পড়ায় হিদাস সেজদা থেকে মাথা তুলে প্রথমেই দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়িতে ১২টা বেজে ৯ মিনিট। নিশ্চিত হওয়ার জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময়টা মিলিয়ে নিলো সে। মাত্র ২ মিনিটের ব্যবধান। সাথে সাথে একটা অপার্থিব আনন্দে হিদাসের ভেতরটা নেচে উঠল। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ মঙ্গলবার। অর্থাৎ স্বপ্নে দেখা মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। বুকের উপর থেকে একটা পাহাড় নেমে গেলো যেন। বেঁচে থাকা এত তীব্র সুখের! এইবার খেলায় জেতার আনন্দটা পাশের রুম থেকে তার ভেতরে সংক্রমিত হলো। কিন্তু তারপরও একটা ছোট্ট দুঃশ্চিন্তা মাথায় থেকেই যায়—ইংরেজি সোমবার আর আরবি সোমবার আলাদা নয়তো!

এসইউ/পিআর

আরও পড়ুন