ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রুদ্র-প্রচেতা : পর্ব ০৭

ড. রাজুব ভৌমিক | প্রকাশিত: ০৫:২৯ পিএম, ১৫ মার্চ ২০২০

ঐদিন খেলার সাথীদের খিলখিল হাসি শুনিবার পর লজ্জা না পাইয়া রেহাই পেলুম না। তবে সেদিন অন্তত বুঝিতে পারছিলুম যে, সাজু পাড়ার বৈরাগীকে প্রচেতা আর আমার সম্পর্কে সবকিছু বিস্তারিত বলিয়াছে—এবং বৈরাগী তাহার চিরায়ত স্বভাব-স্বরূপ সবাইকে তাহা আপন মনে বলিয়াছে। তার জন্যই আমার সব খেলার সাথী আমার দিকে তাকাইয়া হাসিতেছিল। বিসদৃশ কারণস্বরূপ এদিনটি আমার অতীব স্মরণীয় ছিল। প্রথমতঃ—আমি এই দিন প্রথম বুঝিয়াছিলাম যে, প্রচেতার ভালোবাসা পাবার যোগ্য আর যে কেউ হোক না কেন আমি কিন্তু সে নই। যদি প্রচেতাকে বিধাতা তাহারে এমনিতে আমায় দিয়ে দিত—তাহলে আমার মত এক গরীবকে মস্ত-বড় এক হস্তী দানের মত অবস্থা হইত। সংসারে যে অভাগা তাহার পেট-ই চালাইতে অক্ষম, সে কেমন করিয়া এত বড় হস্তীর ভরণপোষণ সহিতে পারিবে। অর্থের সঙ্কট আমাদের বিন্দুমাত্র ছিল না বটে—কিন্তু গুণের ভয়ঙ্কর অভাব নিশ্চিত ছিল। প্রচেতার মত এমন একজন রূপে-গুণের স্ত্রীলোককে আমি কোথায় রাখিতাম? এ ধরিত্রীর কোথাও প্রচেতাকে স্বমর্যাদায় রাখিবার মত প্রকৃত স্থান আসলেই দুর্লভ। স্বর্গলোকে ইন্দ্রেরও সেই ক্ষমতা আদৌ রহিয়াছে কি-না তাহা নিয়ে আমার বিস্তর অভিশঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে—আমিই বা তাহারে রাখিব কোথায়—এই অতিরঁজনশূন্য সংসারে প্রতিদিন। শুধু ভেবেছিলুম—ধন্য তাহার পিতা-মাতা, যাঁহারা সংসারকে এমন এক সন্তান উপহার দিলো। তাহারে নিয়া একসময় সংসার করিবার স্বপ্ন সাগরের জোয়ারের মত আসিত কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন যেন কাঁঠাল গাছের উপর বসা দোয়েল পাখির মত ফুড়ুৎ করিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল।

দ্বিতীয়তঃ—প্রচেতাকে দেখিবার পর আমার বেয়াড়া অবস্থা লক্ষ্য করিয়া যখন আমার খেলার সাথীরা হাসিতেছিল এবং প্রচুর মজা করিতেছিল; তখন আমি তাহাদিগের মুখমণ্ডলে আমার প্রেমের প্রতি তাহাদিগের অকথ্য সমর্থন লক্ষ্য করিতে পারিলাম। খেলার সাথীদের মুখমণ্ডলে আমার প্রতি অকথ্য সমর্থন দেখিবার পর আমার বুকে সাহস জন্মাইল। আর তাহা দেখিবার পর গোপনে করিলুম আমার জীবনের এক মস্ত-বড় শপথ। সেদিন শপথ করিলুম যে, প্রচেতাকে বিধাতা আমার ভাগ্যে লিখে রাখুক বা নাহি রাখুক কিন্তু তাহারে পাইবার জন্য আমি আমৃত্যু চেষ্টা করিব—এবং এই পরানে প্রচেতাকে বিনে কোন দিন কাহারো স্থান কোনমতে দিব না।

যদি জানিতে প্রণয়ী কত সুন্দর তুমি
মোর তৃষ্ণার্ত নয়নে ঊষাকালে সন্ধ্যায়
বুঝিতে নিয়ত দেখি স্বর্গদূতের রশ্মি
ঐ রূপ যখন দেখি সখি অনন্যোপায়।

দেখিলে তোরে নিঃশ্বাস অল্প অল্প করিয়া
হৃদয়স্পন্দন তেড়ে আসে বুকের মাঝে
কত সুন্দর তুমি গো যেন প্রেমদরিয়া
তব চরণ ছুঁইয়া বসুধা কাঁপে লাজে।

করিলুম পণ সখি যদি দিবে দেখিতে
বদন তোমারি মোরে সারা জীবনভর
হৃদয় দিয়ে মুকুট সাজাইব সখিতে
রেখে মোর দেহখানি চরণের উপর।

তোমায় দেখিতে মূর্তি হব আমি সকালে
পূজা শেষে মালা দিব সখি তোরে বিকালে
চাইব তোমা চরণ যেন মিলে কপালে।

নিখিল জীবনে ঐ চরণতলে মোর হৃদয়খানি পুষ্পের মত সাজাইয়া দিয়া তাহার পূজার ভাগ্যটি যেন আমার হয়। শুধু এটি ছিল মোর এ জীবনের একমাত্র চাওয়া—সেদিনের এবং আজও আছে। পূর্বেই বর্ণিত করিলাম যে যকৃত ক্যান্সারের লক্ষণ দেখিয়া সম্প্রতি আমার ডাক্তার বাবু বলিয়াছেন যে, যমবাবু আগামী ত্রিশ দিনের মধ্যে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিবেন। আজ আমি বৃদ্ধ এবং যমবাড়ী যাত্রী একজন রোগী। ম্যানহাটনের ‘লিনক্স হিল’ বৈদ্যশালার যমের বিছানায় শুইয়া আমি এখনো তাহার কথা সর্বক্ষণ ভাবি। প্রচেতা আজ কোথায় রহিয়াছে সেটা মোর অজানা সত্য—কিন্তু আমার সেই দিনের চাওয়াটি আজও অপরিবর্তিত আছে।

এমন করিয়া বেশ কয়েকটি মাস গত হইয়া গেল—এবং আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার মাসটিও হু-হু করিয়া তুফানের মত আসিয়া পড়িল। বিগত কয়েক মাস ধরিয়া আমাদের শহরের বাসাতে স্কুলের শিক্ষকেরা আসিয়া আমাকে এবং জ্যেষ্ঠ সহোদরা মিলিকে পড়াইতেছিল। অথচ পড়াশোনায় আমার বিন্দুমাত্র অভিনিবেশ ছিল না। তখন পড়াশোনাকে আমি ভীষণ ঘৃণা করিতাম। কারণ পড়াশোনার চাপে আমি প্রচেতারে নিয়ে স্বপ্নের ঘর তৈরি বেশিদিন টিকিয়া রাখিতে পারিতাম না। যেমন—একটি ছোট বাচ্চা ছেলে যখন তাহার পিতা-মাতার সহিত সমুদ্রসৈকতে বেড়াইতে যায়; তখন সে সমুদ্রসৈকতের বালু দিয়া গভীর আবেগে সাধের ঘর বানায়। সেই দিন সমুদ্রটি যদি ভারতবর্ষের ফেনসিডিল গিলিয়া মাতাল হইয়া বারবার স্রোতের মাধ্যমে লাফাইতে থাকে তাহলে বাচ্চা ছেলেটির সাধের বানানো ঘরকে ধ্বংস হইতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। বাচ্চা ছেলের স্বপ্নের ঘরটির আর অস্তিত্ব থাকিবে না—স্বপ্নের ঘরটি সমুদ্রেই মিশিয়া পালাইবে।

ঠিক তেমনি করিয়া মোর জীবনের প্রতিক্ষণে আমি প্রচেতাকে নিয়া কত কত সুন্দর ঘর বানাইতাম। সে ঘরে বসিয়া ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজ রোপণ করিতাম। কিন্তু যখনি মোর পড়াশোনার কথা মনে পড়িত বা পড়াশোনার চাপ অনুভব করিত; তখনই প্রচেতাকে নিয়া আমার সব স্বপ্ন সমুদ্রতীরে বালুর ঘরের মত ভাসিয়া যাইত। আর আমাকে আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দর্শন একলাই করিতে হইত। এই পড়াশোনা বারবার মাতাল সমুদ্রের স্রোতের মত আমার স্বপ্ন ধ্বংস করিতে উঠে-পড়ে লাগিত। বহুবার বয়স্কদের মুখে শুনিয়াছিলাম যে, পড়াশোনা করিলে জীবন সুন্দর হইবে এবং জীবনে অনেক সাফল্য লাভ করা সম্ভব হইবে। আর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার চাপে বুঝিতে পারিলাম যে, পড়াশোনাই সকল অনর্থের মূল। কেবল পড়াশোনাই আমার বেবাক দুঃখের মূল কারণ। তাহলে এই পড়াশোনা দিয়া কী হইবে? যে পড়াশোনা জীবনে শুধু দুঃখ বইয়া আনে? তারপরও আপন ইচ্ছের উপর বল-প্রয়োগ করিয়া আমাকে পড়িতে হইত। মাতা-পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করিতে বইয়ের পাতার জ্ঞানগুলো ছাগলের মত জোর করিয়া খাইবার চেষ্টা করিতাম। কোন কিছু জোর করিয়া খাইলে তাহা বেশিক্ষণ পেটের ভিতর থাকে না। আমারও তাই টিকেনি—আজ মূর্খ হইয়া দিনানিবাস করিতেছি। তখন এই পড়িতাম—আবার এই ভুলিতাম। সরস্বতী মাতা কেন যে আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর ছিল তাহা নিয়া সর্বক্ষণ ভাবিতাম—কিন্তু কোনো উত্তর পাইতাম না। কি-বা এমন হইত যদি আমায় একটু জ্ঞান দিত? আচ্ছা, বুঝিলাম না হয় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেবী সরস্বতী আমাকে স্থায়ী জ্ঞান দান করিতে পারিবেন না।

কিন্তু আমাকে দেবী সরস্বতী কিছু জ্ঞান ধার দিলেই বা কী এমন ক্ষতি হইত? অন্তত আমি একটু সহজেই মাধ্যমিক পরীক্ষাটি দিয়ে দিতে পারিতাম এবং আমার এত অহেতুক পরিশ্রমও করিতে হইত না। দৈনন্দিন প্রচেতাকে নিয়ে আমার স্বপ্নের ঘরগুলোও এমন করিয়া ভাঙিয়া চুরমার হইত না।

‘ওরে, পড়াশোনা ঠিকমত না করিলে ভালো বউ পাবি না রে।’ ঠাকুরমা পান চিবাইতে চিবাইতে উনার কক্ষে বসিয়া আমারে শাসাইলেন। ব্যস, উপায়ান্তর না দেখিয়া পড়াশোনা করিতে উঠিয়া পড়িলাম। পরের দিন পরীক্ষা—তাই আগেরদিন রাতে একটানা কয়েক ঘণ্টা পড়িতেছিলাম। রাত্র প্রায় এগারোটা। এখনো পড়িতেছিলাম। মাতাশ্রী রাতের খাবার খাইতে ডাকিলেন। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়িতে তখন বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করতেছিল না। ভালো বউ যে আমায় পাইতে হইবে। এমনি করিয়া মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় দিনে-রাতে যথোচিত পড়াশোনা করিয়াছি। কিন্তু সারা বছর ঠিকমতো না পড়িয়া শুধু পরীক্ষার সময় ভালোমত পড়িলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সম্ভব নহে। আমি তো আইনস্টাইন নই যে ইতর পরিমাণ পড়িলেই সব পড়া মুখস্থ হইয়া যাইবে। যাই হোক, পরীক্ষার মাসটি ভীষণ কষ্টে কোনমতে অতিক্রম করিলুম। এবার আরম্ভ হইল পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অসহনীয় অপেক্ষার পালা।

পাড়ার লোকমুখে প্রচেতার ‘ভালো ছাত্রী’ হিসেবে বহু সুনাম এবং স্বাদুগন্ধ ছিল। সে তুলনায় আমি অত ভালো ছাত্র ছিলাম না। বইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল শীতকালে গ্রামের নতুন বউয়ের সহিত পুকুরের জলের উদ্বেগসঞ্চারী জ্বালাতনকরের মত সম্পর্ক—প্রয়োজন কিন্তু অসময়ে বলপ্রয়োগে মেনে নেওয়া। জানিতাম পড়াশোনার প্রয়োজন কিন্তু আমার জন্য সেই সময়টা উপযুক্ত ছিল না। পরীক্ষার পরে অকস্মাৎ ভাবিলুম যে, এমনিতে প্রচেতা বহুগুণে গুণান্বিত তার উপর সে মেধাবী একজন ছাত্রীও বটে। এদিকে আমার বইয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এইবার যদি আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস না করি—তাহলে প্রচেতাকে এই জীবনে পাইবার আশা চিরতরে বাদ দিতে হইবে নিশ্চিত। প্রচেতা কোনদিন আমার মত একজন গণ্ডমূর্খকে জীবনসঙ্গী করিতে রাজী হইবে না। এইটা ভাবিতেই মোর কলিজায় ভীষণ এক ব্যথা অনুভব করিলুম। ভাবিলাম—হায়, এই বোধটা কেন আমার আগে হইল না। যদি এই বোধ আগে হইত, তাহলে গভীর মনোযোগ দিয়া আমি সারা বছর ধরিয়া পড়িতাম। যাতে প্রচেতা আমার নামটি শুনিবার পর ভালো স্পর্শানুভূতি করে—এবং আমাতে সে চিত্তপ্রসাদ পাইত। অথচ এখন অনেক দেরি হইয়া গেল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া আমার শেষ হইয়াছে—এখন শুধু ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করিতেছি।

শহরের প্রধান পুকুরটির উত্তর পাড়ে অবস্থিত আমাদের পাড়াটি তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। এই পাড়াতে সব মিলিয়ে বারো থেকে চৌদ্দ হিন্দু পরিবার বসবাস করিতেছে। সেই জন্য এই পাড়াতে যখনি কোনো ঘটনা বা সংবাদ আসে, সেই সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই সারা পাড়ার বাসিন্দারা পরমেশ্বরের কৃপায় জানিতে পায়। এই ভাবনা মাথায় উঠিবার পর আরও ভয়ে অস্থির হইয়া গেলাম। যখন আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ঘোষণা করিবে; তখন প্রচেতাসহ তাহার পরিবারের সবাই আমার পরীক্ষার ফলাফলের কথা জানিতে পারিবে। এতে আমার বিরাট সর্বনাশ হইবে! এই বিপদ হইতে কিভাবে উদ্ধার পাইতে পারি তাহা ভাবিতে লাগিলাম। ঠিক তখনই আমার সহিত পরমেশ্বরের সম্পর্ক স্থাপন হইল। সেই দিন হইতে আমি পরমেশ্বরকে সর্বক্ষণ ডাকা শুরু করিলাম। ডাকিবার সাথে সাথে পরমেশ্বরকে পরীক্ষায় পাস করাইয়া দিলে হরেক রকমের ঘুষ দিবার প্রতিজ্ঞাও করিলাম। যেমন—ফল-মূল কিনিয়া মন্দিরে যাইব, যদি পাস করি সেই দিন হইতে পরমেশ্বরকে কখনো ভুলিব না, উপবাসসহ পূজা দিব এবং আরো কত কী। সময়ের অভাবে অল্পের জন্য রাজা হরিশ্চন্দ্র হইলাম না—তাহা নাহি হইলে একে একে শরীরে বিভিন্ন অংশ ঘুষ হিসেবে পরমেশ্বরকে দিয়া দিতাম। যাই হোক, পরমেশ্বরকে আমি এতবার ডাকিলাম এবং এত ঘুষ দেবার প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, আমি উনার দুই কান প্রায় ক্ষত করিয়া দিলুম। কেননা, মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস যে আমায় করিতে হইবে।

আজ মাধ্যমিক পরীক্ষা ফলাফল ঘোষণা দিবার দিন। গত রজনীতে মোর বিন্দুমাত্র নিদ্রা আসিল না। কেননা, আজ যে আমার জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ একদিন। আজ যদি আমি পাস নাহি করিলাম, তবে আমার সহিত প্রচেতার সম্পর্কের কথা চিন্তা করাটাই দুষ্কর হইয়া যাইবে। যদিও আমি যে প্রচেতাকে ভালোবাসি সেইটা সে তখন জানিত না। নিকট ভবিষ্যতে যথার্থ সময়ে প্রচেতারে আমার মনের সব-কথা খুলিয়া বলিবার পরিকল্পনা অবশ্য ছিল। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষায় যদি ফেল করিতাম, তাহলে প্রচেতাকে আমার মুখ কিভাবে দেখাইতাম। তাহার মত একজন মেধাবী ছাত্রী কখনো আমার মত মূর্খের কথা শুনিতে চাইবে না। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় যে পাস আমার চাই। একমাত্র পরমেশ্বর ব্যতীত কেউ আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করিতে পারিবে না। সকাল পেরিয়ে দুপুর হইল। বাসা হইতে পরমেশ্বরের নাম মনে মনে জপিতে জপিতে পরীক্ষার ফলাফল জানিবার লাগি স্কুলের দিকে যাত্রা আরম্ভ করিলাম। স্কুলের বোর্ডে আমার রোল নম্বরটি খুঁজিবার চেষ্টা করিতেছিলাম—কিন্তু আমার রোল নম্বরটি দেখিতে পাইলাম না। পরমেশ্বর কি আমার এত ডাকাডাকির বিন্দুমাত্র মূল্যও দিবে না? পুনরায় স্কুলের বোর্ডে আমার রোল নম্বরটি খুঁজিতেছিলাম। হঠাৎ দেখিলুম আমার রোল নম্বরটা—সাথে সাথে পরীক্ষার প্রবেশপত্রের সাথে রোল নম্বরটি মিলাইবার চেষ্টা করিলুম। রোল নম্বরটি সঠিক—এবার কোন গ্রেড পাইলাম তাহা দেখিবার চেষ্টা করিলুম। জানিতাম আমি কোনো দিন এ-প্লাস গ্রেড পাইব না। সে আশা মনের ভিতর হইতে বহু আগেই বাদ দিয়াছিলাম। এখন শুধু পাস করিতে পারিলেই আমি বিপদমুক্ত হইব। বোর্ডে আঙুলটি টানিয়া দেখিলাম মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি বি-গ্রেড পাইলাম।

স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বোর্ডে দেখিবার পর প্রথমে ভীষণ খুশি হইলাম। আনন্দে প্রায় আত্মহারা হইয়া গেলাম। অনেক স্বস্তি অনুভব করিলাম—যাক মান-সম্মানটা আপাতত টিকল বুঝি। অন্তত এখন আর আমাকে প্রচেতার সামনে মুখ দেখাইতে লজ্জা পাইতে হইব না। আমার প্রেম বুঝি অক্ষুণ্ন রহিল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনটা খারাপ হইয়া গেল। পরমেশ্বরকে গত কয়েক সপ্তাহ কতই না ডাকিলাম—আমাকে যদি এ-গ্রেড বা এ-প্লাস গ্রেডটি দিত তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইত? পরমেশ্বরের প্রতি ভীষণ রাগ হইল। যদি পরমেশ্বর আমাকে এ-প্লাস গ্রেডটি দিত তাহলে মোর বুকটি ফুলাইয়া তাহার কাছে কথা বলিতে পারিতাম। আবার ভাবিলাম গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যাহার সাথে কোনো কথাই হয়নি; তাহার সাথে এ-প্লাস পাইলেও কথা বলিবার সাহস হইবে যে তাহার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। তারপরেও পরমেশ্বরের প্রতি কিছু রাগ হইল। অতঃপর পরমেশ্বরের প্রতি যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম তাহা একে একে ভুলিয়া যাচ্ছিলাম—ঠিক এক খাস বাঙালির মত। দুঃসময়ে বাঙালি প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়—সুসময়ে বাঙালি সবকিছু ভুলিয়া ভূতকূলে জন্ম নেয়।

সেইদিন বিকেলে প্রচেতাদের বাসার সামনের রাস্তাটি দিয়া পায়ে হেঁটে আমি সাজুদের দোকানের সম্মুখে যাইতেছিলাম। হঠাৎ প্রচেতার মাতা কান্তাকে দেখিতে পাইলাম। ‘কিরে রুদ্র পরীক্ষায় পাস করলি, মিষ্টি খাওয়াবি না?’ কান্তা মাসি কহিল। ‘খাওয়াবো মাসি’, প্রচেতার মাতা কান্তাকে মাসি বলিয়া সম্বোধন করিলাম। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি শুধাইলেন, তিনি আমার সম্পর্কে দিদি হয়। তিনি আমার পিতাকে কাকা বলিয়া ডাকেন। তাই তিনি আমার সম্পর্কে দিদি হন। আমার মাথায় যেন দিনদুপুরে অকস্মাৎ এক বাজ পড়িল। মনে মনে ভাবিলাম, ‘ওমা একি অলুক্ষণে কথা রে—ইনি আমার দিদি হইলে তো আমি প্রচেতার সম্পর্কে মামা হই।’ ভাবতেই ভীষণ লজ্জা পাইলাম। কান্তা দিদি আমাকে কিছু খাইতে কহিলেন—এবং উনাদের বাসার ভিতরে বসিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আহা, এই দিনটার জন্য না হয় কতদিন অপেক্ষা করিতেছিলাম। প্রচেতাদের বাসায় বসিয়া গল্প করিব—আর পরান ভরিয়া তাহারে দেখিব। এমন হইতে পারে যে, আমি তাহার সাথে আমার জীবনে প্রথমবারের মত কথা বলিতে পারিব। আহা, স্বপ্ন বুঝি সত্যি হইতে চলিতেছে। হঠাৎ আমার এক প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়িল—আর মনটি সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হইয়া গেল। শহরের আসিবার কিছুদিন পরে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে, কোনদিন আমি পাড়ার কারও বাসায় প্রবেশ করিব না। তখন থেকে আমি পাড়ার কারও ঘরে প্রবেশ করিতাম না। এই কথা পাড়ার সবাই জানিত। কান্তা দিদিও জানিতেন। তারপরেও কান্তা দিদি আমাকে উনাদের ঘরে প্রবেশ করিবার জন্য বারবার অনুরোধ করিল। কিন্তু আর যা-ই হোক, সেদিন আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

অসদৃশ কারণবশত আমি পাড়ার কারও ঘরে প্রবেশ করিতাম না। প্রথমতঃ আমি তখন মনে করিতাম যে, অন্যের ঘরে প্রবেশ করিলে অন্যের সাথে সখ্যতা সহজে হইয়া যায়। অবুঝ এই পরান যে শুধু একজনের সাথেই সখ্যতা করিতে চায়। তাই এতে যেন কোনো বাধা আসুক সেটা মোর কাম্য ছিল না। তাছাড়া পাড়াতে অন্য মেয়েদের অভাব ছিল না। যদিও তাহাদের পানে কভু চেয়েও দেখিনি। তাহাদের কভু চোখে পড়িলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাইতাম না। তাহারা কথা বলিতে চাইলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু আমি যে একজন মানুষ—তাই ভুল যাতে না হইতে পারে সে জন্য আমি যেকোনো কিছু করিতে প্রস্তুত ছিলাম। তৎকালীন সমাজে একটা ছেলে ও একটা মেয়ের বাহিরে বা রাস্তার দাঁড়িয়ে কথা বলা সমাজের চোখে অসহনীয় ছিল। তাই অধিকাংশ সময় ইহারা ঘরের ভিতর বসিয়া কথা বলিত। যেহেতু আমি অন্য ঘরে না প্রবেশ করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম; সেহেতু ঐ দিক থেকে আমার সে সমস্যাটি ছিল না।

দ্বিতীয়তঃ প্রচেতার যেন কভু নাহি সন্দেহ হয় যে, আমি একজন কলুষিত ছেলে। যদিও তখন প্রচেতা জানিত না যে, আমি তাহারে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসিতাম। তারপরও আমি চেয়েছিলাম যতটুকু সম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখিতে। প্রচেতা মানুষ হিসেব অতুলনীয় বা অনন্য ছিল। সবাই তাহারে একজন ভালো মেয়ে এবং শিক্ষিত মেয়ে বলিয়া জানিত। তাই আমি ঠিক করিয়াছিলাম যে, আমাকেও একজন ভালো ছেলে হইতে হইবে। যাতে আমি প্রচেতার যোগ্য হইতে পারি। কোনো কারণে যেন সে আমাকে দূরে না ঠেলিয়া দেয়—কারণ তাহা সহ্য করিবার ক্ষমতা আমার কভু হইবে না।

তৃতীয়তঃ প্রতিজ্ঞা করা আর প্রতিজ্ঞা মেনে চলা দুটি কাজ। প্রতিজ্ঞা করা সহজ—কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিয়া সেটা মেনে চলা অনেক কঠিন। আমি সেই কঠিন কাজটিই করিতে চাইয়াছিলাম। আমি জানিতাম প্রচেতাকে আমার জীবনে পাইতে হইলে আমাকে নানা ধরনের কঠিন সংগ্রাম করিতে হইবে। তাই কঠিন কিছু করার অভ্যাস এখন হইতে গড়িয়া তুলিতে হইবে। তাছাড়া যেই দিন আমি প্রচেতাকে আমার মনের কথাটি বলিব; সেই দিন যেন সে বুঝিতে পারে যে, আমি তাহাকে নিয়ে কোনো মজা করিতেছি না। আমি একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লোক এবং আমি তাহার সম্মান বজায় রাখিতে সক্ষম।

ঐদিন কান্তা দিদি আমাকে ছাড়িবেন না মনে হইতেছিল। আমি জানালা দিয়া প্রচতাকে পড়ার টেবিলে বসে থাকিতে দেখিলুম।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন