যে উপন্যাসে আমিই চরিত্র হয়ে উঠি
মাহতাব হোসেন
দুর্ভিক্ষকে আমি ভয় পাই, প্রচণ্ড! বিভূতিভূষণের ‘অশনি-সংকেত’ আমার বুকের ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষচিত্র দিয়ে।
চার বছরের এক শিশুর বর্ণনায় উঠে আসে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। লেখক সেই সময়ের স্মৃতি লিখতে গিয়ে, হয়তো নিজের কাছেও ‘অবিশ্বাস্য’ ঠেকেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ৪ বছর বয়সের অসংখ্য স্মৃতি আমারও মনে আছে। ৬ বছর বয়সে আমার দ্বোতলা বাসে চড়া, বাসের দ্বোতলার ড্রাইভারকে খোঁজা; বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেট থেকে কয়েন টেলিফোনে মেজ ভাই, চাচার বাড়ির টেলিফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছেন- এ রকম তরতাজা অজস্রতা আমাকে ঘিরে রাখে। ‘মানবজীবন’ উপন্যাসে শুরুতেই চিত্রিত হয়েছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজীবন উস্কে দিয়েছে সে দুঃসহ স্মৃতি। মানুষ খেতে পায় না, পেটে ক্ষুধা, চাল শেষ হয়ে আসে- ঘরে ভাত নেই। কঁচু, ঘেচু খেয়ে বাঁচার চেষ্টা। একমুঠো খাবারের জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রভাবশালী বাড়ির দুয়ার থেকেও যখন ফিরে জলপান করে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করে, মাইলের পর মাইল সবুজ হয়ে যায় সাদা। হবে না কেন, গাছের লতাপাতা, গুল্ম সবই তো মানুষ খেয়ে ফেলেছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য।
চুয়াত্তর পেরিয়ে গল্প পঁচাত্তরে পৌঁছে। বাঙালি জাতির বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস উঠে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়গুলো এগিয়ে যায়, সেই সাথে এগিয়ে যায় এক শিশু থেকে কিশোর হয়ে ওঠার গল্প। আমরা ইতিহাস জানি, পড়েছি। ইতিহাস পড়লে ইতিহাস জানা যায় কিন্তু যখন ইতিহাস উপন্যাসে উঠে আসে তখন তার একটি চিত্র পাওয়া যায়, যাকে বলা যেতে পারে ভিজুয়ালাইজেশন। আমরা যারা সময়টাকে দেখতে পাইনি, তাদের জন্য এটা বড় পাওয়া।
বরিশালের হিজলা উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আসিফ নামের এক শিশু, যে কি-না পড়াশোনা পারে না। আর যখন পারতে শুরু করলো; তখন প্রতিটি ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে গ্রামের একমাত্র বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র হয়ে ওঠে। তারপর? এসএসসিতে তিনটি লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়ে তাক লাগিয়ে দেয়।
আসিফ শুধু চরিত্রই নয়, একটি চলমান থার্টি ফাইভ মিলিমিটার রিল। যার বয়ানে আমরা দেখেছি, সবুজাভ আন্ধারমানিক গ্রাম, কুমির খাল পেরিয়ে হাট-বাজারে যাওয়া, নৌকায় করে খাল পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া। উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সুঁতা ছেড়ে দেওয়া। একটি জলরঙে আঁকা ছবির মতো গ্রাম। আসিফের মা, বড় ভাই, চাচা- প্রতিটি চরিত্রকে আসিফ নিয়ে এসেছে ত্রিমাত্রিক করে। স্কুলের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠা থেকে ক্লাসের লম্বা সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে প্রেমপত্র আদান-প্রদান, বিশ্বাসভঙ্গের কারণে প্রেমিকার বিদায়পর্ব অথবা সাংবাদিক হয়ে ডাকাতি হওয়া পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মেঘনায় ডুবে যাওয়া লঞ্চের উদ্ধারকর্মী- এসব আসিফ খুব সাবলীলভাবে চিত্রায়ণ ঘটিয়েছে।
এ উপন্যাসে চুয়াত্তর থেকে নব্বইয়ের রাজনৈতিক চিত্র এসেছে আসিফের সাথে সাথে। নটর ডেমের ছাত্র আসিফের বুয়েট ক্যাম্পাসে কর্মকর্তার লজিং থাকা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজের খেয়ালে ঢুকে পড়া, বড় ভাইয়ের মাধ্যমে অরুন চৌধুরীর কাছে সাংবাদিক হতে যাওয়া। ৮৮ সালের বন্যায় টিএসসিতে দেশের দুর্গত মানুষের জন্য খাবার বানানোয় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এসব আসিফের চরিত্রকে একটি মাত্রা দিয়েছে, যা ছেলেটির প্রতি হৃদয়ে বিশেষ স্থান তৈরি করে দেবে।
আসিফ চরিত্রটি একটু অন্যরকম। না, খেয়ালি না- সচেতন অথচ ঝোঁক নাটক থিয়েটার, সাংবাদিকতা কিংবা লেখালেখির প্রতি। এ ধরনের চরিত্রগুলো ধূমপায়ী। আসিফও অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে একটি গোল্ডলিফ ধরিয়েছিল, কিন্তু ও-ই শেষ। জীবনযুদ্ধে ক্রমাগত লড়ে যাওয়া সৈনিক এ অনাত্মীয় শহরে টিকে থাকে টিউশনি করে। গল্পের শেষ হয়েছে আকস্মিকভাবে, যেখানেই আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। যা-ই হোক, পরের অংশের আসিফকে কেমন পাই সেটা একটি অপেক্ষার বিষয় অবশ্য।
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভক্ত শুধু উত্তম পুরুষে অসংখ্য জনপ্রিয়, হৃদয়স্পর্শ করা উপন্যাসের জন্য। উত্তম পুরুষ হয়তো চরিত্রকে নিজের করে তোলার সুযোগ তৈরি করে দেয়। হয়তো পাঠক চরিত্রের মধ্যে নিজের সমস্ত চেতনাকে প্রোথিত করে, করতে পারে। উপন্যাসের চরিত্রটিই যেন পাঠক নিজেই হয়ে যান। আসিফ এমনই একটি চরিত্রটি, পুরো উপন্যাস পড়ার সময় মনে হবে যেন আমিই আসিফ। তবে আমার ধারণা, লেখক নিজেই সেই আসিফ। এতো গভীর অনুভূতি অধ্যয়ন থেকে আসে না, আসে নিজের হৃদয় দিয়ে নিবিড় অনুধাবনের মাধ্যমে।
উপন্যাস: মানবজীবন
লেখক: মোস্তফা কামাল
প্রকাশক: পার্ল পাবলিকেশন্স
এসইউ/জেআইএম