ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রুদ্র-প্রচেতা : পর্ব ০৬

ড. রাজুব ভৌমিক | প্রকাশিত: ০৪:৫৪ পিএম, ০৩ মার্চ ২০২০

প্রেম! সে-ই বা কী? প্রেম কি শুধুই পূর্ণ সমর্পণ? নাকি অভিলাষী হইয়া বিরহিত জীবনের কালক্ষেপণ? ইহার মানে এখনো আমি বুঝিতে পারিলাম না। কেহ কহে প্রেমে নাহি থাকে কোন ললুপতা, ঈর্ষা, বা হিংসা—আবার কেহ-বা কহে প্রেম মানে দুটি অজানা চুম্বক খণ্ডের প্রথম দেখা, তারপর কাছে আসা। প্রেমের এই সংজ্ঞাটি কেন জানি আমি মানিতে পারিলাম না। সেদিন যখন প্রচেতাকে আমি বহুকাল পরে আরেক বার দেখিলাম তখন আমি টের পেলুম যে—প্রেমের আসল অর্থ বুঝি এক লৌহ খণ্ডের সাধের চুম্বক খণ্ডের সান্নিধ্য পাইবার উচ্চাভিলাষ মাত্র। যেমন—মোর লৌহ খণ্ড হৃদয়খানি প্রচেতার হৃদয় গভীরের চুম্বকত্বের দিকে বারবার তেড়ে আসিতে চাওয়া। ছোটবেলায় লোকের মুখে বহুবার শুনিয়াছি পুরুষদের মন লৌহ খণ্ডের মতই শক্ত—কিন্তু কেহ-ই বলিতে পারিল না যে কেন পুরুষদের লৌহ খণ্ডের মত শক্ত। তাই বুঝি ইহারা সর্বদা নারীর সৌন্দর্য চুম্বকত্বের পিছনে লাগিয়া থাকে? কিন্তু আজি বুঝিলাম—পুরুষেরা তাহাদের মরিচাপূর্ণ লৌহ খণ্ড হৃদয়কে বারবার মরিচাবিহীন করিয়া সখির চুম্বক হৃদয়ে আকর্ষণ পাইবার জন্য চেষ্টা করিয়া থাকে। আমার লৌহ হৃদয়খানি মরিচায় পরিপূর্ণ, তাই আজি তাহার দর্শন মিললেও তাহাকে আমার দিকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করিতে সক্ষম হইলাম না। রিকশা থেকে নামিয়া প্রচেতা সোজা তাহার বাসায় প্রবেশ করিল। আর আমি নিরুপায় চলিলাম বাজারের সম্মুখে।

বাজার হইতে শাক-সবজি ও মৎস্যাদি ক্রয় করিবার পর আমাদের বাসার সম্মুখে ফিরিতেছিলাম। আমাদের বাসার সম্মুখ যাইতে প্রচেতাদের বাসাটি অতিক্রম করিতে হয়, তাই যতবার ঐ সড়ক দিয়া চলিতাম প্রত্যেকবার আমার বুকের মধ্যে কেমন এক অজানা ঝড় নিঃশব্দে বইয়া যাইত। যেন রঙিন রোদ্দুর দুপুরে আচমকা বজ্রপাত হওয়া—অতঃপর কোমল বৃষ্টির জলে শরীরকে শীতল করিয়া দেয়া। যাই হোক, বাসায় ফিরিয়া মাতাজিকে বাজারের ব্যাগটি ধরিয়া দিলাম—এবং সঙ্গে সঙ্গে পড়ার টেবিলে আমি পড়িবার লাগি বসিলাম। আমাকে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে পড়িবার লাগি যাইতে হইত না। কারণ সম্প্রতি আমরা গ্রাম হইতে শহরে স্থানান্তরিত হইলাম। তাই আগামী বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতিটি আমাকে এ শহরের বাসায় করিতে হইবে। আমাদের গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক প্রতিনিয়ত আমাদের শহরের বাসায় আসিয়া আমাকে এবং জ্যেষ্ঠ সহোদরা মিলিকে একসাথে পড়াইত—তাতেই কোনভাবে পড়াশুনা চলিত। এদিকে আজ কিছুক্ষণ পড়াশুনা করিয়া মধ্যাহ্নভোজন করিলাম—অতঃপর বাঙালির চিরাচরিত মধ্যাহ্নভোজন পরবর্তী ষৎ নিদ্রাতে মোর দেহখানি সমর্পণ করিলাম।

বিকেলটি ঘেঁষাঘেঁষি করিতেই পাঁচটা বাজিল। বাসার অভ্যন্তরের কোন এক অজানা কোলাহলে স্বর্গসুখের ষৎ নিদ্রাটি আমার পলায়ন করিল। দুই চোখ একটু খুলিতেই আমার চোখে-মুখে বিরক্তির বৃষ্টি ঝরিতে লাগিল—আর এভাবেই ভিজতে ভিজতে আমি বিছানাটি ছাড়িলাম। পুরো আঁখি খুলিতেই দেখিলাম পাড়ার কয়েকজন মহিলা মাতার সহিত বেশ খোশগল্প করিতেছিলেন। নিদ্রাহীন মগজটির মেজাজ এত খারাপ হইল যে, আমি কাউকে কিছু না বলিয়া বাসা হইতে হনহন করিয়া বাহির হইলাম। এরপর আমাদের পাড়ার কোণাতে চায়ের একটি দোকানে চা পান করিতে বসিলাম। নানাবিধ কারণে এই চায়ের দোকানটি আমার খুবই শখের ছিল। প্রথমত, এই চায়ের দোকানটি ছিল প্রচেতাদের বাসা হইতে প্রায় একশত ফুট দূরে—প্রচেতাদের বাসার বামদিকে। চা দোকানটির সামনে দিয়া প্রচেতা স্কুলের উদ্দেশে যাইত এবং প্রাইভেট পড়িবার লাগি যাইত—আর আমি এই চা দোকানে বসিয়া তাহার রূপ সাগরে ডুবিবার লাগি বকের মত একপায়ে দাঁড়াইয়া থাকিতাম। দ্বিতীয়ত, চা দোকানটির মালিক অনিমেষ বাবু এবং উনার পুত্র সাজুর সহিত আমাদের পরিবারের দারুণ সখ্যতা পূর্বেই ছিল। অনিমেষ বাবুকে ‘জেঠামসাই’ বলিয়া ডাকিতাম—কিন্তু উনার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক বন্ধুত্বেরই ছিল। অনিমেষ বাবু আমার জীবনের একজন অঘোষিত নায়ক—তিনি আমাকে এতই স্নেহ করিতেন যে দেখিবামাত্র তিনি আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিতেন। তিনি আমার এবং আমাদের পরিবারের জন্য কত উপকার করিয়াছেন তাহা বর্ণনা করিতে যাইলে মহাভারত তিনবার পড়া হইয়া যাইবে। তাই বিস্তারিত নাহি বা বলিলাম। বয়সে আমার পিতার বয়সী হইলেও অনিমেষ বাবুর সাথে যেকোন কথা বলিতে সংকোচ করিতাম না। অন্যদিকে, অনিমেষ বাবুর ছেলে সাজু আমার ছোটবেলার খুব ভালো বন্ধু ছিল। আমি আর সাজু মিলে কতই না দুষ্টামি করিয়াছি, বেলাহীন ক্রিকেট খেলিয়াছি এবং কত অখাদ্য খাইয়াছি। সাজু এবং অনিমেষ বাবু দু’জনই তাদের চায়ের দোকানটি মিলেমিশে চালাইত। সময় পেলে আমি তাদের দোকানে বসিয়া চা-বিস্কুট খাইতাম এবং আড্ডা দিতাম। আজ প্রদোষকালে তাই তাহাদিগের দোকানে সেই উদ্দেশে বসিলাম।

অনিমেষ বাবু এককাপ চা আনিয়া আমার সামনে রাখিল। ‘কিরে রুদ্র, বাসার সবাই ভালো তো?’ আমি মাথা নাড়ালাম এবং চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগিলাম—নয়নে তখনো নিদ্রাভাবটি যায়নি। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইল কিন্তু মস্তিষ্কে যেন কিছুই নাড়াচাড়া হচ্ছিল না—নিজেকে কেমন বুদ্ধিহীন ইস্পাতের যন্ত্র মনে হইতেছিল। অকস্মাৎ মাথা ঘুরাইতে দেখিলাম প্রচেতা চা দোকানটির সামনে দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে। তাহার একহাতে একখানা বই, আরেক হাতটি মুষ্টিবদ্ধ—আর পরনে তার সাদা রঙের থ্রি-পিস। প্রদোষকালে যখন ক্লান্ত সূর্য মামা ডুবিডুবি করিতেছে—তখন কেন জানি স্তন্যপায়ী বালকদিগের মত উৎসুক হইয়া সূর্য মামা তাহার মাথাটি উঠিয়ে প্রচেতাকে একবার দেখিবার চেষ্টা করিলেন। এদিকে মোর নয়ন দুটি বিধবার চোখের মত আকুল হইয়া তাহার পানে চাহিতে লাগিল। মনে মনে সূর্য মামার প্রতি আমার হিংসা কিছুটা বাড়িল। দেখিতে তাহার পানে অবিরত, পড়িল তাহার দৃষ্টি আমাতে সম্ভবত। যেহেতু নয়নের নিদ্রাভাবটি তখনো ঠিক কেটে যায়নি; সেহেতু নিশ্চিত হইবার লাগি আমি তাহার পানে আবারও একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলাম। তখন চায়ের দোকানটির সামনের সেই কাঠের তৈরি লম্বা আসনটিতে বসিয়া ছিলাম। আর ভাবিতেছিলাম, ‘ইস, যদি তাহার নয়ন একবার আমারে পানে চাহিত, এই ভিখারী জীবন নিশ্চিত সার্থক হইত।’ টর্চ-লাইটটি যেমন অমবস্যার নিশিতে মানুষের হাতে চলার সময় তাহার আলোটুকু মনুষ্য ছন্দে তাহার সামনাসামনি চলিয়া থাকে—ঠিক তেমনি প্রচেতা হাটিবার সময় যেন পৃথিবীর সকল সুখ তাহার সামনাসামনি চলিতে থাকে। প্রচেতা এমনভাবে হাটিতেছিল, মনে হচ্ছিল তাহার সামনে পথটি ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। একবারও সে দেখিল না ফিরে আমার—আর তাহা লক্ষ্য করিয়া সূর্য মামার মুখটি বাঁকা হইল এবং রাগে-দুঃখে তিনি অস্তমিত হইল।

মনটি বেশ খারাপ হইল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগিলাম। আর ভাবিতে লাগিলাম, কেনই বা আমার মনটা খারাপ। এইমাত্র আমি প্রচেতাকে একবার দেখিলুম—পরান আমার বরফের মত ঠান্ডা হইবার কথা। তাহলে পরানটি কেনই বা উত্তাল সাগরের মত পাহাড়সম ঢেউ তুলিতেছে। তখন আমি বুঝিলাম—সমুদ্রতীরে গর্তের ভিতরের কাঁকড়াগুলোর মত আমার প্রেমে মোহ লুকিয়ে আছে। পূর্বে প্রচেতাকে শুধু দেখিবার জন্য পরান চাহিত—এখনো তাহা চায় কিন্তু সমস্যা একটাই—নতুন বাসনা যে যুক্ত হইল। এই বাসনা কি গতানুগতিক? না কি আমার প্রেমের ভুল? এই পরান চায় মিলিতে প্রচেতার দুই নয়নে—কী আর এমন হইত, যদি তাহার নয়নে এই দুই নয়ন মিলিত?

অন্যমনস্ক হইয়া চা পান করিতে লাগছিলুম; তখন অকস্মাৎ দেখিলুম আবার মোর প্রচেতারে। এইবার হয়েছিল মোর অভাগা দুই নয়নের সহিত তাহার নয়নের মিলন। তাহার চোখে চোখ পড়িতেই যেন আমার পরানটি শীতকালে পুকুরে ঝাঁপ দেয়া শরীরের মত অবশ হইয়া গেল। নয়নমিলনে মোর দেহ হইতে আত্মাখানি বাহির হইয়া তাহার রাজ্যে প্রবেশ করিতেই আমি ধরা পড়িলাম। সে ক্ষণিকের জন্য তাহার রাজ্যে অবস্থান করিতে দিলেও সজোরে আমাকে চোখের পলকে তাহার রাজ্য হইতে বাহির করিয়া দিলো। প্রচেতার চোখের পলক পড়িল আর কেন জানি সে ইতস্তত বোধ করিল। এরপর নিঃশব্দে সে তাহাদিগের বাসার সম্মুখে চলিয়া গেল। এ মনের পাহাড়সম উত্তাল ঢেউগুলো যেন মুহূর্তেই শান্ত হইয়া যায়। এইমাত্র কী হইয়াছে তাহা এখনো সঠিকভাবে উপলব্ধি করিতে পাইলাম না। তবে এটা বুঝিতে পারিলুম যে, এবার প্রচেতা হয়ত টের পাইল আমি তাহার অন্তর রাজ্যে প্রবেশ করিতে ইচ্ছুক বা প্রবেশ করিবার চেষ্টা আমি করিতেছি। এই পরান যে তাহার রাজ্যটি জয় করিয়া তাহাকে আমার রাজ্যের রানি করিতে চায়।

অনিমেষ বাবু দোকানের ভিতর থেকে সব দেখিতে পাইল—আর কহিলেন, ‘এ কান্তার মেয়ে প্রচেতা—মেয়েটি পড়াশুনায় অনেক ভালো। কিছুক্ষণ পূর্বে দেখিলুম প্রাইভেট পড়িতে গিয়েছে। এখন আবার দেখি সে বাসায় চলিয়া যাইতেছে। হইতে পারে আজ প্রাইভেট পড়া ছিল না।’ আমি সামান্য ইতঃস্তত বোধ করিলাম—লজ্জাও খানিকটা পাইলাম। তাই আর কিছু কহিলাম না। সেদিন অনিমেষ বাবু ঠিক টের পেয়েছিলেন যে, প্রচেতাকে আমার বেশ মনে ধরেছে। আমাকে চুপ দেখিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, আমি বেশ লজ্জা পাইতেছি তাই সেইদিন তিনি আমারে আর কিছু কহিলেন না। আমিও চায়ের টাকা পরিশোধ করিয়া বাসার দিকে চলিলাম।

এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হইল। আমার সাথে অনিমেষ বাবুর ছেলে সাজুর সাথে বেশ খাতির হইল। সাজুর মনটি অনেক ভালো। সাজু বয়সে আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। উচ্চতায় আমার চেয়ে একটু কম—কিন্তু সে অনেক বুদ্ধিমান। একদিন সাজুর সাথে তাহাদিগের দোকানে বসিয়া একসাথে চায়ের কাপে চুমুক দিতেছিলাম। তখন সে হঠাৎ আমাকে কহিল, ‘রুদ্র, আমি জানি তুই প্রচেতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস। কি আমি ঠিক বলিলাম?’ সাজুর কথা শুনিয়া আমি একটু অবাক হইলাম। সে কী করিয়া তা অনুমান করিতে পারিল তা বুঝিবার চেষ্টা করিলাম। ‘আমি এতদিন সব লক্ষ্য করিতেছি বন্ধু। তুই প্রতিদিন প্রচেতার স্কুলে যাইবার সময় আর তাহার প্রাইভেটে যাইবার সময় আমাদের দোকানে চা-বিস্কুট খাইবার উছিলায় আড্ডা দিস। তাছাড়া আমি তোকে কয়েকবার দেখিয়াছি প্রচেতা যখন এখান দিয়া হাঁটিয়া যায়, তুই দুই চোখ সুপার গ্লু’র মত তাহার পানে চাহিয়া থাকিস। আমি সব জানি।’ সাজু কহিল।

সাজুর কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, প্রচেতা ও আমার প্রেমের কথা আর লুকানো সম্ভব নহে। তদতিরিক্ত পুরো শহরটিতে সাজুই একমাত্র আমার ভালো বন্ধু। সাজুর কাছে আমার জীবনের এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা লুকানো পাপের সমতুল্যই হবে। ‘বন্ধু, তুই ঠিক ধরেছিস। আমি প্রচেতাকে আমার প্রাণের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি।’ এই কথাটি বলিতে বলিতে মোর দুই চোখের জল আপনা আপনিভাবে পড়িতে লাগিল। সাজু আমাকে দেখিয়া খুব ব্যথিত হইল আর বুঝিতে পারিল সত্যিই আমি প্রচেতাকে অনেক ভালোবাসি। ‘আচ্ছা, চিন্তা করিস নে। আমি তোকে এ ব্যাপারে সাহায্য করিব।’ সাজু কহিল।

সেদিন সাজু আমাকে একটি পরামর্শ দিলো যে, ‘পাড়ায় বহু ছেলের বসবাস এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের দৃষ্টি প্রচেতার উপরে পড়া অসম্ভব নহে।’ আমার উচিত কোনো এক উপায়ে পাড়ার ছেলেদের জানিয়ে দেয়া যে, প্রচেতাকে আমি ভালোবাসি। তাহলে ভবিষ্যতে আমাকে কোন সমস্যার সম্মুখীন হইতে হবে না। এই বিষয়টি নিয়া আমি সারাটা দিন ভাবিলাম কিন্তু কোন উপায়ান্তর খুঁজিয়া পাইলাম না। সারা নিশিও প্রায় জাগিয়ে ছিলুম। কিভাবে পাড়ার সব ছেলেদের আমার আর প্রচেতার প্রেম সম্পর্কে অবহিত করানো যায়, তা-ই ভাবিতে ভাবিতে নিশি প্রায় অন্ত হইল। শুধু এটা জানিতাম যে, আমার দ্বারা এই কাজ করা অসম্ভব। তাছাড়া যদি আপন মুখে সবাইকে প্রেম-কথা বলিতে যাই। তাহলে পাড়ার ছেলেরা কতটুকু বিশ্বাস করিবে, তাহা সঠিক বলা মুশকিল। খুব ভোরে বিছানা কাত হইয়া আমি এসব নিয়া ভাবিতেছি। তখন মাথায় একটি বুদ্ধি উৎপন্ন হইল। মনে পড়িয়া যায় পাড়ার এক ছেলের কথা। তাহার নামও রুদ্র। তখন আমাদের পাড়ায় মোট পাঁচ জন রুদ্র বসবাস করিত। মজার ব্যাপার হইল, আমরা সব রুদ্রই প্রায় সমবয়সী ছিলাম এবং সবাই একসাথে শহরের রাস্তার মধ্যখানে নিয়মিত ক্রিকেট খেলিতাম। আমরা সব রুদ্র ছিলাম খেলার সাথী। যেহেতু আমাদের পাড়ায় ছিল অনেক রুদ্রের বসবাস, তাই সঙ্গত কারণে আমাদের সবারই পাড়ায় একটি করে ডাকনাম ছিল। এই রুদ্রের ডাকনাম ছিল বৈরাগী। বৈরাগীর পেটে কোন কথা জমিয়া থাকিত না—তাহা সবাই জানিত। তাই তাহাকে আমার প্রেমের বিষয়টি বলা উপযুক্ত ছিল। তাহাকে বলিলে পুরো পাড়ার ছেলেরা বিদ্যুৎ গতিতে জানিবে। তাহাকে যদি আমি বলিতাম, তাহলে সে হাসিয়া আমার কথাটি উড়াইয়া দিত। তাই ভাবিলাম এই কাজ সাজুর মাধ্যমেই শুধু সম্ভব।

সকাল বেলা তাই আমি সরাসরি সাজুদের দোকানে চলিয়া যাই। সাজু কখনো সখনো রাত্রিবেলায় তাহাদিগের দোকানের ভিতরে ঘুমাইত—গ্রামের বাড়িতে যাইত না। তাই আজ সে অনেক ভোরেই দোকানটি খুলিল। আমাকে খুব সকালে তাদের চায়ের দোকানে দেখিয়া সাজু কহিল, ‘কিরে তোর বুঝি রাতে ঘুম হয়নি?’ সাজু আমাকে দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। আমি সাজুকে কহিলাম, ‘একটা কাজ কর বন্ধু, তুই বৈরাগীকে আমার আর প্রচেতার প্রেম সম্পর্কে বল। তাহলে সে নিজেই সবাইকে বলে দিবে।’ সাজু আমার কথায় সাথে সাথে রাজী হইয়া গেল। ‘ঠিক আছে, বৈরাগী যখন আমাদের দোকানে আসিবে তখন আমি কৌশলে সব বলিয়া দিব।’ সাজু কহিল। সাজুর কথা শুনিয়া একটু স্বস্তি পাইলাম। এরপর দোকানে সকালের নাস্তা শেষ করিয়া বাসায় চলিয়া গেলাম।

এভাবে কয়েকদিন চলিয়া যায়। একদিন শুক্রবার দুপুরে আমরা বেশ কয়েকজনসহ রাস্তার উপরে ক্রিকেট খেলিতেছিলাম। সে জায়গাটি প্রচেতাদের বাসা হইতে বড়জোর পঞ্চাশ ফুট ডানদিকে—তার বেশি হইবে না।

ছোটবেলা থেকেই আমি সবসময় কোন খেলাধুলা বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করিলে প্রাণপণ জিততে চেষ্টা করিতাম। কোনদিন যদি খেলাধুলায় না জিতিতাম, তাহলে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হইয়া যাইত। ‘আমাকে জিততে হইবে।’ এই মানসিকতা সবসময় আমার ছিল। কিন্তু ঐদিন কেন জানি ব্যাটে আর বলে মিলছে না। বারবার শুধু খেলায় হারিতেছিলাম। কিছুতেই আমার মেজাজ শান্ত করিতে পারিতেছিলাম না। খেলাধুলা করিলেও প্রতিদিন প্রচেতাকে একবার দেখিবার জন্য মোর দৃষ্টি সবসময় তাহাদিগের বাসার দরজায়ই থাকিত। নানা ছল-চাতুরী করে ব্যাটিংয়ের স্থানটি এমন জায়গায় নির্ধারণ করিতাম যাতে প্রচেতাদের দরজাটি দূর হইতে দেখা যাইত। তখন আমি উইকেটের পিছনে কিপিং করিতেছিলাম—আর দেখিলাম প্রচেতা তাহাদিগের ঘরের দরজাটি খুলিল। প্রচেতাকে দেখিয়া আমার খেলায় পরাজয়ের বেদনাটি বর্ষাকালের ব্যাঙের মত লাফিয়ে চলিয়া গেল। আর আমি অবলা এক কার্পু মাছের মত হা করিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম। প্রচেতা আমার দিকে হাঁটিয়া আসিতেছে। নিজের দুই চোখকে একদম বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলাম না। ভাবিলাম—আসলে কি সব সত্যি দেখিতেছি। প্রচেতা যত বেশি আমার দিকে আসিতেছে এ পরানে তত জোরে ঝড় উঠিতেছিল। নিজেকে এক তেজস্বী সূর্যের সামনে ছোট্ট একটি মোমের টুকরা মনে হইল। সেদিন আমি বুঝিতে পারিলাম, প্রচেতার সহিত আমার প্রেম কখনো বাস্তবে পরিণত হবার নয়। এই প্রেম স্বপ্নের—আর যেই প্রেম স্বপ্নের তাহার বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব? একটি ছোট্ট মোমের সাথে সূর্যের প্রেম কভু হইতে পারে না। যাহারে দেখিবার মাত্রই এই পরান গলিয়া মাটিতে মিশিয়া যায়—তাহার সাথে কথা বলিবার ক্ষমতা তো দূরের কথা, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্বটুকু খুঁজিয়া পাইলাম না। বুঝিলাম—আমার সাথে তাহার সম্পর্কের দূরত্ব অনেক বেশি। দেবতার সাথে মানুষের দূরত্বের চেয়েও বেশি। মানুষ দেবতারে পাইবার লাগি কত কিছু করিয়া থাকে—পুষ্প দিয়া পূজা দেয়, দেবতার সাথে প্রাণখুলে কথা কয় এবং মাঝে মাঝে দেবতাকে ধরিয়া দেখে। সেদিন প্রচেতাকে খুব কাছ থেকে দেখিয়া মনে হইল, একটি মোমের টুকরা কখনো সূর্যকে পুষ্প দিতে পারিবে না, প্রাণখুলে কোনদিন মনের কথা কইতে পারিবে না, আর ধরিয়া দেখা তো কল্পনাতীত। একটি মোমের বাতি যেমন দিনে সূর্যের তাপে গলিয়া শুধু ভিতরের সুতোটি অবশিষ্ট থাকে—তেমনি প্রচেতা যখন কাছে আসিল আমার সারা শরীর গলিয়া মোর দুচোখ অবশিষ্ট ছিল।

প্রচেতা আমার পাশ কাটিয়া চলিয়া গেল—আমার দিকে একবারও তাকাইল না। আর তাতেই আমার এই অবস্থা! প্রচেতা পাড়ার এক বাসায় রানির মত প্রবেশ করিল। এদিকে আমার গলিত অবস্থা সব খেলার সাথী দেখিতে পেল। সবাই হো হো করিয়া হেসে দিল আর বলিল, ‘জানি আমরা সবই জানি।’

চলবে...

এসইউ/পিআর

আরও পড়ুন