সুনীলের জন্মভিটায় এ কোন আলো
এপার বাংলা-ওপার বাংলার জনপ্রিয় কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন ৭ সেপ্টেম্বর। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশে, বিখ্যাত হয়েছেন কলকাতায়। তবুও কবি দুই বাংলাকেই এক করে দেখেছেন- এক বাংলা হিসেবে কামনাও করেছেন আমৃত্যু। সুনীলকে নিয়ে কলকাতার যতটা গর্ব, আমাদেরও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরাও দাবি নিয়ে বলতে পারি, সুনীল আমাদের। আমরা তাকে ভালোবেসেছি, তিনি আমাদেরও মনের মানুষ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের আগেই কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতের কলকাতায়। সেখানেই থিতু হয়েছিলেন মৃত্যু অবধি। কামিয়েছেন সুনাম ও খ্যাতি। কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধে মাতিয়েছেন দুই বাংলা।
দেশান্তরী হওয়ার অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। যখন সুনীলের সুখ্যাতি দিকে দিকে। মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক ডা. এমএ বারী নিজ উদ্যোগে খুঁজে বের করেন তার জন্মস্থান। সুনীলের পৈতৃক ভিটাও তখন মানুষের দখলে। ডা. বারীর চেষ্টা আর প্রবাসী লেখক আ. রাজ্জাক হাওলাদারের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় কবির জন্মভিটা। তারা উদ্যোগ নেন তাকে জন্মভিটায় নিয়ে আসতে। কলকাতায় যোগাযোগের পর তিনি নিজের জন্মস্থানে আসতে সম্মতি দেন। তার পদধূলিতে ধন্য হয় মাদারীপুরের মাটি।
৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর তিনি এসেছিলেন নিজগ্রামে। তার জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কবি সে আয়োজনে সীমাহীন খুশিও হয়েছিলেন। তখন তিন দিনব্যাপী ‘সুনীল মেলা’ বসেছিল। চারদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ছিল। কবিভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল সেই গ্রাম। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি।
তখন তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশের কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন। কবি তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, ‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’
২০০৮ সালের পর ২০১২ সালে তার জন্মদিবসে সুনীল মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেননি। এরপর সে বছর ২৩ অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তিনি আর আসবেন না মাদারীপুরের কালকিনি তথা বাংলাদেশে। তার স্মৃতিগুলোই শুধু রয়ে গেছে। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ৮৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৮ সালে ‘সুনীল মেলা’র আয়োজন করে কালকিনি উপজেলা প্রশাসন। তারই ধারাবাহিকতায় এবছরও আয়োজন করা হয় সুনীল মেলার।
৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনীল মেলার উদ্বোধন করেন মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ। কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মাহাবুব হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হান্নান মিয়া, উপজেলা চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম, প্রকাশক ও সংবাদ উপস্থাপক নেসার উদ্দীন আইয়ূব এবং তরুণ লেখক সাদাত হোসাইন প্রমুখ।
এবারের সুনীল মেলায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রকাশনীর অংশগ্রহণ ছাড়াও কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, পাহাড়ি নৃত্য, লালন গীতি, পল্লী গীতি, একক ও দলীয় নৃত্য, স্থানীয় আবৃত্তি সংগঠনের পরিবেশনা ও মনোহরি মেলাসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
আশার কথা হচ্ছে- ২০১৯ সালে আবার জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে তার জন্মবার্ষিকী। কিন্তু কথা হচ্ছে- তার জন্মভিটার স্মৃতি সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে? যতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার জীবদ্দশায়, তারও কি বাস্তবায়ন হয়েছে?
বলা যায়, এখনো তার স্মৃতির উদ্দেশে দাবিকৃত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হয়নি! তার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠিত সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার করা হয়নি! সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা তার স্মরণসভায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।
মাদারীপুরে প্রবর্তিত একমাত্র সুনীল সাহিত্য পুরস্কারও গত কয়েক বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শাজাহান খান একা হাতে আগলে রাখতে পারেননি। পৃষ্ঠপোষক হেমায়েত হোসেন হাওলাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই।
সবশেষ ২০১১ সালে পুরস্কার বিতরণ করে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্ট। তারপর লেখকদের কাছ থেকে লেখাও জমা নিয়েছে। কিন্তু আজও আলোর মুখ দেখেনি ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার-২০১২’ ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা। এমনকি গত কয়েক বছরে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেও কোন আয়োজন লক্ষ্য করা যায়নি।
সুনীল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের আশীর্বাদ বাক্যে কবি লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই, চিরদিন, চিরকাল।’ তিনি তো আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি তাকে। তাহলে কী নাজিম হিকমতের মতোই বলতে হবে, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’
এবারের সুনীল মেলা আরেকটু গোছানো হতে পারতো। কবি-লেখকদের মিলন মেলা হতে পারতো। আয়োজকরা চাইলে সুনীল মেলাকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত করতে পারতেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কবি-সাহিত্যকগণ উপস্থিত হতে পারতেন। সুনীল মেলাকে ঘিরে বড় ধরনের বইমেলা হতে পারতো। স্থানীয় অনেক প্রথিতযশা কবি-লেখকরা অংশ নিতে পারতেন।
তবুও আশার কথা হচ্ছে- আবার ‘সুনীল মেলা’ আলোর মুখ দেখেছে। এই বা কম কীসের? এ আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। বছর বছর আরও প্রসারিত হোক মেলা। কালকিনির গণ্ডি পেরিয়ে মেলা পৌঁছে যাক বাংলাদেশের প্রতিটি সাহিত্যপ্রেমী মানুষের অন্তরে। উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিনীত নিবেদন- সুনীল মেলা হোক কবি-সাহিত্যিকদের মিলন মেলা। সে ব্যবস্থা নিতে ভবিষ্যতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
এসইউ/এমএস