টেম্পু পাশা : নাইট শিফট- পর্ব ০৭
আজ রবিবার। পাশা সাধারণত রবিবারে কোন কাজ করে না। সে তার ক্যাবও চালায় না। মাংসের ডেলিভারিও দেয় না। প্রতি রবিরাব সকালে পাশা ঘুম থেকে প্রায় সকাল এগারোটা বাজে ওঠে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো পাশা তেমন ঘুমাতে পারে না। তাই প্রতি রবিবারে পাশা প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টার মত ঘুমায়। আজও পাশা প্রায় এগারোটা বাজে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে উঠে পাশা দাঁত মেজে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। তিন্নী পাশাকে সকালের নাস্তা করে দেয়। পাশা নাস্তা খেতে খেতে তিন্নীকে বলল, ‘আজকে বাজার করতে হবে তিন্নী? গত সপ্তাহে তো কোন বাজার করিনি।’
‘হুম, লাগবে। ফ্রিজ একেবারে খালি হয়ে আছে। সবজি, মাছ, ডিম সবই লাগবে। আবার তোমার মাংসও শেষ।’ তিন্নী বলল।
মাংসের কথা শুনে পাশার দু’চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে। পাশা বলল, ‘ঠিক আছে তিন্নী, তুমি বাজারের সব লিস্ট কর আর আমি নাস্তা খাওয়া শেষ হলে বাজার করতে যাব।’ পাশার নাস্তা খাওয়া শেষ হওয়ার পর হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। তিন্নী বাজার করার জন্য পাশাকে একটি লিস্ট দেয়। ‘এই নাও, সবকিছু মনে করে আনবে। আর শোন, সন্ধ্যায় আমার বান্ধবীর বাসায় নিমন্ত্রণ আছে। তোমাকেও যেতে বলেছে।’
‘ঠিক আছে।’ বলে পাশা তিন্নীর হাত থেকে বাজারের লিস্টটি নিয়ে গাড়িতে চড়ে বাজার করতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর পাশা জ্যাকসন হাইটসের একটি বাংলা গ্রোসারি দোকানে প্রবেশ করে। গ্রোসারি দোকান থেকে পাশা একে একে তিন্নীর লিস্টের সব আইটেম শপিং কার্টে তুলে নেয়। এবার পাশা মাংস কেনার জন্য গ্রোসারির মাংসের বিভাগে আসে। গ্রোসারির মাংসের বিভাগের সামনে এসে পাশা থামে। সাধারণত পাশা তার প্রিয় হাঁসের মাংস এই গ্রোসারি থেকে কেনে। কিন্তু গত সপ্তাহে এরিকার মাংস খেয়ে তার আর এখন হাঁসের মাংস কিনতে ইচ্ছে করছে না। পাশা একবার ভাবে সে হাঁসের মাংস নেবে না। মাংস কিনে কী লাভ? তিন্নী তো কোন মাংসই খায় না। সবসময় পাশা তার নিজের জন্য মাংস কেনে। গত সপ্তাহে এরিকার মাংস খাওয়ার পর এখন পাশার অন্য কোন মাংসের প্রতি লোভ নেই। এখন পাশা তার প্রিয় হাঁসের মাংস ছুঁতেও মন চাচ্ছে না। কিন্তু পরে পাশা ভাবল, তার প্রিয় হাঁসের মাংস না কিনলে তিন্নী সন্দেহ করতে পারে। কারণ তিন্নী জানে হাঁসের মাংস পাশার অনেক প্রিয়। তাই পাশা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাঁসের মাংস কিনে নেয়। তিন্নীর লিস্টের সব আইটেম নেওয়া শেষ হলে পাশা দোকানের ক্যাশিয়ারকে বাজারের দাম দিয়ে বাড়ি চলে যায়।
পাশা তার বাড়ির লিভিং রুমের সোফাতে বসে কিছু একটা ভাবছে। ‘সোফার উপর বসে বসে তুমি কী ভাবছো? আমাকে রান্নাতে একটু হেল্প করো না।’ তিন্নী পাশাকে মজা করে বলল। ‘না কিছু ভাবছি না। শরীরটা কেমন ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তাই বসে আছি।’ পাশা বলল। আসলেই পাশার শরীর অনেক ক্লান্ত। প্রতি সপ্তাহে পাশাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। একসাথে দুটি কাজ করা সহজ কথা না। উপরন্তু গত সপ্তাহে এরিকাকে নিয়ে পাশার উপর অনেক বিপদ গেছে। পাশা কয়েকবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যেতে পারত। পাশা ভাবছে এতক্ষণে হয়তো এরিকার আত্মীয়-স্বজনরা পুলিশকে ফোন করে এরিকার নিখোঁজ রিপোর্ট করে ফেলেছে। পাশা গত সপ্তাহে এরিকাকে নিয়ে পুরো ঘটনাটি মাথার মধ্যে পুনর্প্রদর্শন করছে। কিন্তু যতবার পাশা পুরো ঘটনা চিন্তা করে; ততবার পাশা নিজেকে ‘বোকা’ বলে মনে মনে গালি দেয়। ‘এরিকার বডিটি ঠিকমত ধ্বংস করা ছাড়া আমি কোনকিছু সঠিকভাবে চিন্তা করে করিনি। পুলিশ যদি এরিকার নিখোঁজ রিপোর্ট নিয়ে ভালো করে তদন্ত করে, তাহলে আমার বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।’ পাশা ভাবল। পাশা তার মনকে বোঝায় যে, ভবিষ্যতে তাকে অনেক সাবধানে অপহরণ করতে হবে। এভাবে অপহরণ করা যাবে না।
কিন্তু এখন সে কী করবে? পুলিশ যদি তার বাড়িতে এসে পাশাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়? পাশা ভাবতে থাকে কিন্তু সে এর কোন উপায় পাচ্ছে না। ‘পুলিশ এরিকার লাশ খুঁজে পাবে না। সেদিক দিয়ে বেঁচে গেছি। কিন্তু এরিকার মাথায় আঘাত করার পর রাস্তার পাশে মাটির উপরে অনেক রক্ত পড়েছে। যদিও পানি দিয়ে মাটিতে পড়া বেশিরভাগ রক্ত পরিষ্কার করেছি কিন্তু তখন রাত্রির শেষভাগ ছিল। বাহিরে কিছুটা অন্ধকারও ছিল। ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারছি কি-না কে জানে? তাছাড়া এরিকার ফোন কিছু দূরে গাড়ি থামিয়ে ভেঙে ফেলে দিয়েছি। পুলিশ যদি ইচ্ছে করে তাহলে এরিকার ফোনের শেষ অবস্থান জেনে ওই এলাকায় খোঁজ করতে পারে। আর খোঁজ করলে তো ওখানে এরিকার প্রচুর রক্তের নমুনা পেয়ে যাবে। সেখানে আমার কাপড়ের কিছু টুকরাও পড়ে থাকতে পারে। আর সে সূত্র ধরে পুলিশ সহজেই আমাকে ধরে ফেলতে পারবে।’ পাশা ভাবল। পাশা মনে মনে অনেক আফসোস করা শুরু করে। আর ভয়ে কাঁপতে লাগল। কিন্তু এরিকার সাথে তার একান্ত সময়ের কথা মনে পড়লে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।
পাশার মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি আসে যে, তাকে এ মুহূর্তে নিউইয়র্কের বাহিরে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে কোথায় যেতে পারে? পাশা ভাবতে শুরু করে। তখনি পাশার মনে পড়ে যে, ভার্জিনিয়ায় তিন্নীর এক কাকাতো বোন সোমা তার স্বামী নিয়ে থাকে। পাশা সেখানে যাবে বলে স্থির করে। পাশা ভাবছে সোমার বাড়ি থেকে সে নিউইয়র্কের সব খবর রাখতে পারবে। এরিকার নিখোঁজ নিয়ে কোন সংবাদ থাকলে সে তা বুঝেশুনে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। ‘তিন্নী, অনেকদিন হয়ে গেল আমরা কোথাও একটু যাই না। চলো, সোমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন হয়ে গেল আমরা ভার্জিনিয়ায় গেলাম না।’ পাশা বলল।
‘সোমার বাড়ি আমার একদম পছন্দ না। কী রকম এক ভুতুড়ে এলাকায় তাদের বাড়ি। তবে তুমি যদি আমাকে ওদের বাড়ি থেকে হোয়াইট হাউস দেখাতে নিয়ে যাও তাহলে যেতে পারি। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা যে, একদিন হোয়াইট হাউস দেখতে যাব। নিয়ে যাবে আমাকে?’ তিন্নী বলল। সোমাদের ভার্জিনিয়ার বাড়ি থেকে হোয়াইট হাউস বেশি দূরে নয়। গাড়িতে চড়ে বড়জোর এক ঘণ্টার পথ। আর পাশাও কোনদিন হোয়াইট হাউস দেখেনি। তাই পাশা সাথে সাথে তিন্নীর কথায় রাজী হয়ে যায়। ‘হুম, অবশ্যই যাবো হোয়াইট হাউস দেখতে। আমিও কোনদিন হোয়াইট হাউস দেখিনি। তোমার সাথে সাথে আমার ইচ্ছাটিও পূরণ হয়ে যাবে।’ পাশা বলল।
পাশা দুপুরের খাওয়া শেষ করে আবার সোফাতে বসে পড়ে। আজ তার মনটা একদম ভালো না। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নেমে এলো। পাশা সোফার উপরে ঘুমিয়ে পড়েছে। তিন্নী পাশাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। ‘এই ওঠো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমার বান্ধবীর বাসায় যেতে হবে।’ তিন্নী বলল। পাশা একটু বিরক্ত বোধ করে সোফা থেকে উঠে যায়। হাত-মুখ ধুয়ে তিন্নীর বান্ধবী মনিকার বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়। তিন্নী রেডি হওয়ার পর দু’জনে একসাথে মনিকাদের বাড়িতে যায়। মনিকাদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে চড়ে যেতে দশ মিনিটের মত সময় লাগে।
আজ মনিকার মেয়ের চতুর্থ জন্মদিন। তাই মনিকার বাসায় বহু লোকের সমাগম। পাশা মনিকার বাসায় লোকসংখ্যা দেখে বিরক্ত বোধ করছে। পাশা বহু মানুষের সমাগম একেবারে পছন্দ করে না। তারপরও মাঝে মাঝে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের নানা অনুষ্ঠানে বাধ্য হয়ে যায়। পাশা মনিকাদের বাসায় লিভিং রুমের সোফায় এক কোণে বসে আছে। বসে বসে উদ্বিগ্ন মনে টেলিভিশন দেখছে। এরিকার নিখোঁজ নিয়ে কোন খবর আছে কি-না দেখছে। ‘কি ভাই, পছন্দের চ্যানেল খুঁজে পাচ্ছেন না?’ এক ভদ্রলোক বলল। ‘না ভাই, একটা চ্যানেলেও ভালো কিছু দেখাচ্ছে না। আগে আমরা এক চ্যানেল দিয়ে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু এখন এতগুলো চ্যানেল দিয়েও সময় যেন কাটে না।’ পাশা বলল।
ভদ্রলোকের সাথে পাশা অনেকক্ষণ কথা বলল। কথা বলে পাশা জানতে পারে, ভদ্রলোকটির নাম সমর বাবু। সমর বাবু পেশায় একজন গোয়েন্দা। তিনি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ডিটেক্টিভ হিসেবে গত পনেরো বছর কর্মরত আছেন। প্রথমে সমর বাবুর সাথে পরিচয় হয়ে পাশা খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু সমর বাবু প্রচণ্ড এক মজার মানুষ। কথায় কথায় তিনি কৌতুক বলতে পছন্দ করেন। মানুষকে হাসাতে তিনি খুব পছন্দ করেন। পাশা ভাবছে সমর বাবু থেকে যদি পুলিশের নিখোঁজ তদন্তের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানা যায় তাহলে খুব ভালো হতো। তাই সুযোগ বুঝে পাশা বলল, ‘আপনার কাছ থেকে একটি পুলিশি পরামর্শ দরকার।’ ‘ঠিক আছে। জিজ্ঞেস করতে পারেন।’ সমর বাবু বলল। পাশা তখন বলে, ‘সমর বাবু আমার এক প্রতিবেশীর মেয়েকে অনেকদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য আমার প্রতিবেশীর কী করা উচিত?’ সমর বাবু বলে, ‘সত্যি কথা বলতে এ দেশে আঠারো বছর হলে ছেলে-মেয়ে বাড়িতে মা-বাবার কাছে কিছু না বলে অন্যত্র চলে যায়। এ ঘটনা প্রায়ই হয়ে থাকে। অনেক মা-বাবা এসে পুলিশি রিপোর্ট করে কিন্তু পুলিশের আসলে করার কিছুই থাকে না।’
সমর বাবুর উত্তর শুনে পাশার মনে স্বস্তির হাওয়া বইল। পাশা এ প্রশ্ন নিয়ে আর বেশি বাড়াবাড়ি করতে চায়নি। পরে যদি ডিটেক্টিভ কিছু সন্দেহ করে। তাই পাশা বলল, ‘ও আচ্ছা, আমিও সেরকম আমার প্রতিবেশিকে বলেছি।’ পাশার সাথে ডিটেক্টিভের প্রচণ্ড সখ্যতা হয়। ডিটেক্টিভ সমর বাবু পাশাকে পুলিশের একটি কার্ড দিয়ে বলে, ‘যদি আপনাকে কোনদিন পুলিশ রাস্তায় থামায়, তাহলে কার্ডটি পুলিশ অফিসারকে দেখালে আপনাকে ছেড়ে দেবে।’ পাশা মনে মনে খুশিতে আত্মহারা। সে ডিটেক্টিভ সমর বাবুকে অনেক ধন্যবাদ দেয়।
কিছুক্ষণ পর একে একে সব অতিথি মনিকাদের বাসায় এলো।
আজ মনিকার বাসায় আমেরিকান, মেক্সিকান, চীনাসহ প্রায় সব জাতের মানুষের সমাগম। মনিকা ও তার স্বামীর এত বিদেশি বন্ধু আছে সেটা পাশা জানত না। পাশা সব অতিথিকে দেখে অবাক। ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে চেয়ে আছে। রাত প্রায় নয়টা বাজে। মনিকা আর বেশি দেরী না করে সবাইকে জন্মদিনের কেক কাটার জন্য অনুরোধ করে। মনিকার মেয়ের সাথে ছোট-বড় পনেরো জন শিশু দাঁড়িয়ে আছে। আর সামনে জন্মদিনের বিশাল এক কেক। বয়স্করা সবাই একে একে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গান গাইতে লাগল। মনিকা ও তার স্বামী তার মেয়ের সাথে জন্মদিনের কেক কাটে। এরপর সবাই সজোরে হাততালি দেয়। কেক কাটা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মনিকা সবাইকে রাতের খাবার খেতে অনুরোধ করে। মনিকার স্বামী সবাইকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। পাশা ও সমর বাবু একসাথে টেবিলে খেতে বসে। তখন কেউ একজন সমর বাবুকে বলছে, ‘হানি ডু ইউ ওয়ান্ট মাই চিকেন।’ পাশা তার মাথা উপরে উঠায় এবং দেখে এক সুন্দরী লাতিন আমেরিকান। মহিলাটি সমর বাবুকে এ কথাগুলো বলছে। ‘নো ডিয়ার, আই অ্যাম ফুল নাউ।’ সমর বাবু বলল।
সমর বাবু তখন বলল, ‘সিয়ারা, তোমার সাথে আমার নতুন ফ্রেন্ডের পরিচয় করে দেই। এ হচ্ছে পাশা। অনেক ভালো মানুষ।’ সিয়ারা লাতিন হলেও সামান্য বাংলা জানে। ভাঙা ভাঙা সুরে সিয়ারা পাশাকে বলল, ‘ও আচ্ছা, আপনি ভালো আছেন?’ পাশা সিয়ারাকে দেখে অবাক। সিয়ারার মুখের গঠনও সেলিনার মত। সিয়ারার উচ্চতাও সেলিনার মত ৫ ফুট ২-৪ ইঞ্চি হবে। ওজন প্রায় ৫০ কেজির মত। মাথার চুলগুলো অনেক কালো। ফর্সা তার গায়ের রং। পাশা মনে মনে সিয়ারাকে নিয়ে কত কী ভাবছে। কিন্তু সিয়ারা একজন ডিটেক্টিভের স্ত্রী! এ কখনো সম্ভব নয়। ‘সরি, আপনি কেমন আছেন।’ সিয়ারা আবার ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল। ‘ও, সরি। আমি ভালো। আপনি ভালো তো?’ পাশা ইতস্ততবোধ করে সিয়ারাকে বলল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সিয়ারা চলে যায়। সমর বাবুর সাথে পাশা এক টেবিলে এখনো খাচ্ছে। সমর বাবু মাঝে মাঝে মজার মজার কৌতুক বলে যাচ্ছে। কিন্তু পাশার কানে সিয়ারার কথাগুলো এখনো ভাসছে। বারবার সিয়ারার মুখটি পাশার চোখে ভাসছে। হঠাৎ পাশার হৃদয়ে যেন এক বিশাল ঝড় বইছে। সিয়ারাকে পাবার জন্য পাশার মন এখন অনেক ব্যাকুল হয়ে গেছে।
‘কি হলো পাশা ভাই। সব ঠিক আছে তো?’ ডিটেক্টিভ সমর বাবু বলল। ‘হ ভাইজান। পেটটা হঠাৎ কেমন জানি করছে।’ পাশা সমর বাবুকে একটা অজুহাত দিয়ে খাওয়া শেষ করে। পাশা হাত-মুখ ধুয়ে আবার সোফায় বসে পড়ে। সে তিন্নীর খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তিন্নীর খাওয়া শেষ হলেই পাশা তাদের বাড়ি ফিরে যাবে। কাল সকালে আবার ভার্জিনিয়ায় তিন্নীর কাকাতো বোন সোমার বাড়িতে যেতে হবে। একদিকে পাশা এরিকাকে নিয়ে পুলিশি ভয়ে অস্থির। তাই পাশা হঠাৎ করে আজ সিদ্ধান্ত নেয় কিছুদিনের জন্য সোমাদের বাড়ি গিয়ে গা ঢাকা দিতে হবে। অন্যদিকে, পাশা নিউইয়র্ক সিটি পুলিশের ডিটেক্টিভ সমর বাবুর স্ত্রী সিয়ারাকে খুন করার জন্য ভাবছে। পাশা বড় একটি সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। সোফায় বসে পাশা দূর থেকে সিয়ারাকে দেখছে। সিয়ারা অন্য মহিলাদের সাথে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। এরমধ্যে তিন্নীর খাওয়া শেষ হয়। পাশার কাছে এসে তিন্নী বলল, ‘এই সবার সাথে আমার একটা ছবি তুলে দাও না।’ পাশা বলল, ‘ঠিক আছে। তুলে দিচ্ছি। তুমি ওদের সাথে দাঁড়াও।’
তিন্নী মহিলাদের এক গ্রুপের সাথে ছবি তুলতে দাঁড়ায়। ওই গ্রুপে সিয়ারাও আছে। পাশা তার মুঠোফোনের ক্যামেরা অন করে সবার ছবি তোলার আগে সিয়ারার একটি ছবি তুলবে ভাবছে। ছবি তুলতে গিয়ে পাশা সিয়ারাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। যেভাবে পাশা এরিকার বুকের উপর তার ধারালো ছুরি দিয়ে সাজোরে এক আঘাত করে। তারপর চারিদিকে রক্তের ছড়াছড়ি পাশাকে রোমাঞ্চিত করে। সে ধারালো ছুরি দিয়ে এরিকার বুকের গভীর গর্ত করার প্রাণবন্ত অনুভূতি। পাশার দুই হাত দিয়ে এরিকার বুকের ভেতর থেকে একে একে কলিজা, ফুসফুস এবং লিভার বের করে আনার উল্লসিত অভিজ্ঞতা। আস্তে আস্তে এরিকার দুই চোখ বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া দেখা। সে এক বলদায়ক অনুভূতি। সেভাবে সিয়ারাকে খুন করার স্বপ্ন পাশার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘কী হলো? তোমার ছবি তোলা শেষ হলো?’ তিন্নী বলল। পাশার দাঁড়িয়ে দেখা স্বপ্ন অবশেষে তিন্নীর কথায় ভাঙে। তাড়াতাড়ি সে সিয়ারার একটি ছবি তার মুঠোফোনে তুলল আর তিন্নীকে নিয়ে সবার সাথে একটি ছবি তুলে নিল। ‘এই তো শেষ।’ পাশা বলল।
ছবি তোলা শেষে তিন্নী মনিকা আর তার স্বামীর কাছ থেকে বিদায় নেয়। পাশাও সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। এরপর পাশা তিন্নীকে নিয়ে তাদের বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে এসে তিন্নী সাথে সাথে ঘুমিয়ে যায়। পাশাও তিন্নীর সাথে ঘুমাতে যায়। কিন্তু পাশার একদম ঘুম আসছে না। পাশার শুধু সিয়ারার কথা মনে পড়ছে। আবার মাঝে মাঝে এরিকার কথা মনে পড়ে পুলিশি ভয়ও পাচ্ছে। এরিকাকে খুন করতে গিয়ে পাশা অনেক ভুল করে ফেলছে। এই ভুল থেকে কেবল একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই পাশাকে বাঁচাতে পারে। একসময় ভাবতে ভাবতে পাশা ঘুমিয়ে পড়ে। ‘এই ওঠো। সকাল নয়টা বাজে। সোমাদের বাড়িতে যাবে না।’ তিন্নী বলল। আজকে ভার্জিনিয়ায় তিন্নীর কাকাতো বোন সোমার বাড়িতে যেতে হবে। ‘হুম। উঠছি।’ পাশা বলল। পাশা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। তিন্নীর তৈরি করা নাস্তা খেয়ে দুজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। নিউইয়র্ক থেকে ভার্জিনিয়ায় গাড়িতে যেতে প্রায় চার ঘণ্টার পথ।
সকাল প্রায় দশটা বাজে। পাশা ও তিন্নী সোমাদের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। পাশা গাড়ি চালাচ্ছে। তিন্নী বসে বসে রবীন্দ্রসংগীত শুনছে। পাশার মন ভালো নেই। তার মনে এরিকাকে নিয়ে ভীষণ ভয় বিরাজ করছে। পাশা ভাবছে, ‘এ রকম মস্ত বড় ভুল পুনরায় করা যাবে না।’ কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? পাশা বারবার চিন্তা করতে লাগল। পরে পাশার গতরাতে সমর বাবুর কথা মনে পড়ে। সমর বাবু বলেছে, সে অপরাধবিদ্যা জন জে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস থেকে শিখেছে। সমর বাবু আরও বলেছে, জন জে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস বিশ্ববিদ্যালয়টি পৃথিবীর সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথিবীর বড় বড় গোয়েন্দা ও অপরাধবিদগণ অপরাধ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছে। পাশাও মনে মনে ঠিক করে, সে জন জে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিস থেকে পড়াশোনা করবে। এখানে পড়াশোনা করতে পারলে ভবিষ্যতে সে খুন করতে দক্ষ হবে। পুলিশের তদন্তের সব প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জানা যাবে। তাকে আর এ বিপদের মধ্যে পড়তে হবে না। কিন্তু জন জে-তে ভর্তি হওয়া কিভাবে সম্ভব? পাশা যে বাংলাদেশে উচ্চবিদ্যালয়ও শেষ করেনি। পাশা তখন ভাবল, সে তিন্নীকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য জিজ্ঞাসা করবে। কারণ তিন্নী নিউইয়র্কে পড়াশোনা করেছে। তার এ ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞতা আছে।
‘তিন্নী? বহু বছর তো এখানে ক্যাব চালাচ্ছি। আর ক্যাব চালাতে ইচ্ছে করে না। পড়াশোনা করে কিছু একটা করতে চাই। তুমি কী বলো?’ পাশা তিন্নীকে বলল। ‘হুম, আমি তোমাকে পড়াশোনার কথা বলবো বলে কয়েকদিন ধরে ভাবছি। তোমার অনেক মেধা। তুমি পড়াশোনা করলে অনেক ভালো করবে।’ তিন্নী বলল। ‘কিন্তু আমি তো বাংলাদেশে কোন পড়াশোনাই করিনি।’ পাশা চিন্তার সুরে বলল। ‘সমস্যা নেই। তুমি এখানে জিইডি প্রোগ্রাম শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে পারবে। জিইডি পাস হচ্ছে হাই স্কুল পাসের মত। এখানে যারা হাই স্কুল পাস করে না এবং পরে কলেজে ভর্তি হতে চায় তাদের সবাইকে জিইডি করে পাস করে কলেজে ভর্তি হতে হয়। তুমিও জিইডি পাস করলে কলেজে ভর্তি হতে পারবে।’ তিন্নী পাশাকে বুঝিয়ে বলল। ‘জিইডি কি?’ পাশা তিন্নীকে জিজ্ঞেস করল। ‘জেনারেল এডুকেশন ডিপ্লোমা। তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে জিইডি করতে এক স্কুলে ভর্তি করে দেব। জিইডিতে সবাই ভর্তি হতে পারে। ভর্তির পর ছয় মাস ঠিকমত পড়লে তুমি পাস করে ফেলবে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া আমি তো আছি। আমিও তোমাকে হেল্প করব।’ তিন্নী বলল।
চলবে...
এসইউ/জেআইএম