ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

টেম্পু পাশা : নাইট শিফট- পর্ব ০৫

ড. রাজুব ভৌমিক | প্রকাশিত: ০৬:১৫ পিএম, ০৯ জুলাই ২০১৯

পাশা কোন কিছুতেই হার মানতে রাজী নয়। তার জীবনে বহু সংগ্রাম করেছে। কিন্তু কখনো বাধার সামনে মাথা নত করেনি। যত কষ্ট হোক না কেন, পাশা তার জীবনের সব বাধার বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ছে। আজকে এরিকাকে খুব কাছে পেয়েও তাকে হাতছাড়া করেছে। এদিকে আস্তে আস্তে ভোর হয়ে আসছে। অন্যদিকে এরিকা পাশাকে কিছুক্ষণ পর পর তাড়া দিচ্ছে। এরিকার আজ ছয়টা বাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। পাশা এখনো ট্যাক্সির ইঞ্জিনের সামনে বসে মেরামত করার ভান করছে। আর বসে বসে সে চিন্তা করছে।

কিছুক্ষণ পর এরিকা গাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়ে আসে। সে পাশার উপর প্রচণ্ড বিরক্ত। আজ পাশার জন্য তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিংয়ে যেতে দেরি হয়ে যাবে। মনে মনে সে পাশাকে অনেক গালি দেয়।
‘ইজ ইট ডান ইয়েট? হাউ লং আই হ্যাভ টু ওয়েট? আই অ্যাম গোয়িং টু গেট অ্যান অ্যানাদার ট্যাক্সি।’ এরিকা বিরক্ত হয়ে বলল।
এ কথা শুনে পাশারও মেজাজ গরম হয়ে গেল। এরিকা তাকে অন্য ট্যাক্সি নেবে বলে ধমক দিচ্ছে। হাতের পাশে গ্যাস স্টেশন থেকে নেওয়া ইটটি না পেয়ে গাড়ির টায়ার পরিবর্তন করার জ্যাকটি দিয়ে সজোরে এরিকার মাথায় আঘাত করে। সাথে সাথে এরিকা মাটিতে পড়ে যায়। পাশা চারিদিকে তাকায়। ‘কেউ দেখে ফেলেনি তো?’ পাশা ভাবল।

পাশা এরিকার হাতের পালস ধরে বুঝতে পারে এরিকা এখনো বেঁচে আছে। এরিকার মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পাশা তার গাড়ির ভেতর থেকে পুরনো একটি কাপড়ের টুকরা দিয়ে এরিকার মাথা শক্ত করে বেঁধে দেয়। এরিকার রক্তক্ষরণ কিছুটা বন্ধ হয়। পাশার মুখ, হাত ও জামার উপর এরিকার রক্ত লেগে আছে। পাশা গাড়ি থেকে আরেকটি কাপড়ের টুকরা নিয়ে তার হাত ও মুখ পরিষ্কার করে। কিন্তু পাশার জামার ওপর থেকে রক্ত কিছুতেই উঠছে না। কী করবে পাশা বুঝতে পারছে না। এদিকে এরিকা যন্ত্রণায় মাটির উপর কাতরাচ্ছে। পাশা গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে রশি নেয়। রশি দিয়ে সে এরিকার হাত-পা ও শরীর শক্ত করে বেঁধে ফেলে। পাশা এরিকাকে মাটির উপর থেকে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। কারণ এরিকার হাত-পা ও জামার ওপর রক্ত থাকায় তার পুরো শরীর পিচ্ছিল হয়ে আছে। পাশা একটি পুরনো কাপড়ের টুকরা দিয়ে এরিকার হাত-পা ভালো করে মুছে দেয়। এরপর রাস্তার দিকে তাকায়। রাস্তায় এখন আগের চেয়ে একটু বেশি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। পাশার গাড়ির ট্রাঙ্কটি খোলা। পাশা ভাবছে রাস্তায় গাড়ি না দেখা মাত্রই সে এরিকাকে ট্রাঙ্কের ভেতর রাখবে।

কিন্তু কেন জানি রাস্তায় একটির পর একটি গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। এখনো পুরোপুরি ভোর হয়নি। চারিদিকে এখনো অন্ধকার। ভোর হতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। দূর থেকে পাশা পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পাচ্ছে। পুলিশের গাড়ির সাইরেন একটু পর আরও জোরে শোনা যায়। মনে হয়, পাশার দিকে পুলিশের গাড়িটি আসছে। পাশা এরিকাকে সরিয়ে গাড়ির চাকার কাছে রাখে। যাতে রাস্তা থেকে কেউ এরিকার অবচেতন শরীর দেখতে না পায়। পুলিশের সাইরেন ক্ষণে ক্ষণে আরও জোরালো হচ্ছে। পাশা নিস্তব্ধ হয়ে এরিকার শরীরের পাশে বসে। পাশা ভাবে, আজ নির্ঘাত সে জেলে যাবে। কিন্তু পুলিশ কিভাবে এত দ্রুত এ ঘটনা সম্পর্কে জেনে যায়? পাশা ভাবল। উপায়ন্তর না দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে যায়। পাশা তার স্ত্রী তিন্নীর কথা ভাবছে। বাংলাদেশে মায়ের কথাও ভাবছে। পাশা একবার ভাবল, এরিকাকে মাটির উপর রেখে সে তার গাড়ি নিয়ে চলে যাবে। আবার চিন্তা করে এরিকা তাকে দেখে ফেলেছে। সে পুলিশকে সব বলে দিতে পারে। তাছাড়া পুলিশ তদন্ত করলে পাশাকে সহজেই খুঁজে পাবে। কী করবে বুঝতে না পেরে স্থির করে, সে এরিকাকে এভাবে মাটির উপর ফেলে রেখে চলে যাবে না।

পুলিশের সাইরেনের শব্দ আরও জোরালো হয়। পাশা একটু উঁকি দিয়ে দূরে পুলিশের গাড়িটি দেখতে পায়। পাশা ভাবে, আজ তার আর রেহাই নেই। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের গাড়িটি পাশার গাড়ি অতিক্রম করে দ্রুত চলে যায়। পাশা একটু স্বস্তি অনুভব করে। সে ভাবে, পুলিশ হয়তো অন্য কোন জায়গাতে জরুরি সেবা দিতে যাচ্ছে। উঁকি দিয়ে পাশা রাস্তাটি আবার দেখার চেষ্টা করে। কোন গাড়ি আর রাস্তায় দেখেনি। আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি এরিকাকে গাড়ির ট্রাঙ্কে নিয়ে রাখে। এরিকা যন্ত্রণায় কী যেন বলার চেষ্টা করছে। পাশা বিরক্ত হয়ে এরিকার মুখে একটি কাপড়ের টুকরা পুরে দেয়। এরপর ট্রাঙ্কটি সজোরে বন্ধ করে দেয়। গাড়ির উপরে সে কিছু রক্ত দেখতে পায়। রক্ত সে কাপড়ের টুকরা দিয়ে মুছতে থাকে। এরিকাকে যেখানে আঘাত করা হয়; সেখানে মাটির ঘাসের উপর অনেক রক্ত দেখতে পায়। পাশা তার গাড়ি থেকে কয়েকটি পানির বোতল আনে। এরপর ঘাসের উপর পানি ঢেলে দেয়। এখন আর কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই। পাশা রক্তমাখা সব কাপড়ের টুকরা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখে। এরপর ব্যাগটি গাড়ির ভেতরে রাখে।

বড় বাঁচা সে বেঁচে গেল। পাশা নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করে। তার জামা নিয়ে একটু সমস্যায় আছে। জামার ওপরে রক্তের দাগ লেগে আছে। জামাটি খুলে ফেলে। বোতলের পানি দিয়ে জামাটি ধোয়ার চেষ্টা করে। অনেক পানি দিয়ে ধোয়ার পর রক্তের দাগ উঠে যায়। পাশার গায়ে এখন একটা গেঞ্জি ছাড়া কিছুই নেই। পাশা গাড়িতে উঠে বসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি চালু করে। এরপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

গেঞ্জি গায়ে গাড়ি চালাচ্ছে পাশা। ভেতরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে জামাটি শুকানোর চেষ্টা করছে। এত বেশি তাপ দিলো যে, পাশা গেঞ্জি গায়েই ঘামাতে শুরু করে। পাশা ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে ভাবে, হয়তো এরিকা মারা গেছে। প্রায় আধাঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর একটি ফোনের আওয়াজ শুনতে পায়। কেউ হয়তো এরিকাকে ফোন দিচ্ছে। ছয়টা বাজে এরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। এখন সকাল প্রায় ছয়টা বাজে। তাই তার কর্মচারীরা হয়তো তাকে ফোন দিচ্ছে। এরিকার ফোনে একটির পর একটি কল আসছে। এতে পাশা বিরক্ত হয়। রাস্তার পাশে সে আবার গাড়ি থামায়।

গাড়ি থামিয়ে পাশা ট্রাঙ্ক খুলে দেখে এরিকা অচেতন। তার পুরো শরীর রশি দিয়ে বাঁধা। পাশা এরিকার হাতের পালস ধরে বোঝে, সে এখনো জীবিত আছে। মনে মনে অনেক খুশি হয় পাশা। এরিকার প্যান্টের পকেট থেকে তার মুঠোফোনটি নেয়। ফোনটি মাটিতে ফেলে ইট দিয়ে সজোরে আঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। এরপর পাশা তার গাড়ির গ্যাসের ট্যাঙ্কে পুরনো একটি কাপড়ের টুকরা ঢুকিয়ে ভিজিয়ে নেয়। রক্তাক্ত কাপড়ের প্লাস্টিক ব্যাগটি গাড়ির ভেতর থেকে নেয়। ব্যাগটি মাটির উপরে রাখে। এরপর গ্যাসোলিনে ভেজা কাপড়টি এ ব্যাগে ঢোকায়। তারপর সে ব্যাগটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রক্তাক্ত কাপড়গুলো মুহূর্তের মধ্যে ভস্ম হয়ে যায়।

পাশা আবার গাড়ি চালু করে। কিছুক্ষণ পর কুইন্সে পৌঁছে। সকাল তখন প্রায় সাতটা বাজে। পাশা তার ইয়োলো ক্যাবকে হিমায়িত ট্রাকের পেছনে পার্ক করে। গতকাল পাশা তার হিমায়িত ট্রাকটি কুইন্সের এক নীরব এলাকায় পার্ক করেছে। আশেপাশে তেমন কোন বাড়ি-ঘর নেই। একদিকে গাড়ি যাওয়ার রাস্তার উপরে তার গাড়িটি পার্ক করা আছে। রাস্তাটির উপরে একটি ছোট্ট ব্রিজ। এর উপর দিয়ে গাড়ি ও ট্রেন চলাচল করে। এতে এখানে প্রচুর শব্দ হয়। নিউইয়র্ক শহরে রাতের বেলায় আবাসিক এলাকায় বড় ট্রাকের পার্ক করা নিষেধ। তাই পাশাকে প্রতিদিন এসব অনাবাসিক এলাকায় ট্রাকটি রাখতে হয়। পাশা তার ক্যাবটি ট্রাকের পেছনে পার্ক করে বেরিয়ে আসে। সে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। এ সুযোগে পাশা তার হিমায়িত ট্রাকটির পেছনের দরজা খোলে। ট্রাক থেকে দুটি খালি চালের বস্তা নেয়। বস্তাগুলো দিয়ে পাশা সাধারণত মাংস ডেলিভারি দেয়।

পাশা তার ক্যাবের ট্রাঙ্ক খোলে। পাশা দেখে, এরিকা চোখ খোলার চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি চালের বস্তা দিয়ে এরিকার সারা দেহ ঢেকে দেয়। এরপর এরিকাকে ট্রাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে ট্রাকের ভেতর রাখে। এরিকার ওজন বেশি হবে না। বড় জোর পঞ্চান্ন কেজি হবে। পাশা এরিকাকে ট্রাকের ভেতরে রেখে তার ক্যাবের দিকে আসে। পাশা দেখতে পায়, তার ক্যাবের চারিদিকে বেশ রক্ত লেগে আছে। তারপর সে গাড়ির ট্রাঙ্কটি খুলে দেখে, সেখানেও বেশ রক্ত লেগে আছে। ‘এ অবস্থায় অন্য কোন যাত্রী গাড়িতে উঠানো যাবে না।’ পাশা ভাবল।

পাশা আবার তার ট্রাকের দিকে যায়। ট্রাক থেকে কয়েকটি পরিষ্কারক স্প্রে আর তোয়ালে নিয়ে আসে। তার ক্যাবের বাইরে ও ভেতরে সব জায়গায় ভালো করে স্প্রে করে তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে। পাশা ট্রাকের ভেতরে প্রবেশ করে। এতক্ষণ পর্যন্ত এরিকাকে ট্রাকের মেঝেতে রেখেছে। ট্রাকের ভেতর গরু ও ছাগলের মাংসে পরিপূর্ণ। পাশা এই ট্রাক দিয়ে নিউইয়র্ক শহরের বিভিন্ন দোকানে প্রতিনিয়ত মাংস ডেলিভারি দেয়।

ট্রাকভর্তি মাংস দেখে পাশার হঠাৎ মাংস ডেলিভারির কথা মনে পড়ে। আজ তাকে অবশ্যই ডেলিভারি দিতে হবে। না হলে সব দোকানের মালিক তাকে ফোন করে জ্বালাতন করবে। শহরের অনেক দোকানদার পাশার নিয়মিত ডেলিভারির আশায় থাকে। পাশাও কখনো মাংসের ডেলিভারি দিতে দেরি করে না। তাই তারা পাশাকে অনেক পছন্দ করে। অন্যদিকে এরিকাকে ট্রাকের ভেতর কোথাও রাখার ব্যবস্থা পাশা করতে পারছে না। এরিকাকে ট্রাকের মেঝেতে রেখে পাশা চিন্তা করে, আজ তাকে ডেলিভারি দিতে হবে। এরিকাকে ট্রাকের মেঝেতে রেখে পাশা ট্রাকের পেছনের দরজাটি বন্ধ করে।

সামনে বসে পাশা তার ট্রাক চালু করে। দৈনিক প্রায় আট থেকে দশটি দোকানে মাংস ডেলিভারি দেয়। কিন্তু আজ শুধু চারটি দোকানে মাংস ডেলিভারি দিবে বলে ভাবল। এ চারটি দোকানে মাংস ডেলিভারি না দিলে নয়। তাছাড়া এ চার দোকানে মাংস ডেলিভারি দেওয়ার পর ট্রাকের পেছনে অনেক জায়গা খালি হবে।

সকাল তখন নয়টা বাজে। পাশা ‘মোহাম্মদ গ্রোসারি অ্যান্ড হালাল মিটস’ দোকানে মাংসের ডেলিভারি দিতে আসে।
‘কিরে পাশা, আজ এত দেরি করলি?’ তৈয়ব বলল। তৈয়ব এ দোকানে বহুবছর ধরে কাজ করছে। পাশার সাথে তার ভালো সম্পর্ক।
‘তোর তো আগে কখনো দেরি হতো না। আজকে তোর আসতে দেরি দেখে আমরা দোকানের সবাই অবাক। অন্যদিন বরাবর আটটা বাজে ডেলিভারি দিস। আজকে কেন রে এত দেরি হলো। বাড়ির সবাই ভালো তো?’ তৈয়ব জিজ্ঞেস করল।
‘হুম, সব ঠিক আছে। রাস্তায় একটি বড় অ্যাকসিডেন্ট হইছিল। বড় ট্রাক, তাই গাড়ি ঘুরিয়ে আসতে পারিনি।’ পাশা বলল।
‘তৈয়ব ভাই, আজ আমার তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি মাংসের ডেলিভারি বুঝে নাও। আমাকে অন্য দোকানে ডেলিভারি দিতে হবে। দেরি করা যাবে না।’ পাশা বলল।
‘ঠিক আছে দোস্ত।’ বলে তৈয়ব ট্রাকের পেছন দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
পাশা দ্রুত তৈয়বকে সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘আজ আমি তোরে মাংস ট্রাক থেকে দেব। তোর শুধু দোকানে নিয়ে যেতে হবে।’ পাশার অদ্ভুত আচরণ দেখে তৈয়বের কেন জানি সন্দেহ হয়। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে সে পাশার কথামত তার হাত থেকে মাংস নেয়। তৈয়ব আর ট্রাকের ভেতর প্রবেশ করেনি। পাশা ডেলিভারি শেষ করে চলে যায়।

পাশা এখন ‘বাঙালি হালাল মিটস’ এ ডেলিভারি দিতে যাচ্ছে। ট্রাকের পেছন থেকে পাশা যেন কী শুনতে পাচ্ছে। পাশা ভাবছে, এরিকা বোধহয় জেগে গেছে। পাশা ট্রাকটিকে রাস্তার একপাশে থামায়। ট্রাকের ডান সাইডের দরজা দিয়ে পাশা ভেতর প্রবেশ করে। দেখে এরিকার দুই চোখ খোলা আর পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। এরিকার হাত-পা ও পুরো শরীর রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। এরিকা পাশাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। পাশা তার মুখের উপর বাঁধা কাপড়টি সরিয়ে নেয়। ‘প্লিজ, লেট মি গো। আই উইল নট টেল এনিওয়ান। প্লিজ প্লিজ!’ এই বলে এরিকা কান্না শুরু করে দেয়। পাশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখে। এরিকা কী বলছে কিছু তার কানে ঢুকছে না। সে এরিকার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। একটি ছোট্ট শিশু নতুন খেলনা পেলে যেভাবে চেয়ে থাকে।

পাশা ট্রাকের ভেতর থেকে ডাক্টটেপ নিয়ে এরিকার মুখ একেবারে বন্ধ করে দেয়। পাশা এরিকার এ অবস্থা দেখে ছোটবেলার একটি সুখস্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় পাশার কাতলা মাছ খাবার খুব শখ ছিল। পাশা যখন তার বাবার সাথে বাজারে যেত; তখন বাবাকে বড় কাতলা মাছ দেখলে খুব জ্বালাতন করত। বাবাকে সে প্রায় বলত বড় একটি কাতলা মাছ নেওয়ার জন্য। বড় কাতলা মাছ খাওয়ার জন্য পাশার অনেক শখ ছিল।

পাশার বাবা প্রায় বলতেন, ‘বাপজান, আমরা গরিব মানুষ। এত্ত বড় কাতলা মাছের মেলা দাম। একখান বড় কাতলা মাছ দিয়ে আঙ্গো একমাসের সংসার চলে যাইবো।’ পাশার বাবা রহিম মিয়ার সামান্য কিছু জমি ছিল। ওই জমিতে চাষাবাদ করে তাদের সংসার চলে যেত। রহিম মিয়া পাশাকে অনেক আদর করত। সংসারে যত কষ্ট হোক রহিম মিয়া পাশাকে কখনো তা বুঝতে দেননি। পাশা যখন যা চেয়েছে, তা-ই পাশাকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

এক রমজানে পাশার বাবা ঠিক করে পাশার জন্য বিরাট একটি কাতলা মাছ কিনে আনবেন। ছেলের মুখে একটু হাসি দেখবেন। তাই পাশার বাবা সারা বছর খেত-খামারে কাজ করে কিছু টাকা সঞ্চয় করে। পাশার বয়স তখন বারো হবে। ঈদের আগের দিন রহিম মিয়া পাশাকে বলেন, ‘বাপজান, চল আইজ্যা বাজারে যামু। হুনছি বাজারে নাকি মেলা মাছ উঠছে। দেহি একখান কাতল মাছ নিতে হারি কি-না। তোর তো কাতলা মাছ মেলা হছন্দ।’
পাশা তার বাবার কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে। দেরি না করে বাবার সাথে বাজারে চলে যায়। মাছের বাজারে প্রবেশ করার পর পাশা বিরাট একটি কাতলা মাছ দেখে। কাতলা মাছটি কমপক্ষে বিশ কেজি হবে। ‘আব্বা, এইডা নাও না। অ্যাঁর খাইত ইচ্ছা করে।’ পাশা বলল।
রহিম মিয়া বললেন, ‘না রে বাপ, এইডা মেলা বড় মাছ। মেলা দাম হইবো।’ সঙ্গে সঙ্গে পাশার মন খারাপ হয়ে গেল। রহিম মিয়া পাশার মন খারাপ দেখে বললেন, ‘হয়, ঠিক আছে। এডটা লমু।’

কাতলা মাছটির ওজন এত বেশি ছিল যে, রহিম মিয়া নিজে মাছটি উপরে উঠাতে পারছেন না। রহিম মিয়া একটি রিকশা ভাড়া করেন। পিতা-পুত্র মিলে মাছটি রিকশার উপরে উঠান। বাড়ি যাওয়ার পথে পাশা বারবার মাছটি দেখছে। কী আনন্দ তার মুখে। তা দেখে রহিম মিয়ার আনন্দে বুকটা ভরে গেল। পাশা মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে মাছটিকে দেখে। মাছের মুখের ভেতরে মস্ত একটি রশি লাগানো ছিল। যাতে মাছটিকে উঠাতে-নামাতে সহজ হয়। ওটাই ছিল পাশার জীবনের অন্যতম এক স্মরণীয় দিন। আজ এরিকার হাত-মুখ ও শরীর রশিতে বাঁধা দেখে পাশার সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। কী যে আনন্দ আজ পাশার মনে।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন