নজরুলের প্রেম-কাননের ঝরা নার্গিস ফুল
১৯২০ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদে অবস্থান করেন। এখানে পরিচয় হয় কুমিল্লা জেলার মুরাগনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে। আলী আকবর খান নজরুলকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিলে নজরুল রাজি হয়ে যান।
কবি নজরুল ছিলেন এই পান্থশালার এক উদাস পথিক। পথের ইশারায় পথ চলাই যেন তাঁর স্বভাব। কবি নজরুল ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সঙ্গে কলকাতা থেকে কুমিল্লায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কুমিল্লা থেকে আলী আকবর খানের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুর বেশ দূরত্ব হওয়ায় এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা তেমন ভালো না থাকার দরুন কুমিল্লা শহরে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে যাত্রা বিরতি করেন। বীরেন্দ্র কুমার সেন ছিলেন আলী আকবর খানের ছাত্র জীবনের বন্ধু। এই সুবাদে সেন পরিবারের সঙ্গে আলী আকবর খানের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে মানিকগঞ্জের সেন পরিবারে চার-পাঁচ দিন থাকার পর আবার আলী আকবর খানের সঙ্গে পা বাড়ালেন দৌলতপুরের পথে।
দৌলতপুর কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার নিভৃত এক অজপাড়াগ্রাম। দৌলতপুরে এসে কবি তাঁর স্বভাব সুলভ গান গেয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, হো হো করে অট্টহাসি হেসে জয় করলেন খান পরিবারের ছোট-বড় সবার মন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ঘিরে ধরল কবিকে। কবি ছোটদের উদ্দেশ্য করে লিখলেন ‘হার মানা হার’ কবিতা:
‘তোরা কোথা হ’তে কেমনে এসে
মণি-মালার মত আমার কণ্ঠে জড়ালি!
আমার পথিক-জীবন এমন ক’রে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ ক’রে বাঁধন পরালি॥
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব ক’রে হেসে
তা’রা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে
তোরা কেমন ক’রে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ঐ কচি বাহুর রেশমী ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস্,
‘না’ ‘না’ ব’লে ঘাড়টি নাড়াস,
কেন ঘর-ছাড়াকে এমন ক’রে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি॥’
এই নিভৃত পল্লীগ্রাম দৌলতপুরে কবি হাসি-আনন্দে কাটালেন তিন-চার মাস। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন খান পরিবারের সঙ্গে। বলতে গেলে পরিবারের আপনজন হয়ে ওঠেন কবি। আলী আকবর খানের এক ভাইয়ের মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের সঙ্গে নার্গিসের ভাই মুনশী আবদুল জব্বারের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়। এই বিয়েতে নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের প্রথম পরিচয় ঘটে।
নজরুল খানবাড়ির পুকুর পাড়ে বসে মনের আনন্দে বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলতেন। এক নিশুতি রাতে নজরুলের বাঁশের বাঁশির সুর শুনে ষোড়শী নার্গিসের মনে সৃষ্টি হয় রেখাপাত। হৃদয়ে জাগে দোলা, বুকে জাগে স্পন্দন। নার্গিস নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হন। কৃষ্ণের জাদুকর মন ভোলানো বাঁশির সুরে যেমনি ভাবে রাধা আত্মহারা হয়েছিলেন, তেমনিভাবে নার্গিসও নজরুলের বাঁশির সুর-সুধায় হয়েছিলেন বিমোহিত। নজরুলের প্রেম কাননে ফোটে নার্গিস ফুল। প্রেমিক কবি প্রেমময় রূপসী প্রেয়সীর মনের গোপন কথা ব্যক্ত করলেন নিজের লেখা ‘কার বাঁশী বাজিল’ কবিতায়:
‘কার বাঁশি বাজিল
নদী-পাড়ে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল
কার বাঁশী বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল ক’রে সুরে সুরে
এত ক’রে ঝুরে’ ঝুরে’
কে আমায় যাচিল?
পুলকে এ-তনু-মন ঘন ঘন নাচিল।
ক্ষণে ক্ষণে আজি লো কার বাঁশী বাজিল?
কার হেন বুক ফাটে মুখ নাহি ফোটে লো!
না-কওয়া কি কথা যেন সুরে বেজে ওঠে লো!
মম নারী-হিয়া মাঝে
কেন এত ব্যথা বাজে?
কেন ফিরে এনু লাজে
নাহি দিয়ে যা ছিল!
যাচা-প্রাণ নিয়ে আমি কেমনে সে বাঁচি লো?
কেঁদে কেঁদে আজি লো কার বাঁশী বাজিল?’
কবি নজরুল নার্গিসের প্রেমে আত্মহারা হয়ে প্রেম-প্রেয়সী নার্গিসকে নিয়ে লিখলেন:
‘অচকিতে পথের মাঝে পথ ভোলানো পর দেশীকে,
হানলে দিঠি পিয়াস জাগা পথভোলা এই উর্বশীকে।
শূন্য তাহার কন্যা হিয়া
ভুবন বধূর বেদন নিয়া
জাগিয়ে গেল পরদেশিয়া বিধূর মধুর ব্যথা।’
কিংবা-
‘আর পারিনে সাধতে লো সই একফোটা ঐ ছুঁড়িকে।
ফুটবে না সে ফোটাবে কে বল? সে ফুল কুঁড়িকে!
ঘোমটা চাপা পারুল কলি
বৃথাই তারে সাধলো অলি
পাশ দিয়ে হায় শ্বাস ফেলে যায় হুতাশ বাতাস ঢালি;
সন্ধ্যে সকাল ছুঁয়ে কপাল রবির যাওয়া আসাই সার
ব্যর্থ হল পথিক কবির গভীর ভালবাসার হার।
তরুণ চোখের করুণ চাওয়ার চোখ ঠেরেছে ছুঁড়িকে-
বসে আছে লো
এই লজ্জাবতীর বধির বুকের সিংহ আসন জুড়ি কে?’
দৌলতপুর কবি নজরুল জীবনে এক বিচিত্র অধ্যায়। দৌলতপুরে এসেই নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের পরিচয় হয়। সেই পরিচয় সূত্র ধরে ঘটে প্রণয় আর এই প্রণয় পরিণত হয় পরিণীতায়। যৌবনে কবি নার্গিসের প্রেম-পরশে হয়েছিলেন আবিষ্ট। বাঁধন-হারা কবি বাঁধা পড়েন নার্গিসের মায়ার জালে। তাঁরই আভাস কবির ‘মানসবধূ’ কবিতায় ফুটে ওঠে:
‘সে কোন দূরের মেয়ে আমার কবি মানসবধূ
বুক পোড়া আর মুখ ভরা তাঁর পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।
নিশীথ রাতের স্বপন হেন
পেয়েও তারে পাইনে যেন
মিলন মোদের স্বপন কুলে কাঁদন চুমোয় চুমোয়।’
প্রেম পাঠ চুকিয়ে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালের ২০ জুন ধার্য করা হয় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের তারিখ। বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে ধুমধামের সঙ্গে। ছাপা হয় বিয়ের দাওয়াতপত্র:
বিনয় সম্ভাষণ পূর্বক নিবেদন-
‘জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে
এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবারে।’- রবীন্দ্র
এ বিশ্ব-নিখিলের সকল শুভকাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ-আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েচে, সেই পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার করুণাধারা শ্রাবণের ধারার মতই ব্যাকুল বেগে আজ আমার ঘরে-আমাদের মুখের ’পরে বুকের ’পরে ঝরে পড়চে; তাঁর কল্যাণ-ভারাতুর আনত আঁখির সু-নিবিড় চাওয়া কেমন এক সুধা-করুণ আশীষে ছেয়ে ফেলচে!
শিশির-নত ফুলের মতই আজ তাই আমার সকল-প্রাণ-দেহ-মন তাঁর চরণ ধুলার তলে লুটিয়ে পড়েচে। তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নিচে আমার মাথা নত ক’রে আমি আপনাদের জানাচ্চি যে:-
আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নি নার্গিস-আ’সার খানমের বিয়ে বর্দ্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে বিপুল গৌরবান্বিত, আয়মাদার, জমিনদার মরহুম মৌলবি কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ-বিশ্রুত পুত্র মুসলিম-কুল-গৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’-কবি দৈনিক নবযুগের ভূতপূর্বক সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাঙলার এই তরুণ সৈনিক-কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন ক’রে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই। এই-আনন্দ-ঘন চির-শিশুকে যে দেশের সকল লেখক লেখিকা সকল কবি বুকভরা ভালোবাসা দিয়েছেন, সেই বাঁধন-হারা যে দেশ মাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে বসেচে, এর চেয়ে বড় পরিচয় তাঁর আর নেই।
আপনারা আমার বন্ধু, বড় আপনার জন। আমার এ গৌরবে, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ ক’রে আমার-এ কুটীরখানিকে পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট ক’রে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।
এমন আচমকা না-চাওয়া পথে কুড়িয়ে-পাওয়া যে সুখে আমার হৃদয় কানায় কানায় পুরে উঠেচে, আপনাকেও যে এসে তাঁর ভাগ নিতে হবে। এদের পাশে দাঁড়িয়ে, মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ-ভরা আশীর্বাদ করতে হবে! আর, একা এলে তো চলবে না, সেই সঙ্গে আপনি আপনার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবকেও আমার হয়ে পাকড়াও ক’রে আনবেন এ মঙ্গল-মধুর দৃশ্য দেখাতে।
বিয়ের দিন আগামী ৩ আষাঢ় শুক্রবার নিশীথ-রাতে। নিশীথ-রাতের বাদল ধারার মতই আপনাদের সকলের মঙ্গল-আশীষ যেন এদের শিরে ঝরে পড়ে এদিন!
আমি আজ তাই জোর করেই বলচি, আমার এত বড় চাওয়ার দাবির অধিকার ও সম্মান হ’তে-আপনার প্রিয় উপস্থিতি হ’তে আমায় বঞ্চিত ক’রে আমার চোখে আর পানি দেখবেন না। আরজ-
দৌলতপুর, ত্রিপুরা। বিনীত
২৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৮ বাং আলী আকবর খান
নজরুল-নার্গিসের বিয়েতে লেখা হয় কাবিননামা। কবির মানস বধূ নার্গিসকে জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে পাবার মুহূর্তে বেজে ওঠে এক অশনি সংকেত। কাবিননামায় লেখা হয়েছিল বিয়ের পর নার্গিসকে নজরুল দৌলতপুর থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। নজরুলকে ‘ঘর জামাই’ হয়ে নাকি চিরদিনই থাকতে হবে দৌলতপুরে। কবি নজরুল ছিলেন পৌরুষদীপ্ত এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। ‘ঘর জামাই’ হয়ে শ্বশুর বাড়ি দৌলতপুরে থাকা কবির ব্যক্তিত্বে হানে চরম আঘাত। এতে কবি তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তবে সামাজিক মান-মর্যাদা সর্বোপরি ভালোবাসার মানস প্রিয়তমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে বসলেন বিয়ের পিঁড়িতে। ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয় সম্পন্ন।
বাসর রাত। নীরব-নিথর স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। জেগে আছে রাতের চাঁদ-তারা। আবার সে চাঁদ-তারাও আষাঢ়ের মেঘমালার সাথে আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলায় নিমগ্ন। দূর-বহুদূর থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসে রাত জাগা শুকসারির অস্ফুট সুর : ‘সুখ না দুখ’?
নজরুল-নার্গিসের যুগল-মিলন। রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দুজনার মাঝে মধুর আলাপন। এই প্রেমময় শুভলগ্নে-শুভক্ষণে হঠাৎ আষাঢ়ের কালো মেঘের ধূপছায়া ফেলে দুজনার হৃদয়াকাশে। দুজনার মাঝে শুরু হয় বাক-বিতণ্ডা। সে উত্তপ্ত রেশ মুহূর্তের মধ্যে তিক্ততায় পৌঁছে চরমে। আষাঢ়ের কালো মেঘ যেন কঠিন বজ্র-ঝড়ে রূপ নেয়। কবির চাঁপা ক্ষোভ ধুম্রজালে ছেয়ে যায়।
দুখু মিয়া তখনও নজরুল হয়ে ওঠেননি। দুখু মিয়ার দুঃখের অমানিশার ছদ্মাবরণে ঢাকা নজরুল। ছন্নছাড়া, বাঁধন-হারা দুঃখ ভরা জীবনতরীর এক দুর্দিনের যাত্রী। তবে নজরুল দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর আভিজাত্যকে ঢেকে দিতে পারেনি দুঃখের কালোছায়া। ‘ঘরজামাই’ হয়ে থাকার কথা শুনে কবি দুঃখে ক্ষোভে, ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। নববধূ নার্গিসকে দৌলতপুর থেকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন কলকাতায়। কবি-বধূ নার্গিস বয়সে ষোড়শী অনূঢ়া। আর নজরুলও তখন সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখেছেন। ছিন্নমূল বাউন্ডুলে কবিকে বুঝে উঠতে পারেননি নবপরিণীতা কবি-বধূ নার্গিস আ’সার খানম। নাম ঠিকানা বিহীন বাঁধন-হারা এক কবির সঙ্গে ঘর বাঁধলেও নার্গিস অজানা-অচেনা অনিশ্চিত পথে সেদিন পা বাড়াতে সাহস পাননি।
অজানা-অচেনা পথের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়েন নার্গিস। যে কবির চাল নেই, চুলো নেই, সেই কবির জীবন সঙ্গিনী হলেও কবির দুঃখকে বরণ করে নিতে সাহস পাননি নার্গিস। নববধূর অনাহত উন্মাসিকতা কবির বুকে হেনেছিল চরম আঘাত।
কবি তাঁর ‘নিশীথ প্রীতম’ কবিতায় লিখেছেন:
‘মোদের দু’জনারেই জীবন ভরে কাঁদতে হবে গো-
মোরা কে যে কত ভালবাসি কোন দিনই হবে না বলা।
কভু সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকবোনা সে কথা।
শুধু কইতে-নারার প্রাণ পোড়ানি বইবে
দোঁহার ভরে, বুকের তলা।’
দুরন্ত-দুর্বার নজরুল। একরোখা মন তাঁর। পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ার কাঁকর বিছানো রুদ্র কঠিন মাটির ছেলে তেঁতে উঠলেন চৈত্রের খরার মত। জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের মত ফেটে পড়লেন রুদ্র রোষে। আর তখনি আষাঢ়ের মেঘঘন বিদ্যুৎ গতিবেগে বাসর ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন নজরুল।
সেই বাসর-ভাঙা রাতের কাহিনি জানা যায় বিরজাসুন্দরী দেবীর লেখা ‘নৌকা পথে’ নামক এক প্রবন্ধে:
‘সকলের বড় ‘খান’ (আলতাফ আলী খান) আর সকলের ছোট ‘আ খান’ (আকবর আলী খান) এই দুইটির সঙ্গে আমার অনেক দিন থেকে জানা শুনা। ‘আ’ (আকবর আলী খান) আমার পুত্র ‘বী-র’ (বীরেন্দ্রকুমার সেনের) সহপাঠী, তাঁর সঙ্গেই আগে পরিচয়, সে আমাকে মা বলে এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। তাঁর জন্য তাঁর ভাগ্নির (অতএব আমার নাতনীর), বিয়েতে তাদের বাড়ি গিয়েছিলেম। মুসলমানের বিয়ে এই প্রথম দেখলাম। ওদের বিয়ে একদিনে হয় না, সেদিন হ’লো আমাদের পাকা কথার মত বা লগ্ন পত্রের মত (এখন ও প্রথা উঠে গেছে)। বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতন ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা- সে যে কি কান্না-কাটি আমাদের ছেড়ে দিতে, তা’ আর কি লিখব, লিখে বা বলে তা বুঝানো যায় না। মেয়ে বৌদের থেকে আরম্ভ ক’রে বাড়ি শুদ্ধ সব্বাই কাঁদতে কাঁদতে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে এসে আমাদের নৌকায় উঠিয়ে দিলে। পাছে গ্রামের ছোট খাল দিয়ে যেতে কোন বিপদ হয়, সে জন্য সেই সরল স্বভাব মেজ ছেলেটি নৌকায় সকাল পর্যন্ত ‘কো-গঞ্জের’ (কোম্পানীগঞ্জের) বাজার থেকে আমাদের আবশ্যকীয় খাবার জিনিস কিনে দিয়ে হেঁটে বাড়ি রওয়ানা হ’য়ে গেল। এবার গোমতী দেবীকে উল্টো ঠেলে নিয়ে আসতে হলো বলে একদিনের রাস্তায় তিন দিন কাটিয়ে আমরা নিশি ভোরে কুমিল্লায় এসে পৌছুলুম।’
শূন্য বাসর শয্যা...! বাসর ভাঙা রাতের দুঃস্বপ্নে চোখের জলে ভেসে যায় বুক। গোমতীর উথাল পাথাল ঢেউয়ের দোলায় নার্গিসের বিরহ-ব্যথার চোখের জল বয়ে চলে অশ্রুমতির দেশে। কবি নিজেই লিখেছেন বিরহ বেদনার কথা:
‘রূপের দেশের স্বপন কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু
বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙ্গায়িনু।
দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙ্গিয়াই
ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই।’
কবি আরও লিখলেন বেদনার কাব্যমালা:
‘আমি এদেশ হ’তে বিদায় যেদিন নেবো প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ-বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,
তখন মুকুর-পাশে একলা গেহে
আমারি এই সকল দেহে
চুমবো আমি চুমবো নিজেই অসীম স্নেহে গো,
আহা পরশ তোমার জাগছে যে গো এই সে দেহে মম॥’
শিল্পী আফতাব উদ্দিনের বাঁশির সুরে বেজে ওঠে বাসর ভাঙা রাতের বিরহ-বেদনার মূর্ছনা। লোক কবির গানে ফুটে উঠেছে নজরুল-নার্গিসের বিরহ ব্যথার এক করুণ সুর:
‘বিয়া অইল কবির সনে
আমায় ছাইড়া গেল কেনে
সই-সইগো-
মনের আগুন নিভাই কেমনে॥
সই-সইগো-
বর্ধমাইন্যা কবির কথা
কইতে গেলে বাড়ে ব্যথা
বিয়া কইরা মারিল পরানে॥
কাটাইয়া সে মধুর বাসর
ছাইড়া গেল রসের নাগর
জ্বইলা মরি তারি সে দহনে॥
পিরীত কইরা করল বিয়া
পালাইল সে দাগা দিয়া
কান্দি এখন তারে কইরা মনে॥
জীবন-যৌবন বৃথা গেল
রসিক ভোমর আর না আইল
মইজাছে সে গোকূল বৃন্দাবনে॥’
রাত পোহাতে না-পোহাতে ঝরে পড়লো নিশি ভোরের নার্গিস। মুছে গেল হাতের মেহেদী। খসে পড়লো নাকের বেসর- নাকফুল। একবুক বেদনা নিয়ে নার্গিস যুগ যুগ ধরে চোখের জলে গাঁথে মালা।
নজরুলও নার্গিসের বিরহে ধূপের অনলে পুড়ে পুড়ে হয়েছেন অঙ্গার। দুজনের মাঝে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-বেদনায় লিখেছেন অশ্রুলিপি। এমনিভাবে দীর্ঘদিনপর নার্গিসের হাতের চিঠি পেয়ে নজরুল লিখলেন এক বেদনাগাথা:
‘106, Upper Chitpur Road
Gramophone Rehearsal Room
Cacutta, 1.2.37
কল্যাণীয়াসু!
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগণে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝ’রছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবণ নেমেছিল-তা তুমিও হয়তো স্মরণ ক’রতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘপুঞ্জ বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়া দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের- অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থা’কো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে-আর তা মিথ্যা।
তোমার উপর আমি কোন ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না- এ আমি সকল অন্তর দিয়ে ব’লছি। আমার অর্ন্তযামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই-পুড়েছি-তা দিয়ে তোমায় কোন দিন দগ্ধ ক’রতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমাণিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীনা’ বাজাতে পারতাম না-আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে-রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত- মন্দারের মত চির অম্লান হ’য়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন-বাইরের সে-ফুলহারকে স্পর্শ’ ক’রতে পারেনি।
তুমি ভুলে যেওনা, আমি কবি-আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতদের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের, কাপুরুষের আঘাতের মত নিষ্ঠুর নয়। আমার অর্ন্তযামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।
আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হ’য়েছে। তাঁর ‘সেতু’ কোন লোক তো নয়-ই-স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। আমায় বিশ্বাস করো, ‘আমি সেই ক্ষুদ্র’দের কথা বিশ্বাস করিনি। ক’রলে পত্রোত্তর দিতাম না। তোমার উপর আমার কোন অশ্রদ্ধাও নেই, কোন অধিকারও নেই-আবার বলছি। আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরে’র সেবা ক’রছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদের-ই ঢাকার কুকুর একবার আমায় কামড়েছিল আমার অসাবধনতায়, কিন্তু শক্তি থাকলেও আমি তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি তাদের প্রতি আঘাত করিনি।
সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ ক’রেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমার-ই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা ক’রেছিল। নৈলে তাদের চিহ্নও থাকতনা এ-পৃথিবীতে। তুমি আমায় জানবার যথেষ্ট সুযোগ পাওনি, তাই এ-কথা লিখেছ। যাক, তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেকত জুটবে-তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই! আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ ক’রব-বা আদেশ দিব? নিষ্ঠুর নিয়তি সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।
তোমার আজিকার রূপ কি, জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মত আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা ক’রতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ ক’রলে না। পাষাণ-দেবীর মতই বেছে নিলে বেদনার বেদীপীঠ। জীবন ভ’রে সেইখানেই চ’লেছে আমার পূজা-আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে-রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার ক’রেই চ’লেছি।
দেখা? না-ই হল এ-ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ-ধূলিতলে হ’য়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যি-ই আমায় ভালবাস, আমাকে চাও, ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, শিরী ফরহাদকে পায়নি, তবুও তাদের মত ক’রে কেউ প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হ’লেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা ক’রতে পারেনা। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তাহ’লে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হ’য়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছা ক’রলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুলরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোন ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাঁর সংশোধন ক’রে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ, মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজকে উন্নত ক’রতে চেষ্টা কর, স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার ক’রছি, তবু চ’লে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম ক’রে উর্ধ্বলোকে-সেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমাসুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা দেয়। ...হঠাৎ মনে প’ড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হ’য়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র-সুন্দর ললাট স্পর্শ ক’রতে পেরেছিল, তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব ক’রতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকার কথা। মহাকাল যে-স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলে না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কি দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ার-ই সেদিন এসেছিল। সারা দিনরাত আমার ঘুম ছিল না।
যাক-আজ চ’লেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষরশ্মি ধ’রে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে-পথ থেকে ফেরানোর। আর তাঁর চেষ্টা ক’রোনা। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমার ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও-এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ ব’লে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ত। ইতি
নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম।’
এসইউ/জেআইএম