ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

পাহাড় নীরবে কাঁদে

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার | প্রকাশিত: ০৪:০৬ পিএম, ০৯ এপ্রিল ২০১৯

আজ বৃষ্টির মাদকতা নেই। শহরের আবহ কোমল রূপে বিরাজমান। আমি প্রতিদিনের মতো আজও বাসা থেকে বের হয়েছি গন্তব্যহীন পথিকের মতো। আসলে এই উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলার মাঝে এক ধরনের আনন্দ খেলা করে। আমি উপভোগ করি কংক্রিটের নগরীর বাস্তবতার নিত্য চিত্র।

আজ বন্ধু জুয়েলের আসার কথা টিএসসিতে। আমার সাথে ওর জরুরি দরকার আছে। কিন্তু আমি আসলেই তেমন কেউ নই যে, আমার সাথে জরুরি দরকার পড়বে অবেলায়। আমি নীলক্ষেত দিয়ে হাঁটছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। যে পথটি নীলক্ষেত থেকে টিএসসিতে এসে মিশেছে। আজ সে পথটি একদম ফাঁকা। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় পিচঢালা এ পথে এক ধরনের মায়া খেলা করছে।

মৃদু বাতাসের এমন দিনে তোমাকে মনে পড়ে। কিন্তু মনে পড়ার মতো কেউ নেই, যে কি-না আমার হৃদয় মন্দিরে জায়গা করে নিয়েছে। মন্দির পবিত্র জায়গা। সুতরাং স্থান করে নিতে হলে পবিত্র মনের মানুষ প্রয়োজন। আমি মানুষ খোঁজার সময়ই তো পাই না। আর এমন ছন্নছাড়ার দলে কে বা ভিড়বে?

টিএসসিতে জুয়েলের সাথে বন্ধু মামুনও এসেছে। মামুন আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। ও কথার তুবড়ি ফোটাতে জানে। বড় আপুদের সাথে তার সখ্যতা ভালো। তবে আজ আমার সাথে তার বিশেষ আলাপ থাকার কথা নয়। সময়ের আবহে কখন কী প্রয়োজন হয়- সেটিও বলা মুশকিল!

টিএসসির সামনে যে পাশে রাজু ভাস্কর্য, সে দিকটায় দাঁড়িয়ে আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করছি। এরমধ্যে আমাদের সাথে যুক্ত হলো রাজা ও মমিন। ওরা দু’জন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। সময় পেলে ওরা দু’জন আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যায়। আমারও বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে মন্দ লাগে না। আজ আমাদের সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। বলাকায় রায়হান রাফির ‘পোড়ামন-২’ মুক্তি পেয়েছে। যার নায়ক আমার কলেজের বড় ভাই সিয়াম আহমেদ।

জুয়েলের সাথে কাজ শেষ করে আমরা গন্তব্যে যাব। জুয়েল আমাকে এবার একটু কাছে ডেকে নিলো আলাদাভাবে। আমি প্রশ্ন করলাম-
বন্ধু, আমাকে জরুরি তলব করলি। আসলে বিষয়টা কী?
আসলে তোকে আমার সাথে সুনামগঞ্জ যেতে হবে।
আমাকে! কিন্তুু কেন?
যেতে হবে এবং আজই যেতে হবে। তুই ফকিরাপুল চলে আয় সন্ধ্যার মধ্যে। আমি অপেক্ষা করবো।
কারণটা বলবি তো!
তুই আগে আয়, তারপর কথা হবে।
আমি পড়লাম মহা ঝামেলায়। আমাকে সুনামগঞ্জ যেতে হলে প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। কাছে টাকা-পয়সাও নেই। কিন্তু বন্ধুর নিশ্চয়ই আমাকে প্রয়োজন। না হলে তো এমন রিকোয়েস্ট করতো না।

আমি রাজার কাছ থেকে টাকা ধার নিলাম। ঢাকা ফিরে সিনেমা দেখার প্রতিশ্রুতি দিলাম। মমিন ও রাজার মলিন বদন আমার ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি তো মেনে নিতে হবে।

আজ ঢাকার রাস্তায় অন্যদিনের মতো জ্যাম নেই। বাসায় ফিরে রেডি হয়ে বের হলাম ফকিরাপুলের উদ্দেশে। তবে জুয়েল কেন আমাকে এমন জরুরি ভিত্তিতে সুনামগঞ্জ নিয়ে যাচ্ছে, এর রহস্য উদঘাটন আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।

বাস সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করল। আমি, জুয়েল, মামুন আর মনিরা। চারজন রওনা হলাম জুয়েলের বাড়ির উদ্দেশে। জুয়েল ওর বাড়িতে আমাকে অনেকবার নিতে চেয়েছে। সময়ের অভাবে যাওয়া হয়নি। সে যাওয়াই তবে আজ হুট করে হয়ে গেল।

মনিরা আমাদের বান্ধবী। মূলত জুয়েলের প্রেমিকা। আমরা ‘ভাবি’ বলে ডাকলে দারুণ খুশি হয় মেয়েটি। রান্নার হাত ভালো। দেখতে যেমন সুন্দর, মনটা আরও বেশি সুন্দর। সুনামগঞ্জের মেয়ে সুনাম তো থাকবেই। ফলে সুন্দর হতেই হবে। আমরা জানি, সিলেটের সুনামগঞ্জে আছে পাহাড়, যাদুকাটা নদী, টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুল বাগানসহ নান্দনিক সব প্রাকৃতিক সম্পদ। তারই প্রতিচ্ছবি হয়তো মেয়েটি।

জুয়েলকে আমি জোর করে ধরলাম, ‘বন্ধু, এবার বল, আমরা তোর এলাকায় কেন যাচ্ছি?’ জুয়েল ইতস্তত বোধ করল। তবে আমার সাথে সাথে মামুনের পিড়াপিড়িতে মুখ খুলল।

তার কথার সারমর্ম দাঁড়ায়, ওর এলাকায় পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ করছে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। স্থানীয়ভাবে তারা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এমনভাবে চলতে থাকলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হবে, তেমনি এ অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। ও আমাকে আগে থেকে না বলার কারণ হচ্ছে- আমি যদি ভয় পেয়ে যেতে রাজি না হই।

ওর কথার সাথে আমি একমত। কিন্তু আমাদের কাজের বিষয়টি যা বর্ণনা করল, তাতে আমার শরীর শীতল হয়ে এলো। কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমার বন্ধুরা জানে, আমি শর্টফিল্ম বানাই এবং টুকটাক ডকুমেন্টরি তৈরির কাজ করি। জুয়েল সে বিষয়ের প্রয়োগ এখানে করতে চাইছে। ও ক্যামেরা সাথে নেওয়ার কথা বলায় আমি ভেবেছিলাম সুন্দর সুন্দর ছবি তুলবো। কিন্তু এমন কাজে ব্যবহার হবে, তা বুঝতে পারিনি।

জুয়েলের বাড়ি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের খুব কাছে। ওর বাড়িতে এসে চোখে যা পড়লো, তাতে পাহাড় বেষ্টিত এলাকার চিত্র আসলেই পরিবর্তন ঘটেছে। আশেপাশে দিন-দুপুরে চলছে পাহাড় থেকে মাটিকাটার কাজ। কিন্তু একে রুখে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। এখানে পাহাড় থেকে প্রভাবশালীদের মাটি সংগ্রহ নিয়মে পরিণত হয়েছে।

আমাদের পাহাড় থেকে মাটি কাটার বিষয়টি ভিডিও করতে হবে। পরে জনগণের প্রতিক্রিয়া নিতে হবে। যা আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হবে।

প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে ভূমিদস্যুদের থাবায় প্রাণ হারাচ্ছে নদী ও খাল। দখল হচ্ছে ভূমি, উজাড় হচ্ছে বন, পাহাড় হচ্ছে ধ্বংস। যা আমরা নীরবে দেখে যাচ্ছি। কিন্তু জুয়েলের পরিকল্পনাটি আমার ভালো লেগেছে। এমন মহৎ কাজে ঝুঁকি থাকলেও রাজি হলাম। কারণ এর মাধ্যমেও তো দেশের জন্য কাজ করা যায়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ যদি প্রাণ দিতে পারে, তাহলে আমি এ সামান্য ঝুঁকি নিতে পারব না কেন!

পাহাড় নীরবে কাঁদছে। এর স্বাভাবিক জীবন আজ বিপন্ন। হুমকিতে অস্তিত্ব। ভাবা যায়, মানুষ কত আগ্রাসী? পাহাড় তার বিশালতা, উদারতা দেখালেও আজ পরাস্ত। মানুষের কাছে সে অসহায়। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে!

মনিরা, জুয়েল, মামুন এবং আমি মিলে দারুণ টিমওয়ার্ক করলাম। এলাকার সাধারণ জনগণও এর একটি সমাধান চান। কিন্তু তারা ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। আসলে মানুষের বিবেক আছে। মানুষ অনৈতিক কাজকে কখনো সমর্থন করতে পারে না।

রাত-দিন পরিশ্রম করে আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পরিকল্পনা করছি। গোপনে ভিডিও ধারণ করতে পাহাড়ে দীর্ঘসময় কাটাতে হয়েছে। তবে বিশ্বাস একটাই- আমাদের ডকুমেন্টরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারলে একটি সমাধান আসবে। পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হবেন। প্রশাসন গণআন্দোলনের ভয়ে মাঠে নামবে। ভূমিদস্যুরা ভীত হবে। রক্ষা পাবে পাহাড়, খুঁজে পাবে মানুষের মহানুভবতা।

জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এমন বিষয়কে নীরবে মেনে নেয়! তাদের সাহসী ভূমিকা সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে যথেষ্ট। কিন্তু তাদের নীরবতা অন্যদের অন্যায় কাজের সুযোগ করে দেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন