কবিতা লিখতে না পারার দীর্ঘশ্বাসে ‘অক্ষম গদ্য’
কানায় কানায় পূর্ণ বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন। মঞ্চ ফাঁকা তবুও শনিবার বিকেল চারটার আগে থেকেই ভর্তি হতে শুরু করে মিলনায়তন। লক্ষ্য একটাই- পৌনে ৬টার অনুষ্ঠান ‘কথোপকথনে শীর্ষেন্দু মখোপাধ্যায়’। ধীরে ধীরে তিল ধারণের জায়গা নেই! কার্পেটের উপরেও বসা শুরু করলেন অনেকে।
আয়োজকরাও রসিক! ঢাকা লিট ফেস্টের সমাপনী অনুষ্ঠান হলো এরই মধ্যে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পরের বারও থাকতে চেয়ে অষ্টম আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এরপর তিনিও দর্শক সারিতে গিয়ে বসলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আলোচনা শোনার জন্য।
এদিকে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকা দর্শকদের যেন তর সইছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণ ফিরে পেলেন তারা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মঞ্চে হাজির হলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। শুরুতেই উপস্থাপক লেখকের বয়স নিয়ে বেশ হাস্যরস করলেন। এ মাসেই ৮৩-তে পা দিয়েছেন শীর্ষেন্দু। কিন্তু ইমদাদুল হক মিলন বললেন, ‘আমরা যেন ওটাকে উল্টো করে ৩৮ বলি!’
এরপর শুরু হলো মূল আলোচনা। হলভর্তি দর্শক নিশ্চুপ, কেবল শুনে যাচ্ছেন কথা। ইমদাদুল হক মিলন বললেন, ‘আমি শীর্ষেন্দু দাকে পাঁচ টুকরো করতে চাই’। মানে তার জীবনকে পাঁচভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে চান তিনি।
শুরুতেই এলো শিশুসাহিত্যের প্রসঙ্গ। লেখক জানালেন, জোর করেই তার দ্বারা শিশুসাহিত্য লিখিয়ে নিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। সেই থেকে শুরু আর চলছে এখনও। ভূতে ভয় থেকেই তিনি ভূতগুলোকে মজাদার করে উপস্থাপন করেছেন।
খেলা প্রসঙ্গ এলে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ হলে তিনি এগারো জন বাঙালি না এগারো জন ভারতীয়, কার পক্ষ নেবেন- এমন প্রশ্নে একবার আনন্দবাজারকে শীর্ষেন্দু বলেছিলেন, ‘ভারত জিতলে আমি হাততালি দেব আর বাংলাদেশ জিতলে মন থেকে খুশি হবো।’ এখনও রাত জেগে খেলা দেখেন তিনি। আর খেলা নিয়েও লিখেছেন। মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে নিজের লেখা প্রসঙ্গেও অনেক কথা বললেন তিনি। আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে মোহাম্মদ আলী মুসলমান হয়েছেন এটাও জানালেন।
> আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ দর্শন
এরই ফাঁকে এলো কবিতার প্রসঙ্গ। তার অপর দুই বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে অনেক কথা বললেন তিনি। উপস্থাপকের কথায় আরও জানালেন, সুনীল ও শক্তিকে উসকে দিয়ে নানা কথা বের করে লিখেছিলেন তিনি। যা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।
এসময় নিজে কবি হতে না পারাল দুঃখও প্রকাশ করেন শীর্ষেন্দু মখোপাধ্যায়। বলেন, ‘কবিতা লিখতে না পারার দীর্ঘশ্বাসই আমার ‘অক্ষম গদ্যে’ প্রকাশিত হয়েছে।’
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উপন্যাসটিতে অনেক লজিকের অভাব আছে কিন্তু ম্যাজিক অব স্টোরি টেলিং এটাকে পাঠকপ্রিয় করেছে। যার ফলে শতবছর পেরিয়েও আমরা তা পড়েই চলেছি। শরৎচন্দ্র দেবদাসের জন্য দু’ফোটা অশ্রু ফেলতে বললেও আমরা সমানে অশ্রু বিসর্জন করে যাচ্ছি।’
নিজের ভ্রমণ সাহিত্য প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন দিয়ে শুরু করেছিলাম। ওখানে এখন অনেকেই যায়, তাই বাঙাল মানে বোকার আমেরিকা দর্শন নিয়েই লিখেছিলাম।’
এবার শীর্ষেন্দু তাঁর গল্প লেখার গল্প বলেন। তিনি বলেন, ‘এক লেখক বন্ধুর পরামর্শে প্রথমবার অনেক আশা নিয়ে গল্প লিখে ছাপানোর জন্য জমা দিয়েছিলাম। যেটাকে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সেরা গল্প! কিন্তু সেটা ছাপেনি! পরের বারও একই অবস্থা। বারবার লেখা ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল। তৃতীয়বার আরেকটা লিখে জমা দিলে সেটা ছাপে (জলতরঙ্গ)।’ এর ফলেই লেখালেখি চালিয়ে যান বলেও জানান তিনি।
নিজের প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু বলেন, ‘বেশি কিছু জানি না। এখান-ওখান থেকে শব্দ এনে লিখি। মনের মতো একটা শব্দ পেয়ে গেলে তা নিয়েই লেখা শুরু করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এতকিছু লিখে ফেললাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যে লেখক এটা ভুলে যাই। রাস্তায় কোথাও গণ্ডগোল হলে দাঁড়িয়ে হা করে দেখি। মোবাইলের দোকানে গিয়ে অবাক হয়ে দেখতে থাকি। কত কী মানুষ বানাচ্ছে।’
> আরও পড়ুন- বিশ্বমঞ্চে বাংলা কবিতা
পুরো অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে রাখেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। তিনি বলেন, ‘শীর্ষেন্দু দা আমি আপনাকে পড়ার চেষ্টা করেছি।’ কিন্তু তার সেই ‘শীর্ষেন্দু পড়া’ যে কত ব্যাপক তা দর্শক সহজেই বুঝতে পারে।
এরপর আসে প্রশ্নোত্তর পর্ব। রাজশাহীর তানি থেকে নাম না বলা ঢাকার ছেলে কতজনই প্রশ্ন করেন প্রিয় লেখককে কাছে পেয়ে। অনেকেই প্রশ্নের খেই হারিয়ে ফেলেন। তাদেরকে ‘বিস্মিত বোকা’ মনে হয়। কেউ লেখককে প্রশ্ন করেন, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’ কেউ আবার বলেন, ‘ঢাকায় (বাংলাদেশে) আপনার বাড়ি কোথায়?’
হালকা প্রশ্নের পাশাপাশি রাশভারি প্রশ্ন করেন অনেকে। একজন বলেন, ‘দেশ পত্রিকার সেরা লেখকদের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো লেখকের নাম নেই কেন? আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের যত পড়ি আমাদের লেখকদের কি ওখানে পড়ে?’ শীর্ষেন্দু মিলনকে দেখিয়ে বলেন, ‘কেন মিলনকে তো দেখি ভালোই পড়ে।’
শীর্ষেন্দু আরও জানান, তিনিও এখন ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখেন। ছোট ছোট নাটকগুলো তার বেশ ভালো লাগে।
দর্শক যেন ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে। কিন্তু কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘আমি যতই বলি শীর্ষেন্দু দা’র বয়স ৩৮ কিন্তু তার বয়স ৮৩ এটা বুঝতে হবে। তিনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমরা তাকে আবারও পাবো এই প্রত্যাশায় আজ শেষ করছি।’
এসএইচএস/বিএ/এসইউ/এমএস