রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা : দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট
মানবজীবনের অত্যন্ত মৌলিক তথা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হল মৃত্যু। মানুষ বাদে অন্যকোনো প্রাণী মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে এমন নজীর নেই। মৃত্যুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম এমনকি বিজ্ঞানও। মৃত্যু স্থান-কাল ভেদে সব মানুষকে ভাবায় এবং সত্যিকারার্থে পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া ভার, যারা মৃত্যু নিয়ে ভাবেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কাব্যিক এমনকি দার্শনিক ঢঙে সমগ্র জীবনব্যাপী মানবজীবনের নানাদিক নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে তা প্রকাশও করছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, তাঁর এই মৃত্যুচিন্তা নানারকম দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ। বলতে গেলে অনেকটা মিশ্র।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপনিষদিক ভাবনার একান্ত বরপুত্র। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, তাঁর সব চিন্তার মাঝে লুকিয়ে আছে উপনিষদিক দর্শনের মর্মবাণী- ‘ইশা বাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগতাং জগত’ (এই গতিশীল বিশ্বে যাহা কিছু চলমান বস্তু আছে তাহা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করিবে)। কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ এবং গানের ভেতর প্রকাশিত হয়েছে এই দর্শনের অন্তর্গূঢ় রহস্য। অর্থাৎ চিন্তার সব অংশের মাঝে তিনি ছিলেন ঋজু, যার মর্মার্থ গিয়ে পৌঁছেছে বেদান্তের মর্মমূলে। মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছেন একান্তে, গ্রহণ করেছেন বন্ধুরূপে, ভেবেছেন একান্ত সখা ও প্রেমিক হিসেবে। আবার কোন সময় মৃত্যুকে বলেছেন অতি নিচ, অনুদার, সর্বগ্রাসী এবং স্বার্থপর। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর জীবন-শেষের উপলব্ধি যা দার্শনিক সংশয়ী চিন্তায় পরিপূর্ণ, অনেকটা অস্পষ্ট, দ্বিধাযুক্ত এবং পরিশ্রান্ত পথিকের ন্যায় বেশখানিকটা উদাসী। আমরা এখানে তাঁর চিন্তার একটি রেখাচিত্র তুলে ধরবো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যমানস অতি শৈশব থেকে প্রলম্বিত হয়েছে জীবনের নানাভাগে এবং সেটা কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের বিভিন্ন খাঁজে আটকে গেছে কিছুকাল। তারপর আবার সেখান থেকে উদগত হয়েছে নতুন চিন্তার বীজ নিয়ে। পৌঁছেছে সীমা থেকে অসীমে, ভূমি থেকে ভূমায় আর কাব্য থেকে দর্শনে। এক নিরন্তর পরিক্রমায় নব উচ্ছ্বাসের যাত্রী রবীন্দ্রনাথ তাই একজন সুদূরের পিয়াসী। তবে এক এবং অদ্বিতীয় সত্তার প্রতি একান্ত নিবেদনে তিনি সমর্পণ করেছেন সব ভাবনাকে, সব রসের ধারাকে। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছেন, ‘প্রাচীন পারস্য মতে এ-জগৎ শুভাশুভ শক্তিদ্বয়ের দ্বন্দ্বক্ষেত্র, মানুষকে তারা আহ্বান করেছিলেন শুভ দেবতার পক্ষে এই সৃষ্টিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন– ব্রহ্মের কঠোর তপস্যা এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে জড় থেকে প্রাণ ও মনের দিকে, অশুভ থেকে শুভের দিকে, অপূর্ণ থেকে পূর্ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’ (পৃ.২৭)। কাজেই মনে রাখতে হবে, সৃষ্টি সবসময় উদ্দেশ্যমূলক, পরিণতিমূলক, ঐক্য ও সমন্বয় কেন্দ্রিক। কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, নয় যাদৃচ্ছিক ও ইতর বিশেষ। তাই তো বলতে শুনি, ‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।’
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে তিনি মৃত্যুকে বলছেন, ‘মরণ রে/ শ্যাম তোঁহারই নাম। চির বিসরল যব নিরদয় মাধব/ তুঁহু ন ভইবি মোয় বাম/ আকুল রাধা–রিঝ অতি জরজর,/ ঝরই নয়ন– দউ অনুক্ষণ ঝরঝর/ তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,/ তুঁহু মম তাপ ঘুচাও।/ মরণ তু আও রে আও।।’ মরণ শ্যামের মত উদার, প্রেমিকের মত বন্ধু যিনি বিরহাতুর রাধার পথ প্রদর্শক এবং ক্ষুব্ধ, ঝঞ্ঝাপূর্ণ বিজন পথে অভিসারের প্রেমিকাকে প্রণয়ক্ষণের সাহস সঞ্চারক। তাই তো ভানুসিংহ বলছেন, ‘ছিয়ে ছিয়ে রাধা,/ চঞ্চল হৃদয় তোহারি--/ মাধব পহু মম, পিয় স মরণ সে। অব তুঁহু দেখ বিচারি।’ মৃত্যুর আগে ভাবতে হবে জন্ম নিয়ে। কেননা জন্ম আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে মৃত্যুর স্বাদ নিতে, জীবনের সব পর্বের প্রসাদ গ্রহণ করার এক অনবদ্য ও বিরল সুযোগ করে দিতে আর ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে বস্তুনিচয়ের ওপর নানা রঙের চিন্তার জাল ফেলাতে।
> আরও পড়ুন- হুমায়ূন ভক্তি-বিরক্তি ও বন্দনা
জীবনের সিংহদ্বার দিয়ে আমাদের প্রবেশ হয়তো অনেকটা অনাহূতের মতো। পরিচয়হীন আগন্তুকের মতো অতি সন্তর্পণে শুরু হয়েছিলো এ যাত্রা, কোন এক শক্তি এ বিপুল রহস্যের মাঝে আমাকে নিক্ষেপ করেছিলো অর্ধরাতে মহা অরণ্যে মুকুলের মতো। ‘নৈবেদ্য’র ‘জন্ম’ কবিতায় কবি তাই লিখেছেন, ‘যখনি নয়ন মেলি নিরখিনু ধরা/ কনককিরণ- গাঁথা নীলাম্বর–পরা, নিরখিনু সুখে দুখে খচিত সংসার—তখনি অজ্ঞাত এই রহস্য অপার।’ আগেই বলা হয়েছে, জগত সম্পর্কে কবির প্রাথমিক উপলব্ধি ছিল অনেকটা পরিষ্কার, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্ফটিক ধারণার ওপর মেঘ জমতে থাকে। এক অস্পষ্টতা ঘিরে ধরে জগতের বিশালত্ব আর না-মেলা কিছু প্রশ্ন। তবে এটা ঠিক- পরক্ষণেই তিনি ‘মৃত্যু’ কবিতায় এক ভিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, লিখেছেন— মৃত্যু অজ্ঞাত, তার চিন্তায় শরীর শিহরিয়া ওঠে, ভয়ে বুক ওঠে কেঁপে, সংসার থেকে বিদায় নিতে চোখে জল আসে, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। দুই বাহু দিয়ে এ বিদায়কে রুখে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই জীবন সংসার তো ক্ষণিকের। শুধু অকারণ পুলকে ক্ষণিকের গান গাওয়া ছাড়া আর বুঝি কিছু নয়। তবে মৃত্যু যেন মৃত্যু নয়, মায়ের এক স্তন থেকে অন্য স্তনে শিশুকে স্থানান্তর করলে কিছুটা অস্বস্তিবোধ জন্মে, অনুভূত হয় সাময়িক বেদনা। কিন্তু ‘মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে’। সম্ভবত জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের মুহূর্তটা এমনি অস্বস্তিকর। মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেন এ কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘অর্জুন, তুমি আমি সহস্র বছর ধরে জন্ম মৃত্যুর এই ধারাবাহিক শেকলের মাঝে আছি, পার্থক্য হোল, তুমি সেটা স্মরণ করতে পার না, আমি পারি’।
‘জন্ম ও মরণ’ কবিতায় কবির অনুভূতি আরেকটু ভিন্ন। শূন্য হাতে শুধু কান্না সম্বল করে আচমকা এক পথিকের অজানিত এক মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা সেই পথিক ধীরে ধীরে স্থান করে নেয় নিজের, নব নব গীতে, নব উচ্ছ্বাসে নিজেকে বিস্তৃত করে চলে নতুন প্রেমের টানে। অর্থাৎ ‘প্রেম-আকর্ষণে/ যত গুঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে/ উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে,/ বাহিরে আসিবে ছুটি—অন্তহীন প্রাণে/ নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে/ নব নব জীবনের গন্ধ যাবো রেখে/ নব নব বিকাশের বর্ণ যাবো এঁকে।’ কবির এহেন অনুভূতি অনেকটা অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তাবিদের ন্যায়। মানুষের প্রথম আবির্ভাবে মনটা থাকে অলিখিত এক সাদা কাগজের মতো, দিনে দিনে সেখানে লেখা হয় নতুন অভিজ্ঞতার নানারকম প্রয়াস। এখানে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তথা প্রয়োজনীয় কাজের কথা।
তবে মৃত্যুকে সবথেকে বেশি বন্ধুরূপে আলিঙ্গন করেছেন ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায়। তিনি মৃত্যুভয় কাটিয়ে উঠেছেন, তাকে দূর থেকে যতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় মনে হয়েছে- কাছে আসার পর সে অহেতুক ভয় ভেঙে গেছে। আসলে মৃত্যু কিছুতেই ‘আমার’ থেকে বড় নয়, ‘আমি মৃত্যুর-চেয়ে বড়’ এই উপলব্ধি কবিকে সান্ত্বনা দিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি, প্রত্যহ ভয়ের শাসনে কুঞ্চিত, শুধু আমিই নয়, পৃথিবী তার শাসনের বিভীষিকায় কম্পিত, কিন্তু বজ্রপাতের সময় যতটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তারপর সবকিছু হয়ে উঠে শান্ত নিমিষে। তিনি লিখেছেন, ‘এইমাত্র? আর-কিছু নয়? ভেঙে গেলো ভয়/ যখন উদ্যত ছিল তোমার অশনি/ তোমারে আমার চেয়ে বড় বলে নিয়েছিনু গণি/ ‘আমি মৃত্যু–চেয়ে বড়’ এই শেষ কথা ব’লে/ যাব আমি চলে।’ ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতায় কবি মৃত্যুকে সব শান্তির আশ্রয় হিসেবে মনে করেছেন। মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক। জীবনের সব ভ্রান্তির অবসান, সব তর্কের শেষ, সব কামনার পূর্ণ তৃপ্তি। ‘সব তর্ক হোক শেষ-/ সব রাগ সব দ্বেষ,/ সকল বালাই/ বলো শান্তি, বলো শান্তি,/ দেহ-সাথে সব ক্লান্তি/ পুড়ে হোক ছাই’।
তবে পত্রপুট কাব্যের ‘পৃথিবী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নির্মোহ পরিব্রাজকের ন্যায় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এক চিত্র এঁকেছেন মানবজীবনের। এটি ১৯৩৫ সালে লেখা। কাজেই পরিণত কবি সারা জীবনের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তার এক অনিন্দ্যসুন্দর চিত্র এঁকেছেন দক্ষ কালির আঁচড়ে। তাই এই কবিতাটা হয়ে উঠেছে এক মহাকাব্য। পৃথিবী ও আমি- এর মাঝে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, মিলন, প্রেম, বিরহ, কর্তব্য, স্বপ্ন, কর্মধারা ও পরিণতি নিয়ে এক নতুন ছবি এঁকেছেন তিনি। এ যেন চিত্রপটে আঁকা এক দক্ষ শিল্পীর ক্যানভাস। যেখানে ফুটে উঠেছে পৃথিবী নামক এক গ্রহের মহাপরিক্রমা। পৃথিবী যেন এক রহস্যে আবৃত মহাস্থান যার প্রকৃতি নারী-পুরুষের মিশ্রণ। ডান হাত তার পূর্ণ সুধায়, বাম হাত ধ্বংসের। তার যাত্রা হয়েছে বড্ড অশৈল্পিকভাবে, কেননা সে ছিটকে পড়েছে মহাশূন্যে কোন এক অযুত-নিযুত বছর আগের অজানা ক্ষণে। কিন্তু সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে তার ওপর পড়েছে শিল্পের ছোঁয়া, নেমে এসেছে প্রাণের যাত্রা। শুরু হয়েছে এক অভিনব প্রাণের লীলা। যখন সে অন্নপূর্ণা; তখন সুন্দরী, আবার কখনও সে অন্নরিক্তা ভীষণা। ঋতু পরিক্রমায় কখনও নিষ্ঠুর, ধ্বংসাত্মক, হিংস্র আবার কখনও প্রণয়ীর মতো শান্ত, বন্ধুর মতো আপন। কবির অভিব্যক্তি তাই গভীরভাবে প্রলম্বিত হয়েছে বিশ্বভূমিতে। ‘পৃথিবী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে স্থান দিয়েছেন অজস্র ধূলিকণার মতো একটা ছোট্ট বিন্দুবৎ জায়গায়। প্রণতি জানিয়েছেন তার নির্মম পদপ্রান্তে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো- এখানে কবি মৃত্যু, জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিণতি ইত্যাদির থেকে অনেক দূরে। অনেকটা বস্তুবাদীর মতো নিরুত্তাপ, অনেকটা নির্মোহ পথিকের ন্যায় আশাহীন। মৃত্যু যেন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ এটা স্বাভাবিক। এটা অন্যান্য জড়ের মতো সফল পরিণতিতে এর সমাপ্তি।
> আরও পড়ুন- নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় প্রেম
অন্যদিকে স্পষ্ট রবীন্দ্রনাথ যেন আস্তে আস্তে অস্পষ্টতার কুয়াশায় নিজেকে ঢেকে ফেলেছেন জীবন সায়াহ্নে। কঠোর বাঁধ যেন ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করেছে কাল পরিক্রমায়। বিশ্বাসের ইস্পাতসম দেয়াল ক্রমে ক্রমে ক্ষয়ে গেছে সংশয়ের তীব্র আঘাতে। ‘শেষলেখা’-তে তাই তাকে চিনতে একটু হোচট খেতে হয়। প্রথম কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নতুন আবির্ভাবে-/ কে তুমি।/ মেলেনি উত্তর।/ বৎসর বৎসর চলে গেল,/ দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-/ কে তুমি।/ পেল না উত্তর।’ প্রথম দিনের সূর্যকে যদি আমরা জ্ঞানের আলো হিসেবে তুলনা করি তাহলে স্বভাবত প্রশ্ন আসে, পরম সত্তা কে? সেটাই ছিল মানুষের আদি জিজ্ঞাসা, মূল প্রশ্ন। কিন্তু হতাশার কথা হলো, অনন্তকাল পর সেই প্রশ্ন আবার দেখা দিলো, কে তুমি? উত্তর না মেলাটাই স্বাভাবিক। কারণ এ প্রশ্নের হয়তো উত্তর হয় না। উত্তর নেই। এখানে বিরাট একটি দার্শনিক প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে, সত্তা ও আবির্ভাবের চির দ্বন্দ্ব। আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছেন, ‘তবে কি প্রশ্ন করা হ’লো নতুন আবির্ভাবকেই– ‘আবির্ভাব’ অর্থ আবির্ভাব কালে নয়, আবির্ভাবকে? সত্তা এবং আবির্ভাব, এই দ্বৈতের কথা তোলা হয়েছে তাহ’লে।’ খুব সম্ভবত কবি একটি দ্বন্দ্বের ভেতর নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি জীবনকে পবিত্র বললেও তার স্বরূপকে বলেছেন অভাব্য। কোন অজ্ঞেয় রহস্য হতে এর আগমন, তার কূল-কিনারা পাওয়া মোটেও সহজ নয়। এ যেন কিছুতেই না-মেলা এক প্রশ্ন।
১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই তিনি সর্বশেষ লেখাতে সেই অজানিত প্রশ্নকেই রেখে গেলেন মানুষের চিন্তার দুয়ারে। তিনি বললেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী’। সৃষ্টির এই পথ ভীষণ অজানা, কেননা এক বিরাট দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি জগতের প্রতিটা মানুষ, আসলে জীবনের অর্থ কী? কী আছে পথের শেষে। এর শেষ কোথায়? ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথকে এজন্যই পৃথিবীর অন্যতম এক দার্শনিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। জ্যা-পল-সার্ত বলেছেন, ‘মানুষ শূন্যতায় বিশ্বাস করে না। কেবল তার সংশয় তাকে নাস্তিকতা থেকে রক্ষা করে।’ অন্যদিকে বিজ্ঞানী কার্ল সাইগন বলছেন, ‘সত্য অনেক সময় বিভ্রান্তিকর। এটা কিছু কাজকে আঁকড়ে ধরতে অনুপ্রাণিত করে, এটা হতে পারে স্বজ্ঞাবিরোধী, হতে পারে এটা গভীরভাবে সংস্কার বিরোধী। আমরা যেটাকে তীব্রভাবে সত্য বলে গ্রহণ করছি, তা অনেক সময় না-ও হতে পারে। আদতে আমাদের কর্মধারা ঠিক করতে পারে না কোনটা প্রকৃত সত্য।’ স্বাভাবিকভাবে বলা সংগত হবে যে, সংশয় জ্ঞানের পরিবর্ধক। সংশয়ী মানুষই জ্ঞানের ধারক। রবীন্দ্রনাথ বুঝি শেষ বেলায় সেটাই গ্রহণ করলেন।
তবে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু নিয়ে এক গভীর আপাত বিরোধী চিন্তার মুখোমুখি হয়েছেন। সারাজীবন প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয়েছেন। ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে কলম ধরেছেন। কিন্তু কোন মৃত্যু তাকে থামাতে পারেনি। তাই তিনি যথার্থই লিখেছেন, ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রব তারা।/ মন রে মোর, পাথারে হোসনে দিশেহারা/ বিষাদে হয়ে ম্রিয়মান বন্ধ না করিও গান, সফল করি তোল প্রাণ টূটিয়া মোহকারা।’
কবির মৃত্যু ভাবনার সাথে তাঁর সর্বেশ্বরবাদী দার্শনিক বোধের একটি নিবিড় যোগসূত্র আছে। আগেই যেমনটি বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন বেদান্তের ফসল, এক এবং অদ্বৈত চিন্তার ধারক। কাজেই জগতের সব প্রপঞ্চের মাঝে তিনি খুঁজে ফিরেছেন সম্পর্কের অন্ত্যমিল। খুঁজে পেয়েছেন এক বিচিত্র ঐক্য। কাজেই জন্ম-মৃত্যু যেন এক সূত্রে গাঁথা এক অভিন্ন চেতনার নাম। তবে তিনি এই দুর্লভ জন্মকে মূল্য দিয়েছেন, অর্থবহ করে তুলেছেন এর প্রতিটি স্পর্শ। সংগত কারণে তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি/ এ ভালবাসাই সত্য, এ জন্মের দান/ বিদায় নেবার কালে/ এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যরে/ করিবে অস্বীকার’।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/জেআইএম