নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় প্রেম
জগতে প্রেম অনিবার্য। প্রেমহীন পৃথিবী তাই নরকের মতোই। যুগ যুগ ধরে প্রেমের আরাধনা করে আসছে প্রাণিকূল। সে যাত্রায় বাদ পড়েননি কবি-সাহিত্যিকগণও। বরং সাহিত্যে প্রেম হয়ে উঠেছে উচ্চকিত। কবির কলমে তাই লেখা হয়েছে প্রেমের অমর বাণী। তাই তো কবি মানেই প্রেম। প্রেম মানেই কবিতা। প্রেমের প্রথম পাঠ আসে এই কবিতা থেকেই। বা প্রেমে পড়ে প্রত্যেকেই কবিতা আওড়ান।
নির্মলেন্দু গুণকে বলা হয় আধুনিক কবিতার প্রাণপুরুষ। কবিতায় প্রেমের পথে হেঁটেছেন তিনিও। সমকালীন প্রেমিক-প্রেমিকার মুখে মুখে উচ্চারিত হয় তার কবিতা। চরণে চরণে প্রচারিত হয় প্রেমের মহত্ব। ‘প্রেমের কবিতা’ শিরোনামে তার একটি বইও প্রকাশিত হয়। কবিতায় প্রেম সম্পর্কে কবি বলেন, ‘আমি কিভাবে নারীর ভিতর দিয়ে প্রকৃতির কাছে এবং প্রকৃতির ভিতর দিয়ে নারীর কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলাম, আমার কাব্যোপলব্ধিতে নারী ও প্রকৃতি মিলিমিশে কিভাবে একটি অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছিল, এ বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে।’
নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমের কবিতা’ মানেই মনের মধ্যে উথাল-পাতাল ঢেউ। হৃদয়জুড়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে প্রেয়সীর ঠোঁটে চুমু খাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কবিতার ঘোরে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকা কয়েক ঘণ্টা। কবির একেকটি প্রেমের কবিতা একেকটি আকাঙ্ক্ষার নাম। যে আকাঙ্ক্ষা গোগ্রাসে গিলে খায় একের পর এক অমীয় কবিতার পাতা।
সমকালীন শক্তিমান কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা পড়ে বোঝা যায়, নারী ও প্রকৃতি একে অন্যের পরিপূরক। জীবনানন্দ দাশের মতো কবি নির্মলেন্দু গুণ মানুষ ও উদ্ভিদজগতকে একটি সজীব অনুভূতিতে একাকার করে দেখেছেন। এই বিশিষ্টতাই তার প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতায় ফুটে উঠেছে।
কবির প্রেম শুধু নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কখনো কখনো দেশ, সংগ্রাম, সমাজ, বিশ্বকেও প্রেমের বাঁধনে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন। ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতায় তাই তো তিনি বলেন-
‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’
তার বহুল আলোচিত ‘হুলিয়া’ কবিতায়ও আমরা প্রেমের ছোঁয়া পাই। বিপ্লবের অগ্নিকে ছাপিয়ে সেখানে ভালোবাসার শীতলতা লক্ষ করা যায়। কবি বলেন-
‘একসময়ে কী ভীষণ ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়।
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম।’
কবির প্রেম মাঝে মাঝে প্রকৃতিকেন্দ্রিক। মানুষ এবং প্রকৃতিকে তিনি কখনোই আলাদা করে দেখেননি। প্রকৃতির মাঝেই তিনি খুঁজেছেন প্রেম। তার আকাশ সিরিজের কবিতাগুলোয় তেমনটিই ফুটে ওঠে। কবি বলেন-
‘শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।
শুধু একবার তোমাকে ছোঁব,
তারপর হবো ইতিহাস।’
যুদ্ধের মতো একটি কঠিনতম বিষয়েও তিনি ভালোবাসাকে মহান করেছেন। ‘যুদ্ধ’ শিরোনামের কবিতাটিতে তিনি প্রিয়জনের উদ্দেশে বলেছেন-
‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা।’
কিংবা রাষ্ট্রীয় বিড়ম্বনায়ও তার প্রেম চুপসে যায় না। সামরিক শাসনের মাঝেও তিনি ভালোবাসার বীজ বপন করতে পারেন। কবি বলেন-
‘সামরিক কায়দায় রাষ্ট্রপতি যেমন
সাভার স্মৃতিসৌধে স্থাপন করেন
তাজা ফুলে সাজানো পুষ্পস্তবক :
আমিও তেমনি তোমার নিমীলিত
চোখে চুম্বন-স্তবক স্থাপন করে
এই দেশ ছেড়ে দূরে চলে যাবো।’
এছাড়াও নির্মলেন্দু গুণের বেশকিছু কবিতা প্রেমের অমর কাব্য হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবে। সেগুলোর মধ্যে- ‘শুধু তোমার জন্য’, ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?’, ‘যাত্রাভঙ্গ’, ‘ওটা কিছু নয়’, ‘মাছি’, ‘আসমানী প্রেম’, ‘তুলনামূলক হাত’, ‘মানুষ’, ‘মোনালিসা’, ‘ফুলদানি’, ‘টেলিফোনে প্রস্তাব’, ‘এবারই প্রথম তুমি’, ‘এপিটাফ’, ‘উল্টোরথ’, ‘উপেক্ষা’, ‘আমি চলে যাচ্ছি’, ‘পতিগৃহে পুরোনো প্রেমিক’, ‘পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু’, ‘আবার যখনই দেখা হবে’ উল্লেখযোগ্য।
কবির পুরো নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। তিনি ১৯৪৫ সালের ২১ জুন নেত্রকোনার বারহাট্টায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এ পর্যন্ত বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
শুভ জন্মদিনে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তাকে অশেষ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।
এসইউ/পিআর