‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা’
আবেগের ঋতু, কবিতার ঋতু বর্ষা। বাঙালির আবেগপ্রবণ মন এই বর্ষায় আরো বেশি বিগলিত হয়। মনের অজান্তেই গেয়ে উঠে ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ বর্ষায় অভ্যস্ত পরিচিত সংসার হতে বিক্ষিপ্ত হয়ে মন বাইরের দিকে যেতে চায়।‘মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে, নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে। রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।’
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘আমরা সম্পন্ন গৃহস্থটি হইয়া আরামে সন্তোষে অর্ধনিমিত লোচনে যে গৃহটুকুর মধ্যে বাস করিতে ছিলাম। কালিদাসের মেঘ ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ হঠাৎ আসিয়া আমাদিগকে ঘরছাড়া করিয়া দিল।’ কালিদাসের মেঘদূত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এ উক্তি তার নিজের বেলায়ও প্রযোজ্য।
বর্ষায় বাঙালির চির সংবেদনশীল মন রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ছাড়া একেবারে রুক্ষ শুষ্ক। গীত বিতানের বৃষ্টির সুবাসিত বর্ষার গান ছাড়া বর্ষা যেন কালিদাসের মেঘহীন মেঘদূত। মন এতটুকু চলতে চায় না অথচ বৃষ্টি এলেই পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল মনটা ছুটে বেড়ায় দিগদিগন্তে। যেখানে চেনা নেই জানা নেই সেখানেও মন ছুটে চলে যায় মেঘে সওয়ারী হয়ে।
গীত বিতানের বর্ষার গানে কবি বর্ষাকে আবাহন করেছেন শ্যামল সুন্দর বলে। তাপ শুষ্ক পৃথিবীকে সুধারসে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। যেখানে বিরহী হৃদয় চাতক পাখির ধেয়ান নিয়ে চেয়ে আছে আকাশে। বিছিয়ে দিয়েছে তার ব্যথিত হৃদয়। তমাল কুঞ্জপথে সজল ছায়াতে। নয়নে করুণ রাগ-রাগিণী জাগিয়ে। বকুল ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে আগন্তক বসে আছে। কখন মিলনের বাঁশি বাজবে তার জন্য।
গীত বিতানে কখনও বর্ষা আসে নব সৌরভে নব হরষে।
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে
ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
নতুন বর্ষা এসেছে আকাশ জুড়ে। এসেছে ভুবন ভরসা। বাতাসে বন বীথিকা দুলছে। যেন শত যুগের কবিদলে মিলে আকাশে ধ্বনি তুলছে শতেক যুগের। তার জন্যই গীতি মুখরিত হয়েছে বনদল।
মেঘকে তুলনা করা হয়েছে প্রেয়সীর কাজল কালো চোখের সঙ্গে।
হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সেই সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।
করুণা মাখা অধর মিনতির বেদনা এঁকে নীরবে চেয়ে থাকে বিদায় ক্ষণে। ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে বিজলি আঘাত হানে বাতাস পাগল হয় পরাণ পুটে হৃদয় কোণে কার কথা যেন জেগে উঠে।
শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীত যামিনী রে
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
শাল পিয়াল তমাল বনে বাঁশি বাজছে ঘন হয়ে মেঘ আসছে। সখি বল এ দুর্যোগে কোথা গেলে রাধাকে পাওয়া যাবে।
আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে। ফলে পৃথিবী আঁধারে ছেয়ে গেছে। এমন সময় আমায় কেন একলা ঘরের কোণে বসিয়ে রাখ। কাজের দিনে নানা কাজ থাকে। তখন আমি কাজের মাঝেই ডুবে থাকি। কিন্তু আজ আমি তোমারই আশ্বাসে বসে আছি।
তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা।
দূরের পানে আঁখি মেলে চেয়ে থাকি পরান আমার কেঁদে বেড়ায় বৃষ্টিভেজা মিষ্টি বাতাসে কখন আসবে তুমি।
এ গানটিতে আকুল করা প্রেমিকের করুণ আর্তি ফুটে উঠেছে।
যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা
তুমি যেয়ো না,তুমি যেয়ো না,
আমার বাদলের গান হয়নি সারা।
কুটিরে কুটিরে দ্বার বন্ধ। নিভৃত রজনী অন্ধকারে ডুবে আছে ঘুমহীন চঞ্চল বাতাসে কেঁপে উঠছে। দীপ নিবেছে নিবুক। আঁধারেই তোমার পরশ রাখো। তোমার হাতের কাঁকন বেজে উঠুক আমার গানের তালের সাথে।
যেমন-নদীর ছলো ছলো জলে ঝরো ঝরো ঝরো শ্রাবণধারা।
বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।
তোমার মন্ত্রের গুণে পাষাণগলে, ফসল ফলে
মরুভূমি বয়ে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।
কোনো কোনো গানে বর্ষা আর বিরহী হৃদয় মিলে মিশে একাকার। উতল ধারা বৃষ্টি ঝরছে। সকল বেলা একা ঘরে। সজল বাতাসে বেগে বয়ে যায় তারই পরশ লেগে পাগল নদী জেগে ওঠে। আকাশ ঘিরে কাজল কালো মেঘে, তমাল বন আঁধার হয় তাতে। এমন দিনে তুমি কেমন বেশে এলে, আঁচল দিয়ে শুকাব জল পা মুছিয়ে দেব আকুল কেশে। অন্ধকার রাত ক্রমেই নিবিড় হয়ে আসবে। তখন প্রেমের বাতি জ্বেলে দেব।
পরানখানি পেতে দেব। তারপরে চরণ রেখ। জীবন মরণ ভুলে গিয়ে তোমায় বরণ করে নিব। শরম লজ্জার ভয় না করে তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াব। যত বাধা আসে যাবে জ্বলে। সুখ-দুঃখ দেব দলে। ঝড়ের রাতে তোমার সাথে বের হবো অভয়ভরে। উতল ধারা বাদল ঝরে দুয়ার খুলে এল জাগে সকল মনে। তোমার মুখ পানে চাইতে গিয়ে চোখ কেঁপে ওঠে শরমে। বর্ষার গানে মেঘদূতের মতো বৃষ্টিকে প্রাণ দেওয়া হয়েছে। বাদলকে বলা হয়েছে একতারা বাজানিয়া বাউল।
বাদল বাউল বাজায়রে একতারা
সারাবেলা ধরে ঝরো ঝরো ঝরো ধারা।
জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে নেচে হল সারা। জটাধারী বাউলের কেশ যেন কালো মেঘরাজি। পাতায় পাতায় টুপুরটুপুর মধুর নূপুর বাজে। ঘর ছাড়ানো আকুল সুরে পুবের গৃহহারা উদাস হাওয়া বেড়ায় ঘুরে।
‘এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে/এসো কর স্নান নবধারা জলে।’ গানে এভাবেই বৃষ্টিকে আহ্বান করা হয়েছে। আকুল করে দাও ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ, কাজল নয়নে যুথী মালা গলে দিয়ে ছায়াবীথি তলে এসো। ক্ষণে ক্ষণে হাসির রেখা উঠুক সখী। তোমার অধর নয়ন উঠুক চমকি বর্ষার মেঘ মল্লার রাগে ঘন বরিষণে জল কল কলে ছায়াবীথি তলে এসো।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সংলগ্নতার কথা ক’জন অনুভূতিপ্রবণ লেখক বলতে পেরেছেন এমনভাবে রবীন্দ্রনাথের মতোন।
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরান সখা বন্ধু হে আমার ।।
বর্ষা এলে ময়ূর নাচে। কিন্তু মন আজ ময়ূরের মতো নেচে উঠছে। কেননা বর্ষা আজ জাগ্রত দ্বারে। কবি বলেন, হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে...।
নির্জনে বকুল শাখায় আজকে দোলা দিয়ে যায়। ঝরকে ঝরকে বকুল ঝরছে আঁচল আকাশে আকুল হচ্ছে। বিচূর্ণ চুল ওড়ে এসে চোখ ঢেকে দিচ্ছে। চুল খসে পড়ছে খোপা থেকে।
ঝরে ঘন নবধারা নবপল্ল¬বে কাঁপিয়ে কানন ঝিল্লির রবে তীর ছাপিয়ে নদী কল কল করে চলে এল পল্লীর কাছে। তাই হৃদয় আজ ময়ূরের মতো নেচে ওঠে। বৃষ্টির গানে বর্ষার অপরূপ মাধুর্য সম্পর্কে বলেছেন,
আজ বরষায় রূপ হেরি মানবের মাঝে
চলেছে গরাজ চলেছে নিবিড় সাজে।
হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা
ধাইতে ধাইতে লোপ করে সীমা,
কোন তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে
বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।
মেঘের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কবি মানবীয় করে তুলে বলেছেন, বুকের সঙ্গে বুক মিলানো। কবি প্রশ্ন রেখেছেন কোন তাড়নায় এ মহামিলন। সে যে বর্ষার বৃষ্টি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বর্ষার সেই মোহন রূপ এখন অনেকটাই ম্লান। সেই বজ্রবিদ্যুৎ কোথায়? মেঘের দামামা কোথায়? কবি আফসোস করে বলেছেন-‘ছেলেবেলায় বর্ষা যেমন দেখতেম, তেমন ঘনিয়ে বর্ষাও এখন হয় না। বর্ষার তেমন সমারোহ নেই যেন, বর্ষা এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে- নমোনমো করে জল ছিটিয়ে চলে যায়।
কেবল খানিকটা কাদা, খানিকচা ছাঁট, খানিকটা অসুবিধে মাত্র- একখানা ছেঁড়া ছাতা ও চীনে বাজারের জুতোয় বর্ষা কাটানো যায়, কিন্তু আগেককার মতো সে বজ্র-বিদ্যুৎ-বৃষ্টি বাতাসের মাতামাতি দেখি নে। আগেকার বর্ষায় একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল, এখন যেন প্রকৃতির বর্ষার মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাব কিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শংকা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।(বর্ষার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
যায় দিন শ্রাবণ দিন। মন আঁধার করে আসে শঙ্কায়। শিলনের বৃথা প্রত্যাশায় মায়াবী এই সন্ধ্যায়। আসন্ন নির্জন রাতে আমার পথ চাওয়ার ব্যাকুলতা। ফিরে ক্ষ্যাপা হাওয়া গৃহছাড়া ব্যথিত হৃদয় বৃষ্টির মর্মর ছন্দে ভাষা খুঁজে বেড়ায়।
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানিনে জানিনে কিছুতে কেনযে মন লাগে না।
এই চঞ্চল সজল পবন বেগে উদভ্রান্ত মেঘে, মন চায় হংস বলাকার মতো উড়ে বেড়াতে। বর্ষার মেঘমল্লারে সারাদিনমান ঝর্নার গান বেজে ওঠে। তাই মন আজ হারিয়ে যেতে চায় পথ ভুলে। হৃদয় জড়াতে চায় কারে যেন চিরঋণে।
অথবা
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
বর্ষাকে বলা হয় নিষ্প্রয়োজনের ঋতু। কবির ভাষায়, ‘সকল বয়সেরই একটা কাল আছে। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধ্যকের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। ছেলেবেলায় আমরা যেমন গৃহ ভালোবাসি এমন আর কোনো কালেই নয়। বর্ষাকাল ঘরে থাকবার কাল, কল্পনা করবার কাল, গল্প শোনবার কাল, ভাইবোনে মিলে খেলা করবার কাল।’ (বর্ষার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
গীতবিতানের বর্ষার গানগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটা নিবিড় সম্পর্ক রচনা করে দেয়। বর্ষাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কাব্যগাথা দ্বিতীয়টি আর নেই। তাই বর্ষাকে স্বাগত জানাতেই হয়। ‘হে নব ঘনশ্যাম হে শ্যামল সুন্দর। আমরা তোমাকে অভিবাদন করি। এসো এসো জগতের যত অকর্মণ্য, এসো এসো ভাবের ভাবুক, রসের রসিক, আষাঢ়ের মৃদঙ্গ ঐ বেজে উঠল, এসো সমস্ত খেপার দল, তোমাদের নাচের ডাক পড়েছে।
বিশ্বের চিরবিরহ বেদনার অশ্রু-উৎস আজ খুলে গেল, আজ তা আর বাঁধ মানলো না। এসো গো অভিসারিকা, কাজের সংসারে কপাট পড়েছে, হাটের পথে লোক নাই। চকিত বিদ্যুতের আলোকে আজ যাত্রায় বের হবে। জাতীয় পুষ্প সুগন্ধি বনান্ত হতে সজল বাতাসে আহ্বান আসলো কোন ছায়া বিতানে বসে আছে বহু যুগের চির জাগ্রত প্রতীক্ষা।’
এইচআর/জেআইএম