বাবা আছে
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
পুলিশ একাডেমি সারদায় যিনি আমাদের পেপার দিয়ে যেতেন তার নাম ছিল সামাদ চাচা। পুরো নাম আব্দুস সামাদ। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যখন রুমে ফিরতাম, তখন দেখতাম দরজার নিচ দিয়ে পেপারের উপস্থিতি। কিন্তু তার সাথে দেখা হতো না।
একদিন বৃষ্টির সময় ক্লাস থেকে ফিরছিলাম, দোতলায় এক বয়স্ক লোক, দেখি তার হাতে অনেক পেপার পলিথিনে মোড়ানো। বুঝলাম, তিনিই হকার। ঘামে ভেজা শরীর, বয়সের ছাপ কপালের ভাজে স্পষ্ট, পরনের শার্ট বিবর্ণ, রং চলে গেছে সেই কবে। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটানো, অনেক কালের পুরনো।
ঘামের অস্পষ্ট সাদা দাগ তাতে বিচিত্র মানচিত্র তৈরি করেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কাচা পাকা। পরিশ্রান্ত শরীর। বয়স ৫৫ পেঁরিয়েছে বোধ হল। সেদিন কথা বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে পারলাম না।
এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর খাওয়া দাওয়া করে রুমে শুয়ে আছি। দরজার নিচ দিয়ে পেপার আসার শব্দ শুনে, উঠে দরজা খুলে ডাক দিলাম- ‘চাচা’। উনি ফিরে এসে দরজার কাছে দাঁড়ালেন, ‘স্লামালিকুম স্যার’
-ওয়ালাইকুমাস-সালাম। চাচা, ভালো আছেন?
-জি স্যার। আপনাদের দোয়া।
-কী নাম আপনার, বাড়ি কোথায়?
-আব্দুস সামাদ। বাড়ি স্যার এখানেই, সারদা।
-ছেলে মেয়ে?
-২ ছেলে ১ মেয়ে।
-কী করে তারা?
-বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে, এবার অনার্স ফাইনাল দিবে। ছোট ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ১ম বর্ষে পড়ে, আর মেয়েটা এখানেই একটা স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে।
এসব কথাগুলো বলার সময় তার চেহারা চকচক করছিলো। চোখের তারায় মহাবিশ্বের কোন এক প্রান্তে দ্রুত বেগে ছুটে চলা উল্কাপিন্ডের উজ্জ্বলতা চমকে উঠলো। সন্তানের সাফল্যে গর্বিত পিতার বিনয়ী হাসি। বড় বিচিত্র, বড় পবিত্র, বড়ই নিষ্পাপ সেই হাসি।
আমরা কি পেরেছি আমাদের বাবাকে সেই হাসি হাসাতে? বুকের ভেতরটা কেমন জানি হু-হু করে উঠলো। নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, পেপার বিলি ছাড়া আর কিছু করেন?
-তেমন কিছু না স্যার, চাষের একটা জমি আছে। ঐটা আর পেপার বিলি করে যা হয়, তা দিয়ে কোনমতে চলে যায়।
-ছেলেরা কিছু করে না?
- না, স্যার। আমি কিছু করতে দিই না। স্যার, আমি নিজে টাকা পয়সার অভাবে পড়ালেখা কিছুই করতে পারি নাই। আমি বুঝি এর কষ্ট। শুধু দোয়া করবেন স্যার। আমার সন্তানদের লেখাপড়াটা যেন হয়।
তখন মনে পড়ে গেল বাবার কথা। দাদা মারা যাওয়ার পর অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরেছিলেন। নিজে বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেন নাই। আমার চাচা ও ফুফুদের সবাইকে শিক্ষিত করে বিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। শুধু নিজের কথাই ভাবেননি কখনও।
আমাদেরও বলতেন, আমি বেশি পড়তে পারি নাই, এখন যদি তোমরা ভালোমতো না পড়ো, তাহলে আমার সারাজীবনের পরিশ্রম ব্যর্থ হবে। পড়ালেখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন।
একবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে আমার প্রচÐ মাথা ব্যথা উঠলো। মাথাব্যথায় অস্থির। রাত তখন দশটা কি এগারোটা। আমার বাবা পাশে এসে বসলেন আর মাথা টিপতে লাগলেন। বললেন, বাবা আছি। একটু ধৈর্য্য ধর, ব্যথা কমে যাবে। ঘুম না আসা পর্যন্ত মাথায় তার পরম স্নেহের স্পর্শ অনুভব করলাম।
ঘুম ভাঙলো, রাত তখন প্রায় দুটা। পাশে জায়নামাজে সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবা প্রার্থনারত। দু’চোখে বেয়ে আনন্দের অশ্রুবের হয়ে আসল। এই ঘটনার মাস খানেক পরেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চলৎশক্তিহীন ছিলেন দীর্ঘ নয় বছর।
আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার এক মাস আগে তিনি এই রোগে আক্রান্ত হন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডে চেতন অবচেতনের মাঝে কেটে গেছে প্রায় বিশটি দিন।
এর মাঝে একদিন হঠাৎ তিনি বিছানা থেকে উঠে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালালে মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? তিনি বললেন, ছেলের পরীক্ষা না! ওর জন্য নতুন স্কেল, জ্যামিতি বক্স, কলম কিনতে যাই।
তার দু’পা যে অসাড় সে বোধ ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তার কাছে অচেতন হয়ে পড়েছিল। তার সেই অবস্থাতে অবচেতন মনের কোনো জায়গায় আমার পরীক্ষার ব্যাপারটি অক্ষত ছিল। এই ঘটনাটি মনে হলে আজো বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠে।
বাবা আজ নেই। নয় বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু কয়টি রাত জেগে তার জন্য মহান আল্লাহ দরবারে দোয়া করতে পেরেছি। এই সেদিন ফেসবুকে একজন লিখলো তিনি কমলাপুর থেকে মিরপুর ডিওএইচএস যাবেন। সিএনজি চারশত টাকার নিচে যাচ্ছিল না। এক বয়স্ক রিকশাওয়ালা এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, যাবো চলেন, আড়াইশ টাকা দিয়েন।
ভদ্রলোক বললেন, ডিওএইচএস অনেক দূর, পারবেন এত দূর রিকশা নিয়ে যেতে? রিকশাওয়ালা বললেন, সামনে মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষা বাবা, টাকার দরকার। শুনে লোকটি অবাক হয়ে গেল।
বড় মেয়ে খুলনা বিএন কলেজে মাস্টার্স করে সবে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। বড় ছেলে একই কলেজে মাস্টার্স করছে, ছোট ছেলে ঢাকার পলাশীতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে। পরে ভদ্রলোক প্রশ্নের মাধ্যমে জেনে ছিলেন সেই কলেজ আসলে বুয়েট। আর তার স্বপ্ন, ছোট মেয়ে ডাক্তার হবে।
রিকশা চালিয়ে তিনি ছেলে মেয়েকে কোথায় নিয়ে এসেছেন! ভাবতেই অন্যরকম লাগে। আসলে তিনি রিকশা চালাননি, চালিয়েছেন ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যতের প্যাডেল। ভদ্রলোক গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বাড়তি কিছু টাকা দিতে চাইলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। কি প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ।
বাবারা এমনই- সন্তানের জন্য নিজের সুখ, শান্তি, বিশ্রাম, রোগ-বালাই উপেক্ষা করে ‘বাবা আছি’ বলে পাশে থাকতে চান। ভালবাসার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থহীনভাবে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে যান। আর নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থপরের মতো ঋণী করে চিরদিনের মতো চলে যান- না ফেরার দেশে।
এই যে সামাদ চাচা কিংবা রিকশাওয়ালা বা আপনার-আমার বাবা সন্তানের পড়াশুনা আর ভবিষ্যতের জন্য নিজের কত স্বাদ আহ্লাদ আর প্রয়োজনীয়তাকে কবর দিয়েছেন তার হিসাব নেই। আচ্ছা, সামাদ চাচার কি একটাই শার্ট ছিল?
আমি ভাবছি আমাদের কথা- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে আড্ডায়, লাইব্রেরিতে বইয়ের সাথে বোঝাপড়ায়, টিএসসির বারান্দায় প্রেমিকার হাত ধরে বসে থাকায়, অপরাজেয় বাংলার নিচে বিজয়ের হাসিতে কিংবা বই মেলার হৈ-হুল্লোড়ে অথবা শীতের কুয়াশায় চায়ের চুমুকের উষ্ণতায় যে নিশ্চিত তারুণ্য তার পিছনে আছে সেই ক্লিষ্ট মুখ, সেই ভরসা- ‘বাবা আছি’।
এটাই আমাদের সবার গল্প। পাংশুটে মুখ, পায়ের তলা কংক্রিটের মতন হয়ে গেছে। তবুও ছুটছে সামনে। দৌড়াচ্ছে, হাপাচ্ছে। শুধু নিজের জন্যতো নয়ই- সন্তানদের জন্য।
আসলে বাবাই একমাত্র যিনি সন্তানের জন্য সব পারেন। সন্তানের জন্য- ‘বাবা আছি’ এর চাইতে বড় ভরসা আর কি হতে পারে? বাবারা সব পারেন, সব। শুধু পারেন না বেশি দিন বেঁচে থাকতে!
পৃথিবীর সব বাবা দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকুক আর বলুক, ‘বাবা আছি’ - এটাই কি যথেষ্ট নয়?
প্রছণ্ড গরমে অস্বস্তি লাগছে। একমাত্র স্বস্তি আমার চোখের নোনা জল, ‘বাবা ভাল থেকো’।
এইচআর/জেআইএম