ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

যেভাবে সময় কাটে: বোধবিবেকহীন সমাজের চিত্র

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৫৪ পিএম, ০৯ এপ্রিল ২০২৫

সেলিনা শেলী

আমার রাতেরা নিদ্রাহীন, ঘুম গেছে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। দিনগুলো নির্বান্ধব—দৃষ্টিতে ধূসর দৃশ্য ভেসে ওঠে। সকালে বাজার থেকে কিনে আনি ব্যাগভর্তি মানুষের ঘৃণা। চুলায় চড়ে না হাঁড়ি, সেও আজ যুগপূর্তি হলো। পাতিলেরা কালো কালো দাঁত বের করে হাসে। আর সিঁড়িঘরে ঠ্যাঙ তুলে শিশ্ন দেখায় সারমেয়র ছানা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বন্ধুদের হাতে সময় নেই। কারও সঙ্গেই দেখা সাক্ষাৎ হয় না তেমন। যদিও বা কাউকে কালেভদ্রে হ্যালোট্যালো বলি, শুনি একগাদা উপদেশ। সবাই একেক জন, যিশু, মুহম্মদ, গৌতমবুদ্ধ, অ্যাডাম স্মিথ, হাইডেগার, দেরিদা, ফুকো। কেউ কেউ রাশ ভারী কণ্ঠে বলে : জরুরি মিটিংয়ে আছি। ফ্রি হলেই কল দেব। কিন্তু তারা আর কোনোদিনই ফ্রি হন না। ফলত আমি নিজেই খেয়ালের বশে আবারও ডায়াল করি। ওপারে বন্ধু ক্ষেপেই আগুন। আমি তার কণ্ঠ শুনে নির্বোধের মতো হাসি। এখন কেমন করে বলি : আমি কৃপাপ্রার্থী নই, তোমাদের কাছে কোনো সাহায্য চাই না। শুধু চাই, একটু সময়।

হা ইশ্বর! এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো আর কত দীর্ঘতর হবে?
[যেভাবে সময় কাটে ।। মোহাম্মদ নূরুল হক]

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কবি মোহাম্মদ নূরুল হকের অনেক কবিতাই আমার প্রিয়। আজ হঠাৎই তার ‘যেভাবে সময় কাটে’ কবিতাটি পাঠে আমার তাৎক্ষণিক অনুভূতি না লিখে পারলাম না।

শহরের ইট-কাঠের ভেতর কত কত নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতিচ্ছবি এই বেদনাদীর্ণ কবিতাটি! নাগরিক জনজীবনের ব্যস্ততায় ফাঁপা হৃদয়হীন সময়ের হাহাকার কবির একার নয়; এটি এই শহরেরই বোবা আহাজারি। এখানে কত কত মানুষের চুলায় যুগের পর যুগ হাঁড়ি চড়ে না। একজন সাধারণ মানুষ বাজার থেকে ফেরে ঘৃণা নিয়ে! কার ঘৃণা? নিজের, নিজের প্রতি নিজের, সমাজের, শূন্য ব্যাগের হতাশায় স্বপরিবারের। সেই দৃশ্যটি আর তার কার্যকারণ খুঁজলে হতাশা, ক্ষোভ, ব্যর্থতা জাগবে। যে মানুষগুলো নিজেকে সমাজ কারিগরে সাজায়, ফাঁপা সেই মানুষগুলোর ঘৃণা-তাচ্ছিল্যের কী অপূর্ব রূপায়ণ এই কবিতা!

বিজ্ঞাপন

বাজারের ব্যাগ একটি অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। হয়তো সম্মানেরও। সেটি যে পথেই অর্জিত হোক, এই মূল্যবোধহীন সমাজ তা বিচার করতে যায় না বা চায় না। কেবল তোয়াজ করে।

আরও পড়ুন

কার বাড়িতে কত বছর হাঁড়ি চড়ে না, সেই খবর তো বহু দূরের বাতচিত, কেউ কারও খবরটুকুও রাখে না! সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে, সবাই বিজ্ঞতার মুখোশ পরে আছে, সবাই নিজের মতো স্বার্থপর ভাবছে অন্যকেও। জীবনানন্দীয় এক হাহাকারব্যাপ্ত এই কবিতায়,
‘আমার রাতেরা নিদ্রাহীন, ঘুম গেছে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। দিনগুলো নির্বান্ধব/দৃষ্টিতে ধূসর দৃশ্য ভেসে ওঠে। সকালে বাজার থেকে কিনে আনি ব্যাগ ভর্তি ঘৃণা।’

বিজ্ঞাপন

এই এক অদ্ভুত শহর! এখানে অসংখ্য বন্ধু থাকে, থাকে সেলফোনজুড়ে অসংখ্য সংযোগ নাম্বার, তবু যোগাযোগ নেই, নেই হৃদয়ের উষ্ণ আলিঙ্গন। অতএব,
‘পাতিলেরা কালো কালো দাঁত বের করে হাসে। আর সিঁড়িঘরে ঠ্যাং তুলে শিশ্ন দেখায় সারমেয়র ছানা।’

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে সবাই। এখানে যে যাকে চেনে বলে দাবি করে; সে-ও মূলত অচেনা। সময়হীনতার বাহানায় খসে পড়ে বন্ধুত্ব, আত্মার বন্ধন। সেই ক্রন্দন কে শোনে আর, এক কবি ছাড়া? পদ-পদবি, জ্ঞানগম্যির মুখোশ খুলে ফেলে না কেউ। পাছে তার ভেতরটি ধরা পড়ে যায়! খোলনলচে খুলে পড়ার ভয়ে দূরত্বে চলে; সবাইকে ভিখিরি মনে করে, যেন মানুষের আর কিছু চাওয়ার নেই। মূলত এক বোধবিবেকহীন অস্পর্শিক নিষ্ঠুরতায় ঢুকে পড়েছে এই সমাজ। গভীর থেকে গভীরতর তার ক্ষত। সেখানে যে পুঁজির পুঁজ জমেছে, এই মেকি সমাজ তা বোঝে না বা বুঝতে চায় না। এতটুকু সময় তাদের নেই।

তীব্র শ্লেষের এই কবিতা আজকের শাহুরিক সমাজকে অল্প কটি পঙ্ক্তিতে উলঙ্গ করে ছেড়েছে। এরকম একটি কবিতার পাঠ আমাদের নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কবি-প্রাবন্ধিক-সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল হককে এই কবিতার জন্য সাধুবাদ জানাই। আর বুকে তুলে নিই এক দীর্ঘশ্বাস। যা বুকেই আটকে থাকে।

বিজ্ঞাপন

‘হা ইশ্বর! এই দুঃস্বপ্নের রাত্রিগুলো আর কতো দীর্ঘতর হবে।’

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন