থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে চাই সচেতনতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক এবং ৭০ হাজারের বেশি শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। সেই সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। ইন্টারন্যাশনাল থ্যালাসেমিয়া ফেডারেশনের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ কোটি থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছেন। এ ছাড়া পৃথিবীজুড়ে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
রক্তাল্পতাজনিত বংশগত ও জীনগত একটি মারাত্মক রোগ হলো থ্যালাসেমিয়া। তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। ১৯৩০ এর দশকে প্রথম ‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গ্রিক শব্দ Thalassa এবং ইংরেজি শব্দ aemia সহযোগে থ্যালাসেমিয়া শব্দটি তৈরি। Thalassa অর্থ ভূমধ্যসাগরীয় এবং aemia অর্থ রক্তাল্পতা। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রথম এই রোগ আবিষ্কৃত হয় বলে এর নামকরণ হয় থ্যালাসেমিয়া। ভূমধ্যসাগর ছাড়াও আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়ার উৎপত্তি হয়। ক্রোমোসোমে বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ব লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের ফলে রক্তাল্পতা দেখা যায়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের: আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। ১৬ নাম্বার ক্রোমোসোমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির কারণে আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ১১ নাম্বার ক্রোমোসোমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির কারণে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (যা শিশুদের হাইড্রপস ফিটালিসের কারণ) ও আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (যা হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ বা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট নামেও পরিচিত) এই ২ রকম হতে পারে, যেখানে প্রথমটি অপেক্ষাকৃত মারাত্মক বেশি। বিটা থ্যালাসেমিয়া অনুরূপভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (যার আরেক নাম কুলি’স এনিমিয়া) ও বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট) ২ রকম হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও প্রথমটিই বেশি মারাত্মক। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া, আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি তীব্র ও মারাত্মক।
আরও পড়ুন
বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথমদিকে অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, বার বার রক্ত সঞ্চালনের ফলে শরীরে অতিরিক্ত লৌহ জমা হওয়া, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, জন্ডিস, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইটের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন হলো প্রধান চিকিৎসা। তবে বার বার রক্ত সঞ্চালনের একটি প্রধান অসুবিধা হলো যকৃতসহ বিবিধ অঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এ ধরনের জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আয়রন চিলেশন থেরাপি এবং খাদ্যগ্রহণের পর চা পানের অভ্যাসকে উৎসাহিত করা হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী আধুনিক চিকিৎসা কিন্তু অসুবিধা হলো এটি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। অনেক সময় প্লীহা বেশি বড় হয়ে গেলে সার্জারির মাধ্যমে তা অপসারণেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কল্পে বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষার বিষয়টি উৎসাহিত ও বাহকদের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করতে হবে। রক্ত পরীক্ষা ও হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফেরেসিসের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করা যায়। গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না জানার জন্য ফিটাল ব্ল্যাড স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং প্রভৃতি অত্যাধুনিক পরীক্ষা করা যায়। তবে এসব পরীক্ষা গর্ভাবস্থার ১৬-১৮ সপ্তাহে করানো উচিত।
থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সমাজে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, থ্যালাসেমিয়া বাহক বা ট্রেইট এবং থ্যালাসেমিয়া রোগী এক নয়। বাহক হলেন সুস্থ ব্যক্তি। একজন বাহক কখনো থ্যালাসেমিয়া রোগী হন না। থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং রোগীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারলে তারা সুষ্ঠু সামাজিক জীবনযাপন করতে পারবেন। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করতে।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিসিন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা।
এসইউ/জিকেএস