বিশ্ব হাঁপানি দিবস
হাঁপানি হলে কী করবেন?
আজ বিশ্ব অ্যাজমা বা হাঁপানি দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী অ্যাজমা দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- "Asthma Education Empowers" অর্থাৎ অ্যাজমা শিক্ষার ক্ষমতায়ন।
বিষয়টিকে সোজা কথায় ব্যাখ্যা করা যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাজমা সম্পর্কে জানতে হবে। অর্থাৎ এটি কেন হয়? এর চিকিৎসার জন্য কোথায় যেতে হবে? কীভাবে সচেতন হতে হবে এবং কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে? - ইত্যাদি সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা থাকতে হবে। প্রায়শই দেখা যায়, অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়ে থাকে। হাঁপানি রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রচলিত বিবিধ কুসংস্কার দূর করতে পারলে আক্রান্ত রোগী সুস্থভাবে সামাজিক জীবনযাপনে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন
সারাবিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রতিবছর হাঁপানির কারণে মারা যায়। হাঁপানিতে মারা যাওয়া মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী। ছেলে-মেয়ে উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত শৈশবে ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হলে এ রোগ বেশি হয়। হাঁপানি মূলত শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত একটি রোগ। শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত কারণে শ্বাসনালী স্ফীত হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ, বুকে চাপ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। এসব লক্ষণের সমন্বিত অবস্থার নামই হাঁপানি বা অ্যাজমা।
হাঁপানি রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলা যায় না। এর বেশিরভাগ কারণই কিন্তু অজানা। তবে কয়েকটি বিষয় রয়েছে- যেগুলো হাঁপানি রোগের উৎপত্তি ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেকক্ষেত্রেই এ রোগ জেনেটিক বা বংশগত কারণে হতে পারে। বংশে কারো এ রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের যে কেউই হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া কুকুর, বিড়ালের মতো পোষা পশুর লোম, পাখির পালক, তেলাপোকা, পরাগরেণু, ছত্রাক প্রভৃতির প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা হাঁপানি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও বায়ুদূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া, কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন পদার্থ, রঙের ঝাঁঝালো গন্ধ, ঠান্ডা হাওয়া, ঝাঁঝালো মসলা প্রভৃতির কারণেও হাঁপানির আশঙ্কা বেড়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যাসপিরিনের ব্যবহার কিংবা হেরোইনের অপব্যবহারের কারণে হাঁপানি হতে পারে। মানসিক চাপ, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতাও অনেকক্ষেত্রে হাঁপানির তীব্রতা বাড়াতে পারে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বিশেষ ধরণের খাবার, যেমন গরুর মাংস, চিংড়ি, ইলিশ, বেগুন-এসব খেলেও হাঁপানির মাত্রা বাড়তে পারে।
আরও পড়ুন
দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্ট, বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময় এবং ভোর রাতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, ধূলাবালি বা পশু-পাখির সংস্পর্শে আসলে শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া, বুকে চাপ অনুভূত হওয়া, শুকনা কাশি, শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বুকে বাঁশির মতো হঠাৎ সাঁ সাঁ শব্দ হওয়া, দমবন্ধ লাগা ইত্যাদি হলো অ্যাজমার লক্ষণ। স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লোমেট্রি পরীক্ষা, রক্ত ও কফে ইয়োসিনোফিলের অতিরিক্ত উপস্থিতি এবং রক্তে ইমিউনোগ্লোবিউলিনের মাত্রা পরীক্ষা করে হাঁপানি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
হাঁপানির চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী। সালবিউটামল, স্টেরয়েড, অ্যামাইনোফাইলিন, সোডিয়াম ক্রোমগ্লাইকেট, মন্টিলুকাস্ট, ইপ্রাট্রপিয়াম ইত্যাদি বহুবিধ ওষুধ রয়েছে অ্যাজমার চিকিৎসার জন্য। এর মাঝে কিছু ওষুধ অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট তাৎক্ষণিক লাঘব করে আর কিছু ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। কোন ধরনের ওষুধ কী মাত্রায় প্রয়োজন বা ওষুধের মাত্রা কমানো-বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। কোনো কারণে হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তিরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
হাঁপানির চিকিৎসায় ইনহেলার এবং নেবুলাইজার অন্যতম উপকারী দুটি ডিভাইস। বহুবিধ ওষুধ এই ধরনের ডিভাইসের সাহায্যে সরাসরি শ্বাসযন্ত্রেই প্রয়োগ করা যায়। এর ফলে খুব অল্প মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করেই ভালো ফল পাওয়া যায় এবং খুব একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হয় না। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে ইনহেলারের সাহায্যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় এবং শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নেবুলাইজারের সাহায্য গ্রহণ করা হয়।
আরও পড়ুন
হাঁপানি রোগীদের সবসময়ই কাছে ইনহেলার রাখা প্রয়োজন। এটা নিজে নিজেই ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহারবিধিও খুব একটা জটিল নয়। বিভিন্ন রকম ইনহেলারের মাঝে মিটার্ড ডোজ ইনহেলার বহুল প্রচলিত ডিভাইস। অনেকক্ষেত্রে ঠিকমতো ইনহেলার ব্যবহার করতে না জানার কারণে হাঁপানি রোগীর সমস্যা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে আসে না। তাই কীভাবে সঠিক উপায়ে ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়, তা হাঁপানিতে আক্রান্ত রোগীর জন্য জানা থাকা খুবই প্রয়োজন।
মিটার্ড ডোজ ইনহেলার ব্যবহারের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন- প্রথমে ইনহেলারের মাউথপিসের ঢাকনা খুলে চিবুক উঠিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকাতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ত্যাগ করে বুকের সব বাতাস বের করে দিতে হবে। ইনহেলারের মাউথপিসটি দাঁতের ফাঁকে রেখে ঠোঁট দিয়ে এমনভাবে চেপে ধরতে হবে যেন কোনো ফাঁক না থাকে। এবার ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে ইনহেলারের ক্যানিস্টারে দৃঢ়ভাবে চাপ দিয়ে উৎপন্ন অ্যারোসল ফুসফুসে টেনে নিতে হবে।
বুক ভরে শ্বাস নেওয়া হয়ে গেলে ইনহেলার মুখ থেকে সরিয়ে ফেলে ৫-১০ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখতে হবে, যেন ওষুধ ফুসফুসের শ্বাসনালিতে জমা হয়। এরপর রোগীকে স্বাভাবিক শ্বাস নিতে হবে। এভাবে রোগীর এক পাফ বা টান ওষুধ নেওয়া সম্পন্ন হয়। যদি দুই পাফ ওষুধের প্রয়োজন হয়, তবে অন্তত ৩০ সেকেন্ড পর প্রক্রিয়াটি পুনরায় করতে হবে। তারপর ইনহেলারের ঢাকনাটি দিয়ে মাউথপিসটি বন্ধ করে রেখে দিতে হবে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে, ইনহেলারে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীর মুখে পানি নিয়ে কুলিকুচি করে পানি ফেলে দিতে হবে। ইনহেলার একবার ব্যবহার শুরু করে দিলে সেটিতে বিদ্যমান ওষুধ ছয় মাসের বেশি কার্যকর থাকে না। উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য ইনহেলার অতিরিক্ত ও সরাসরি সূর্যরশ্মি থেকে দূরে ২০°-২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে।
একটি বিষয় সকলেরই খেয়াল রাখতে হবে যে, শ্বাসকষ্ট মানেই কিন্তু হাঁপানি নয় এবং হাঁপানি কোনো ছোঁয়াচে রোগও নয়। হৃদরোগ, রক্তশূন্যতা প্রভৃতি কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই শ্বাসকষ্ট হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি। হাঁপানি রোগীকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় না করে তাকে রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে হবে। তবেই বিশ্ব হাঁপানি দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য পূরণ হবে।
এমআইএইচ